ছোট একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, সেদিন পোস্ট অফিসে গেছি।একটা চিঠি মানে স্পিড পোস্ট করবো বলে। অফিশিয়াল চিঠি, তাই বাদামী রঙের একটা খামের উপর যথারীতি ঠিকানা লিখে, এপিঠে আমার ঠিকানা লিখে নিয়েছি আগেভাগেই। ঠিকানা বাঃলা হরফে পরিস্কার গোটা অক্ষরে লেখা।এমনকি আমার ফোন নং টাও বাংলাতেই লিখেছি। দশটা নাগাদ যখন ঠিকানাটা লিখছি খামের এপিঠ ওপিঠ বেয়ে, তখনি মনে হচ্ছিল, কিছু ঘটতে চলেছে। এবং সেটা কী হয় তা একটু পরখ করতেই চেয়েছিলাম। যথাস্থানে পৌঁছলাম, পোস্টমাস্টার বসেছেন, কম্পিউটারে লিখছেন, ঠুকঠাক! মুখ বেজার। খুব বিরক্ত, ঠিকানা লেখা শেষ করে, ফোন নং,
ফোন নম্বরটা ইংরাজীতে বলুন, বিড়বিড় করতে লাগলো, কেন যে বাংলায় লেখেন, বুঝি না!
আস্তে করে বললাম, কেন বাংলায় লেখা কি অপরাধ!
আরে, যান তো, এতো কথা শোনার সময় আমার নেই!
আশাই করেছিলাম এমনটাই ঘটবে! পরিস্থিতির কথা ভেবে ভেতর ভেতর হাসতে হাসতেই ফিরলাম। ভাবতে ভাবতে আসছি, আচ্ছা উনিও তো বাঙালি, এতোটা রিঅ্যাক্ট না করলেও তো পারতেন! উনিও তো ছেলেবেলায় লিখেছেন, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান! তবে বাংলা লিখতে এতো অনীহা! এতো বিরক্তি!
ভাষা নিয়ে ছোট থেকে কত কী না, শিখেছি! কতো কী পড়েছি, মাধ্যমিকে রচনা পড়েছি, ভাষাকে সবার যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই জেনেছি। পড়াশুনা করেছি প্রথম ভাষা বাংলাতেই। কিন্তু এই ভাষাকে টিকিয়ে রাখার কোন মহৎ প্রচেষ্টা দেখিনি।মহৎ কথাটা হয়ত একটু বেশিই বললাম, সামান্য সৎ প্রচেষ্টাও নেই। সরকার বা আমজনতা কোন তরফ থেকেই তার প্রয়াস দেখা যায় না। “মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান” এ বাক্য পড়ে বড়ো হলাম, অথচ বাস্তবিক বোধ এটা বলে, এর থেকে আমরা অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। বাঙালি হয়েও আদতে কি বাঙালি থাকতে পারছি? বাংলা ভাষার অবমাননা, ভাষা নিয়ে কাটাছেঁড়া, যেখানে সেখানে তার প্রয়োগ প্রমাণ করে এই নীরব সহন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে ভাষার আদান-প্রদান, চর্চা হতাশাজনক। শিশু ইংরাজি মাধ্যমে ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে তাকে পাঠযোগ্য ন্যূনতম বাংলা শেখানো হচ্ছে না। না বিদ্যালয়ে, না বাড়িতে। রাস্তাঘাটে অর্ধ বাংলা, অর্ধ হিন্দি, অর্ধ ইংরাজী মিশ্রিত একটি নতুন ধরনের ভাষা শুনতে পাই। কিন্তু যে শিশুটিকে শৈশব থেকে শেখানোই হল না ভাষাপ্রেম, তার দায় কি অভিভাবক বা বিদ্যালয় তথা সরকারের আসে না? ধীরে ধীরে আমরাও কেমন বাংরেজীতে অভ্যস্ত হয়ে চলেছি।এও তো একরকমের ভাষা ধর্ষণ!
এ ভাষা রক্ষার জন্য গুলি চললো, প্রাণ গেল! পৃথিবীতে একমাত্র এই ভাষাটির আন্দোলনকে স্মরণ করেই ‘ভাষা দিবস’ পালিত হয়! এ ভাষায় রামপ্রসাদ কমলাকান্ত, এ ভাষায় মুকুন্দরাম ভারতচন্দ্র, এ ভাষা কৃত্তিবাসী কাশীদাসী, অতুলচন্দ্র দ্বিজেন্দ্রলাল রবিঠাকুর নজরুল,এ ভাষায় জসীমউদ্দীন, শামসুর, আর মাহমুদ, প্রাণের জীবনানন্দ…আরো কতো কে…সম্পদে সম্পদশালী!অথচ চারিদিকে এ আঁধার।চলেছি এ বিপন্নতাকে সাথে করে!
ছোট একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। ব্যাক্তিগত কারনে এক উকিলবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বিহারী।যদিও বাংলায় বসবাস। ফলে বাংলাটা জানে, একটু টান আসে অবশ্য।যা হোক, সমস্ত সমস্যা আমি বাংলাতেই জানালাম।উনার কাছে পরামর্শ সেরে ফিরবো, তিনি কেমন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। বললাম, কিছু বলবেন?
উনি বললেন, একটা কোথা বোলবো?
আমি বললাম, অবশ্যই, বলুন না!
আপনি এমন সুন্দর বাংলায় কোথা বললেন, আমি বাংলা শোব্দোগুলো শেখার চেষ্টা কোরছিলাম। কী সুন্দর বাংলা বোলেন!!
হু, ওনার কথায় স্পষ্ট বাংলার উচ্চারণ নেই, তাই সত্ত্বেও এই চেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এ প্রচেষ্টা সার্বিকভাবে হলে হয়ত ভাষার প্রতি অবিচারটা কমে যেত অনেক!