মাঝেমধ্যে কেন আমি
বোকা ব’নে যাই,
তুমি বোঝো?
সে আসলে নিয়তি আমার;
পাঁজরে পাঁজরে থাকে
মুখ গুঁজে, হাত পা গুটিয়ে।
সে আসলে নিয়তি আমার;
চেক শার্ট গায়ে দিয়ে
মিশে যায় অন্ধকার বাঁকে।
সে আসলে রপ্ত,
রাজপুরুষের আয়ত্তে আসবে না;
অনেক কবিতাব্যাপী
শোধ হয়ে যাবে সব দেনা।
অতিদূর দেবদারুর ফাঁকে
খুঁজেও পাবে না কেউ তাকে।
২০০১ সাল নাগাদ এই কবিতা লিখেছিল যে তরুণ কবি, এখন তার বয়স ঊনপঞ্চাশ। আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগেই সে এই লেখায় ‘বোকা ব’নে যাওয়াকে’ নিজের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিল। টের পেয়েছিল পৃথিবীতে বিস্মিত হবার অধিকার আছে শুধুমাত্র বোকাদের।
বিস্ময়। জীবনের বীজমন্ত্র। মরণেরও ওপারে যার ব্যাপ্তি। মুগ্ধ হওয়ার বিস্ময়, বিপন্ন হওয়ার বিস্ময়, ব্যথিত হওয়ার বিস্ময়। অনুতে-অনন্তে বিস্ময়। নুড়িতে-নক্ষত্রে বিস্ময়। শুধু একজন বোকা মানুষই পারে কথায় কথায় বোকার মতো বিস্মিত হতে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়াই যে বাকসিদ্ধ হয়ে ওঠার অন্যতম পথ, তার আভাস সে পেয়েছে নিজস্ব জীবনের কেন্দ্র থেকে। রাত্রির অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে যখন কথা হারিয়ে ফেলে, হয়তো তখনই বোকা মানুষ বুদ্ধির অগম্য সেই অসীমের নিঃশব্দ ইশারা পেতে থাকে তার গহন চেতনায়। চালাকচতুর সমাজ যাকে ‘আকাশকুসুম কল্পনা’ বলে দাগিয়ে দিতে পারলেই মহা খুশি। কিন্তু বোকা মানুষ জানে আকাশের মতো অপার কোনো বিস্ময়ই জন্ম দিতে পারে যাবতীয় তুরীয় প্রশ্নের।
আসলে কিন্তু বোকা মানুষরাও চালাক মানুষদের অত্যন্ত অবোধ ভাবতেই অভ্যস্ত। চালাক মানুষ সারাজীবনের চালাকির ফলস্বরূপ যে পার্থিব সাফল্যের ঢিবি জড়ো করে, বোকা মানুষ তার দিকে তাকিয়ে অনায়াসেই বলে উঠতে পারে ‘যা আমাকে অমৃত করে না, তাই নিয়ে আমি কী করব?’।
বোকা মানুষ গোটা ব্রহ্মাণ্ডকেই নিজের বাসস্থান বলে কল্পনা করতে সক্ষম। তাই স্বার্থপর দস্যুর বাগানে বসন্ত এসেছে দেখলেও তার মুগ্ধ-বিস্ময়ের শেষ থাকে না। সীমা থাকে না আনন্দের। পৃথিবীর কোনো মালিকানার বেড়া বোকা মানুষকে তার এই বিস্ময় থেকে বিযুক্ত করতে পারে না।
সুখে-দুঃখে— ভাবে-অভাবে— আনন্দে-বেদনায়— ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ, বেবাক, বোকা বনে যাওয়াই একেকটা আজব মানুষের নিয়তি। কোন ছলনার ফুলে কোন দেবতা সহজেই তুষ্ট হয়ে থাকেন, সে ভালোই জানে, কিন্তু বোকা মানুষের বিবেক বড় বালাই। আত্মসম্মান ব্যথার মতো টনটনে। আত্মপ্রত্যয় অভিমানের মতো টানটান। যেকোনো শর্তে যখন-তখন যার-তার পায়ে লুটিয়ে পড়ার নাটক তার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়। তাই সে সজ্ঞানেই এড়িয়ে চলে ক্ষমতার হাতে আত্মসমর্পণের বিনম্র যত ছলচাতুরি; আত্মপ্রতারণার যত সুচতুর কৌশল।
