১. ইরানি বুড়ি বাড়ির পিছনে মায়াপৃথিবীর সেই মাঠ বাহারি লেবাস ঝলে উঠছে জিপসি ইরানিরা তাবুতে বসিয়ে কোনো কালিবঙ্গান-যুগের গীত দিয়ে পাক করে নিচ্ছে বাতাস ফলে একটি নিকুঞ্জের মধ্যে আমরা চলে আসছি। সব পরাৎপর বর্তুল খোঁদাগুলি ভেঙে স্মরণীয় মুনিয়ারা এই অন্তহীন ময়দানে আমাদের দুঃখসুখের শরিক হয়ে যাচ্ছে। ইরানিদের মাঝে জ্যেষ্ঠা নারীটির মায়া সবচেয়ে চুম্বক মনে হল। কারণ তার হাতের সাপটি করুণ ও ক্রুদ্ধের সেই অনচ্ছ ধাতুরূপ। ওই সাপ সর্বশুরুতে দেখেছিলাম জাঙ্গুলির হাতে, তখনও সে দেবী হয় নাই ফলত কাঁচা খোলস তুলে তুলে সুমধুর উদ্বোধন করেছিল অন্য জগৎ বা চিহ্নভাষা ব্যবহারকারী কোনো গোত্র, কবিলা… এভাবে খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে আজ আমাদের কাছে এসেছেন ধাত্রীদেবী কিন্তু ওঁর ভাষা একটুও বুঝি না এখন চিহ্ন ব্যবহারের রীতিও আর এই দুষ্ট-সমাজে নাই, জানি অতএব মায়াপৃথিবীর দিকে যাওয়া নিয়ে সংশয় রহিল… ২. সেই শবরী এক শবরীকে জানতাম : আমার ফুলপাতানো দাদি মহুয়ার ভাঁড় নিয়ে কখনো-কেমনে দেখা দিতেন পথে আমাদের দৃষ্টিধর্মকে গন্ধদ্রব্যের পারা ভ্রমণশীল করে তুলতেন তিনি ফলে বাতাস গাহে-বেগাহে বয়ে নিয়ে যেত আমাদের দৃষ্টিক্ষমতা এভাবে একদিন কটালির বনের পারে তাঁর গাঁও দেখেছিলাম। গাঁও বলতে চার-ঘর অনহা লাঠা নিয়ে দিনরাত ঘুরে বেড়ানো এক উদাম মরদের সাথে পাতানো সংসার কেঁদছাওয়া কুড়িয়ার ছামুতে একটি সার্ধ-ত্রিবলিত লতাও দেখেছিলাম, মনে আছে সেই সান্ধ্যক্ষণ, ঈষৎ আভাময় বাতাসে লতাটি যত দুলেছে মরদ উঠেছে হামলে তত শবরীকে 'বসন্ততিলক' বলে ডেকেছে অদ্ভুত মেশওয়াকি নামে সেদিন ওঁর রূপ সুঁদরি গারার পারা, দেখেছিলাম অন্ধ বনের আড়ে নিজেদের বিকীর্ণ করতে করতে ওরা বেসুমার প্রতিচ্ছবিতে ভরে দিচ্ছিল আমাদের দিগর দুনিয়া… ৩. বঙ্গভাষা সংবাদ জাড়ের সন্ধ্যায় আগুন তাপার কালে জঙি বাউরির কাছে একদা বঙ্গলিপির কথা, শুনেছিলাম। অবাক্যি কালিহাঞ্জি সাঁঝ কাঁজি-আলোতে শুধু দেখা যাচ্ছে তাঁর মুখ বৃহদ্ধর্মবর্ণিত সেই গূঢ় নাক ও চোখ একটি আবহমণ্ডলকে রচনা করছে। লিপিকালের বঙ্গভাষায় একটি পদের ধূয়া তুললেন তিনি, বোঝালেন এ কদাপি অর্ধম্লেচ্ছ চর্যাগীতি নয় এর সাথে মিল আছে বায়ুরুৎম, পুষ্করশারী ও মহোরগ ভাষার কিছুকিছু এবং প্রাচীন পাখুড়ির লাহান ধ্বনি দিয়ে তিনি একটি ভাবকেও জাগালেন এভাবে মধ্যবর্তী বায়ুস্তর গাঢ় হয়ে একটি নীলাভতম দুনিয়া পয়দা হল মাঝের মান্দার আগুনকে চকিতে মনে হল জন্মপলের মিহির আর আমরা নীহারিকাপুঞ্জের মাঝে বসে আছি তবুও আমার গুমান আর যায় না কিছুতে