ফার্মগেটের মোড়ে অন্তত সতেরো হাজার ফেরিওয়ালা থাকার কথা ছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে সতেরোজন ফেরিওয়ালা রয়েছে বড়জোর, তাদের গুঞ্জরণ সন্তরণে জায়গাটা যথাগমগমে। কিছু রেস্তোরার আলো নিভে গেছে বলে খাবারের ঘ্রাণ আছে, কিন্তু খাবার নেই। একটা রেস্তোরা খোলা, সেখানে বেয়ারাদের বারংবার মোছার যন্ত্রণা থেকে টেবিলগুলো রক্ষা পেয়ে একা একা দাঁড়িয়ে, বিচ্ছিন্ন। কোনো চা কিংবা মোগলাই পিয়াসীর আনাগোনা নেই। আর একটা জুতোর দোকান খোলা, বিজ্ঞাপনের হাসিখুশি তরুণী ক্রেতা টানতে ব্যর্থ। আনন্দ সিনেমা হলের নিচে জমাট অন্ধকারে রূপজীবিনীরা কেউ নেই। তবে পাবলিক টয়লেটের সামনে বেঞ্চ পেতে তৈরি করা নার্সারিটা আছে, নার্সারির মালিক বোধহয় টয়লেটে গেছে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর অসুস্থ হলুদ আলোর নিচে সারি সারি ধুঁকতে ধুঁকতে থাকা টেম্পো দেখা যায় এ সময়। যাত্রী নিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে যেতে যেতে যারা হুটহাট ব্রেক কষে আর আইল্যান্ডে উঠে যাওয়া বা পথচারী চাপা দেওয়া থেকে অলৌকিকভাবে নিজেদের রক্ষা করে। এ মুহূর্তে প্রায় নেই বললেই চলে সেই টেম্পোগুলো। যাত্রীও নয়। রোজা শুরুর আগে আজ প্রথম রাত্রি, সে কারণে। গোটা শহর ফাঁকা করে লোকজন মসজিদে সিজদা রাখতে গেছে। এশার নামাজের পর আজ প্রথম তারাবির নামাজ, তাই মসজিদে ভিড়টা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবেই। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রাস্তাগুলো বিশ্রাম পাচ্ছে।
আমার যাওয়া দরকার ফুলার রোড। ফুলার রোডের মোড়ে শহীদ চত্বর, কড়ই গাছ, সেখানে মিতা অপেক্ষা করে আছে। মিতা আমার প্রেমিকা, আমার সহধর্মিনী। সেখানে দুজন এক হয়ে কিছুক্ষণ রাত্রিমধুর সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরব, এই হলো পরিকল্পনা।
ফুলার রোডে যেতে হলে আমাকে উঠতে হবে নিউ মার্কেটগামী ওই ক্ষ্যাপা টেম্পোগুলোয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা টেম্পো প্রায় ভরে উঠেছে, দূর থেকে দেখতে পেলাম। টেম্পোর ভেতরে জ্বলতে থাকা আলোয় একটা টিয়ে রঙের গেঞ্জিপরা লোক খুব জ্বলজ্বল করছে। আর লাল জামা পরা এক পরিপাটি তরুণী। সব সিট ভরে গেছে, কেবল সেই লাল তরুণীর পাশের সিটটা খালি। ধূসর গেঞ্জি পরা এক কিশোর সেখানে চটপট উঠে বসতেই টেম্পোর চালক তার প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেট ফেলে দিয়ে দৌড়ে সিটে বসে পড়ল, স্টিয়ারিঙ ধরল। তার মুখটা এখন অন্ধকারে। হাত নাড়লাম দেখতে পেলো না। অবশ্য হাত নেড়ে লাভ নেই, আসন খালি নেই। পা দানিতে ঝুলে ঝুলেই যেতাম নাহয়! পারলাম না। টেম্পোটা ছেড়ে গেল। ধীরে ধীরে দু চারটা রিকশাকে পাশ কাটিয়ে পান্থপথের সিগনালের দিককার আলো আঁধারে মিশে গেল।
