কথায় বলে, বোকারা নাকি দুইবার হাসে। কৌতু্ক, একবার না-বুঝিয়া, সবাইকে হাসিতে দেখিয়া, আর একবার তাহা টের পাইয়া। তবে, প্রবচনে যাহা বলা নাই, তাহারা আরও একবার হাসে। নিজেরই খোঁড়া খন্দে পা-পিছলাইয়া পড়িয়া অক্কা পাইয়া, তাহাদের বিধুর ওষ্ঠাধরে ফুটিয়া উঠে সেই তিন নম্বর হাসি। প্রকৃত বুদ্ধিমানেরা সেই অন্তিম হাসিটিকে অতিচালাকিও বলিতে পারেন। তবে, কথায় ইহাও বলে : অতি চালাকের গলায় দড়ি। কাজেই, যতবারই হাসুক, বোকা, বোকাই রহিয়া যায়। আর তাহার মরণও হাসি দিয়া ঠেকাইবার নহে।
তবু, মৃত বোকাদের মুখে, কমলকুমার প্রণোদিত মায়া-র মতোই, হাসিটুকু রহিয়া যায়। নিজেদের এই বিনাশ তাহারা নিজেরাই ঘনাইয়াছে। তাহাতে কী? তাহাতে কি হাসি না-জায়েজ হইয়া যায়? তাহাদের রক্তে কি চর্যাপদের সেই হরিণী নাই, যাহার আপন মাংসই আপনার দুশমন! কীভাবে যে কী ঘটিয়া যায়, একদিন দেখা যায়, সবকিছুই হাতের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। অন্তকাল অনিবার্য। খেলার নিয়মে মই বাহিয়া যতটুকু উঠা গিয়াছিল, বিশাল এক ময়ালের মুখে পড়িয়া, সাঁত করিয়া এক্কেরে মহীপাতালের গহন আঁধারে। অতঃপর হাসি।
আমাদের এই বর্তমান প্যাচালটিকেও বোকার মুখের ওই তিন নম্বর হাসি বলিয়া ধরিয়া লইলে, মরণের পরেও আমরা কাদাখোঁচা পাখির মতো এধার ওধার কিছু শামুক গুগলি চুনামাছ তালাশ করিবার ভরসা পাই। মরণের পরে বলিতে যে স্বামী অভেদানন্দ হাতড়াইতে হইবে, তাহা কেন! আমাদের এ-যুগের এক কাপ্তেন, নবারুণ, তাঁহার হার্বার্ট সরকারকে দিয়া মৃতের সহিত কথোপকথনের এন্তেজাম করাইয়াছিলেন। ব্যাপারটিকে ‘অকাল্ট’ বলিয়া কালো তালিকায় ফেলিবার ভুলে আর এক সরকারের পতন হইল। সাধে কি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল বলিয়াছিলেন : ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মায়ায় কেউ যথেষ্ট মুগ্ধ ততক্ষণ (অকাল্ট) বিষয়টি তিনি ধরতে পারবেন না। এর বেশি বলার দরকার নেই।’
আমরা কি মানুষের মায়ায় মুগ্ধ? কী করিয়া হইবে! স্বয়ং কবি যেখানে বলিয়া গিয়াছেন – রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি। আমরা কি তবে বাঙালির মায়ায় মজিয়াছি? তাহা হইলে আর বাঙালি মরিল কেন? এ তো বড় রঙ্গ জাদু, এ তো বড় রঙ্গ!
২.