কথায় বলে ‘একায় বোকায় সমান’। অর্থাৎ বোকা মানুষ সামাজিক অর্থে সাধারণত একা। এই একাকীত্বই বোকা মানুষের কথোপকথনের শ্রেষ্ঠ অবকাশ। আসলে কিন্তু বোকা মানুষ মোটেই একা নয়। বোকা মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকে আরো সরল, সুপ্রাচীন কোনো সত্তা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে, শোকে বিহ্বল হয়ে, বোকা মানুষ তার সঙ্গে গোপনে কথা বলে। সেই সত্তাই বোকা মানুষের আজীবনের আশ্রয়। সেই সত্তাই বোকা মানুষকে এই চালাকিপূর্ণ দুনিয়ায় টিকে থাকার সৎ পরামর্শ দিয়ে থাকে। আপাতভাবে মনে হয় বুঝি বোকা এবার নির্ঘাত জাহান্নমেই চলল। কিন্তু চালাক-চোখে বিপথগামী সেই বোকাই হয়তো একদিন তার সরল জীবনসায়াহ্নে মহাপ্রস্থানের পথ খুঁজে পায়।
বোকা মানুষ পাঁচবছর যাবত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেও বার-কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত করায় না স্রেফ অনীহাবশত। তার বদ্ধমূল ধারণা যে আইনজীবী হতে হলে ধূর্ত হতে হয়। কিন্তু সে তো ধূর্ততাকে চিরদিনই সন্দেহের চোখেই দেখে এসেছে। কারণ সে তো কবিতা লিখতে চায়। উইলিয়াম ব্লেকের ‘Songs of Innocence’ তার প্রাণে রেখে গেছে এক স্বর্গীয় সারল্যের আনন্দ। ‘Songs of Experience’ তাকে সংঘর্ষময় জীবনপথে বেরিয়ে পড়ার দুরন্ত প্রেরণা দিয়ে গেছে। শুধুই কবিতা লেখার শপথ নিয়ে— না, সে সুনীলের মতো উপন্যাস লেখার ব্যাবসা খুলে বসে না, বরং একটা এনজিও-র কাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে। কখনো কোচবিহারের বাংলাদেশ লাগোয়া সিতাই ব্লকে জনস্বাস্থ্য সচেতনতার ওয়ার্কশপ করাচ্ছে তো কখনো পুরুলিয়ার ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী গড়জয়পুর ব্লকে ঘুরে বেড়াচ্ছে দরবারী ঝুমুর শিল্পী অমূল্য খুড়ার সন্ধানে। ততদিনে তার সহপাঠী বন্ধুরা কেউ আলিপুর জাজেস কোর্টে, কেউ বা হাইকোর্টে পসার জমিয়ে গাড়িবাড়িনারীসমৃদ্ধ সফল মানুষ হয়ে উঠেছেন রীতিমতো। বোকা মানুষের সেসব দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।
বোকা মানুষ সাত বছর দেশ পত্রিকায় কবিতা লিখেও আনন্দ থেকে বই প্রকাশের সম্ভাবনাকে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে একলা নিজের পথে ফিরে যায়। কেননা বোকা মানুষ তার চেয়ে একটু কম-বোকা কয়েকজন বন্ধুর আনন্দপ্রাপ্তি থেকে এই শিক্ষা পায় যে নিজের বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিজে সাজানোর সুযোগ না পেলে সেই বই কোনোদিনই কোনো পাঠকের মনে সুস্থায়ী দাগ কাটতে পারে না। সে লক্ষ করে দেখেছে যে তার সমসাময়িক যত কবিতার বই তথাকথিত বড় প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে, তার সবকটা বই পড়লেই মনে হয় যেন একজনমাত্র কেউ অন্তরালে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের গলায় অদৃশ্য দড়ি পরিয়ে নিজের চারপাশে ঘোরাচ্ছেন। সেই থেকেই বোকা মানুষ বড় প্রকাশনের ছায়া পর্যন্ত এড়িয়ে চলে। খুচরো চালাকির বিনিময়ে বিখ্যাত সং সাজার চেয়ে বোকা মানুষ তার অখ্যাতির আড়ালটিতে নিজস্ব এক তপোবন গড়ে তুলতেই স্বস্তি পায় বেশি।
সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে মনুষ্য হৃদয়ে যে বেদনা সঞ্চারিত হয়, তা যে কোন রাগরাগিণীর সুরে কেঁদে উঠবে কখন, সে একমাত্র বোকা মানুষই জানে। উপেক্ষিত, অবহেলিত, প্রতারিত হতে হতে বোকা মানুষ ক্রমশ আবিষ্কার করে একেকটা রাগের, একেকটা লয়ের, একেকটা ছন্দের, একেকটা শব্দের, একেকটা শ্রুতির, একেকটা পৃথক স্বর্গ। একেকটা রাগ শুনতে শুনতে সে বোকার মতো কাঁদে। বোকা মানুষ লিখে রাখে— ‘মালিনী রাজুরকার কাঁদালেন কেঁদে জৌনপুরি…’। ১৯৭১ সালে জার্মানিতে নিখিল ব্যানার্জীর বাজানো বাগেশ্রী-আলাপ, ২০২১ সালে শুনতে শুনতে বোকা মানুষ ভাবে ‘কত নক্ষত্রের অশ্রু জমে জমে একটি নিখিল আকাশ এই মরবিশ্বে মূর্ত হয়েছিল’! অকাজের কথা ভাবতে বোকা মানুষের কোনো জুড়ি নেই।
তার একটি দীর্ঘকবিতা শুনে মহামান্য বাবু শঙ্খ ঘোষ ‘বারোমাস’ পত্রিকার জন্য সেটা ছাপতে চাইলে একমাত্র বোকা মানুষই বলতে পারে ‘না স্যর, এটা আমি অন্য একটা লিটল ম্যাগাজিনে দেবো বলে কথা দিয়ে ফেলেছি’। বোকা মানুষের জীবনে কিস্যু হবার নয়। ব্যর্থতা অবধারিত জেনেও, বোকা মানুষ সজ্ঞানেই রাংতা মোড়া মেকি সাফল্যকে প্রত্যাখ্যান করে। বোকা মানুষ দেখেছে, একটু হাঁটু মুড়ে বসতে পারলেই কত মানুষের কতরকম হিল্লে হয়ে যায়, কিন্তু বোকা মানুষ গ্যাঁট হয়ে ডিভানেই বসে থাকে। বোকা মানুষ চিরদিনের মতো রবিবারের চা-চানাচুর পাশ-কাটিয়ে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু বোকা মানুষ কি এতই বোকা, এটুকু বুঝবে না যে এই বাজারে অবোধকে সুবোধ বলে মেনে নিতে পারলেও কিছু না কিছু এঁটোকাঁটা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ওপরচালাক এই দুনিয়ার উপেক্ষার পাত্র হয়েই সে নিজেকে ধন্য মনে করে, পুরস্কৃত মনে করে।
বোকা মানুষ একদিন হঠাৎ, একচল্লিশ বছর বয়সে, কর্পোরেট মিডিয়ার চাকরি ছেড়ে কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথে লিটল ম্যাগাজিন বিছিয়ে বসতে পারে, পাথরের চেয়ে ভারী বইয়ের ব্যাগ বইতে পারে সামান্য পয়সার বিনিময়ে। বোকা মানুষের বাড়িতে বাবা-মা-বউ-মেয়ে তার দিকেই তাকিয়ে থাকে, সে জানে, কিন্তু সব বুঝেও তার কিছু করার থাকে না। সে তার অসহায়তার কথা কাউকে বলে বোঝাতে পারে না। সে তার নিঃস্ব জীবনের গোপন আনন্দ, সংসারের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখে। সে লক্ষ করে দেখেছে যখন জীবনের সাংসারিক দুঃখকষ্ট চরম আকার ধারণ করে, তখনই জীবন তার শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনা নিয়ে হাত বাড়ায়। সে দেখেছে কে যেন আড়াল থেকে আগলে রাখে তার জীবন-জীবিকার ভালোমন্দ। কে যেন একদিন তাকে আবার ফুটপাথ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় কোনো উচ্চতর আসনে। কে যেন তার হয়ে সমস্ত জটিল সমস্যার প্যাঁচ কাটতে কাটতে এগিয়ে চলে, আর বোকা মানুষ তার পিছু নেয় সম্মোহিতের মতো।