আমার সামনে তখন দ্বিতীয় ও একমাত্র টেম্পোটা হাসছে। ভেতরে নরম আলোয় একটা বৃদ্ধ লোক বসে আছে, এ মুহূর্তে একমাত্র যাত্রী।
টেম্পোর পা দানিতে পা রাখতেই লোকটা কথা বলে উঠল। ‘‘আসুন আসুন! লোকজন এতো কম হবে বুঝতেই পারিনি। নয়ত ঠেলেঠুলে আগের টেম্পোতেই উঠে যেতাম। বসুন। এটা এখন কতক্ষণে ছাড়বে কে জানে। কী মুশকিল! এই সময়ে কিন্তু কখনো এমন হয় না জানেন? আজকে তো প্রথম তারাবি, তাই লোকজন সব হাওয়া। নেই। প্রথম কদিন এমন থাকবে। এদিকে একা বসতে বসতে আমি তো দুর্ভাবনায়। ভাবছিলাম না জানি কতক্ষণ আমাকে এখানে একা বসে থাকতে হয় যাত্রীর অপেক্ষায়। এমন সময় আপনি এলেন। যাক, চটজলদি ভরে গেলে হয়। তবে ভরবে না। লোক কই? সব হাওয়া।’’
লোকটা থামল। আমি কি কোনো অদৃশ্য বোতামে চাপ দিয়ে দিয়েছি এখানে বসতে গিয়ে? নয়ত এ মানুষটা এমন হঠাৎ এক সারি শুনিয়ে দিলো কেন চাবি মুচড়ে দম দেওয়া পুতুলের মতো? আমি সাবধানে তাকে লক্ষ্য করলাম। লোকটার মধ্যে একটা বোকাটে পুতুল পুতুল ভাব প্রবল। গড়নে হালকা পাতলা। বয়েসে বৃদ্ধ হলেও কণ্ঠে কিশোর ভাবটা-
‘‘সেই বেগুনবাড়ির মোড় থেকে এই পর্যন্ত আসতে আমার কতক্ষণ লেগেছে বলতে পারেন? অনুমানে বলুন তো? দেড় ঘণ্টা লেগেছে। পাক্কা দেড়টা ঘণ্টা। এটা কোনো সভ্য দেশে সম্ভব? আপনি ভাবতে পারবেন না একেকটা সিগনালে কতক্ষণ ধরে গাড়ি আটকে রাখে। আর গলির ভেতরে সব কেমন জট পাকিয়ে থাকে। বাইরে জট, ভেতরেও জট। বাইরে জট দেখে গাড়িগুলো সব ভেতরে ঢোকে, বুঝলেন? আর ভেতরে জট বাড়ায়। আরে অলিগলি কি অতো চাপ নিতে পারে নাকি। ভেতরে আরো জমাট জঙ্গল পাকিয়ে যায় না? আর হাতে তো সময় নেই কারো। ভেতরে মানুষগুলো যে কোনো মুহূর্তে চাপা দেয়ালে পোস্টার হয়ে সেঁটে যাবে এমন বেপরোয়া চালায় কিছু গাড়ি আছে। রিকশাগুলোর কথা আর কী বলব। কারা যেন ওই যে এঞ্জিন লাগিয়ে দিয়েছে রিকশায়। একেবারে উড়ালপঙ্খী এখন একেকটা। সেদিন একটা রিকশা মোড় ঘুরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার সামনে। আরেকটু হলেই মেরে দিয়েছিল। যাত্রী মেয়েলোকটা মাজা ভাঙল। ইশ! রিকশাওয়ালা, ও ব্যাটা নিজের দোষ ঢাকতে তখন মুখ বাঁকি লুলা সেজে কোঁকাচ্ছে। অবশ্য এভাবে বলা ঠিক না। জানেন তো, যার ঘা তার ব্যথা। আর আমিও এজন্যেই এতো কথা বলছি- যার ঘা তার ব্যথা। জীবন থেকে দেড়টা ঘণ্টা হারিয়ে গেল, যেখানে আমার পনের মিনিটের বেশি লাগার কথা ছিল না। এই দেশ কোনোদিন ভালো হবে? কোনোদিন ভালো হবে না।’’