অনেকে মনে করেন, আধুনিকতাবাদের শুরুয়াতবিন্দুটি হইল ফরাসি বিপ্লব। আর তাহার প্রতীক বা প্রতিমা হইল গিলোটিন। যে-গিলোটিন বংশগত রাজতন্ত্রের ধড় হইতে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন করিবার বদৌলতে, না-আধুনিক অতীত হইতে ভবিষ্যৎকেও টুকরা করিল। ব্যাস, শুরু হইয়া গেল আধুনিকতাবাদের কালচক্কর। গিলোটিন শুধু কাটিতেই লাগিল। সমগ্রতার বোধ। সংযোগের সেতু। মূল্যবোধের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কাটিল কাটিল কাটিল।
অনেক পরে পরা-আধুনিকেরা (যাঁহাদের অনেকে মশকরা করিয়া পোস্ত বলেন) আসিয়া অবশ্য প্রতিমার ধারণাকেই নস্যাৎ করিলেন। কিন্তু আবাহন হইতে বিসর্জন – এই পুরা পূজা-পর্বই তো সাগরপারের লীলা। সেখান হইতে জাহাজে চড়িয়া এক পিস গিলোটিনও কি আমাদের এই বাংলাদেশে আসিয়া পৌঁছাইয়া ছিল? গিলোটিনের কারিগরি ছাড়াই, পলাশীর প্রহসনের পর চব্বিশ বছর বয়সী এক রাজার শুধু শিরশ্ছেদই নয়, সমস্ত শরীরটিকেই কুপাইয়া কিমা বানাইয়া দেওয়া গিয়াছিল। আর কী আশ্চর্য, সাথে সাথে আমাদের ইতিহাসেরও আধুনিক যুগের পত্তন হইয়া গেল। ছ্যারারা ছ্যাররা ড্যা ড্যাং। বছর কয়েকের মধ্যেই ক্লাইভ দেওয়ান হইলেন। আর সেই মহান দেওয়ানি প্রাপ্তির ছয় বছরের ভিতর এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি স্রেফ না-খাইতে পাইয়া লোপাট হইয়া গেল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর!
মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি। গিলোটিন ছাড়াই আমরা সমগ্রতার বোধ হারাইলাম। সংযোগের সেতু হারাইলাম। মূল্যবোধের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চুরচুর করিলাম। আমরা আধুনিকতার আলোয় সিনান করিলাম। আমাদের রামমোহন কালাপানি পার হইয়া সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার নিশানকে সেলাম ঠুকিলেন। ক্রমে ঢাকার তাঁতিদের আঙুল কাটা পড়িল। ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্পবিপ্লব সম্পূর্ণ হইল। আমাদের জন্য আরও আরও আধুনিকতার আলো আসিতে থাকিল। এইজন্যই না সাহেবদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আজ তক কত মহা-মহোপাধ্যায়ের চক্ষে পানি আসে – ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে। নহিলে কোথায় পড়িয়া থাকিতাম আমরা, কোন্ অন্ধকারে। সেই ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদের বেড়াচাপায় ? ছোঃ!
এখন কথা হইল, আগের অনুচ্ছেদে বারবার যে-আমরা-দের কথা উঠিল, সেই আমরা কাহারা?
– কেন? বাঙালি!
– হুম। তাহা হইলে প্রাতঃস্মরণীয় রামমোহনকে দিয়াই সওয়াল শুরু করা যাক্। তিনি অমরতা পাইলেন কীসে?
– ইহা কি কোনও প্রশ্ন হইল! সতীদাহর মতো এক বর্বর প্রথা …
– আচ্ছা আচ্ছা। বাংলাভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনার জন্যও তাঁহাকে ভুলিয়া যাওয়া হারাম বটে। বা ঐ যে তিনি, ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের সংস্কৃত কায়দায় লিখা সমাসসন্ধিসঙ্কুল তথাকথিত বাংলাকে লোক-ঠকাইবার কায়দা বলিয়াছিলেন, স্রেফ সেজন্যও তাঁহার শ্রীচরণে রোজ একটি করিয়া ফুল নিবেদন করা যায়।
– এসব পড়ালিখা-জানা মানুষদের ব্যাপার। কিন্তু, বাঙালি সমাজের সেকালীন ওই ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর প্রচলন রদ করিবার জন্য তাঁহার যে-অনমনীয় জেহাদ …
– দাঁড়ান দাঁড়ান। বাঙালি সমাজ বলিতে কাহাদের বুঝাইতেছেন?
– বাঃ রে, বাঙালি মানে, বাঙালি। এখন আবার নূতন করিয়া তাহার সংজ্ঞা তৈয়ার করিতে হইবে নাকি!
– নূতনের কী দরকার? পুরানা কিছু থাকিলে তাহাই এস্তেমাল করা যায়। আলাপ চালাইবার জন্য নাহয় রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সহজ সংজ্ঞাটিই মানিয়া লওয়া যাক – যাঁহারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, মনের ভাব প্রকাশ করেন, তাঁহারাই বাঙালি। তা, বাংলায় কথা বলা মানুষের কত শতাংশের ভিতর সতীদাহের প্রচলন ছিল? বাঙালি মুসলমান? বাঙালি তথাকথিত অন্ত্যজ বর্ণ? বাংলার মফসসলের মানুষ?
– মু মুসলমান! অন্ত্যজ! মফসসল!
– কেন, ইঁহারা কি বাংলাভাষায় কথা কহিতেন না?
