
ক.
সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে আলো থাকতে থাকতে কাজিয়া দেখার জন্য ভন ভন করতে থাকে অচেনা কিছু মুখ। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়, এর আগে এমন কিত্তিকালাপ তারা দেখে নি। তাবিজ-কবচ আর জোড়া ফণা সহ সর্পমণি অংকিত লোহার লক্করঝক্কর ট্র্যাংকে সাপের ছোট বড় কাঠের খুপরি বাসস্থান গুছিয়ে ওঠে পড়ে মোঁচারু বাইদ্যা। সে ও মিট মিট করে তাকায়, কাজিয়া করা মেয়েদের সাথে এই মোঁচারু বাইদ্যার আলাপ থাকলেও তার দৃষ্টি অন্যত্র হাঁকিয়ে দুম করে উঠে পড়ে। পেচ্ছাপের চাপ ধরে রাখার মতো অসহ্য যন্ত্রণা জগতে নাই, মুত্রথলি ভারী হয়ে গেছে, কটকটে ব্যথা নিয়ে লক্করঝক্কর লোহার ট্র্যাংকটা বা পা দিয়ে সরিয়ে চলে গেল মুদি দোকানের পেছনটায়। সে অপেক্ষা করছে সান লাগার আগে আগে যদি কাজিয়াটা লাগে তাহলে দেখে যাবে। তেতুলতলার দিকে মুখ করে লুঙির তলা দিয়ে বা হাত ঢুকিয়ে কুলুপের ঢ্যাল নিয়ে চল্লিশ কদম হাঁটাহাঁটি করছে মোঁচারু বাইদ্যা। তাতে তার ভেতরে লজ্জা শরমের বালাই নাই, শুধু খোনা গলায় বলল বেলজ্জার সম্মুখে বেলজ্জাপনায় ওসুধ।
মোঁচারু বাইদ্যা রাজাবাড়িহাটে ব্যবসা করছে বেশ কয়েক বছর ধরে , সাধে কি ও এখানে এসে পড়ে আছে তার ভেতরেও রয়েছে চরম গুপগুপি ৷ সে ব্ল্যাকির মাল কিনে এবং তার বড় দুই ছেলেকে ব্ল্যাকির মাল বিক্রির তালিম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে অন্যান্য স্থানে, যেখানে রোজগারের ফাঁক বেশি আর ব্ল্যাকির মালের গাহাক মেলাই। তারা তানোর, কাঁকনহাট কিংবা রহনপুর, পোরশার হাটগুলোকে টার্গেট করে। সেইসব স্থানে কলবল করে ঢুকে যায় তেলুক গলার ললি। যাদু মন্ত্রের মতো তাদের মুখস্থ কথা বাস্তবে একেবারে ফলিয়ে দেয়, জড়ো হওয়া মানুষের ব্যক্তিগত আঁধার গুলোতে । মানুষ ও জন্মের বোকা তারা মোঁচারু বাইদ্যার ছেলেদের কাছে কথার চোটে নাস্তানাবুদ হয়ে যায়, তাদের সঙ্গে কোন মেয়ে বাইদ্যানী না থাকলেও তারা দুই ভাই দারুণ এক্সপার্ট হওয়ার কারনে তুলকালাম বাধিয়ে ফেলে। তারা প্যান্ট শার্ট পরে, চামড়ার বাটা স্যান্ডেল পায়ে দেয়, আর অনামিকা মধ্যমায় আটকে থাকা চকচকে পাথরের আংটি দ্যুতি ছড়ায়। ইচ্ছে হলে কখনো বিয়ের সোনালি রঙের হাতঘড়িটি পরলেও বা হাতের কব্জিতে তা ঢলফল করে, জুত হয়ে বসে থাকে না । বয়ান শুরুর আগে আড্ডায় মানুষের জমায়েত বাড়িয়ে মোটা একটা বিভিন্ন দেশি বিদেশি সাপের ছবিসহ লেমনেটিং করা অ্যালবাম বের করে সবাইকে দেখায়। বলে তারা নাকি আসামের ক্যামাক্ষ্যা মন্দিরের কালী সাধন করা গুরুর শিষ্য, সাপ মুখে নিয়েও খেল দেখাবার শক্তি তাদের আয়ত্ত্বে। উৎসুক জনতা কথার ফুলঝুরি শুনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, আর যখন সাপের বাক্স খোলা হয় তখন সবাই পেছনে সরে যায়। ভয়ে, বিস্ময়ে।
