‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় ’ …. এ গান ঠিক সন্ধেবেলাই বেজে উঠবে । গীতা দত্তের কন্ঠে হাজার রকম সুগন্ধফুলেদের আসর বসে । নানান গান গাওয়া পাখিরা উড়ে উড়ে এসে বসে । ভিজে ভিজে জ্যোৎস্নায় আমার ছোটোবেলার ঘরে শরৎকাল আসে । শরৎকাল আসে স্বর্গ থেকে নেমে । আমার ছোটবেলার ঘরের পাশের বারান্দা । বারান্দার বন্ধু শিউলিফুলের গাছ । কুঁড়িতে ভরে আছে । ফুল , কুঁড়ি , জোৎস্না , রাত্রি , সব্বাই মিলে ভালো লাগার ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিচ্ছে শুধু । এবং শিরশিরে এক রহস্য । এত সুন্দরের মধ্যে কেমন গা শির শির করে আমার । আমাদের বাড়ির চারদিকে ভিড় করে আছে গাছ-গাছালিরা । খুব নিঝুম এই রাত । এখন রেকর্ডপ্লেয়ারে বাজছে ‘ নিশিরাত … বাঁকা চাঁদ আকাশে … চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে .. ‘’
.
পুজো সংখ্যা প্রকাশিত । বাবার অফিস যাওয়ার ঝোলাব্যাগের থেকে বেরুলো । একের পর এক । সে কী উত্তেজনা ! নমস্য সব সাহিত্যিকেরা বাংলার সাহিত্যজগত আলো করে আছেন । রমাপদ চৌধুরী , বিমল কর , সমরেশ বসু , সমরেশ মজুমদার , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় … এবং শৈলেন ঘোষ , এবং ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় । আরো অনেকেই । আমি দিনরাত এক করে ডুব দিই শরতের জাদু-অক্ষরের দেশে । হুঁশ থাকে না।
.
মা সবাইকে দিতে ভালোবাসত । যত পিসতুতো মাসতুতো ভাইবোন , ঠাকুমা , দিদা , সবাইকে । মনে করে সকলের জন্যে পুজোর বাজার করা ছিল বিরাট একটা ব্যাপার । আমি তো মায়ের ছায়া । চোখে টলমল করছে ভোরের শিশির । মনে শিউলিফুল ঝরে টুপটাপ … টুপটাপ । মনে ফোটে স্থলপদ্ম । স্থলপদ্ম হলো দেবদেবীর ঘড়ি । ভোরবেলা এর রঙ শুভ্র । বেলা যত বাড়ে গোলাপি , গোলাপিরঙ আরো গাঢ় হয় । কেমন আশ্চর্য না ? মনে হয় এই সবই শরতের জাদু । নয়তো রোদ্দুরের রঙ এই রকম বদলে যায় কখনো ? রোদে মিশে থাকে দুগ্গা ঠাকুরের হাসি ! তখন প্যান্ডেল মানে তো এমনি – প্যান্ডেল । মানে ঠিক পান্ডাল নয় । থিম নেই । সাধারণ । সাধারণের অসাধারণত্ব । গর্জনতেল মাখা মা- দুর্গা । টিউবলাইটের আলো । তাতে শ্যামাপোকাদের ওড়াউড়ি । ধূপের গন্ধ , ধুনোর ধোঁয়া , ফলের আর ফুলের সুগন্ধ । কচিকাঁচাদের হৈ চৈ আর ক্যাপ ফাটানো বন্দুক । ঠাকুরমশাই মন্ত্র পড়ছেন । খুব ভোরে ঢাকিরা ঢাকে কাঠি দিয়েচে ।
.
আমার মায়ের সঙ্গে মা – দুগ্গার খুব মিল খুঁজে পেতাম আমি । আর বাবার সঙ্গে শিব-ঠাকুরের । ছোটবেলায় ছিল না শূন্যতা । মা আর বাবার মতন দুজন জীবন ভরে রাখা মানুষ ছিলেন আর ছিল খুব বড় এক পরিবার । ঠাকুমা , দাদু , কাকা পিসি , ভাইবোন , প্রতিবেশী , বন্ধুরা । সব কিছু যা যা ভালো আর আলো আলো ।
.