বাপরে বাপ। লোকটাকে তখনো খেয়াল করে উঠতে না উঠতেই আবার কথার তোড়ে ভেসে গেলাম। কথা বলতে বলতে বোধয় মাথা গরম হয়ে গেছে লোকটার। মাথায় একটা বারান্দাওয়ালা সাদা ক্যাপ। ক্যাপটার বারান্দা ধরে একবার নেড়েচেড়ে মাথার কিছু ভাপ বের করে দিলো। একটা সাদা সুতি শার্ট পরনে লোকটার। শার্টটা এতো পুরনো যে অনেককালের ঘামপ্রোথিত লাল আভা ছড়াচ্ছে। বারংবার তার ওপর ইস্ত্রি চালানো হয়েছে বোঝা যায়। লাল আভাটা এখন স্থায়ী। টেট্রনের কালো প্যান্টটা বিবর্ণ প্রায়। গোড়ালির দিকে পাটির মতো গুটিয়ে গেছে নিজ থেকেই। প্রমাণ করছে প্যান্ট বেচারা এ ভদ্রলোককে একাকী সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে আজ বহুকাল।
পায়ে খয়েরি রঙের পুরনো চামড়ার জুতা। এও তার বহুকালের পুরনো সঙ্গী সন্দেহ নেই। সোলের কাছে কাদা শুকোনো সাদা মাটি লেগে আছে। পায়ে মোজায় ঢিল পড়েছে। আচমকা পা ঝাঁকিয়ে লোকটা বলল, ‘‘মশা দেখেছেন? আমাকে ভেবেছে একদম নিজের সম্পত্তি। যেন ওর জন্য আমি নিলামে চড়েছি আরকি। খুব সস্তায় পেয়েছে আমাকে। তাই কামড়ে এখন আর রাখবে না। মানুষের চেয়ে সস্তা আর কিছু আছে, বলেন? চলতে ফিরতে সারাক্ষণই এই সত্যটা দেখছি। আপনাকে মশা কামড়াচ্ছে না? পা নাড়ুন, পা নাড়ুন! তাহলে আর বসতে পারব না। নিজেরটা তো নিজেদেরকেই বুঝতে হবে, তাই না?
লোকটার ভাঙা চোয়ালটায় অনেককালের অভাবের কথা লেখা। খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি, তবে ওরা এতোই ক্ষুদ্র যে বোঝা যায় ব্লেডটা গতকালই চলেছিল। চোখদুটো কোটরে একটু বসে যাওয়া, অভাবী লোকদের যেমন হয়। কোলের ওপর ব্যাগটা এতোক্ষণ খেয়াল করিনি। ছোট একটা অফিসব্যাগ। সামনের পকেটটা চেইন নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়। ওটা আধখোলা।
টেম্পোকে আরেকজন উঠে এলো। এক মধ্যবয়স্ক লোক। বৃদ্ধ তার কিশোর গলায় উৎফুল্লতা ঢেলে বলল, ‘‘বাহ বাহ! যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দ্রুত ভরে যাচ্ছে। এমন হলে খুব বেশি দেরি হবে না আর। আমি আবার একটু তাড়ায় পড়ে গেছি আজকে। আর আপনি দেখবেন, যেদিন খুব তাড়া থাকবে, একটার পর একটা বাধা এসে দাঁত বের করে হাসবে। তাও ভালো আজকে বোধয় ফাঁকা পাওয়া যাবে রাস্তাটা। একবার ছাড়লে হয়ত আর খুব বেশি দেরি হবে না কী বলেন।’’
লোকটা এবার আমাকে ছাড়াও বাকি লোকটাকে সাক্ষী মানল। কেউ কোনো উত্তর দিলাম না। এমন সময় একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে এসে দাঁড়াল টেম্পোর কাছে। হাতে সিগারেট। বৃদ্ধের কাঝে দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকেই সবচেয়ে বিশ্বস্ত কেউ বলে কোনো কারণে মনে হয়েছে। বলল, ‘‘একটা ব্যাপার দেখবেন, এই শহরে সবার হাতে সিগারেট। কমবয়েসী ছেলেদের হাতে সারাক্ষণ সিগারেট। এদের কার কেমন রোজগার জানি না, কিন্তু সারাক্ষণ আগুনে টাকা পোড়াচ্ছে। নিজে মরছে অন্যদেরও মারছে। বলুন ঠিক বলেছি কিনা। এতো এতো সিগারেট খায়, বাঁচবে কদিন?’’