ভাটিবেলা কাজিয়াটা যখন শুরু হল।
মিথ্যুক রে মিথ্যুক ও মাগি মিছা ছেচায় এক্সপাট। কি বুইলল দেখলি রি চন্দনা। ঘরে জুয়ান ভাতার তার উপরে ও মাগি বুলে ও বিনা ভাতারি। লজর এমন দিয়্যাছিল খোদা তোকে, বুইলছে উুঁ নাকি একা সংসার করে। মরণ বুইল্যা ডর করিস, খোদা যে তোর জিভ্যা কাইট্যা লিবে, পাছাতে গরম শিক ভরবে তখন সহিতে পারবি! গুঢ়ি পাড়ায় ব্ল্যাকির মাল বেচ্যা ফের পহার দ্যাখে সুপুরুষ নাঙের । ওর মুখে মুতি, যি ভইর্যা হাগি আমি ফুলেরা। তারপর সুর করে বলে ও মিথ্যুক রে, ও মাগি বেজায় মিথ্যুক। আসমান জমিনের কির্যা কাটছি।
রাজাবাড়িহাটের খরচাকা সীমান্ত দিয়ে ব্লাকির মাল নিতে এসে গুঢ়ি পাড়ার একদল নারী এই ভাবে কাজিয়া করে। একে অন্যকে গালি দেয়। মুখামুখি থেকে হাতাহাতিতে চলে যায়।
কি বুইলছ বাপু তুমাদের এখানে ন্যাড়া তালতলায় রহা বসাও তুমাদের সহ্যি হয়না।
কে বুইলছে তোরাকে যেতে ও ত্যাতলতলায় বসগা যেয়ে।
অত দরদ হইতে বুলিনি এই গুঢ়িপাড়ার মাগিরা নিজেদের বসার জাগা ঠিকি ঢুইর্যা লিবে। ফুলেরা চোখ পাকিয়ে স্থান পরিবর্তন করে ।
বড় পদ্মা, খরচাকা সীমান্ত তারপর ছোট পদ্মানদী, দূর্গাদহ বিল পার হয়ে ব্ল্যাকের মাল আসতে সেই সন্ধ্যা হয়ে যায়।
এই গুঢ়িপাড়ার মেয়েদের জন্য একটি বাস দাঁড়িয়ে থাকে। এই স্থান থেকে রাজশাহী শহরের দূরত্ব ৮ মাইল। শহরের উপকন্ঠে এদের বসবাস। তাদের দাবি তারাই রাজশাহীর আদিম বাসিন্দা। ভাষায় তাদের মূল প্রমাণ।
ফুলেরার সাথে যে কজন মেয়ে এসেছে তাদের সবার বয়স কমবেশি ২৮ থেকে ৩০ এর কাছাকাছি।
ফুলেরা তাদের উদ্দেশ্য করে বলে এতখণ ধইর্যা বইস্যা আছি ছুড়ির্যা বুলিসন্যা ক্যান কদান তাস খেলা হইতোক, গহাতে বুঝি আন্দাজ থাকেনা?
পাশে থেকে অন্য একটি মেয়ে টিপ্পনী কাটে মানুষের মনে রং খেললে কি আমরা খেলার রং ধরাইতে পারব। খিলখিল হাসিতে চারপাশ ভরে উঠে।
ফুলেরা উন্মাদের মত তার সাথিদের চুলের মুঠি ধরে এলোপাথাড়ি কিল বসাতে থাকে। তারা মাগো মাগো বলে চেঁচাইতে থাকে। এই মাগি ছাড়, কি বুইলনু তোকে, আটে তোরা দেখছিস কি মাগি আমাকে মাইরে ফেলবে তোরা ছুটা, ও মাগির বিষ উঠ্যাছে। ফুলেরার গড়ন দোহরা হাড়ের, মাঝবয়েসী পুরুষরাও তাকে পেরে উঠেনা। ফুলেরা যার উপর যেদিন চড়াও হয় সেদিন তার রক্ষা নাই আর যারা তাকে থামাতে আসে এই মহাপ্রলয় দেখে কাছে ভিড়ে না।
এদের কাজিয়া দেখে মানুষ জুটে যায় বলে ও দ্যাখ লাগিনী লাগিনী ল্যাগাছে।
তাদের ঝগড়া দেখে যারা অভস্ত্য নয় কিংবা কখনো দেখেনি তারা আশপাশের দোকানদারকে জিজ্ঞাস করে ওরা কাজিয়া করছে ক্যান? কোন কোন দোকানদার হেসে বলে ওরা ওরকমি বজ্জাত একেকটা।
দিব্যি কাজিয়া শেষে ওরা আবার একসাথে তেতুলতলায় বিড়ি ফুঁকে। রঙ্গ তামাশায় মেতে যায়। অশ্লীল শব্দ তাদের রসের ভান্ডার। সত্যি বলছি কিন্তু, খোদ্দার কির্যা।
খ.
