বিডন স্ট্রিটের এই ঘরটাতে বসে একদিন দুপুরবেলা, যে দুপুরবেলায় কলকাতা ঝাঁঝালো রোদে বেশকিছুটা শান্ত হয়ে যায়, ট্যাক্সি ও বাসের হর্ন আলাদা আলাদা করে চেনা যায়, সেই দুপুরবেলায় মনে হয়েছিল রাস্তাটা আসলে ‘বিজন স্ট্রিট’।
‘আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে…,’ পৃথিবীতে সব বিডনের নাম আদপে ছিল ‘বিজন’, এমন দুপুর এলে বোঝা যায়।
ওই বিজন শব্দটা নিয়ে বেশ একটা বড় সময় অস্বস্তিতে কেটেছে, এক বিখ্যাত শিল্পী শব্দটাকে অন্তে রুদ্ধদল হিসাবে উচ্চারণ করেছিলেন, গানটা তাঁর গলায় শোনার পর থেকে তাঁর গানের প্রতি আকর্ষণ কমতে শুরু করেছিল। অথচ এক সময়ে এই শিল্পী তার খুব পছন্দের ছিলেন।
ঘড়-ঘড় করে মাথার উপর একটা পাখা ঘুরছে, ফলস-সিলিং দেওয়া হয়েছিল একদিন। ভিতরের পেস্টিং চটে গেছে, বাইরের কোটিং উঠে গেছে। এটাকে বলে ছালের ভেতর থেকে মাল বেরিয়ে আসার সময়। এ সময়টা খুব কঠিন, একদিকে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে; অন্যদিকে ওই ফুটিফাটা অবস্থা দিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
অনেকটা পর্বতে ওঠার মতো, প্রথম কয়েক হাজার ফিট সবাই অতিক্রম করতে পারে, প্রায় সবাই। আসল পরীক্ষা ওই শেষ হাজার ফুটে, অথবা শেষ একশো ফুটেও হতে পারে। যে টিঁকতে পারবে সে টিঁকবে, বাকিরা নেমে আসবে। মরেও যেতে পারে। শৃঙ্গ জয় করা হবে না তাদের, এর থেকে বেশি সত্য আর কিছুই নেই।
মাথার ওপর ঘড়-ঘড় করে ফ্যানটা ঘুরেই চলেছে, সামনে বসে থাকা ছেলেটা ফাইল খুলে আউট-লাইন স্টোরি বলে যাচ্ছিল। বলা অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে। এবার ওকে কিছু বলা দরকার, এই বলার কায়দা ও অভ্যাস দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে, ‘তোমার মেল পেয়ে ভাল লেগেছিল, সেখানে আরও শর্টে ছিল কাহিনি। এখানে বেশ ইলাবরেট করে বলেছ, কিন্তু এখানে তত ভাল লাগল না। মানে ভাল লাগল, কিন্তু ততটা ভাল না… যাকে বলে একদম ছিটকে যাওয়া তেমনটা নয়…,’ প্রথমে একটু ব্যাকফুটে ফেলে দেওয়াই দস্তুর। এমনিতে ছেলেমেয়েগুলো কাজ পায় না; কিন্তু একবার কমপ্লিমেন্ট পেলে রাষ্ট্র করে বেড়াবে। সেখান থেকে কলার তুলে ঘুরবে, তাকে আর পাত্তা দেবে না দু’দিন পর। বরং যাদের একটু ব্যাকফুটে ফেলে দেওয়া যায় তারাই দীর্ঘদিন ঘুরঘুর করে, অনেকের থেকে ভাল কাজ কম খরচে করেও ঘুরঘুর করে। একে লাইনের ভাষায় বলা ‘আপার হ্যান্ড’ না-নিতে দেওয়া।
‘আপনার ভাল লাগেনি জেনে খারাপ লাগছে, বাট আমি আপনার সাজেশনসগুলো মাথায় রেখেই কাজ করেছি। কিছু কি চেঞ্জ করতে হবে?’