এর মাঝে আরো দুজন লোক উঠে এলো। টেম্পো ক্রমে ভরাট হয়ে আসছে। বোরকা পরা এক মহিলা উঠে কিনারের দিকে জায়গা চেয়ে উঠে বসলেন, বৃদ্ধের মুখোমুখি। মহিলা হাত থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢুকে স্ক্রলডাউন করতে শুরু করেছেন কি করেননি, বৃদ্ধ সরব হয়ে উঠলেন। ‘‘আর এক নেশার নাম মোবাইল। এই রাস্তার পাশে এরকম ব্যস্ত জায়গায় আপনি এমন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, টান দিয়ে কেউ নিয়ে দৌড় লাগালে কিছু করতে পারবেন? এটা ফার্মগেট মনে রাখবেন। এখানে তক্কে তক্কে আছে এমন লোকের অভাব নেই। আছে, বলুন? নিয়ে চোঁ চোঁ দৌড় লাগাবে। কেউ কিছু করতে পারবে না। যেসব উঠতি ছেলে মোবাইল টানে, নেশাখোর বলে বেশি ভাবনা টাবনা করে না। বাধা পেলেই চালিয়ে দেয়। ভাবছেন চিৎকার করবেন। চিৎকার শুনে কেউ আটকাবে ভেবেছেন? কেউ আটকাবে না। আটকালে পেটে ছুরি খাবে যে। তবে আছে, কিছু পাগল আছে আটকায়। তার মূল্যও দেয়। মোড়ে মোড়ে কিন্তু পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশগুলো আটকাবে ভেবেছেন? হা হা হা! আটকালে ওর বখরা পাবে কোথায়।’’
মহিলা ভালোয় ভালোয় মোবাইল ফোনটা ব্যাগের পকেটে ভরে ব্যাগটা কষে আঁকড়ে ধরল।
‘‘না, পুলিশগুলোকে মন্দ বলার অধিকার আমার নেই,’’ বলল বৃদ্ধ লোকটা। ‘‘কারণ ওদেরকে মন্দ করে রাখা হয়েছে। আপনি পুলিশে গিয়ে সৎ থাকবেন? পাগল হয়েছেন? আপনাকে টেনে নর্দমায় নামাবে। যারা ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকে তাদের বাড়িতে হাঁড়ি কয়বার চড়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখার অনুরোধ। ওরা টাকা নেয়, কিন্তু টাকা রাখতে পারে না। শেষমেশ ওরাও আমাদের মতোই খুব সাধারণ মানুষ। যদিও পোশাকটা গায়ে চড়ালেই সব ভুলে যায়। বাসায় গিয়ে যখন পোশাকটা খোলে, সব আবার মনে পড়ে যায়। একটা দেশ চালাতে হলে কী লাগে জানেন? ভালো ভাবে চালাতে লাগে প্রচুর প্রচুর শিক্ষিত লোক। আর খারাপ ভাবে চালাতে লাগে প্রচুর প্রচুর পুলিশ লাগে। করাপ্টেড পুলিশ। এই যে আপনি— ’’
সবাই এরইমাঝে সতর্ক হয়ে উঠেছে লোকটার ব্যাপারে। কাকে ডাকছে লোকটা? তাকে কিনা আড়চোখে দেখে বোঝার চেষ্টা করে নিশ্চিন্ত হলো। এবারের বাছাই আবার সেই সিগারেটওয়ালা ছেলেটা। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সে তখন টেম্পোতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
‘‘সিগারেটটা তো খুব শেষ করলেন।’’
‘‘আমাকে বলছেন?’’