হাটের দিন পান সিগারেটের দোকানে ভিড় খুব। মিষ্টির দোকানগুলোতেও একই অবস্থা । এদের মধ্যে আদিবাসী সাঁওতালদের সংখ্যা বেশি। দেখা যায় তাদের মহিলাদের আঁচড়ানো চুল, একছেটি করে পড়া কাপড়ের সাথে হাতে নকশাকাটা ধবধবে সাদা শাখা, গলায় কানে চান্দির গহনা আর সিঁথি ভরা সিঁদুর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। হ্যাঁ এটুকুই সাজগোজ। মজু যার এই রাজাবাড়িহাটে ছোট একটি পান সিগারেটের দোকান। দোকান ছোট হলে কি হবে, চলে বেশ রমরমা।
সেদিন শুক্রবার বলে দুপুরের দিকে মানুষের যাতায়াত ছিল কম। যে স্থানে বাস থামে সেখানে কিছু সাঁওতাল নারী কৃষক আর গুঢ়িপাড়ার যাত্রী দাঁড়িয়ে।
রাজশাহীর দিক থেকে একটি বাস এসে যাত্রী উগলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে চলে গেল।
যাত্রী নামল মোটে দুইজন। একজন মাঝারি গড়নের বুড়ো আর সাথে এক যুবতী মহিলা । যুবতীটির চালচলনে বুঝা গেল সেও গুঢ়িপাড়ার মেয়ে কিন্তু নতুন। এই এলাকায় প্রথম।
মজু দোকান সেটে মুখে পান গুঁজছিল। এরই মধ্যেই সেই বুড়ো তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতজোড় করে প্রণাম করল। যুবতীটি পেছনে দাঁড়ানো। মজুকে দেখে সে হাসছিল।
বুড়োটি যুবতীর হাসি বুঝতে পেরে পিছনে মুখ ঘুরিয়ে বলল অহ মাগির মুখে দিব লাথ।
যুবতীটি কিছুক্ষণ হাসি থামিয়ে আবার হাসল। সে হাসির কোন শব্দ ছিলনা। তার হাসি দুই ভ্রু আর ঠোঁটের কোণে চমকে উঠল।
মজু যুবতীটির হাসি দেখে পানের পিক ফেলল। বাপু কিছু বুইলছে নাকি?