‘এক্ষুনি বলতে পারছি না, রেখে যেতে হবে তোমার ম্যাটারটা। আমার একটা টিম আছে, তারা দেখবে। অন্তত একমাস সময় লাগবে।’
আসলে টিম-ফিম কিছুই নেই, সে নিজেই দেখবে। দেখা হবে যাবে দশদিনের মধ্যে, তারপর মূল প্রোডিউসারের সঙ্গ কথা বলে নিতে হবে। কাজটা ফাইনাল হলে ‘মুভি-অন প্রোডাকশন হাউসের’ নামে হবে। সেখানে প্রোডিউসার হিসাবে একটা বড় নামের সঙ্গে তার নামটাও যাবে। লোকে জানবে, এ ছেলেটির মতো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জানবে যে সে বড় প্রোডিউসার। কিন্তু ছক আলাদা। ‘মুভি-অন’ বড় হাউস, চলে একদম মাড়োয়াড়ি কায়দায়।
নাম তুমি নাও, আমার সংস্থার নাম ব্যবহার করে আমাকে প্রফিট দাও। তুমি বিডন স্ট্রিটে বসে নিজেকে ফেলিনি বা গোদার, যে নামেই নিজের পরিচয় দাও না কেন আমার কোনও সমস্যা নেই। শুধু কমদামে কম-খরচে কাজ নামিয়ে দিতে হবে।
বছর-খানেক হল হাউসের বড় কোনও কাজ নেই, মানে সিরিয়াল হিট করছে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার চেষ্টা করা হয়েছে, কোনও উন্নতি নেই। এমনকি মৃত চরিত্রকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, প্ল্যানচেট করা হয়েছে। শহর থেকে কিছুদূরে জমি-দখলের কারণে গড়ে ওঠা আন্দোলনের জেরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে একটা সরকার- এতদূর পর্যন্ত ট্রাই করা হয়েছে। কিন্তু ফল সেই একই। উপর থেকে নির্দেশ আসছে ভাল সিরিয়াল নামাতে, বারবার নির্দেশ আসছে। যারা প্রকৃত টাকা ঢালে তারা বসে থাকে না। এক হাউসে বেশিদিন কাজ না-থাকলে তারা হাউস পালটে ফেলে। এক হাউস থেকে অন্য হাউসে লোক নিয়ে যাবার জন্য’ও লোক আছে। কমিশন ছাড়া পৃথিবী অচল এখন।
ছেলেটা টেবিলের ওপর প্রিন্ট করা কটা কাগজ রাখল। স্টোরি-লাইন, পয়েন্ট করা সাজানো। এবার একবার মুখ তুলে ঘাড় নাড়লেই সে বেরিয়ে চলে যাবে, এবং এটাই করতে হল। ছেলেটা বেরিয়ে গেল দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে। ইন্ডাস্ট্রিতে এমন শয়ে শয়ে ছেলে-মেয়ে ঘুরছে; সবাই মাথা গলাতে চায়। একবার মই পেয়ে গেলে তরতর করে উপরে ওঠার সুযোগ; শুধু একটা হিটের অপেক্ষা।
এই ম্যাটারটা একটু এদিক ওদিক করে কাজ করলে কেউ টিকি ছুঁতে পারবে না; ইন্ডাস্ট্রিতে এটা যে হয় না তা নয়। কিন্তু ‘মুভি-অন’ ব্যতিক্রম; তাদের এ দুর্নাম নেই।
আউট-লাইনটা মাথার ভেতর ঘুরছিল, ঘুরতে ঘুরতে ঘূর্ণী তৈরি করছিল।
স্টোরি-লাইনে সিরিয়াল হিট হবার উপাদান ভরপুর, মানুষ সন্ধেবেলা ঘরে বসে কচকচানি শুনতে চায় না। যারা বলে সিরিয়াল দাঁড় করানো কোনও ব্যাপার নয়, তার আসলে মিক্সিং’টাই জানে না। এই মিক্সিং’টা ঠিকঠাক না-হলে মানুষ ফিরেও তাকাবে না। গল্প টানটান থাকা জরুরি, তার থেকেও জরুরি মানুষের সেন্টিমেন্ট কী চায় তার সন্ধান পাওয়া।
ছেলেটাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মনে পড়ল, ‘জোকার নিয়ে শয়ে শয়ে সিনেমা আর সিরিয়াল হয়েছে। বাংলায় খাবে?’
