‘বোকা আর সৎ’ এবং ‘সৎ, তাই বোকা’ খুব পরিচিত মুখফেরতা তকমা। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের খুব প্রিয় তকমা এটি। মধ্যবিত্ত অনেক চাওয়া এবং অনেক না-পাওয়ার দ্বন্দ্বে মানিয়েগুছিয়ে নিতে নিতে বিত্তবৃত্ত বহমান রাখে। সে প্রচুর চেষ্টা করে নিম্নবিত্তের সংকটের সম্মুখীন না হওয়ার, আবার উচ্চবিত্তের (বা অতিস্বচ্ছল মধ্যবিত্তের) আর্থ-মর্যাদায় পৌঁছানোর তৈলাক্ত বাঁশে পিছলে যেতে থাকে বারবার। মধ্যবিত্তের এহেন সংকট কখনও বাড়িয়ে তোলে আবার কখনও সেই সংকটের মলম নিয়ে হাজির হয় সংস্কার। ভদ্রলোকের অনেক সংস্কার! তার মধ্যে অন্যতম- বানিয়ে তোলা নীতিবোধ। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের আর্থ-রাজনৈতিক অসহায়তা তাকে নীতিভাঙ্গার খেলায় ঠেলে দেয় বারবার। নিজের আর্থ-রাজনৈতিক অসহায়তা কাটাতে হাঁকুপাকু করে সে। যদি জিতে যায় সে খেলায়, তাহলে আপাত-সফলতার আড়ালে চাপা পড়ে যায় ওই ভদ্রলোকীয় সংস্কার। যদি না পারে, তখনই ভদ্রলোকীয় সংস্কার সততা নামক যষ্টি আঁকড়ে ধরে। “সৎ বলেই তো পারলুম না অমন করতে”। “বোকা বলেই গুছিয়ে নিতে পারল না”। “আমি সরল, অত প্যাঁচ-পয়জার কষতে পারি না।” এর সঙ্গেই জুড়ে যায় ‘বোকামি’ নামক শব্দটি। বোকামি বহ্বার্থবাচক। কখনও তা সততার নামান্তর। কখনও মূল্যবোধের। কখনও মেনে নেওয়ার। কখনও সরলতার। কখনও না-উন্নতির। সততাকে প্রায়ই একাকার করা হয় বোকামির সঙ্গে। চালাকি ক’রে কাজ হাসিল না করতে পারা। মওকা বুঝে উন্নতির সিঁড়িতে পা না দিতে পারা। নীতিবোধে আপস না ক’রে সামাজিক স্টেটাসের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া। বোকামির সামাজিক সংজ্ঞায় এসব অন্তর্ভুক্ত হয়ে চলে। আভিধানিক পরিসর ছাড়িয়ে বাড়িয়ে। সততা একটি আপেক্ষিক মূল্যবোধ। সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদির উপাদানগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত বদলায়, মূল্যবোধগুলিও বদলে যেতে থাকে। বিশ্বায়ন-উদারিকরণের আগের মূল্যবোধ এবং পরের মূল্যবোধ আলাদা হয়ে গেছে ও যাচ্ছে ক্রমশঃ। একদা যা ছিল লজ্জার, তা এখন দেখনদারি। যে ভোগ্যপণ্যের ক্রয় আগে চেপেচুপে রাখতে হত প্রতিবেশী-আত্মীয়দের থেকে, সেই ভোগ্যপণ্য কিনে দেখনদারি না হলে স্টেটাস বাড়ে না এখন। ক্রয়ক্ষমতার বাইরে গিয়ে খরিদ করার নৈতিক বাধা সরে গেল ধীরে ধীরে। উৎকোচ ছিল অসৎ অভিব্যক্তির প্রকাশ, ক্রমশ তা স্বাভাবিক হয়ে এল বিভিন্ন উপায়ে। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য থেকে পরিষেবা- ঘুষ রাস্তা সহজ ক’রে দেয়। সংসদীয় রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির হদিশ পেতে পেতে মেনে নেওয়া গেল যে, দুর্নীতির লেসার-গ্রেটার বিভাজন হয়। বেশি ভালর থেকেও কম মন্দকে বেছে নেওয়া আশু স্বস্তিদায়ক- মেনে নেওয়া গেল। যারা এই উপায়গুলি অবলম্বন করতে পারল না- তাদের ‘বোকা’ পরিচিতি গাঢ় হল। চালাকরা তাদের তিন গোলে হারিয়ে দিল! প্রতিটি লোক চালাক হতে চায়। কিছু সহজ রাস্তা, কিছু পাশ-কাটানো বাই-লেন খুঁজে পেতে চায়। এমন উপায় যাতে কম শ্রমে কম উদ্বেগে কম খরচে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। প্রয়োজনে