হ বাপ কিছু বুইলব। ব্ল্যাকির মাল কোন জাগায় পাব? ব্যবসা নতুন লয় কিন্তু গুঢ়িপাড়ার মাগির্যা জাত বেশ্যা মেলা দাম ল্যায়। ঠকায়। তাই এই জাগার নাম শুইনা আনু।
বুড়োর সাথের যুবতীটি তার কথা শেষ হবার পর বলল বুড়্যা তুমি ঠইকব্যা না তো কি…. বলতে গিয়ে থেমে গেল।
হ বাপু এই খানে ব্ল্যাকির মাল পাওয়া যায়। ঐ যে ত্যাতলতলার পেছনে সবাই বসে আছে। আইজ মাল আসা বন্ধ। কাইল পাইবেন গে । ওখানে গিয়্যা গাইড়া বইসেন। খান। ঘুমান। দিশ্যা হইবে। মজু বলল।
যুবতীটির নাম বেলি। তার দিকে তাকিয়ে বুড়োটি বলে উঠল চল বেলি। হ চল, চোলাইতো যাছি। বেলি আড়চোখে মজুর দিকে তাকাল। মজু বেলিকে দেখে পানের পিক জোরে দূরে আওয়াজ করে ফেলল। বেলি হেসে সেই মাঝারি গড়নের বুড়োকে অনুসরণ করে চলে গেল।
মুক্তিযোদ্ধা অফিসের টিনের বারান্দায়, মোটা পলিথিনের একটা ঘের দিয়ে ঘরের মতো করে একসাথে পুরুষ এবং মহিলারা চাপাচাপি করে সেখানেই রাত কাটিয়ে দিয়েছে। অনেকেই বলাবলি করে ওরা বাজে মহিলা বলেই পরপুরুষকে সাথে নিয়ে শুতে পারল।
তার পরের দিনের ঘটনা। বেলি মজুর দোকানের সামনে তার সামগ্রীর ঝাঁকা নামিয়ে ঝুঁকে পান চাইল। পান দাও।
ঐ ছুড়ি ও বটা তোর কে লাগে? বেলি মুখে পান গুঁজে সুপুরি টুকরো দাঁতের তলায় দিয়ে জিব্বায় চুন লাগাল। তারপর ড্যাবড্যাব করে মজুর দিকে তাকিয়ে বলল ও আমার সুয়ামি গো। প্যাচপ্যাচ শব্দ করে পিক ফেলে মজুর দোকানের খুঁটি ধরে আবার ও হেলে পড়ল বেলি।
এ ম্যা ঐ বুড়্যাডা তোর ভাতার, ভ্রূ তুলল মজু। কোমরে হাত ঘুরিয়ে বলল হ্যাঁ, ঘরে দুই ব্যাটা আছে ওর অরিশ, আমার গর্ভে জন্ম বিশ্বাস হয় ন্যা। এজ্জা তাহিলে কেমুন কইর্যা বিশ্বাস করাব গে। গাল ভাঙা হাসি, কপালে হাত, কাচের চুড়ি বেজে উঠল, আমি বেলি হিন্দুর বেটি ছোড়ার বয়েস একটু বেশি কিন্তুক জুয়ান ছিল গে নাহিলে আমার কোঁখে দুই ব্যাটা। দেখ্যাছিল্যা দুকানদার তুমার সাথে কথা বুইলব্যার সময় ক্যামুন কইর্যা বুড়্যার চোখ পরিক্ষ্যা করছিল, বুইঝ্যাছ? আবার কোমর ভাঙা ইঙ্গিত।
ও কত বুড়্যা চড়াইনু, আইজ থাইক্যাকি দুকান করি ঐ যে ত্যাতলতলার মাগির্যা কাইয়্যার মতন ক্যা ক্যা কইর্যা গতর ঝুক্যাইয়্যা কাইজ্জা করে ওরা তো এখ্যানে মানুষ এই মজুর দুকানে।
ও কমলা মাগি বিড়ি খোরনি , পাক্কা খানগি গাইল দিব না বিটি ছ্যালা জাইত, তোমার সোনার অঙ্গে লাগতে পারে। উুঁ ঢেমনি মাগি বিড়ি খাইয়্যা এখন টাকা দিতে পারেনা, ওদের কাছে টাকা নাই আমি বিশ্বাস করব! টাকা চাহিতে গেলে গা ঘেঁষিয়ে দিল, আমি বুঝিন্যা ওদের ছলা কলা।
আমার ছলা কলা নাই বুঝি দুকানদার, তারপর মুখে কার্তিকের হাসি ক্ষুর ধারালো।
অনেকক্ষণ রঙ্গ তামাশার পর খিকখিক করে হাসি শেষে – তুমি তো মুছলমানের ঘরের ব্যাটা, আমি হেন্দু ঘরের বহু বেটি, লাগরগিরি করিওনা মরদ বলে চ্যাপ্টা জিব্বাহ চুন লাগাবার জন্য সাপের মত বের করল বেলি। পান চিবুবার চপর চপর শব্দ শুনে মজু বলল তোর আওয়াজ খান কত মিঠ্যা, যেনে গানের সুর বইহ্যা যাইছে। বেলির উদাম বুকের রেখায় এমিটেশনের মালা ঝুলছে তা দেখে মজু বলল মালাখানটা তোর বুকের উপর এমন সোন্দর লাইগছে গো, কি বুলব। বেলি উত্তরে বলল মালাখানটা লাওয়ার ব্যবস্থা করো তুমাকে দিয়া দিছি। খিকখিক হাসি। এই কথা শোনার পর মজু বেলির শরীরের অন্যান্য অংশের অশ্লীলতায় ভরা রসালো প্রশংসা করতে থাকে। তা শুনে বেলি আবার বলে ও তোমার মন ভুলানো কথা দুকানদার, টাকা লিব্যানা ল্যাও ল্যাও বলে বেলি তার বুক মজুর দিকে এগিয়ে দেয়। বেলির খোলা বুকের দিকে কুয়াতে পানি দেখার মতো ঝুঁকে এল মজু , তারপর বলল যা বেলি তোর আইজকার পানের দাম মাফ।
গ.