‘আমার ম্যাটার’টা একটু আলাদা, এখানে ঠিক জোকার নয়, ডোয়ার্ফদের নিয়ে কাজ করা হয়েছে। একজন বামুন ধীরে ধীরে তার মতো আরও আরও বামুন খুঁজে বেড়াবে, প্রেম-খুন-অপহরণ থাকবে… গ্র্যাজুয়ালি তারা ডোয়ার্ফদের একটা কম্যুনিটি গড়ে তুলবে। সে কম্যুনিটি সফল হবে… মানে, তারা ব্যবসা করে সফল হবে। অনেক অনেক ‘স্বাভাবিক’ মানুষের থেকে বেশি সফল হবে তারা, একটা স্বপ্ন একটা ড্রিম বাস্তবে ফুটে উঠবে…’
‘বুঝলাম, কিন্তু ডোয়ার্ফদের সঙ্গে অন্য মানুষদের কনফ্লিক্ট আছে তো? ওটা না থাকলে কিন্তু পাবলিক নেবে না…’
‘আছে, স্যার… আপনার সঙ্গে সেদিন ফোনে যে কথা হয়েছিল সেগুলো মাথায় রেখেই করেছি কাজটা… মনে হয় এটা পাবলিক নেবে…’
‘হুম… আগে আমাদের টিম দেখুক। একটা বড় কাজ হবার আগে বহু ঝামেলা থাকে, অনেক ফ্যাক্টরস মাথায় রাখতে হয়; তোমরা নতুন আসছ, সব বুঝবে না…’
সব বুঝতে চায়নি ছেলেটা, সেও জানে সে সব বুঝবে না। অনেক টিম-ওয়ার্কের পর একটা কাজ ফিক্সড হয়। প্রথম প্রথম কাজে বেশি টাকাও পাওয়া যাবে না, ওই নামটা যাবে। প্রতিটা এপিসোডে নামটা যাবে, আর এই কাজটা দেখিয়ে আরও কাজ পাওয়া যাবে।
প্রথম প্রথম ইন্ডাস্ট্রির এটাই দস্তুর।
২
এসডিও অফিসের সামনে অটোর পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল টোটো, বৃষ্টির ভেতর থেকে উঠে আসছিল আনারস আর পেয়ারার গন্ধ। পরপর কয়েকটা ফলের দোকান। সারা দেশ জুড়ে সংযুক্তি পর্ব চলছে, আধারের সঙ্গে প্যানের, প্যানের সঙ্গে আধারের, রেশন-কার্ডের সঙ্গে ভোটার-কার্ডের, ভোটার-কার্ডের সঙ্গে প্যানের। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন দৌড়ে চলেছে, দৌড়ে আসছে এ মফসসল শহরের দিকে। নিজের সঙ্গে নিজের সংযুক্তি না-হলে সব বন্ধ হয়ে যাবে, তবে ঠিক কী কী বন্ধ হবে এবং কবে থেকে হবে তা কেউই জানে না।
এসব কাজ পাড়ার দোকানেও হয়, সেখানে টাকা লাগে। মানুষের হাতে সেটুকু টাকাও নেই; তাই তারা ছুটে আসছে প্রতিদিন। প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছে, সংযুক্তি হবার পর ঠিক কী হচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝছে, একটা কার্ডের ভেতর ঢুকে গেল আরেকটা কার্ড।
এসডিও অফিসের সামনে বিকেলের দিকে একটা ছোট্ট জটলা হয়েছিল, কারণ টোটো থেকে সামনের চায়ের দোকানে চা খেতে নেমেছিল গুটু বামুন।
গুটু’র উচ্চতা সাড়ে-তিনফুট; গুটু এ মফসসলের অলিতে-গলিতে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছে। এখন সে টোটো’য় করে ঘোরে, মানুষ তাকে দেখে মাঝে মাঝে ঘিরে দাঁড়ায়। খিলখিল করে হাসে, গুটু সামনে থেকে ইদানিং বেশ কয়েকজন স্টার’কে দেখেছে। গুটু জানে লোকে তাকে ঠিক স্টার মনে করে না, আবার একদম ফেলেও দিতে পারে না।