– ইঁহাদের ভিতর সতীদাহ ছিল না! মফসসলে ছিল না?
– ইসলামে তো বিধবা বিবাহ অনুমোদিত। কাজেই বাঙালি মুসলমানের সতীদাহের প্রয়োজন পড়ে নাই। আর তথাকথিত নিচু জাতের মোট জনসংখ্যার খুব সামান্য অংশ, যাঁহারা তুলনায় বড়লোক, তাঁহাদের ভিতর এই নারকীয়তার কিছু নজির আছে। মূলত কলিকাতা ও সন্নিহিত জেলাগুলিতেই সতীদাহের প্রকোপ বেশি ছিল। তাহা হইলে, মুসলমান আর ‘অন্ত্যজ’ বাদ দিলে পড়িয়া রহিল কয়জন? সেই কাবাব সম্প্রদায়।
– কাবাব!
– হ্যাঁ, কায়স্থর কা, বাউনের বা, আর বদ্যির ব। ইঁহাদের লইয়াই আমাদের বাঙালি সমাজ। ইঁহাদের লইয়াই আমাদের আমরা। সেই আমরা-ই সুলতানি-বাদশাহি-নবাবি আমলে ফারসি পড়িয়া কৃতবিদ্য হইয়া এবং শাসকদের পদলেহন করিয়া রাজদরবারে বড় বড় পদ ও জমিজমার মালিকানা বাগাইয়াছি। সেই আমরা-ই পলাশির চক্রান্তে সামিল হইয়াছি। ব্রিটিশের জয়ে তোপ দাগিয়া দুর্গোচ্ছবের পত্তন করিয়াছি (সেগুলিই আজও হে হে হেরিটেজ পূজা!), সিপাহিযুদ্ধের সময় সিপাহিদের গাল পাড়িয়াছি, আর উত্তরোত্তর আধুনিক হইয়াছি। হইতে হইতে আমরা পুলিশও হইয়াছি সন্ত্রাসবাদীও হইয়াছি। এমনকি কালক্রমে বলশেভিকও হইয়াছি। কী অসহযোগে কী ইংরজদের ছুঁড়িয়া-দেওয়া লবেঞ্চুসের মতো ভোটাভুটিতে, কী আগস্ট বিপ্লবে কী তেভাগায় – কাবাব নেতৃত্ব কিন্তু অটুট ও জম্পেশ। বাঙালি আমরা-ই। মারী ও মন্বন্তরে আমরা টিকিয়া গেছি। ও পদ্য রচিয়াছি।
তাহা হইলে মরিল কাহারা – ছিয়াত্তরের, পঞ্চাশের, মন্বন্তরে? গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের মহোৎসবে? বছর বছর আজও কাহারা মরে – রাজনৈতিক দলগুলির অবিশ্রাম সংঘর্ষে? ওই অন্ত্যজ, ওই মুসলমান। আহা, তাহারাও নাকি বাঙালি! আধুনিকতার বাহিরে পড়িয়া থাকা, ফলত আমাদের সহৃদয় জ্ঞানের বাহিরে পড়িয়া থাকা, এক অঞ্চল। কিছুদিন আগে আদর করিয়া আমরা তাহাদের নাম দিয়াছি – নিম্নবর্গ।
৩.
