
কবি যখন কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন তখনই তিনি বুঝতে পারেন সৃষ্টির উৎসস্থলই ভাষা এবং তাঁর রচিত কবিতাটি যতটা তাঁর ঠিক ততটাই তাঁর ভাষার সৃষ্টি। ভাষার উচ্চতম ও সত্য রূপ আমরা দেখতে পাই – কবিতায় এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্যে। আমরা যেমন প্রতি মুহূর্তে চলি, এগোই, পাল্টাই, হাঁটি ভাষাও তেমনিভাবে পাল্টায়, সবকিছুকে সম্পর্কে জড়িয়ে নেয়, কিছু ছাড়ে, আবার কিছু গ্রহণও করে। এই পরিবর্তনশীল সম্পর্কের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে ওঠে। এই একটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করলে আমরা উপলব্ধি করি যে ভাষা কোনো উপায়মাত্র নয়, ভাষাই উৎস; চিন্তা থেকে ভাষা নির্গত হয়না, ভাষাই চিন্তার জন্ম দেয়।
কাব্যের আলোচনায় ভাষা বা শব্দ একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। ভাষা বা শব্দই বাক্য, বাক্য থেকেই কাব্য। নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়। কিন্তু শব্দের নতুন সৃষ্টি কেমনভাবে সম্ভব? তখনই আমাদের বুঝে নিতে হবে যে সাহিত্যের ভাষা নয়, লৌকিক ভাষা মৌখিক ভাষাই হল কবিতার অবলম্বন। কবিতার শব্দ বলে আলাদা করে কিছু হয় না, সমস্ত প্রচলিত শব্দই কবিতার শব্দ। একজন কবি একই শব্দ বিভিন্ন কবিতায় ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু ওই শব্দ ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অর্থ বহন করে, বাক্যই ভিন্ন। শব্দ দিয়ে আমরা বস্তুকে, প্রকৃতিকে, বর্হিজগৎকে পেতে চাই। এই করতে গিয়ে নিজেদের একটা জগত তৈরি করি আমাদের চিন্তাভাবনায় ও যুক্তিতে। আমি যখন শব্দ বা বাক্য তৈরি করি, তখন এই প্রক্রিয়া চলে, আমার শব্দ বা বাক্য যখন কেউ শোনে তখন তার মধ্যেও একই প্রক্রিয়া চলে। একটা ঐক্য গড়ে তোলে। এই ঐক্যই বাক্যের অর্থের মধ্যে কাজ করে। এই ঐক্য ও ঐক্যহীনতা দুটো একই সঙ্গে বাক্যের অর্থের মধ্যে কাজ করে। যে কারণে বাক্য পড়ে বা শুনেই বুঝতে পারি তৎক্ষণাৎ, বুঝতে গিয়ে দেখি যে ঐক্য আমার মধ্যে আছে, তা ঠিক নয়, তবুও ঐ ঐক্যের সূত্রেই একটা পরিবর্তনকে নিজের মধ্যে সাজিয়ে নিতে চাই।
শব্দও জন্মায়, থাকে, হয়ে ওঠে – এটা অবশ্যম্ভাবী। শব্দের নতুন ব্যবহারের জন্য যা চাই তা হল এর অনায়াস পারম্পর্য ভেঙে ফেলা। অন্তত প্রকাশের মুহূর্তে কবিকে জানতে হয় পূর্বসূরী বা সমকালীন সিদ্ধিগুলির কথা, তৎসাময়িক প্রচলিত শব্দের ধরণ বুঝতে হবে তাঁকে, আর সেই সকল বেড়াগুলি ভাঙবার জন্য তৎপর হয়ে উঠতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। আমরা আবেগে বিস্ময়ে কিছু প্রকাশ করতে চাই, কখনো নির্দেশ দিই, কখনো ঘটনাকে উপস্থাপিত করতে চাই, শব্দের সঙ্কেত শুনি, ভাষা থেকেও ভাষার বাইরে কিছু থাকে যা বক্তা ও শ্রোতার ধ্বনির মধ্যে প্রকাশ পায়,
আর থাকে কবিতার ধ্বনিময় ব্যঞ্জনা। এই সমস্ত কার্যকারিতাই ভাষার মধ্যে থাকে। চমস্কি বলেন : ভাষার মধ্যে দর্শন-বিজ্ঞান-মনস্তত্ত্ব ও সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত। সুতরাং ভাষাকে ওই সামগ্রিক পূর্ণতায় দেখতে হবে। যে ব্যক্তি ভাষা ব্যবহার করে এবং যে ব্যক্তি ভাষা শোনে ও বোঝে, দুয়েরই হৃদয়ে ভাষার মধ্যে দিয়ে এক প্রকার স্বজ্ঞা ও নীরব জ্ঞানক্রিয়া চলে।