একটা সিরিয়াল গুটুর ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে, একটা মাত্র সিরিয়াল। প্রায় প্রতি এপিসোডে সে স্ক্রিনে এসেছে, দর্শক দেখেছে। এখন গুটু’কে ক্লাবগুলো ডেকে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দেয়। একদিন ক্লাবের যে ছেলেরা তার প্যান্ট টেনে খুলে দিত প্রায় তারাই গদগদ হয়ে নিচু হয়ে গলায় মালা পরায়।
গুটুর বাড়িতে এখন গামছার মতো অনেক উত্তরীয়, গুটু রঙ দেখে বুঝতে পারে কোন ক্লাব কোন দলের দিকে ঝুঁকে। গুটু স্টেজে উঠেই কায়দা করে উত্তরীয়র রঙ দেখে নিয়ে বক্তব্য রাখে। সিরিয়ালের ডায়ালগ ছুড়ে দেয়, হাততালি পড়ে দেদার।
আজ টাউন-হলের সেমিনার কক্ষে গুটু’কে সংবর্ধনা দেবার পালা, এ শহরে ইভনিং রায়চৌধুরী ছাড়া এসব অনুষ্ঠান ভাবাই যায় না। ইভনিং স্টেজে হাজির। ইভনিং বলে চলেছিল, ‘গুটু সর্দার আমাদের কাছে শুধু একজন সেলেব নন, তিনি আমাদের ইন্সপিরেশন… এ শহরের গর্ব। মানুষের উচ্চতা যে শুধু কায়িক নয় সেটা গুটু-বাবু আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে এ শহর একদিন আমাদের রাজধানী হবার কথা ছিল…’
গুটু স্টেজের ওপর একটা চেয়ারে বসে। তার পা স্টেজের মেঝে ছুঁতে পারেনি, তার আগেই শেষ হয়ে গেছে তার উচ্চতা। এ শহরে সত্যি একদিন নেমে এসেছিল ইংরেজ, তারপর পাত্তাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছিল কলকাতার দিকে। ভেসে আসছিল ইভনিং রায়চৌধুরীর গম্ভীর স্বর, ‘এ শহর আজ বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী… গ্রাম দিয়ে শহরে ঘেরার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে ধীরে ধীরে…’
ইভনিং জানে আজও মানুষ নকশাল সেন্টিমেন্ট খায়, আজও এই রাজনীতির বাইরে নকশাল ও সত্তর দশক যেন মানুষের কাছে একটা রিলিফ।
আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিল ইভনিং; তার গলার কাছে ভর করছিল অচেনা সব পঙক্তি। এবার পর পর বক্তব্যের পালা, ওটা সোসাইটির সেক্রেটারি সামলে নেবে। স্টেজের পিছন দিকের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছিল ইভনিং; আধো-অন্ধকারে সিগারেট ধরিয়ে ছিল।
‘তোমার বাবা অনন্য রায় পড়েছিলেন, এবং অনন্য রায়ের কবিতা থেকেই তোমার নাম রাখা হয়েছিল, ইভনিং…’
‘আই ডোন্ট নো… হতে পারে, আবার নাও হতে পারে…’