বিভিন্ন অপূর্ণ বাক্যে তাঁর কাছে ভেদ জানতে চাইলাম বিবিধ কূটধ্বনি যা স্মরণে এল ব্যবহৃত হল একে একে অগত্যা, কথাপ্রসঙ্গে তিনি লাল্হ দেশ ও মহাস্থবির কালিকের কথা শোনালেন, একিন এল, তিনি সত্যই বঙ্গভাষায় কথা বলিতেছেন… ৪. ডোম্বিপুত্র মিহির জাফরি বেড়ার ধারে তাঁকে দেখেছিলাম প্রথম কতগুলি বাগডুল-সহযোগে এক আয়নাজগত বাঁধতে বাঁধতে আমার দিকে একবার চেয়ে দেখেছিল ডোম্বিপুত্র মিহির… ইশারায় কাছে ডেকে চোখের বিনাঈ তুলে খেলতে খেলতে শূন্যে ছুঁড়ে দেবার সেই মুদ্রা আমি ভুলি নাই… সেই সদ্য আজাদ বিনাঈ দেখেছিল এখ্যানদিনে ঢাকতালে মত্ত কুঁকড়া আর মিহিরের সেই মনোহারী ভেশ ঢহ্মণিকা, তালমুল, বল্লি খেটক হাতে শক্ত করে ধরা খড়্গের মায়াৎসরু কোনো চিত্র ফোটার আগেই নেমে গেল নিচে, আখড় কেলেকঁড়ার লাটাভরা মোট আট শতক জমিতে কাঁচা গোবর-ছঁতের গন্ধে প্রধান প্রতীক কলকেটির মুখে রেখে এল পৌন্ড্রদেশের প্রাচীন গঞ্জিকা, মাটিতে পোতা হাতি আর ঘোড়াগুলি ছুটিয়ে একে একে তুলে দিল বড়োভোগ, পালাদোক্তা সীমাসাড়ে, মড়েক, তুরুইক-সহ ছয়জন পূর্বপিতাদের মুখে… শোল ধান কাটার পূর্বকাল, এসব দেখছি আর দিন ছোটো হয়ে আসছে দৃষ্টির গহন হতে ঝরে পড়ছে ব্যবহৃত মণি…! ৫. ফুল ফুটবে গিরি হরিদ্রা নিয়ে আবার এসেছি এই বসুমতি পাথরের সকাশে সহসা বায়ুর মতো পথ আসবে বলে গেছে সুকু মুর্মুর বাবা। দুচোখ বিস্ময় নিয়ে তাই এক লীলাবতী মাছিকে দেখছি তার বৈখরীর কাছে এসে থেমে গেছে প্রাঞ্চ বোতাই ভাষার ঋকগুলি। বিষ্ঠা-আলূদ ক'টি পায়ে শুধু কী সহজে মলে ও কমলে ঘুরে ফেরে আর নিজের জেবাকে দেখে মুগ্ধ এত ছিঁটেবেড়ার দেয়াল টপকে নিজেরই সম্মুখে এসে ঘুমায় সলাজে… তার অবিচল ঘুম থেকে বর্তুল হাওয়ায় কাঁইবিচি ফেলে ফেলে বাজি হল শুরু পাথর-ছামুতে আরও পিনদ্ধ শামা উঠল রেঙে… নিবিড় সবুরে তাই বসে আছি। বলে গেছে এই মাটির গতরে জমা হচ্ছে রস এক আনোখা রঙের ফুল উঠবে ফুটে একদিন সদানন্দ আকাশে, বাতাসে… ৬. ঘোর বর্ষায় কী এক বিপন্ন দিন। দেখো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মহাগর্তগুলি, ফুল্ল শ্রীমুখ। এই ঘোর বর্ষায় তুমি চাইছ মান্দাস ভাসাই মুলুটি মৌলীক্ষার দেশে। এ হেন আবদারে খিদিবিদি প্রাণ, মনে হল বর্ষার নাভীর থেকে তুলে আনি সুস্বাদু হায়াৎ, খুঁটে খুঁটে খাওয়াই তোমাকে। মহাক্ষোভে ঘনিয়ে আসা ভ্রুসন্ধির জন্য বয়ন করি আরেকটি মাখলুকাত, অন্বয়রসে ভরা। কিন্তু চর্যাকথিত অতীব কাক কিছু সাদা আকাশ ভঙ্গ করে লুটোপুটি খেল। কা-শব্দে কুম্ভক দিয়ে বসে রইল অসহ্য সহন এই দিনে। ৭. সীমানা আমি আর তুমি, পথের সন্ধান একটি পেয়ে সীমানা