‘‘জি। কিছু মনে করবেন না বাবা। এখন উঠবেন তো? আপনি ওঠার পর টেম্পোটা একটা উৎকট গন্ধে ভরে যাবে না বলুন? কেন করলেন এ কাজটা? সিগারেটের গন্ধ কত খারাপ আপনি জানেন? যে খায় বোঝে না। যে খায় না সে টিকতে পারে গন্ধে। গোটা টেম্পোটা উৎকট গন্ধে ভরে যাবে, আর সেই গন্ধটা আমাদেরকে পেতে হবে, এটা তো ঠিক না। আপনিই বলুন। একে তো সিগারেট খাওয়া ঠিক না, দুইয়ে এই ব্যাপারটা ঠিক না। আমি কোনো খারাপ কথা বলেছি? খারাপ কিছু বলছি না কিন্তু। বলুন, ঠিক বলেছি কিনা।’’
ছেলেটা টেম্পোতে উঠে বসল। লোকটা বলেছে বলেই কিনা জানি না, ধূমপায়ীর স্বাভাবিক গন্ধটা মুহূর্তের জন্য খুব উৎকট বলে মনে হলো। বৃদ্ধ নাকে হাত দিয়ে তার কিশোরসুলভ কণ্ঠে করে বলল, ‘‘উঁহ, গন্ধ! উঁহ, গন্ধ!’’
ছেলেটার চোখে মুখে একটা ভেজা আর ক্ষিপ্ত ভাব ফুটে উঠল। কপালটা ঘেমে উঠেছে, নাকি আগে থেকেই ঘর্মাক্ত ছিল? এরইমাঝে সব সিট ভরে গেছে। টেম্পোর চালক সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিঙ ঘোরাল। ধীরে ধীরে গতিতে উঠে গেল গাড়ি। গাড়িটা মনে হচ্ছে শুকনোর ওপর আছাড় খাচ্ছে। হেলে হেলে পাশের লোকের ওপর পড়তে পড়তে সামলে নিচ্ছিলাম, তারও একই দশা। রঙ ওঠা মরচে ধরা হাতলে বিগত অনেক লোকের ঘামের সঙ্গে ঘাম মেলালাম।
টেম্পোর সবাই চুপ। সবাই ভয়ে ভয়ে আছে, লোকটা কখন কথা বলতে শুরু করে। দেখে মনে হলো, কিছু একটা বলার জন্যে বৃদ্ধ উসখুস করছে। একসময় বলেই ফেলল, ‘‘রোজা এসেছে, সবাই একটা ব্যাপার মনে রাখবেন। তারাবি বাদ যায় যাক, কিন্তু রোজা যেন বাদ দেবেন না। এটা আল্লার উপহার। এ উপহার সবাই পায় না। একটা রোজাও যেন বাদ দেবেন না খবরদার!’’
সেই মুহূর্তে গাড়িটা আচমকা ব্রেক কষল। তাকিয়ে দেখি এক শিশুর হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিল এক বৃদ্ধ। আরেকটু হলেই গাড়ি তাদের গায়ে উঠে যাচ্ছিল। চালককে দেখে মনে হলো কিছুই ঘটেনি। যেহেতু তারচেয়ে বড় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আর কেউ নেই, তাই তার চেয়ে ঋষিশান্তও আর কেউ নেই। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। এবং পা দানিতে পা রেখে কোনো ক্রমে ঝুলতে থাকা হেল্পার এবার ভাড়া কাটতে শুরু করল। এক ছাত্র পান্থপথ সিগনালেই নেমে যাবে। সে দশ টাকা বাড়িয়ে দিলো।
‘‘বিশ টাকা ভাড়া’’, বলল হেল্পার।
‘‘আমি তো বিশ টাকার পথ যাচ্ছি না।’’ ছেলেটা ত্যাদড়।
‘‘যেখানেই যান বিশ টাকা।’’
‘এটা কোনো কথা হলো? দেবো না বিশ টাকা।’’
‘‘এই গাড়িতে আপনে নতুন নাকি মিয়া? এইখানে সবসুমায় বিশ টাকা, যেখানেই নামেন। ওনাগোরে জিগান।’’
এসময় বৃদ্ধ লোকটা আঙুল তুলে বলল, ‘‘এই, তোমার কথা ঠিক করো ছেলে। সবসময় বিশ টাকা, এটা কোনো কথা হলো? সবসময় যদি কোনো অন্যায় চলতে থাকে, তার কি কোনো প্রতিবাদ করা যায় না?’’