‘হতেই হবে। আমরা জানি, আমরা কেউ-ই আর বেঁচে নেই… আমাদের কেউ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে না এ পৃথিবীতে, তবে তোমার বাবার সঙ্গে অনন্য’র ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তোমার বাবার হাত ধরেই অনন্য রায় এ মফসসলে প্রবেশ করেন; ঠিক পাঁচজন পড়েছিল তাকে। তার মধ্যে তিনজন বাতিল করে দিয়েছিল, সহ্য হয়নি। কুকুরের পেটে ঘি-ভাত সহ্য হয় না, আমরা জানি। আমি আর তোমার বাবা তাঁকে বাতিল করিনি…’
‘আমি অনন্য পড়িনি, এক সময়ে কিছু কবিতা লিখেছিলাম। তারপর ভেবে দেখলাম, এফসিআই-তে চাকরি পাবার পর, জীবনে ওই চাপ নিয়ে লাভ নেই। তবে বাবার দেওয়া নামটা আমাকে মাইলেজ দিয়েছে, যে মহিলা আমার বউ সে ছিল কলেজের সব থেকে সুন্দরী। আমার নাম ইভনিং- লোকমুখে শুনে নিজে এগিয়ে এসে আলাপ করে। ফলে বলতে পারেন অনন্য আমার বউ খুঁজে দিয়েছেন। বাট, আমার আর অনন্য’র সংযোগ কোথায় বুঝতে পারছি না..,’ সিগারেটের বাট’টা এক পাশে ফেলে জুতোর শুকতলা দিয়ে একটু ঘষে দেয় ইভনিং।
‘অনন্য’র একটা কবিতায় ছিল ইভনিং পুরকায়স্থ’র কথা… তোমার বাবা ওখান থেকেই ইন্সপায়ারড হয়েছিলেন…’
‘কিন্তু বাবার যে পুত্র সন্তান’ই হবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন কি? যদি আমি মেয়ে হয়ে জন্মাতাম তা হলে আমার নাম কী রাখতেন?’
‘ব্যালেরিনা… শুধু ‘নীল’টা মুছে দিতেন। ওই নীলের ভেতর মৃত্যু লুকিয়ে রয়েছে, অসহ্য যন্ত্রণা রয়েছে। তুমি ঠিক বুঝবে না। জীবনকে পুড়িয়ে মৃত্যুর ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ওসব কিছুটা আন্দাজ করা যায়…,’ লোকটা কথাগুলো বলে মিলিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে।
মফসসলে নেহাত কপালজোরে বিখ্যাত হয়ে গেল গুট্টু, গুট্টুর গলা ভেসে আসছিল। খনা গলা, গুট্টু এসময়ে হাসে। দর্শকদের পালস বুঝে নিয়েছে গুট্টু, গুট্টু বিখ্যাত হয়ে গেছে।
বিখ্যাত গুট্টুর থেকে কিছুটা দূরে এই পিছনের গেটের দিকে অন্ধকার, গুটখার ছোপ। কে যেন ঘষে ঘষে লিখে দিয়েছে, ‘হারামির দল / করে কোলাহল’।
৩
এ মফসসল থেকে একদিন কলকাতার দিকে বেঁকে গিয়েছিল জোব চার্নকের নৌকা; সেই থেকে এ মফসসলের প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় ট্র্যাজিক এক কষ্ট।
যা হতে পারত অথচ যা হল না- এই বোধ কোঁচবকের মতো মানুষের বুকের মধ্যে ঘুরে ঘুরে পাক খায়।
মানুষ কলকাতার দিকে চলে যায়, কলকাতা থেকে ফিরে আসে… আবার কলকাতার দিকে চলে যায়।
এ মফসসলে শুধু যে ইভনিং রায়চৌধুরী আছেন তা নয়, ছিলেন মর্নিং হালদারের মতো মানুষ’ও।
মর্নিং হালদারের কাহিনি বেশ রোমাঞ্চকর, মর্নিং লেখা শুরু করেছিলেন মধ্য-কুড়িতে। মর্নিং হালদারের সঙ্গে মফসসলের কারও তেমন বনে না; কারণ মর্নিং হালদার অ্যনার্কিতে বিশ্বাস করেন। গোপনে লেখেন ও প্রকাশ্যে ছাপতে দেন পত্র-পত্রিকায়। মর্নিং হালদারের পথ ও মত আলাদা।