‘চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ সম্ভব নয়’ এই আপ্তবাক্য সে জন্ম থেকেই শুনে আসছে, অথচ আজন্ম সে দেখে আসছে এই সমাজ, এই দেশ, এই দুনিয়া, ওপরচালাক হবার প্রতিযোগিতায় নেমে এই গ্রহের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলছে ক্রমশ। এই বিশ্বে চালাক মানুষ যারা, তারা বহুদিন আগে থেকেই জানত বিশ্বউষ্ণায়ণ কী, কেন হয়, কী তার প্রতিবিধান… কিন্তু তারা কেউই আসন্ন বিপদের কথা জেনেও আপন মুলুকের খণ্ডিত উন্নয়নের স্বার্থে নিজস্ব কার্বন-উদ্গিরণ কমাতে রাজি হয়নি। বছরের পর বছর তারা একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থেকেছে। উপরন্তু, এই গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে যেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনবরত চলতে থাকে তার জন্য প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছে। অস্ত্র বিক্রি করে তারা এই গ্রহে সবচেয়ে ধনী সবচেয়ে ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে চেয়েছে। অথচ চালাক মানুষরা এও জানে যে বিশ্বউষ্ণায়ণ এই হারে বাড়তে থাকলে আর কয়েকবছরের মধ্যেই বিশ্বের অধিকাংশ উপকূলবর্তী শহর বিপন্ন হয়ে পড়বে, ভেসে যাবে কত দেশ, মহাদেশ… সব জেনেবুঝেও তারা দিনের পর দিন এই গ্রহে অন্ধ আধিপত্য কায়েমের যুদ্ধ জারি রেখেছে। কিন্তু চালাক মানুষ এতই চালাক যে এটা বোঝে না— তাদের জয়যাত্রার ফলস্বরূপ গ্রহটাই যদি আর প্রাণধারণের যোগ্য না থাকে, তাহলে কোথায়, কার ওপর, প্রভুত্ব করবে কে?
বোকা মানুষ তাই কোনোদিনই চালাক হতে চায় না। তার জীবনের মোক্ষ আরো সরল হওয়া। সেই সারল্য মোটেই শিশুর সারল্য নয়। সেই সারল্য অর্জন করতে হয় জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। অভিজ্ঞতা-পরবর্তী যেই সারল্যকে বলা হয় ‘Higher Innocence’। পরমহংসের মতো সেই সারল্য অর্জন করা তো আর মুখের কথা নয়, তবু বোকা মানুষের জীবন তাকে ক্রমাগত আরো সরল হওয়ার বিচিত্র সব প্ররোচনা দিয়ে যায়। এই যেমন কিছুদিন আগে, সে একজন অগ্রজ কবির বেশি-বয়সের কবিতা পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করল এমন একটি কবিতা যা তার নিজের লেখাও হতে পারত। কবিতাটি পড়ে বোকা মানুষের এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হল যে তার আজন্মের বোকামি তাকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সঠিক পথেই নিয়ে এসেছে এযাবৎ—
নিজেকে বলি, হে…
তীক্ষ্ণ চোখা ধূর্ত সেজে থাকবার দিন
শেষ হ’ল
এইবার বোকা হয়ে যাও
এবারে সহজ হয়ে যাও
এবারে ঘোচাও চালাকির
বন্দিদশা চিরতরে… ও হে
যা হবার অনেক হয়েছ…
এইবার দুই ডানা মেলে
হাঁস হয়ে… হালকা হয়ে… বুদ্ধি ছাড়িয়ে
উড়ে পড় ঊর্ধ্বে… হৃদাকাশে
কাব্যসূচি :-
- সূচনাকাব্য— সমসাময়িক বন্ধুদের/শোভন ভট্টাচার্য/এক প্রেমিকের ইচ্ছামৃত্যু
- সমাপ্তিকাব্য- বোকা হয়ে যাই/প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়/আনন্দ ভিখিরি