‘ব্যথার তির বিঁধে আছে বুকে, বিঁধে আছে বলেই কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু এটিও সত্য যে তিরটি খোলামাত্রই মারা যাব আমি। ’ -১৮১৩ সালে জন্ম-নেওয়া এক একাকী মানুষ যখন এ কথাটি বলেন তখন কে জানত তাঁর থেকে একশ বছরেরও পরে জন্মানো অন্য-একজন বলবেন ঠিক একই ধরনের কথা: ‘যন্ত্রণার মধ্যে বসবাস করছি আমি… এই যন্ত্রণাকে আমার জীবন থেকে সরানো হলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
প্রথম জন কিয়ের্কেগার্দ, পরের জন রলাঁ বার্ত। একই কথা, আর সুর; মাঝে সময়ের নদী। দুজনের বেঁচে-থাকার এবং লেখার বিষয় ছিল ভিন্ন কিন্তু মনের ভাব কত-না অভিন্ন। যন্ত্রণাই জীবন, এবং মরণ। একে কি বলা যায় সত্তার ক্রন্দন? প্রকৃত-অর্থে সুখের যে জলস্রোত তা দুঃখের সমুদ্রে মিশে যায়; আমাদের অস্তিত্বের যে আকুলিবিকুলি তা শান্ত হয় দুঃখকে আশ্রয় করে। দুঃখের প্লাবিত করার ক্ষমতা অসীম। কিন্তু কী এই সংবেদন যার জন্য বাহ্যিক পৃথিবীর সঙ্গে যন্ত্রণার কাঠে পেরেকবিদ্ধ থাকেন মানুষটি আর এই কাঠ কাঁধে নিয়ে বহন করে চলেন সারা জীবন? তার জীবনটাই যেন তার পেরেকবিদ্ধ কাঠ, যাকে তিনি বহন করে বেড়াচ্ছেন।
মনে হয়, মানুষের ভিতরে যে অতিপ্রাকৃতিক সত্তা রয়েছে তার অতি ভারীত্বের এবং অভিনব দোলাচলের জন্যই এই ধরনের মনোবস্থার জন্ম হয়। মানুষ যে-মানসজীবনকে ধারন করে তার গভীরতা বেশি হলে সেখানে অনবরত চলে নানা প্রতিবিম্ব, দ্বিধা, বর্জন ও পুনর্জ্ঞানের খেলা। এই খেলায় ব্যক্তি অপরিসরে পড়ে থাকে এবং পরিসরে সে যেতেও চায় না। ভৌতসত্যগুলো থেকে মানসসত্যগুলোর দ্বারা ব্যক্তি তাড়িত থাকে বেশি। ফলে ব্যক্তির আত্মা আর্তনাদ করে ওঠে।
এভাবেই কিছু মানুষের মনের ভাব স্বভাবতই দুঃখমুখী। সে যেন দুঃখের সৌন্দর্যে রূপময় হয়ে উঠতে চায়। হয়তো ‘এক্সট্রিমস মিট’ বলে ইংরেজিতে যে কথা আছে, তাই ঘটে ব্যক্তির মনে- সুখ ও দুঃখের দুই প্রান্ত এসে মানুষটির মধ্যে সাক্ষাৎ করে, তখন মানুষটি দুঃখের প্রান্তটি নিয়ে ঝুলে পড়ে যায়। দুঃখ তাকে দিয়ে কথা বলায়। কিন্তু কী এর কারণ? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এর কারণ হল, মানুষ বড়ো হতে চায়, সুখী হতে চায় না।
রবীন্দ্রনাথ ‘ভূমা’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন, দুঃখনিবৃত্তিই মানুষের একান্ত লক্ষ্য নয়, মানুষ দুঃখকে অঙ্গীকার করে নেয়। ‘দুঃখের সম্বন্ধে মানুষের একটা স্পর্ধা আছে’, ‘মানুষের সকলের চেয়ে সত্য ইচ্ছা হচ্ছে বড়ো হবার ইচ্ছা।’ রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, দুঃখনিবৃত্তির জায়গায় এসে ঠেকে গেলে ‘মানুষকে আবার দুঃখের সন্ধানে বেরোতে হত।’ রবীন্দ্রনাথের কথায় মনে হয়, দুঃখ মানুষের চির অভিমুখিতা, দুঃখ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব পরিচেয় ও সম্বন্ধযুক্ত হয় না।
ব্যথায় বেঁচে থাকা, ব্যথা নিয়ে বেঁচে থাকা, ব্যথায় মরে যাওয়া – জীবনের এই তো ধ্রবলেখা। রবীন্দ্রনাথের পিলু রাগে আধারিত সেই গানটি যেন এর এক অন্তিমউন্মোচক:
আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি,
সেথায় চরণ পড়ে
তোমার সেথায় চরণ পড়ে।
…
ব্যথা-পথের পথিক তুমি,
চরণ চলে ব্যথা চুমি
কাঁদন দিয়ে সাধন আমার
চিরদিনের তরে গো
চিরজীবন ধ’রে।
কুমার চক্রবর্তী
জন্ম ২ চৈত্র ১৩৭১ বঙ্গাব্দ, কুমিল্লা, বাংলাদেশ।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হল – কবিতা: ‘লগপুস্তকের পাতা’ (১৯৯৮), ‘আয়না ও প্রতিবিম্ব’ (2005), ‘সমুদ্র, বিষণ্ণতা ও অলীক বাতিঘর’ (২০০৭), ‘পাখিদের নির্মিত সাঁকো’ (২০১০), ‘হারানো ফোনোগ্রাফের গান’ (২০১২), ‘তবে এসো, হে হাওয়া হে হর্ষনাদ’ (২০১৪), ‘অধিবিদ্যা সিরিজ’ (২০১৬), ‘কবিতাসংগ্রহ’ (২০১৯), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (2022); প্রবন্ধ: ‘ভাবনাবিন্দু’ (২০০২), ‘ভাবনা ও নির্মিতি’ (২০০৪), ‘অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা’ (২০০৫, ২০০৬, ২০১২, ২০১৬), “মৃতদের সমান অভিজ্ঞ’ (২০০৯), ‘শূন্যপ্রতীক্ষার ওতপ্রোতে আছি আমি আছে ইউলিসিস’ (২০০৯), ‘কবিতার অন্ধনন্দন’ (২০১০), ‘ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা’ (২০১১), ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (২০১৫), ‘আত্মধ্বনি’ (২০১৬), ‘উৎসব’ (২০১৮), ‘পথিকান’ (২০২২); অনুবাদ: ‘আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত: টোমাস ট্রান্সট্যোমারের কবিতা’ (১৯৯৬, ২০০২, ২০১২), ‘নির্বাচিত কবিতা; ইত্দা আমিহাই’ (২০০৫, ২০১৩), ‘মেঘ বৃক্ষ আর নৈঃশন্দ্যের কবিতা: চেসোয়াভ মিউশ’ (২০১৪), ‘বহু হও ব্রহ্মাণ্ডের মতো: ফের্নান্দো পেসোয়ার কবিতা’ (২০১৬), ‘জর্জ সেফেরিস; কবিতা সাক্ষাৎকার প্রবন্ধ (২০১৯)।
তিনি কবিতার লোক এবং হুমায়ুন আজাদ পুরস্কার পেয়েছেন।