মর্নিং হালদারের নামডাক বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার পত্র-পত্রিকায়। একদিন মর্নিং হালদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইভনিং রায়চৌধুরী’র। তাদের কথাবার্তা হয়েছিলে এরকম,
মর্নিং হালদার- আমার বাবা জুটমিলের শ্রমীক ছিল… আমাকে ওই কেতা দেখাতে এস না
ইভনিং রায়চৌধুরী- আমার বাবা যখন অনন্য’র সঙ্গে আড্ডা মারছে তোমার বাবা তখন বাঁশবন থেকে বেরিয়ে আসছে ঘটি হাতে… তোমার লিগ্যাসি আমি জানি। ওই সাব-অল্টার্ন মারিয়ে অনেক করেছ… আমাকেও বেশি কেতা দেখাতে এস না।
মর্নিং- আমার সাব-অল্টার্ন খাঁটি… বিশুদ্ধ
ইভনিং- আমার ‘অনন্য’ও খাঁটি ও বিশুদ্ধ
এ ঘটনার পর থেকে মর্নিং ও ইভনিং-এর কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। মফসসল শহরের কোনও অনুষ্ঠানে মর্নিং ও ইভনিং-কে এক সঙ্গে দেখা যায় না। কেউ তাদের এক মঞ্চে হাজির করাতে পারেনি।
সেদিন মর্নিং প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল-ফোনটা বের করে কানে ধরেছিলেন, ফোনের ওপার থেকে ভেসে এসেছিল রাজধানীর আধা-বাণিজ্যিক পত্রিকার সম্পাদকের গলা,
‘আপনার মেল পেয়েছি, পড়ছিলাম। আপনার লেখায় সেই ঝাঁঝ আছে যা বাংলা সাহিত্যে এ মুহূর্তে বিরল। তবে একটা রিকোয়েস্ট আছে…’
মর্নিং শান্ত গলায় বলেছিলেন, ‘কী? আপনার কাছে থেকে রিকোয়েস্ট পাওয়া আমার কাছে আদেশের সামিল…’
‘যে লেখাটা দিয়েছেন সেটা অসামান্য…,’ ‘অসামান্য’ শব্দটিকে আজকাল বেশ সন্দেহ করেন মর্নিং, ‘শুধু একটা কথা, নেক্সট টাইম থেকে মাথায় রাখবেন, আমাদের পাঠক মূলত মিডল-ক্লাস পিপল… একটু জার্ক থাকলে ভাল হয়… জার্ক মানে কিন্তু আমি ‘মশলা’ বোঝাচ্ছি না, জার্ক মানে জার্ক…’
নদীর ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিল একটা বক, ওখান থেকেই শোনা যায় জোব চার্নকের জাহাজ শহরের দিকে বেঁকে গিয়েছিল।
জার্ক মানে জার্ক, আর কিছু না। জার্ক মানে মশলা না… মর্নিং মনে মনে বারবার আওড়াচ্ছিলেন শব্দগুলি।
ইভনিং-এর স্টেজে উঠে গলা কাঁপিয়ে অতিথি-বরণ করা ও মর্নিং-এর লেখার মধ্যে জার্ক বেশ কাছাকাছি চলে আসছিল ইদানিং। দু’জনকে আজকাল অনেকের দুই ভাই বলে মনে হয়, মফসসল-শহরের অনেকেই এটা লক্ষ করেছেন।
মর্নিং এখন বরাত পান লেখার, ঠিক ছয়-শো ষাট শব্দের মধ্যে একটি ফিচার লিখে দিতে হবে কাল-ই।
বিচিত্র বিষয়ে লেখার বিচিত্র ক্ষমতা যে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল তা বেশ অনুভব করছিলেন মর্নিং। লেখা সন্তান, সন্তান বেড়ে ওঠার সময়ে মানুষ টের পায়।