জার্মান দার্শনিক হামান বলেছিলেন ‘কবিতাই মানবজাতির মাতৃভাষা’। কবিরা নারীকে হৃদয় দিয়ে যত না ভালবাসে, শব্দকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসে। শব্দের মধ্যে একটা অন্যতর জগত
আছে। যে জগতের ধ্যান আমাদের অপর এক জগতে নিয়ে যায়, ধ্যানে ও অনুভূতিতে একটা পরিপূর্ণ স্পষ্ট বাস্তব জগত ও রূপ তৈরি করে। প্রত্যেকটি শব্দই তখন নতুন স্বতন্ত্র বিশিষ্ট জগত। রবীন্দ্রনাথের গানে এর সার্থক উদাহরণ আছে, কবিতাতেও আছে, তবে সর্বত্র নয়। আবার জীবনানন্দের কবিতায় এই শব্দের জগত এবং বাক্য, এই জগতের সম্পর্ক অদ্ভুতভাবে ধরা পড়েছে। বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের কবিতার ভাষায় বাক্যে এবং বাক্যপরম্পরা ও বিন্যাসে; অর্থ দিয়ে একে বোঝা যায় না; ভাষার গতিপ্রকৃতি ক্রিয়া-প্রক্রিয়া দেখেই এর অর্থ বুঝতে হয়। ভাষা ছাড়াই চিন্তা সম্ভব মনের মধ্যে নীরবে – এই কথা চমস্কি খুব জোরের সঙ্গে বলেছেন। কিন্তু কবিতায় ভাষা ছাড়া অনুভব নেই, অনুভব ছাড়া ভাষা ‘হয়ে’ ওঠে না, অনুভবেই ভাষা আস্তে আস্তে মনের ভেতরে অদ্ভুত রঙিন খেলাঘর তৈরি করে, সারারাত জাগে, অবশ হয়ে যায়। সেই শব্দময় জগতের পরিপূর্ণতার মধ্যেই কবির সাধনার পরিপূর্ণতা। কবির ভাষার মধ্যেই তাঁর মনের সামর্থ্য সামগ্রিকভাবে ধরা পড়ে।
জীবনানন্দের কবিতার ভাষা স্পষ্ট নয়, অন্তত সুধীন্দ্রনাথ যে অর্থে জীবনানন্দকে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কবিতার ভাষার দার্ঢ্য লুকিয়ে আছে অভিজ্ঞতার সামগ্রিকতায় ও ঘন সংহতিতে। জীবনানন্দ নিয়ত এগোন, এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান, থমকে দাঁড়ানো ক্ষণকালের মুহূর্তের; কিন্তু তাঁকে থামানো যায় না। এই রীতি তাঁর কবিতায় প্রথম থেকেই ছিল।
ধ্বনির ব্যঞ্জনা কবিতার প্রথম অভিঘাত তৈরি করে। পরবর্তীতে শব্দার্থের সঙ্কেত কবিতাকে বিশিষ্ট থেকে সামান্যের দিকে নিয়ে যায়, বাক্যার্থের পরিপূর্ণতা শুধু সামান্যের অনুভবই তৈরি করে না, সেই অনুভবকে সামান্য থেকে অসীমে নিয়ে যায়। এই অসীমতার বোধই কবিতার প্রাণ। মানুষের বুকে ব্যথা হয়ে ওঠার জন্যই কবিতার আলোর উদভাস, এই উদভাস কেমনভাবে অসীমতার প্রাণের আলোয় শ্যামল নীল ব্যথা হয়, তারই প্রক্রিয়া ভাষায় ধ্বনিতে ব্যঞ্জনায় সঙ্কেতে বলে চলেন কবি। এই অনুভব পৃথিবীর নয়, মানুষের, তাই ব্যথা শেষে মানুষই উপলব্ধি করে বা মানুষের উপলব্ধিতেই ছড়িয়ে পড়ে অনাদি ভালবাসা। কবিতার ভাষায় ব্যথা বা আনন্দ’র হয়ে-
ওঠাকে মূর্ত করবার জন্য শব্দ ধ্বনি অর্থকে কাজে লাগিয়ে থাকেন কবি। এই ‘হয়ে-ওঠার’ কোনো শেষ নেই। প্রাণই মহাতরু, আর কবিতা সেই প্রাণের আলো। প্রাণ যখন প্রাণের আলোয় জাগে, তখনই সে নিত্য অবিনাশ স্বর শুনতে পায়, সেই অবিনাশ স্বর প্রেমের আলোর ভালবাসার, বিশ্বপ্রাণের এই স্বর আনন্দের ও আলোকের এবং এই স্বর আনন্দ থেকে জাত
আলোকের, এবং এই আলোক সৃষ্টির বীজের অনাদি অন্ধকার গড়ে তোলে, সৃষ্টির অন্ধকারের মুগ্ধ বিহ্বলতায় এসে মেশে, এই স্বরের প্রভাবেই আনন্দ থেকে আলোক জাগছে, আলোক থেকে অন্ধকার জাগছে, এবং আনন্দ আলোক অন্ধকার সব মিলে কবিতার বিহ্বলতা সৃষ্টি করছে। এবং এই প্রাণের মর্মরিত লাবণ্যসাগরের অনুভবকেই প্রকাশ করছে কবিতার ‘হয়ে-ওঠার’ ব্যাপ্ততায়।

স্নেহাংশু বিকাশ দাস
কবি ও প্রাবন্ধিক। মূলত কবি। স্নাতকোত্তর, বিষয় ইতিহাস। বর্তমানে যাদবপুর নিবাসী
1Comment
November 25, 2023 at 12:00 pm
অপূর্ব