বোকারা হাসিতে হাসিতেই অনধিকার চর্চা করে। প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, আজ সামান্য প্রশ্রয়বশে এটুকু সহ্য করুন। চর্যাপদে ভুসুকু বংগালি হইলেন। মুনিদত্তের টীকা অনুযায়ী সেই বংগালি-শব্দ প্রয়োগের অর্থ যাহাই হউক, মানুষের ব্যবহারে না-থাকিলে তো আর কবি সেই শব্দটিকে লইয়া ঠারের এন্তেজাম করিতে পারিতেন না। অবশ্য শব্দ বানানোও যায়। তবু সোনা এবং তরীর ব্যাপারে আমরা ওয়াকিবহাল বলিয়াই সোনার তরী তৈয়ার হইল। যেমন বাজনাও (না-এর পর অন্তস্থ ব, যাহার উচ্চারণ ওয়>ও)। ভুসুকু বঙ্গালি হইবার আগে ‘বাজণাব পাড়ী পউয়াঁ খালে বাহিউ’। হায় হায়, এ-শব্দের মানে কী? বুঝি না, বুঝি না। অথচ, ওড়িয়ারা চর্যাপদের মালিকানা দাবি করিলে, কোন্দল করিতে ছাড়ি না। আমাদের মাথায় তখন বাজ ভাঙিয়া পড়ে। ঝগড়া করিতে রূপনারায়ণের ঢেউ ভাঙিয়া কলিঙ্গের পানে নাও ভাসাইয়া দেই। তবু, বাজনাও বুঝি না, ডিকশোনারি দেখিতে হয়। এবং দেখি, তাহার অর্থ (?) বজ্রনৌকা।
আমরা বজ্রনৌকা বুঝি, বাজনাও বুঝি না। চর্যাপদ নাকি আমাদের আদি কবিতা। অথচ তাহার শত শত শব্দ বুঝিতে আমাদের অভিধান হাতড়াইতে হয় (যেমন, পউয়াঁ খাল)। সে কি শব্দ রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে বলিয়া? হ্যাঁ, ভাষার তো তাহাই লক্ষণ। কিন্তু এ কেমন রূপান্তর? কৃষ্ণ হইতে আদি বাঙালির মুখে যাহা কাহ্ন হইয়াছিল, অজলচল বিধায়, তাহার আবার কৃষ্ণপ্রাপ্তি ঘটিল। কানু-শব্দের তাস ফেলিয়া তর্কপ্রিয় কেহ কোমর বাঁধিতে পারেন। কিন্তু, সে-কানু, হারামজাদা মাত্র, বা সান্যাল। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যপুঁথির আবিষ্কারক কিন্তু বহির নাম কানুকীর্তন দেন নাই, তাহা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এইরূপ শত শত তদ্ভব ও অর্ধতৎসম শব্দ পুনর্মুষিক হইল। সেই কারণেই আজ অভিধান সহায়। শুধু চর্যাপদের বেলায় নয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেরও সেই দশা। কে না বাঁশী বাএ বড়াই কালিনী নইকূলে? নাই নাই, আমাদের তিনসীমানায় সেই কালিনী নই নাই। কীভাবে ঘটিল এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড – ভাষার স্বাভাবিক বিকাশের কোন্ উলটপুরাণে? এসব প্রশ্ন ভুলিয়া যাওয়াই ভালো।
প্রশ্ন ভুলিতে ভুলিতেও তবু কেবলই আরও প্রশ্নের জন্ম হয়। চর্যাপদের ওই সুমহান কবিকৃতির পর বাঙালি অমন চুপ মারিয়া গেল কেন? এমনই চুপ, যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী, কোনও ট্যাঁ ফোঁ নাই। ইহার একটি চটজলদি জবাব হইল , তুর্কি অভিযানের ধাক্কায় বাঙালি সমাজ এমনই বিধ্বস্ত হইয়াছিল যে, তাহার আর কবিতা রচনার ফুরসত মিলে নাই। বা, লিখিলেও, বিদেশী বিধর্মীরা সেসব নষ্ট করিয়াছে। এই উত্তরের ভিতর দিয়া একটি নিষ্ঠুর সত্য ধামাচাপা দেওয়া হয়। কর্ণাটকি সেন-আমলে আমদানি হওয়া ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বাংলার বুকে এক জব্বর ফতোয়া জারি করিয়াছিল। তাহা এই যে, ভাষায় (অর্থাৎ, মাতৃভাষায়) পুরাণাদি কোনও কেতাবই রচনা করা যাইবে না। করিলে, লেখকদের ঠাঁই হইবে পুন্নাম নরকে। ফলত পণ্ডিতেরা যাহা কিছু রচিলেন, সবই সংস্কৃতে। এমনকি জয়দেবের মতো কবিকেও প্রায়-বাংলার-মতো সংস্কৃতেই লিখিতে হইল। সেসব সংস্কৃত পুঁথি কিন্তু ধ্বংস হয় নাই। বাছিয়া বাছিয়া বাংলা পুঁথি যদি ধ্বংস করা হইয়াই থাকে, তবে কাহারা করিল সেই কাজ? প্রশ্ন আবার!