‘‘এইটা কোনো অন্যায় না। এইটা বিশ টাকা। ইনসাফ।’’
‘‘নিউ মার্কেটের ভাড়া বিশ টাকা হতে পারে। মাঝপথেও আসেনি এই ছেলে, তুমি পুরো ভাড়া চাইছ। এটা ইনসাফ? উঁহু। এটা তুমি বলতে পারো না। তোমাদের এসব অন্যায়। এবং কেউ এসব ঠিক করে না বলে, প্রতিবাদ করে না বলে তোমারা লাখেরাজ পেয়ে গেছ। গেছ কিনা। নো নো! কেউ কোনোদিন কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি বলে কোনো অন্যায় নিয়ম হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তুমিই বলো, পারে?’’
‘‘আপনে এই গাড়ির খরচ জানেন মুরুব্বি? আমাগো কাছ থিকা যেরা চান্দা তোলে তাগোরে পারলে কন। পেটে মাড়া দিয়ে তারা টেকা বাইর করে। আমরা এতো টেকা কই পাই।’’
বৃদ্ধ বলল, ‘‘তাহলে আমরা কই পাই, সেটা ভেবে দেখেছ? তোমার কাছ থেকে যারা টাকা জোর করে নেয়, সেই জোর তুমি আমাদের ওপর খাটাচ্ছ কেন। আমাদের কী দোষ। তোমাদের আয় যারা নিয়ে যাচ্ছে, তোমাদের উচিৎ তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া। তাদের বিরুদ্ধে তোমারা এক হও। প্রতিবাদ জানাও। আমাদের ওপর কেন চাপিয়ে দিচ্ছ? তুমি এখানে প্রতিটা মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখো ভাই, কেউ ভালো নেই। আমরা কেউ ভালো নেই। বলুন, কেউ কি আপনারা ভালো আছেন? জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ে, সরকার ভাবে আমরা বুঝি না। কালোবাজারির জন্য বাড়ে। মজুদের জন্য বাড়ে। কোটি লোক যদি কোটি লিটার তেল চায়, কোটি লিটার তেল বানিয়ে তেলব্যবসায়ী কোটি কোটি পতি হয়ে যাক না। তার সেই সুযোগ আছে। বড় বাজার তো ভালো, বড় বাজারে দাম করে। কিন্তু বাজার যত বড় হচ্ছে, দাম তত বাড়ছে। এর মানে কী। একশ টাকা লিটার ছিল তেলের, তাও ছিল বেশি। সেটা একশ নব্বই টাকা। দুই কেজি আটা সত্তর টাকা ছিল ছিল সেটা একশ ছাপ্পান্ন টাকা। সবচেয়ে ভালো যে চাল সাতাত্তর টাকা কেজি ছিল— আমি যে অতো দামি চাল খাই না— তার দাম এখন কত? হা হা হা, হা হা হা! মাংসের কথা থাক। আমি সবজি খাওয়া লোক, সবজি কিনতে গেলেই দোকানিরা আমাকে অপমান করে কথা বলে, তুমি জানো? যুদ্ধের কথা বলছ তুমি? (হেল্পার বোকা বোকা হাসল) বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখানো বড়ই সোজা। যুদ্ধের বাজার আমরা দেখিনি? সে যুদ্ধ গায়ের ওপর এসে পড়ে নাড়ি ছিড়ে নেওয়া যুদ্ধ। সে সংকট সত্যিকারের সংকট। কেন বেড়েছিল দাম? উৎপাদন ছিল না, কাঁচামাল ছিল না, লোকবল ছিল না। প্রযুক্তি ছিল? কোথায় থাকবে। এখন একজনের এক মাসের কাজ এক ঘণ্টায় হয়। তবু বুঝলাম, যুদ্ধ। আর যুদ্ধ যখন বাধেনি, তখন? শনৈ শনৈ বাড়েনি দাম? আমাদের আয় কি একটাকাও বেড়েছিল তুমি বলো? কেউ আমরা ভালো নেই। আমি ভালো নেই, তুমিও ভালো নেই। তোমাকেও তো বাজার করে খেতে হয়। বলো তুমি ভালো আছ?’’