খুঁজেছি। যেহেতু সীমানা দেয় আশা, আর সুখের আর নিশ্চয়তার ফুরসত। ফলে প্রবৃত্তিবশে পৌঁছানোর জিদ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমরা এগিয়ে চলেছি… হয়ত আরও কিছু কারণ রয়েছে, আরও গভীর কোনো প্রণয় জোছনা অথবা দুয়ারে যেন কেউ অপেক্ষমান কিন্তু তুমিও জানো, শুনেছ কোথাও কোনো উপালির কাছে, মধ্যযামে, কালপুরুষ রাতে অসীম অসীম সব দুষ্কের জাঙ্গাল ঠেলে তেরালেঙ্গা চলেছে জীবন তবু দেখো, মরমি জাহানে প্রতীকে প্রতীকে জাগে মণিপদ্মের পারা হাওয়া… ৮. অজাত যত কাছাকাছি যাই, তত মনে হয় জন্ম হয়নি এখনো সেভাবে। এখনো একটি বীজ অথবা বীজের ভাবনা হয়ে রয়ে গেছে সমূহ জাহান। এ দুনিয়া আগুল্ফশির এখনো কল্পের মতো লাগে। যেন মিটিমিটি জিহু, একটি কাঞ্চন গোলাপি দারুণা হামেশাই হাজার অছিলায় নেমে আসে অস্পষ্ট পালকরাশির পারা আনীত আত্মিকা কৃষ্ণাজিন বিছানো ডহরে ওড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো কালের বিভূতি শুধু মানসরেণুর পারা কালের বিভূতিরাজি ঘোরেফেরে কুল-কায়েনাতে… ৯. পলাশ এবারে পলাশ ফুটবে, ডুঙরি-টিকরে তার আগেই দেখি আমি থোকা থোকা সমূহ পলাশ… লাল ও হলুদ রুদ্রযুবক-যুবতী তারই মাহিয়াত বিবিধ প্রকারে তাকে ডালে ডালে ফুটিয়ে তুলেছে, আমি দেখি তার অজুদ, মাধুরী অপেক্ষায় ছিল জাহির হবার জন্য পরিপূর্ণ বসন্ত দিনের সে ছিল সেই থেকে এমন তুমুল শুধু 'হও' ধ্বনি দিয়ে তার দৃশ্যতা আঁকা হবে বলে সে ছিল, যেমন আছে চির সবকিছু শুধু 'হও' দিয়ে তার থাকা দৃশ্যমান হবে এই পরিপূর্ণ বসন্ত দিনে… ১০. শরৎ মেঘ কেন সমস্ত অনাবশ্যক ঘটনার দিকে আমি চেয়ে আছি কেউ কি জানাবে এই ধারাবাহিক মেঘেদের সংহতি কেন এত নির্মল হল…! তারা কি সজল? নাকি বিশুদ্ধ শিল্পীর গুণে সমস্ত রঙ মেখে আজ এত আবুয়াজ সাদা হয়ে আছে? কিছুই জানি না আমি শুধু মেঘ দেখি দেখি ব্যর্থ ক'রে সব উন্মোচন, তাদের সমূহ আভাস প্রাচীন সুফির পারা হেঁটে যায় একটি ভুবন সাদা সাহজিক প্রতিভাসে অখণ্ড নীল চিরে চিরে হেঁটে যায় অসীম মর্মের দিকে একেকটি বেলফুল সংহত লীলায়িত প্লাবিত জীবন…
মহিউদ্দিন সাইফ
জন্ম ১৯৯৬ সালে, বাঁকুড়া জেলার বিহারীনাথ পাহাড় সংলগ্ন একটি গ্রাম, দুর্লভপুরে। লেখালেখির শুরু ২০১৫ সাল থেকে। প্রথম লেখা প্রকাশ হয় ২০১৮ সালে ‘আরশিনগর’ পত্রিকায়। ২০২০, ডিসেম্বরে প্রথম বই ‘আহত নীলাভ শাখা’ প্রকাশিত হয় ‘অহিরা’ থেকে। ২০২৩, বইমেলাতে দ্বিতীয় বই ‘গোধি-চামড়ার পথে’ প্রকাশ পায় ‘গদ্যপদ্যপ্রবন্ধ’র সহযোগিতায় ‘সপ্তর্ষি’ প্রকাশনী থেকে। মৌলিক কবিতা ছাড়া অনুবাদ ও প্রবন্ধে আগ্রহী।
Facebook Comments Box