চর্যাপদের রচনার পাল আমলের শেষের দিকে। কবিরাও প্রান্তিক। ব্রাহ্মণ্যবাদী তো নহেনই। তাহার পর আর বাংলাভাষায় লিখিবার সাহস কাহারও হইল না। একেবারে জমানা বদল ইস্তক এন্তেজার করিতে হইল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ফতোয়াকে বুড়া আঙুল দেখাইয়া, সুলতানি আমলেই বাংলাভাষায় লেখালেখির পালে বাতাস পড়িল। এত এত বাংলা পুঁথি আর কি কেহ নষ্ট করিল, এক যদি না কাল করিয়া থাকে? তবেই না বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গোয়ালঘর হইতে বসন্তরজন বিদ্বদ্বল্লভ মহোদয় বিশ শতকের শুরুয়াত অবধি টিকিয়া-থাকা এমন এক পুঁথি পাইলেন (খ্রি. ১৯০৯) যে, বাংলাভাষার ইতিহাসই বিলকুল বদলাইয়া গেল।
৪.
মস্তিষ্কের কিছু কিছু কোষ জখম হইলে মানুষের স্মৃতিভ্রংশ ঘটে। কিন্তু সেইসব শারীরতান্ত্রিক কারণ ছাড়াও কখনও কখনও মানুষ বহু কিছু ভুলে। ভুলে, যখন সে স্বেচ্ছায় ভুলিতে চায়। ভুলিয়া যাওয়াই ভালো। যাহা ভুলিলে আমরা আমাদের লইয়া আপরুচি কাহিনি ফাঁদিতে পারিব, সেসব কথা মনে রাখিতে যাইব কোন্ দুঃখে! ভুলিতে ভুলিতে ক্রমে ১৯৪৭ আসিয়া গেল। ১৯০৫ সালে যে-আমরা বাংলা মা বাংলা মা করিয়া কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়াছিলাম, সেই আমরা-ই অতঃপর বাংলা ভাগের জন্য উন্মত্ত হইয়া উঠিলাম, বাঙালি মুসলমান আর ‘অন্ত্যজ’-রা নন। এখন তো সেই দায়ভাগের কথাও বেমালুম ভুলিয়াছি। যেমন ভুলিয়াছি ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির (১৯৩৬) কথা। যাঁহাদের লক্ষ্য ছিল জমিদারি প্রথা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান ঘটানো। ভুলিয়াছি বসু-হাসিম চুক্তির কথা। যে-চুক্তিতে এক স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক অখণ্ড বাংলার ডাক দেওয়া হইয়াছিল।
গিলোটিন লাগিল না, বাংলা ভাগ হইয়া গেল। একটি শরীর দুই টুকরা হইলে সেই জরাসন্ধ কি আর বাঁচে! আমাদের মৃত্যুর পরোয়ানাও সেইদিনই রচিত হইল। তাহার পরও, গত শতকের ৭০-৭১এ, বাঙালি একবার সত্যই মরিয়া প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিল, সে মরে নাই। পূর্বখণ্ডটিতে অনেক রক্তস্নানের ভিতর দিয়া প্রতিষ্ঠা হইল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র্বের। সে কোনও স্বর্গরাজ্য নয় যদিও, তাহাকেও আরও অনেক যুদ্ধ মাড়াইয়া যাইতে হইবে হয়তো। তবু তাহা বাংলাভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ। আর, পশ্চিম খণ্ডের তারুণ্য রক্ত দিতে কার্পণ্য না-করিলেও, মুখ থুবড়াইয়া পড়িল। হয়তো আত্মানুসন্ধানের অভাবে। হয়তো আপন জমিনের নাড়ির স্পন্দনটিকে চিনিতে না-পারার ভুলে। কাবাব শ্রেণীর কুক্ষিগত করিয়া রাখা জাতপাতভিত্তিক ধূর্ত ক্ষমতাতন্ত্র যে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে পুরাদস্তুর চিহ্নিত হয় না, তাহা টের না-পাওয়ার অবিচক্ষণতায়। তবু সেই আত্মত্যাগে সততা ছিল, নিষ্ঠা ছিল, জেদ ছিল, স্বপ্ন ছিল।