আশির দশকের শেষ দিকে আব্দুল হান্নান রাজাবাড়িহাটে এসে এই ব্ল্যাকির কারবার দেখে হতভম্ভ হয়ে যান। ছাত্র বয়সে ছাত্র ইউনিয়ন করার জেরে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান বিভিন্ন অঞ্চলে। তারপর কীভাবে যেন বদলে ফেললেন নিজেকে, ইউনিয়ন ফিউনিয়নের ভূত ভাগিয়ে লম্বা চুল স্কয়ার করে কেটে দাড়ি ছেচে ক্লিন সেভ করে দ্রুতই নিজেকে পালটে ফেললেন। তিনি যেই সংগ্রাম ও স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য পুলিশের মার খেয়ে, সাধু সন্ন্যাসীর মতো চেহারা করে এ দুয়ার ও দুয়ার ঘুরে বেড়ালেন অবশেষে তার এই মসৃণ চকচকে অবস্থা দেখে তার দলের অনেকেই চমকে যেতে পারেন , কিন্তু কেউ কেউ তো চমকে যাননি কারন আব্দুল হান্নানের মতো তার সাথকার অনেকেই এই শীতল, সুরক্ষিত ঝামেলাহীন জীবন বেছে নিয়ে ঘর সংসার করছেন। সেই আব্দুল হান্নান যখন বদলি হয়ে নতুন জায়গায় নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন তখন জায়গাটা আব্দুল হান্নানের বেশ পছন্দ হয়ে গেছে। শহর থেকে খানিক দূরে গ্রামীণ পরিবেশ। এখানকার মানুষসব সহজ সরল। আর রয়েছে প্রচুর আদিবাসীর ( সাঁওতাল, ওঁরাও, বুনা, ধাঙ্গর ও ডোম) বসবাস।
গ্রীষ্মের প্রথমেই আব্দুল হান্নান অফিসের কোয়ার্টারে পরিবার নিয়ে উঠলেন। এখানে গরম খুব। গাছ পালা যদিও যথেষ্ট রয়েছে তবুও গরম। কোয়ার্টারের পেছনে পদ্মানদী আর সামনে বিশ্বরোড হাইওয়ে। এইসব সরকারি কোয়ার্টারেও একসময় ব্ল্যাকির মালামালের হাওয়া এসে লাগে, সস্তাতে পাওয়া যায় সেসব ব্ল্যাক হয়ে আসা ওপারের জিনিসপত্র। একদিন হঠাৎ আব্দুল হান্নান তার জুনিয়র কলিগের কাছে গিয়ে বললেন আলি আপনার ভাবি একটি পশমি চাদরের বায়না ধরেছে, সে শুনেছে এখানে নাকি অল্প দামে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। সবার ঘরে ঘরে পরনের থ্রি পিস, কাপড়সহ বিছানার চাদরটাও নাকি ইন্ডিয়ান! আলি মুচকি হেসে বললেন জ্বি স্যার ভাবি সত্যটাই বলেছেন, তবে একটা ঝামেলা আছে আপনি হয়তো জানেন কি জানেন না এখানে আর ব্ল্যাকির মাল পাওয়া যাচ্ছে না। হান্নান সাহেব বললেন কেন- কেন?