‘‘সবাই নিজের কথা কয়। আমাগো কথা কেউ কয় না। আপনিই কইলেন।’’
‘‘হা হা হা। পাগল ছেলে। আরে আমি আছি তো। আমাকে সবসময় পাবে তোমাদের পাশে। দেখো, সবাই চলে যাবে, আমি যাব না। আমি থেকে যাব। এই দেখো, তোমার বিবেক এখন কথা বলছে। একটা নাড়া খেয়েছে বলেই তো, না? এই ছেলেটিকে ধন্যবাদ। ও প্রতিবাদ করেছিল বলেই না আজকে কতগুলো কথা হলো। তুমিও আমাদের পথে এসো। দেখো আমরা প্রতিবাদ করছি। তুমি কেন করো না? তুমি অন্যায় সহ্য করছ। যদি তুমি অন্যায় সহ্য করো, তাহলে তুমি অন্যায়কারীর সমান অপরাধী, তুমি জানো?’’
টেম্পোতে এতোক্ষণের নীরব লোকেরা এবার সরব হতে শুরু করেছে। ভেতরে বাতাসের পর্দায় কাঁপাকাঁপি। দেখা গেল সবারই বলার মতো অনেক কথা রয়েছে। কেউ কেউ বৃদ্ধকেও সাক্ষী করতে শুরু করল। তিনি তাদের সমর্থন জানালেন, হাসলেন, প্রত্যুত্তর বললেন। হাত নেড়ে নেড়ে সাগ্রহে তাদের কথাসঙ্গ দিলেন, সান্ত্বনা দিলেন। একটু আগেও সবাই কোঁচকানো ভুরু নিয়ে আড়চোখে চাইছিল তার দিকে। হঠাৎ সবার আড়ষ্ট ভাব গিয়ে একটা সহজ শৈথিল্য চলে এসেছে। একজন দেশ ছেড়ে চলে যাবে এমনও বলছিল। তখন শাপ-সান্ত্বনার ফাঁকে ছাত্র ছেলেটার কাছ থেকে হেল্পার বিশ টাকার বদলে দশ টাকাই নিলো। বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল—
‘‘আপনি কই নামবেন?”
‘‘আমি নামব তোমার সায়েন্স ল্যাবের ওভারব্রিজের নিচে। দেখো, আমাকে সায়েন্স ল্যাবের ওভারব্রিজের নিচে, রাস্তাটা পার করিয়ে নামিয়ে দিও। কোনো ধানাই পানাই কোরো না। সবসময় আমার নামার গোলমাল করে দেয় এরা, জানো? না, তোমাকে বকছি না। তোমার সঙ্গে তো আজই দেখা হলো।”
টেম্পো যখন সায়েন্স ল্যাবের ওভারব্রিজের সামনে এলো, আমি ছাদে একটা চাপড় মারলাম। টেম্পো থেমে গেলে লোকটা পা দানিতে দাঁড়িয়ে থাকা অপর এক যাত্রীর পেটে টোকা দিয়ে বলল, ‘‘সরুন সরুন! নামতে দিন আমাকে। এই ড্রাইভার! চলন্ত অবস্থায় আমাকে নামিয়ো না। আমার ক্ষতি হতে পারে।”
লোকটা নেমে গেল। যেতে যেতে বলছে, ‘‘নিজেরটা তো নিজেকেই বলতে হয়। কে বলে দেবে বলো?”
টেম্পো যখন আবার চলতে শুরু করল, সিগারেট খাওয়ার ছেলেটা হেসে বলল, ‘‘বেশি পড়ালেখা করলে এই হয়।”
আমার পাশের লোকটা বলল, ‘‘বড় ভালো লোক।’’
একজন বলল, ‘‘আহা আহা। এই লোকগুলা থাকুক।”
নিউ মার্কেট নামলাম। মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ ছাড়িয়ে আরো খানিকটা হাঁটতেই দেখি দূরে সেই রহস্যমিতা প্রাচীন কড়ই গাছের নিচে আমার মিতা ইটের দেয়ালের ওপর এক কাপ চা হাতে বসে আছে। আরেকটু কাছে আসতেই আমাকে ইশারা করল, চা খাব কিনা। খাব না— ইশারায় দেখালাম। মিতা দাম মিটিয়ে চা ওয়ালা বিদায় দিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকল যেন কত কী বলার আছে। আমারও অনেক কথা বলার আছে তাকে। আমারও কি নেই?