তাহার পর? তাহার পর কি আর বলিবার মতো কিছু আছে, অন্তত আমাদের এই ভাঙা পশ্চিমে? রাজনীতির কথা ছাড়িয়াই দিলাম, সৃজনশীলতা বা মননচর্চার এমন একটি এলাকাও কি আছে, প্রজন্মান্তরে যেখানে দুনিয়ার কাতারে দাঁড়াইবার মতো কোনও এলাহি কাজ হইয়াছে? সময়পরিসর ব্যাপী এই মুমূর্ষার ভিতরেও অবশ্য অতি দূর আসমান হইতে নজরে পড়ে কিছু চিকন পুঞ্জাক্ষির মতো আলো। হামবড়াই ঠাহর হইলেও একথা না-বলিয়া উপায় নাই, মন্থর আলোথাম ঘেরা সেই নিভৃত দ্বীপাঞ্চলটি হইল বাংলা কবিতা। এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাঙালি প্রাণ, এই বাংলায়, নিজেদের উজাড় করিয়া দিতেছে। ঋতু হইতে ঋতুতে প্রান্তর কেবলই ভরিয়া উঠিতেছে হরিৎ শস্যে। পরিকাঠামোর অভাবে তাহা যদি দুনিয়ার গোল চত্বরে না-ই গিয়া পৌছায়, তবে সে-ক্ষতি দুনিয়ারই। সেই যোগাযোগের ফাঁকিতে বাংলা কবিতার বড় একটা কিছু যায়-আসে না।
কবিতা লইয়া দেমাগ দেখানো গেল বটে, কিন্তু অকৈতব আনন্দ-বেদনা ছাড়া কবিতার তো লেনদেনের মতো কিছুই নাই। সে যেন আবহমণ্ডল ছাইয়া-থাকা ওজোন-স্তরের মতো। সেখানে ছিদ্র হইলে বিপদ, কিন্তু স্বাভাবিকতায় বহাল থাকিলে তাহাকে টের পাইবার জো নাই। সে তাহার কাজ নীরবে করিয়া যায়। দেহের দীর্ঘ মেয়াদি পুষ্টি যোগানোর মতো তাহার লম্বা সময়ের লীলা। কোনও আশু সংকট মোকাবিলায় ছুরি-চিকিৎসার মুরোদ তাহার নাই। মনপ্রাণ দিয়া কবিতা লিখিয়া ফিলহালের বাঙালি তরুণী-তরুণ কোনও লাশের বুকে যে কিছুটুকুও প্রাণসঞ্চার করিতে পারিবে না, একথা সে ভালোই জানে। তবু মৃতের শিয়রে বসিয়া, নাড়ি ছুঁইয়া, নিজের কাজটুকু করিয়া যাওয়া তাহার ফরজ।
কবিতা যেমন ইতিহাসের কোনও সংকট সামলাইতে পারে না, তেমনই তাহা সংকট লইয়া পর্যালোচনাও করিতে পারে না। হয়তো সংকটের সারাৎসারটুকু তাহার আত্মাকে আলোড়িত করে। হয়তো দূরাগত স্বপ্নের মতো কোনও অজানা আগামীর ইঙ্গিত সহসা ঝলকিয়া উঠে তাহার স্নায়ুতরঙ্গলহরে। আবার মিলাইয়া যায়। বর্তমানের সহস্রনাগ তাহার অস্তিত্ব ঘিরিয়া ঘিরিয়া খলখল হাসে। কবিতা শুধু সবকিছু দেখিয়াই যাইতে পারে, আহরণই করিতে পারে চারিপাশের হলাহল ও সুধা। কিন্তু কিছু বলিতে পারে না। বলিলেও কেহ শুনিবে না। সামাজিক ভাষা সে হারাইয়াছে। প্রাণ যাহা বলে, সে তাহা কবিতাতেই বলে। কবিতার ভাষা এক অ-সামাজিক ভাষা। কলমটি কাগজের বুকে নামাইয়া বা যন্ত্র/ফোনের হরফচাবি বন্ধ করিয়া কবিকেও তাই নামিয়া আসিতে হয় কবিতার বাহিরে। রাস্তায়। কখনও কখনও।
বলা বাহুল্য, আজ সেই সময় হইয়াছে। সময় জলদিই ফুরাইয়াও আসিতেছে। ইহার পর হয়তো রাস্তা বলিয়াই কিছু থাকিবে না। আলোটুকুও না। এক অন্ধ তিমিরে শুধু ঝকঝক করিবে হাজার হাজার শকুন ও শৃগালের চোখ। তাহাদের খুনে-রঙিন নখর চঞ্চু ও দন্তরাশি। তাহাদের প্রান্তরব্যাপী হাসিতে একদিন হয়তো দেশান্তরের কোনও শুভার্থীর মনে পড়িয়া যাইবে, এই দেশেও এককালে কিছু আস্ত গাড়ল ছিল। তাহারা তিন বার হাসিত।

কবি, গদ্যকার, চিন্তক
জন্ম : ২ মার্চ ১৯৫২,
কানপুর, উত্তর প্রদেশ, ভারত
বর্তমান নিবাস: পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়