রাজাবাড়িহাটের চেকপোস্টে এক কড়া অফিসার এসেছেন, তিনি নাকি প্রচন্ডরকম সৎ। কাউকে কোন প্রকার ছাড় দিচ্ছেন না পিটিয়ে সিধা করে ছাড়ছেন। হাটের ভেতর এক দোকানের সামনে কেরোসিনের ড্রাম উলটে আগুন দিয়ে দিলেন কারণ সেই কেরোসিন নাকি ভারতে ব্ল্যাক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি গুঢ়িপাড়ার মেয়েদেরও নাকি মেরে হাগিয়ে মুতিয়ে ছেড়েছেন, যখন ইন্ডিয়ান কাপড়গুলো অফিসারের কাছে দেয়া হচ্ছিল তখন অফিসার বললেন নিয়ে যা, টাকা দিয়েই তো নিয়েছিস ভাত মারবনা বিক্রি করে টাকাটা তুলে অন্য ব্যবসা করিস। এখানে যেন আর কোন দিন না দেখি। সেই থেকে রমরমা ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। আলি কিছুক্ষণ পর বললেন একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে স্যার। আব্দুল হান্নান জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে বললেন কি রকম! আমাদের দেশে জনগণের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দরকারি জিনিসপত্র ব্ল্যাকি হয়ে চলে যাচ্ছে ভারতে। বিশাল মজার খেলা হয় ব্ল্যাকির ধান্দায়। যখন বাংলাদেশে দাম পড়ছে তখন ভারতে চলে যাচ্ছে আর ওদিকে দাম পড়লে এদিকে আসছে। মানে একই জিনিস এপার ওপার হতে থাকে, দামের কম বেশির উপর পারাপার নির্ধারিত হয়। দুধ, চিনি, কিউকারপিন তেল, বিড়ির পাতা তামাক, রেডিও, মশলা, পেঁয়াজ, থ্রি পিস, কেরোসিন থেকে কাচপেয়ালার জিনিস পর্যন্ত চালাচালি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যখন কোন নিম্নমানের পলেস্টার কাপড় গেছে, বুদ্ধি করে তারাই আবার সেই কাপড়ের উপর নকশা কিংবা প্রিন্ট করে বাংলাদেশে বেশি দামে পাঠিয়ে দিয়েছে। আব্দুল হান্নান আলিকে থামিয়ে বললেন, তাহলে তো কেস খেয়ে গেলাম এখানে যেহেতু পাবোনা অগত্যা গুঢ়িপাড়ায় যেতে হবে। আপনি কি গুঢ়িপাড়া গেছেন কখনো? আলি বললেন আমি তো কখনো যাইনি তবে ঠোরেঠোরে গেলে ঠিকই চিনতে পারবো। তাহলে কালই সকালে চলুন, আলি মাথা নাড়লেন, আচ্ছা স্যার -।
পরদিন সকাল ১০ টার দিকে একটি লোকাল বাসে উঠলেন আব্দুল হান্নান আর আলি । বাসে খালি সিট ছিল না বিধায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। গরমে যেন সেদ্ধ হবার উপক্রম। ঝিম ধরে বাস চলছে তারপর থেমে থেমে যাত্রী তুলছে নামাচ্ছে।
হরিপুরের কাছে এসে বাসটি কয়েকমিনিটের জন্য থামল।
বাসের ছাদে মালামাল উঠছে এই জন্যে দেরি। আব্দুল হান্নান বিরক্ত হয়ে বললেন কি অবস্থা বলুন তো, আলি বললেন কিছু করার নাই স্যার পথে যখন নেমেছি তখন না পৌঁছে থামছিনা।
বাসটি চলতে লাগল। মনে হচ্ছে কে যেন পেছন থেকে বাসটিকে ঠেলছে আর তার সাহায্যে চাকা গড়ছে।
বাসটি মানুষে গিজগিজ করছে। এদের মধ্যে কোন বিরক্তি কিংবা অস্থিরতা কিছুই নাই। সটান হয়ে যে যার মত পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর যারা সিটে বসা তারা কেউ ঘুমুচ্ছে কেউ জানলা দিয়ে বাইরের বাতাস টেনে নিচ্ছে একাই নিজের ভেতরে।