সেই মর্নিং সেদিন বসেছিলেন শহরের আধা-বাণিজ্যিক পত্রিকার দপ্তরে। একটা দুটো করে ছেলে-মেয়ে আসছে, যাচ্ছে। মার্কেটে নতুন নেমেছে, ঘুরে বেড়ায় দপ্তরে দপ্তরে। মর্নিং-এর জন্য চা এসেছিল, খোদ মালিক ডেকেছেন বলে এ খাতির।
কিছুক্ষণ পর একজন দাঁড়কাকের মতো মানুষ ঢুকেছিলেন দপ্তরে। মর্নিং-কে স্রেফ বাইপাস করে খোদ সম্পাদক-কাম-মালিকের গা ঘেঁষে বসেছিলেন।
সম্পাদক হাত কচলাতে শুরু করেছিলেন, ‘আপনাকে যে কারণে ডাকা… একটা বড় প্রোজেক্ট নিয়ে বাজারে আসছেন এঁরা। কাজটাতে আপনাকে যোগ্য মনে হয়েছে বলেই ডেকে পাঠানো, না হলে বাজারে লোক কম নেই…,’ হেঁ-হেঁ করে একবার হেসে উঠে হঠাৎ চুপ করে গিয়ে মর্নিং-এর দিকে তাকিয়ে ছিল লোকটা।
বাজারে লোক কম নেই, বাজারে লোক কম নেই। তবু তাকে ডাকা হয়েছে, সুড়ঙ্গের মুখে এক-চিলতে আলো দেখতে পেয়েছিল মর্নিং।
‘আপনাকে তো কাজটাই বলা হয়নি… এরা আসলে একটা বিগ প্রোডাকশন হাউসে কাজ করে। একটা সিরিয়াল হচ্ছে, জম্পেশ করে স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে… এপিসোড পিছু রেমুনারেশন পাবেন, তবে আপনার প্রথম কাজ, ফলে টাকা একটু কম হবে।’
মর্নিং-এর শহর থেকে একদিন চার্নকের নৌকা বেঁকে গিয়েছিল কলকাতার দিকে। যা হতে পারত অথচ যা হল না সেই কোঁচবক ঘুরতে শুরু করেছিল মর্নিং-এর মাথার মধ্যে।
ঘরের একদিকে তাকে ডেকে নিয়েছিল দাঁড়কাকের মতো মানুষটি, বুঝিয়ে চলেছিল, ‘আসলে মেলোড্রামা বলে কিছু হয় না, দুনিয়াজোড়া সবাই বোকচন্দর আর আপনি-আমি দু’পাতা কাফকা, সতীনাথ ভাদুড়ী পড়ে সব জেনে গেছি এটা ভাবাই এক ধরণের পাঁঠামো…।’
লোকটা তাকে প্রকারান্তরে পাঁঠা বলল ভেবে একবার রাগ ভর করতে শুরু করেছিল মর্নিং-এর শরীরে।
এ দুনিয়ায় কোনও বাবা-কাকা তাকে সাহিত্যের আঙিনায় বিন্দুমাত্র সাহায্য করেনি, তার কোনও এমনকি ‘অনন্য রায়’ পর্যন্ত ছিল না।
অনন্য রায় ভিন্নধারার কবি ছিলেন, গূঢ় সন্ত্রাসবাদীর মতো। ইভনিং-এর সে কানেকশন ছিল। এটিও একটি কানেকশন অবশ্যই, মর্নিং মনে করে। বিকল্প পথের কানেকশন, আলো দিয়েছিল ইভনিং-কে। কিন্তু নিজের লেখা নিজে না-লিখতে পারলে ওই কানেকশনের কোনও মূল্য নেই। ইভনিং সে মূল্য পায়নি, এমনকি অনন্য রায়’ও তাকে বাঁচাতে পারেনি।
আচ্ছা অনন্য রায়ের এই কানেকশন’কে আশির্বাদ বলে ভাবা যেতে পারে আদৌ? এমন একটা চিন্তা মাথার ভেতর একবার এসেই মিলিয়ে গিয়েছিল, কারণ বুকের ভেতর তখন উড়তে শুরু করেছিল সেই কোঁচবক।
শোন ইভনিং, আমি বাংলা সাহিত্যের শহিদ-প্রায়, কিন্তু এভাবে পড়ে পড়ে মার খাব না আর। মেলোড্রামা বলে কিছু নেই এই দুনিয়ায়, যে পারে সে আউট অফ নাথিং সামথিং ক্রিয়েট করে চলে যেতে পারে।