যেন ঘড়ির কোনো মানেই নেই । শুধুমুধু কাঁটা ঘুরে যায় । কেউ কোনোদিন কোথাও হারিয়ে যাবে না । সব্বাই থাকবে । থাকবে আমাদের গ্রামটা একই রকম । সবুজ আর পাশ থেকে নদী বয়ে যাওয়া । যেন মা আমাকে রঙ রঙ টিপের পাতা কিনে দেবেন । কিনে দেবেন পরিদের মতো ড্যানসিং ফ্রক আর সিল্কের রিবন । বাবুজি নিয়ে যাবেন কলকাতায় । বাটা কোম্পানির জুতোর দোকানে । কেবল জুতোই নয় । সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে মুখোশ আর বেলুন । সঙ্গে আছে উটপেন্সিল উপহার । নতুন জুতোর সঙ্গে ঘুমাতে যাই আমি । বাবুজি হাসেন । এই পৃথিবীতে কোনো দুঃখ নেই । অভাব নেই । দুগ্গা ঠাকুরের সঙ্গে খুবই আপন সম্পর্ক । সরল সহজ সম্পর্ক । মহালয়ার ভোরে উঠে রেডিওতে মহালয়া শোনা আর বার বার ঘুমিয়ে পড়া । একটা খাটের মধ্যে নিজের মানুষদের সঙ্গে মিশে । রেডিও তখন খুব বেশি ছিল জীবনে । গানে , খবরে , খেলা শোনায় , মহালয়ায় … সে যে আকাশের থেকে নেমে আসা বাণী !
.
পুজোর গান আলাদা । মাইকে বেজে উঠবে নতুন গান ফি বছর । সেও কি কম উত্তেজনা ? অপেক্ষা সারা বছরের । এবার কি কি নতুন গান হয় … আচ্ছা , এই যে সময়টা , দু হাজার তেইশ , এখন কি আর পুজোর গান ব্যাপারটা নেই ? কই , শুনতে পাই না তো ! সেই রকম আনন্দ হয় না তো আর পুজোসংখ্য পড়েও । সব কিছুই বদলে গেছে । এখন কার পুজো অন্য রকম । এখন থিম -প্রধান পুজো । এরকম এক থিম পুজোতে একবার দেখে ছিলাম মা দুর্গা রাজস্থানের মরুভূমিতে কেমন ময়লা শাড়ি পরনে মলিন মুখে বসে আছেন ছেলে মেয়েদের নিয়ে । ঠিক মেনে নিতে পারিনি । আমার আবার সেকেলে ধরণের মন তো । দুগ্গা ঠাকুরের ঝলমলানো হাসিমুখটি বড্ড প্রিয়
.
তখন পুজোর পরে বিজয়া । বিজয়া মানে সকাল সকাল নাড়ু-নিমকি নিতে পাড়ার কচি কাঁচাদের দলে দলে আগমন । আর মা বাবুজিকে , ঠাকমাকে ঢিব ঢিব করে পেন্নাম । তারপর মিষ্টি সংগ্রহ করে একমুখ হাসি নিয়ে অন্য বাড়ি গমন । আর বড়রা কোলাকুলি । বাজি দাদুকে প্রণাম করে আলিঙ্গন করলেন । পাড়ার চিন্ময়কাকু জড়িয়ে ধরলেন বাবুজিকে বুকে । এ বড় সুন্দর এক প্রথা । বিজয়া । এখনকার বিজয়া থেকে অনেক অংশই মুছে গিয়েছে । এখনকার ছোটরা , কই আর আসে না তো নাড়ু -নিমকি নিতে বাড়ি বাড়ি ।
.
একটা সময় । একটা পৃথিবী । অনেক প্রাণের মানুষ । আশ্চর্য সেই ভোরগুলি । অন্য সে সাহিত্যজগত । অন্যরকম সেই পুজো আর শরতের আলো । আন্তরিকতা , ভালোবাসায় মাখামাখি । কেননা তখন আমার চোখে শিশিরবিন্দু , মনে শিউলিফুল ঝরতো ।
.
এখন যে সময়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি , কত কি হারিয়ে গেছে । যোগ হয়েছে কতো কিছু নতুন নতুন । অতীতকালকে ছুঁয়ে থাকি আমি । স্মৃতির ভিতরে চুপটি করে বসে নীল গগনে সাদা মেঘের ভেলা দেখি । কাশফুলের ছবি দেখি গুগল সার্চ করে । বিজয়ার পরে মেসেজ পাঠাই । এখন তো আর চিঠি আসে না । গোটা গোটা হাতের লেখায় বিজয়ার প্রণাম আর শুভেচ্ছা জানিয়ে । এখন ফোনের মেসেজ । ফিরে যেতে ইচ্ছে করে খুব । গীতা দত্তের গান আমাকে ফেরায় । সন্ধেবেলা । একা ঘরে , বেজে ওঠে ‘ জানো না কি তুমি কার … আমি কে …ওগো সুন্দর ও … ’
.
একটা শিউলিফুলের গাছ আমি রচনা করি মনের ভিতরে । অনেক কুঁড়ি , ফুল ঝরে , ফুল ঝরে , ফুল ঝরে … শিশিরমাখা ভোরের ফুল সব । উঠোনে মানে আঙিনায় …সাদা হয়ে আছে । মা -বাবা আর তাঁদের মেয়ে খুব ভোরে উঠে ফুল কুড়োবে । রাশি রাশি শিউলিফুল মা দুগ্গা উপহার এনেছেন … আর স্থলপদ্ম …