এরইমধ্যে হঠাৎ ভীড় ঠেলে কয়েকটি মেয়ে তাদের দুজনের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল।
অদ্ভুত ব্যাপার। বলা নেই কয়া নেই সেই মেয়ে দুটি পজিশন নিতে আব্দুল হান্নানের পিঠে নিজেদের সুডোল বুক আর পশ্চাৎপদ দিয়ে হুড়াতে লাগল।
তিনি এসব সহ্য করতে না পেরে বলতে থাকলেন এই মেয়ে, এই মেয়ে ছি ছি তোমার লজ্জা করে না। তুমি বুক ঠেকাচ্ছ, পাছা ঠেকাচ্ছ। গুঢ়িপাড়ার মেয়েদের তো আব্দুল হান্নান চেনেন না তারা একেকটা বারুদ। সারা রাস্তায় পুরুষদের ঠেলে ঠিকই জায়গা করে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে তারা, কোন তোয়াক্কা নাই তাদের মধ্যে নিজের জায়গা পেলেই ব্যস তখন তুমি কোন চ্যাটের বাল। শহরের মুখে বাস এসে থামলে তারা নামতে লাগল । তাদের উদ্দেশ্য করে আব্দুল হান্নান বললেন এই যাও তো যাও, তাড়াতাড়ি নামো ইশ্ কি বিরক্তিকর পরিবেশ , কি যন্ত্রণা। মেয়েটি বাস থেকে নেমে সরাসরি আব্দুল হান্নানের দিকে বিষ করে তাকিয়ে বলল অ্যাই শালা তোর পুটকি মারবো। মেয়েটির এই অশ্লীল কথা শোনার পর আব্দুল হান্নান নীচে নেমে একবার আলির দিকে তাকান একবার মেয়েটির দিকে তাকান, অল্প সময়ের জন্য তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন । আলি লজ্জিত হয়ে বললেন বাদ দেন স্যার এসব মাইন্ড করলেই করা হবে। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বললেন আরে এতো ডেঞ্জারাস মেয়ে। আপনি ডেঞ্জারাসের কি দেখেছেন স্যার চলেন দেখাচ্ছি, খানিকক্ষণ পরে আলি আবার বললেন আসেন স্যার ওদের সাথেই তো আপনাকে যেতে হবে। কি বলেন আপনি! হ্যাঁ স্যার। তাহলে এখানে একটু থামি ওরা আগে চলে যাক। আসলে গুঢ়িপাড়ার মেয়েরা তো হাঁটেনা, বাস থেকে নেমেই মারে দৌড়।
গুঢ়িপাড়া নিতান্তই ঘুপচি বসতির মতো, সবার চালে চালে বাস। এখান ঘর এখান হেঁসেল তার মধ্যে পায়খানা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আবার রাস্তামুখো বারান্দায় কাঠের চৌকির উপর চাদর বিছিয়ে ব্ল্যাকির বিভিন্ন ধরনের মালামালের পসরা সাজিয়ে, মেয়েরা পরনে শুধু ছায়া ব্লাউজ আর বুকে ওড়না অথবা গামছে ফেলে একটা টুলে বসে থাকে। তাদের লিখাট্টু স্বামীদের তেমন কোন কাজ থাকেনা, ঘরের বউ মেয়েরাই এই ব্যবসা দেখছে। এসবের ভেতর তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাস্তার মোড়ে বসে বিড়ি ফুঁকানো আর খেয়াল করা পাড়ার দিকে পুলিশ কিংবা বিডিআর আসছে কিনা। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট ছেলেপিলেরা পাড়ার মধ্যে দৌড়ে এসে বলে পুলিশ ঢুকেছে, তা শুনেই মেয়েরা চাদরের দুইকোণা দুজনে ধরে গিঁট মেরে নিমিষেই চম্পট। কোথায় যে তারা হাওয়া হয়ে যায় কেউ টেরই পায়না। শহরের উপকণ্ঠে খাসজমিতে বসতি গেড়ে পেশা বদলের ( কখনো মুটে, কুলি, রিক্সাওলা, ফেরিওয়ালা) ঝুঁকিপূর্ণ উপেক্ষিত জীবন কি অবশেষ আব্দুল হান্নান ও আলি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন?
ঘ.