দাঁড়কাকের মতো লোকটা বুঝিয়ে চলছিল।
যথেষ্ঠ চ্যালেঞ্জিং কাজ, করে দেখিয়ে দিতে হবে।
৪
হেমন্তের হিম পড়ছে শহরের বুকে, নদীর দিকে ঘনিয়ে উঠছে কুয়াশা।
এ সব কুয়াশার দিনে মনে পড়ে একদিন সংবর্ধনার ঘনঘটা ছিল শহরে।
প্রায় প্রতি শনি-রবিবার সংবর্ধনা ছিল।
বামনদের নিয়ে সিরিয়াল শেষ হয়ে গেছে কয়েক বছর। গুট্টু শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে একজন-দু’জন চা খাওয়ায়, বিড়ি দেয়। স্টেশনের দিকে হেঁটে যেতে যেতে দেখে লম্বা লম্বা মানুষজন গাড়ি চেপে, পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। শহর থেকে মানুষের দল পেটের ভেতরে বয়ে এনে উগরে চলে যাচ্ছে ট্রেন। দেশি মদ খাওয়ার পর বমি করা মানুষের মতো বিবর্ণ আর ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে শহর। এ শহরে আর কেউ তেমন চিনতে চায় না গুট্টু’কে। শুধু একজন চিনতে পারে, গুট্টু’র সঙ্গে কথাবার্তা হয়।
সেদিন হেমন্তের হিম মাথায় নিয়ে স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল গুট্টু, ভাবছিল তার পুরানো পেশা, ভিক্ষে করায় ফিরে যাবে কি না।
ভাবতে ভাবতে দেখেছিল স্টেশনের গেট পেরিয়ে হনহন করে বেরিয়ে আসছে সেই মানুষটি, এ শহরে যে দেখামাত্র গুট্টু’কে চিনতে পারে।
মর্নিং হালদার গুট্টুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, বেঁটে মানুষদের নিয়ে সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে সে একদিন জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠেছিল শহরের। কত স্টেজ শেয়ার করেছে গুট্টু তার সঙ্গে। আজ একটা বিড়ি শেয়ার করল মর্নিং হালদার গুট্টুর সঙ্গে। এবার তারা এক সঙ্গে বেশ কিছু দূর হেঁটে যাবে, গুট্টু দেখছিল মর্নিং হালদারের গায়ে হাই মাস্ট থেকে আলো এসে পড়েছে। কিন্তু তার ছায়া গুট্টুর মতই ছোট, বেঁটে।
মর্নিং হালদার ঠোঁটে বিড়ি চেপে বলেছিল, ‘দিন আবার আসবে গুট্টু, যারা বলে আমার হাত থেকে কলম খসে গেছে তাদের আমি জবাব দেবই। …মেলোড্রামা বলে আসলে কিছু হয় না, এখন আমি বিশ্বাস করি, তোদের নিয়ে সিরিয়াল আমিই হিট করিয়ে ছিলাম; আবার করাব। দু’একপাতা কাফকা আর অনন্য রায় পড়ে আসলে কিস্যু হয় না, ওসব এ বয়সে এসে বুঝে গেছি… আই উইল গো টু দ্য টপ… টপ… টপ…’
গুট্টু দেখছিল মর্নিং হালদারের দু’ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শ্লেষ্মা আর হলদেটে থুতু।
দুটো বেঁটে ছায়া শহরের স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গিয়েছিল শহরের পেটের ভেতর।