নীতিবোধের সঙ্গে আপসের ছোটখাটো চালাকি (কোনটা ছোটখাটো কোনটা বড়, সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় তার পরিমাপও) কে না করে? চালাকি সফল হলে সেটাই কৌশল থেকে নীতি বনে যায়। না হলে? মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত ভদ্রলোক যখনই হেরে যায়, তখনই অপারগতাকে ঢাকতে সৎ ঢাল ঝুলিয়ে দেয় সামনে। বোকামুখোশে সাজার ঢং। প্রতিটি লোকই সম্ভাব্য অসৎ। প্রতিটি লোকই সম্ভাব্য অতিচালাক। বোকামিতে কোনও মহত্ব নেই। ‘বোকা আর সৎ’ শংসাপত্র ততক্ষণই ভাল, যতক্ষণ নিজের ব্যর্থতার অজুহাত খাড়া হয়ে থাকে। যতক্ষণ আখের গুছোনো না যায়। ক্যালেন্ডারের পাতা অনেক অনেক পাল্টে গেলে, বোকামি কিছু আফসোস দেয়। বোকামি আত্মগ্লানি দেয়।
রাষ্ট্র বোকা ভাবে নাগরিকদের। রাজনৈতিক দলগুলি ভাবে ভোটারদের। ভোটাররা ভাবে সহভোটারদের। সংসদীয় গণতন্ত্রের পাংচার্ড চাকা গড়াতে থাকে। রাষ্ট্র জানে কুকীর্তি তলিয়ে ভাববে না জনগণ। মৌলিক অধিকারের দাবি থেকে জনগণের নজর সহজেই ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে অপ্রয়োজনীয় কথায়, নির্দেশে। কোনও জনগণ-ভবি তাতেও না ভুললে, রেউড়ি সংস্কৃতি রয়েছে। হ্যান দেঙ্গে, ত্যান দেঙ্গে, শেষে জটাবুড়ির লেজের লোম দেঙ্গে! ‘পাইয়ে দেব’ টোপে ভুলবে বোকা জনগণ- খুড়োর কল দেখে হাঁটতে হাঁটতে রাষ্ট্রশাসনে সায় দিতে যাবে। যেসব অধিকার নাগরিকত্বের স্বাভাবিক প্রাপ্তি, তাকেই ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে হাতে তুলে দেবে শাসক। বোকা শাসিত বিশ্বাস করবে যে, শাসক মহান বলেই দান-খয়রাতি করছে! শাসক ধর্মে মাতিয়ে ক্ষিদে ভুলিয়ে দেবে। স্টেটাসে মাতিয়ে শ্রেণি। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতিয়ে রাস্তায় নামার পথ। সংসদীয় দলগুলি ভাবে দুর্বলস্মৃতি জনগণ বোকা। বাঁধা-ভোটার বুদ্ধিহীন হয়ে অন্ধ আনুগত্যে বিশ্বাস করবে। বিপরীত শিবিরের ভোটার ভাঁট প্রচারে বিশ্বাস ক’রে শিবির বদলে নেবে। আর, ভোটার যখন দেখে যে, তার দেওয়া ভোটে প্রিয়প্রার্থী জিতল না, তখন বোকা ভাবে সহভোটারদের। সহভোটাররা মূর্খ, অবুঝ, বোকা বলেই নাকি অন্য প্রার্থীকে ভোটে জিতিয়েছে! যারা শাসকের দিকে তর্জনী তুলে লোক জড়ো করে, তাদের বোকা ভাবে নিরাপদে নিশ্চিন্তে থাকারা। যারা জড়ো হচ্ছে, তারা ভাবে ঘরে-থাকা বোকারা অচেতন। এসবের মধ্যেই কতিপয় গুছিয়ে নেয় প্রাপ্তির ভাঁড়ার। শাসিত হয়েও কিছু ফুলেফেঁপে ওঠা। বেশিরভাগ থেকে যায় একই গলতায়। শাসিতই বোকা বনে যায় সবশেষে। শাসক বুদ্ধিমান। শাসনযন্ত্র অবিকল।
বহু যুগ আগে কোনও এক বুড়ো পাহাড় কেটে সরাতে গিয়ে বোকা তকমা পেয়েছিল। সে ছিল মহৎ বোকামি। বহুজনের উন্নতিকল্পে অথচ বহু জন তাকে বোকা বুড়ো দেগে দিয়েছিল। দেবদূতেরা এসে তাকে সাহায্য ক’রে পাহাড় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেছিল। মিথে মিথে মুখফেরতা আখ্যানে ছড়িয়ে পড়েছিল তার নিরলস শ্রম আর জেদের উদাহরণ। তবে, আশ্চর্য এই যে, যুগান্তরেও পাহাড় কেটে সরানোর বোকামি করতে কেউ এগিয়ে আসে না আগে। আজও তেমন নিরলস শ্রম আর জেদকে হাস্যকর বোকামিই ভাবে। ঠাট্টা সাজায়। মিম আর ট্রোল। গোপনে গোপনে অপেক্ষায় থাকে কোনও এক বোকা বুড়োর।