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চম তিথি। খেতুরের মেলা। জমজমাট আয়োজন, সেই উপলক্ষে রাজাবাড়িহাট – বিজয়নগর – প্রেমতলী লোকে লোকারণ্য। বিখ্যাত এই মেলায় পদ্মা স্নানের দিন খুব ভিড়। এর মধ্যে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে, ওলট পালট হয়েছে অনেকের জীবন। ধরি যদি বেলিরই কথা, সে মজু দোকানদারের সাথে লাইন করে বিয়ে করেছে, মুসলমান হয়েছে। ওসব দিন শেষে বেলির সেই আগিলা বুড়ো স্বামী আরো বুড়ো হয়েছে। খেতুর ধামের তীর্থ যাত্রায় পদ্মায় স্নানের উদ্দেশ্য সেও প্রেমতলী এসেছে। এবং থাকছে পালিয়ে বিয়ে করা স্ত্রীর বাড়িতে, সাথে দুই ছেলেকে নিয়ে। এসব নিয়ে আপত্তি তুলেনি মজু, সংকীর্তনে যোগ দেওয়ার জন্য বুড়ো ও তার ছেলেরা বাড়ি থেকে বাহির হলে মজুকে অনেকেই জিজ্ঞেস করে এরা কে? ঘনিষ্ঠ কেউ হলে তাদের সামনে সে হেসে উত্তর দেয় এরা হচ্ছে তার স্ত্রীর আগিলা তরফের স্বামী এবং ছেলে।
বেলি তাদের থাকা খাওয়ার কোন ত্রুটি রাখেনি, দ্বিতীয় তরফের ছেলে মেয়েরা বেলির আগের দুই ছেলেকে ভাই বলেই ডাকছে তারাও এদের স্নেহ করছে। বেলির স্বাভাবিক কথাবার্তা দেখে বুড়োটা অবাক হয়, এই কি তার স্ত্রী! কয়বছরই বা তার সাথে ঘর সংসার করেছে সে, তা মনে করতে পারে না কিন্তু সেই অল্প সময়ে দুটি ছেলে ও হয়ে গেছিল ভাবতে ভাবতে সে অবাক হয়। এখন বয়সটা অবাক হওয়ার। সে বেলিকে প্রথম প্রথম শাপ শাপান্ত করলেও এখন কেমন মায়া জাগে তার প্রতি। তাকে ক্ষমা না করলে কীভাবে সে এই বেলির নতুন সংসারে এসে উঠল। মুসলমানের ঘরে এসে থাকছে খাচ্ছে তা নিয়ে বুড়োর ভেতর তেমন খচখচানি নাই। মনে খচখচানিরই বা কি আছে বড় সমাজের সাথে না আছে উঠ বস, না কোন সমাজের লোকে তাকে পুছে। তারা তো বরাবরই উঁচু সমাজের নিকট ব্রাত্য, জাতের ভয় তার নাই, কে দেখছে তাকে । মাত্র তিন দিনের তো ব্যাপার। সে মহাপ্রভু চৈতন্য দেব এবং নরোত্তম ঠাকুরের নাম স্মরণ করে, হরিনাম জপে এই তার সম্বল। ওসব ভাবতে ভাবতে বেশরম বেলির সেই লাছন কুদনের দিনগুলো সব বুড়োর চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
পদ্মায় স্নানের দিন বুড়োর শরীরটা ফ্যাকাসে মনে হলো। দুই ছেলেকে সাথে করে তবুও ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে সে পদ্মায় স্নান সেরে ফিরে এল বাড়িতে। সেদিন সারাদিন এবং রাতে কিছুই খেলনা। শেষ রাত্রিতে বুড়োর ভয়াবহ গোঙানির শব্দে বেলি ও মজু দৌড়ে এল তাদের ঘরে। তার ছেলেরা তাকে ধরাধরি করে উঠে বসিয়েছে। বেলি তার স্বামীর কানে কানে বলছে বুড়োর কপালে আর বোধহয় দানা নাই। মজু বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক দিয়ে বলল, চোপ।
তারপর সে ধরমর করে লুঙিটা বেঁধে দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল, সাথে বেলিও।
বেলি বলল, কুনঠে?
– দেখি কামালের ভ্যানখানটা পাই কিনা ও বটাকে আগে হাসপাতালে লিয়া যাইতে হইবে, এই বলে মজু দোকানদার আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল