যজ্ঞডুমুর গাছগুলোর গায়ে ভয়ঙ্কর ক্ষয় ধরেছে। মাটি মাটি হয়ে গেছে গাছের গোঁড়া, বয়েসি বাহুগুলো। পিঁপড়ে, উল্লা আর মাজুলি পোকারা ফুটোফালা করে দিয়েছে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা গাছগুলোর শরীর। তবু থোকায় থোকায় ডুমুর ধরেছে। বাঁচার আনন্দে পাতাগুলোর ভেজা চোখ চকচক করছে। রুরু দেখে নিশিন্দির গাছটা নেই হয়ে গেছে। সেখানে কতগুলো লাল হলুদ রঙ্গনফুল বিমর্ষ আতংকে পুকুরের দিকে সিঁটকে চেয়ে আছে। ব্যবহৃত তেলের বর্জ্য কালো সরের মত ঢেকে রেখেছে পুকুরের পানি। পানি কি আছে আর ! রুর মন বলছে, নেই। যা আছে তা কেবল পানি নামের তরল কিছু।
এই পুকুরটা ওদের ছিল। তিনশ বছরের পুরনো। ঠিক পুকুর নয়। উত্তুঙ্গ মধুমতি্র বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্রাসের ধারাজল শাখা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এই জনপদে। সেই শাখাজলের ধারা কোথাও মৃদু স্রোতস্বিনী নদী হয়ে থেকে গেছে। কোথাও খাল আবার কোথাওবা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে হাওড় বাওড়ে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় বিলের জলে টইটই করত দিনের আলো। এপারের মানুষ ওপারের কাউকে ডাকত দিত অদ্ভুত সুরে। সাড়া আসত সুরের প্রতিধ্বনি তুলে। তখনও মানুষ ছিল মানুষের মত। এই নদী, খাল, হাওর বাওড় বিলের পারে সরল জীবন ছিল তাদের। সাদা জলে পাল ভাসিয়ে তারা চলে যেত দূর দূরের নদী, মহানদী সাগর মহাসাগরের পথে বাকলিয়া- চন্দ্রদ্বীপ, প্রাচীন ফরিদপুর, খুলনা সুন্দরবন, বিক্রমপুর, নদীয়া ছাড়িয়ে আরও বিশাল সুদূরে। খাবারের লোভে নদী বা খাল থেকে দু একটি কুমির কিম্বা ঘড়িয়াল বুকে হেঁটে প্রায়ই চলে আসত গৃহস্থ বাড়ির গোয়ালে। শুশুক রূপালি পিঠ দেখিয়ে ভেসে উঠত খেলাচ্ছলে। নদীতে উজান ভাটির সুর ছিল। গভীর সাগরে গহন রাতে বেজে উঠত মল্লারধ্বনি, ভোর আসত আহির ভৈরবে, পড়ন্ত বিকেলে ভীমপলশ্রীর আবাহন, প্রকৃতি যেন রঙিন বাজিগর— এরকম এক সময় রুরুদের কোন পূর্বপুরুষের প্রথম পুত্র মুসলিম সুফিপীরের অনুগামী হয়ে পড়েছিল। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক ও পারিবারিক সংঘাতে মুহুর্তে রক্তের বন্ধন পলকা হয়ে গেছিল। ততদিনে স্বজন ত্যাজ্য অই তরুণ ব্রাম্মণ ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে লা শরীক আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় তার মুর্শিদ বা পীরের কাছে এই গ্রামে চলে আসেন। তিনি মুসলিম হেকিমদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন কিছু চিকিৎসাবিদ্যা। এবারে স্থানীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের কাছে বিশেষ শিক্ষা নিয়ে বসতি গড়ে তোলেন এক নামকরা কবিরাজের বিশাল ওষুধী বাগানের পাশে। এই বাগানের এক পাশে সুদৃশ্য একটি মন্দির ছিল। এলাকার এক ধনী কায়স্থ তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত করেছিল মন্দিরটি। লাল রঙের এই মন্দিরের পুরোহিত সপরিবারে বাস করত সেখানে। প্রাকৃতিকভাবে ভেসে আসা ধারাজলে সৃষ্ট একটি খাল বয়ে গেছিল এই মন্দির ছুঁয়ে। সামান্য বাঁক নিয়ে খালটি রুরুদের বসতবাটির পাশ দিয়ে বয়ে মিশে গেছিল বৈরাগী খালের বুকে। ক্রমে খালটি শুকিয়ে একটি বিশাল দীঘিতে পরিণত হয়। জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ি মানা ব্রাম্মণের জাত বাঁচাতে রুরুর পূর্বপুরুষরা তাদের ভাগের দীঘির অংশটি মাটি ফেলে পৃথক করে নিয়েছিল। রুরুদের দিকের অংশটিকে পাড়ার লোকে বলত, মুসলমানের পুকুর। ঘাটলা ছুঁয়ে কিছুটা জায়গা ঘেরা ছিল বাড়ির মহিলাদের জন্য। সেটা ভেঙ্গেচুড়ে বহুদিন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে কাচারিঘরে সুফি আউলিয়াদের মজলিশ বসতে সেটি আর নেই। যেখানে যজ্ঞডুমুরের গাছগুলো এখনও টিকে আছে সেই জায়গায় ছিল নানারকমের ওষুধী গাছের বাগান। দশ দিকের বৈদ্য কবিরাজ আর ধন্বন্তরিরা বছরে একবার এসে ফলফু্ল, শিকড়বাঁকর, বীজপাতা, ছালবাকল কিনে নিয়ে যেত।
সকাল সন্ধ্যা মন্দিরের ঘন্টা বেজে উঠত মৃদু তরঙ্গে। আর কাঁচা মসজিদে পাঁচবেলা আজান হত সুমধুর সুরে। মুসলমান বাড়ির সাথে পুরোহিত বাড়ির কোন দ্বৈরথ ছিল না। সকালে হুজুর এসে ছেপারা কুরান পড়িয়ে যেত ছেলেমেয়েদের। আবার দুপুরে এই ছেলেমেয়েরাই মন্দিরের চাতালে বসে শুনত বেদ, রামায়ন মহাভারত। ছোঁয়াছুঁয়ি বজায় রেখে হিন্দু ছেলেমেয়েরা দূরে থাকলেও একসময় একসাথে খেলাধূলা করে সন্ধ্যায় যে যার নিজেদের পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে আসত।
সব চেয়ে আনন্দের ছিল, পূর্ববাংলার দুর্গা পুজো। বারোয়ারী আনন্দে শরতের আকাশে যেমন মেঘেরা উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াত, তেমনি হিন্দু মুসলিম ছেলেমেয়েরা পুজো এলেই এপাড়া ওপাড়ার প্রতিমা দেখতে বেরিয়ে পড়ত । পুব্বাংলার দক্ষিণ অঞ্চল ছিল নমঃশূদ্র অধ্যুষিত। ইতিহাসে আছে, ব্রাম্মণ্যবাদের প্রবল আধিপত্যের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ করেছিল এ অঞ্চলের সকলে। এদের দুর্গা আসত আটপৌরে ঘরের মেয়ের মত সাধারণ সধবার মত। দুর্গা আসার খবর হলেই হিন্দু মুসলিম ঘরের বিবাহিতা মেয়েরাও নাইওর আসত বাপের বাড়িতে। পুজোয় মেলা হত। সারা বছর রিহার্সেল করে যাত্রা দলগুলো চলে আসত দুর্গা পুজোর তিনদিনের মেলায়। ঘর গেরস্থালী থেকে হেন জিনিস নেই যা এই মেলায় পাওয়া যেত না। রুরু নিজেও শৈশব কৈশোরে বন্ধুদের সাথে দেদার মেলায় ঘুরেছে।
তো শরতের সকালে যখন পুজো আরম্ভের প্রথম ঢাকে বাড়ি পড়ত তখন রুরুদের কাউকেই ঘরে পাওয়া যেত না। প্রতিমার কাঠামো বানানোর প্রথম দিন থেকে ওরা কেউ মন্দিরের চত্বর ছেড়ে যেতে চাইত না। আর যখন লালনীল রঙিন কাগজ আর শোলার ফুলপাতায় মন্দির সেজে উঠত তখন এক রূপকথার রাজ্য খুলে যেত রুরুদের সামনে। মুসলিমদের যারা খুব কট্টর মানসিকতার তারা দূর থেকে চোখ নামিয়ে চলে যেত। কিন্তু বেশিরভাগ মুসলমান পুজো নিয়ে কোন বিরাগ বা অনুযোগ করত না। শুধু আজানের সময় স্বতস্ফুর্ত সম্মানে কয়েক মিনিট গান বাজনা, ঢোল, কাঁসর বন্ধ থাকত।
রুরু পুরোহিত ঠাকুরদাদের ঘাটে এসে বসে। ভাঙ্গা ঘাট। ঘাস আর বুনো গাছ জন্মেছে ভঙ্গুর জায়গাগুলো থেকে। খুব বেশিদিন নয়। পঁচাশি সালের দিকে ঠাকুরদারা চলে গেছে দেশ ছেড়ে। রুরুর আম্মু চা নাস্তা দিয়ে বলেছিল, যাচ্ছ কেন ভাই ? আমরা কি তাড়িয়ে দিচ্ছি তোমাদের ?
চায়ের কাপের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে ছোটঠাকুরদা বলেছিল, সে ত মিথ্যে করে হলেও বলতে হয় গো বড়ভাবি। এদেশে গঙ্গা নাই, দক্ষিণেশ্বরের কালি মন্দির নেই। হিমালয় নেই। নেই জয় জগন্নাথের মন্দির। আমাদের ছোট বড় সবগুলো ধাম ভারতে। ইচ্ছে করলেই ত যেতে পারিনা। তাই আর মন বসে নাগো এখানে। শুধু মায়া লাগে। যতদিন বেঁচে থাকব, আসব মাঝে মধ্যে।
রুরু এসেছে সুদুর মার্কিন মুলুক থেকে। ওদের জায়গা জমিও বিক্রি করে দিচ্ছে। জীবন জীবিকার জন্য সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে স্বজনরা। কে দেখবে এই বিশাল সম্পত্তি ! রুরুর এক কাকা হারিয়ে গেছে। উনিশ বছর বয়েস ছিল তখন তার। স্থানীয় বঙ্গবন্ধু কলেজে ব্যবসায় শিক্ষায় গ্রাজুয়েশন করছিল আবিদ হাসান সুখ। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে পোষ্টার টাঙ্গাতে গিয়ে ধরা পড়ে থানার হাজতে ছিল দুদিন। একরাতে বাঁশিতে মালকোষ বাজিয়ে রুরুর আম্মুকে শুনিয়ে বলেছিল, ভাবিম্মা কে যেন আমাকে ডাকে। সারাক্ষন ডাকে। ডেকেই যাচ্ছে। আমি মনে হয় চলে যাব কোথাও। আমাকে যেতেই হবে।
ভাবিম্মার আর্তনাদ শুনে ছুটে এসেছিল রুরুর আব্বু।
ছোটভাইয়ের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে সাহস দিয়েছিল, এভাবে ভাবতে নেই রে সুখ। এত এত আপনজনের রক্তের বন্ধন ছেড়ে তুই কোথায় যাবি ভাই ! বলত কে ডাকে তোকে? বল আমাকে ! কে সে জন?
ঘন পাঁপড়িতে ঢাকা মায়াবী চোখদুটি মাটিতে গেঁথে সুখ বলেছিল, জানিনা ভাইজান। আমি তাকে দেখতে পাইনা। শুধু দেখি চলমান দুটি পায়ের সঙ্গে আরও আরও কয়েকটি ধূলিধূসরিত পা। তারা হাঁটছে ত হাঁটছেই। তাদের চলার শেষ নেই। পাহাড় গিরি, সাগর, মরু —
রুরুর আব্বুর বুক কেঁপে ওঠেছিল। তিনি জ্যোতিষ বিদ্যা মানেন না। তার জীবনে কর্মই ধর্ম। কতবার জ্যোতিষীরা এসেছে, সন্তানদের ভাগ্য গণনা করতে। তিনি হাসিমুখে অত্যন্ত ভদ্রভাবে প্রত্যাখান করে গেছেন। কিন্তু দোতলার অন্ধকার একটি রুমে কয়েকটি মজবুত বাক্স আর সিন্দুক পড়ে আছে। সিন্দুকে রাখা আছে কয়েক শত বছর আগের বংশ গণনালিপি। তাদের বংশের কেউ কেউ হারিয়ে যাবে। হারিয়ে গেছেও। কিন্তু এই ভাইটি এই আধুনিক যুগে কোথায় হারাবে ?
মুখের ভেতর মাছ নিয়ে একটি হলুদ জলঢোঁড়া সরসর করে উঠে আসতে গিয়ে রুরুকে দেখে থেমে যায়। ফণা তোলে। এরপর ফণা নামিয়ে গা ভাসিয়ে দেয় পুকুরে। নবদ্বীপের কোথাও কোন জলঙ্গী নদীর তীরে ঠাকুরদারা জমি কিনে ঘর বেঁধেছে। যতদিন বেঁচেছিল বছরে দু বছরে এরপর আরও পরে হলেও বেড়াতে আসত ছোটঠাকুরদা। কিন্তু কখনও কাউকে বেড়াতে যেতে আমন্ত্রণ জানাত না। রুরুর আম্মু কয়েকবার উৎসাহ দেখালেও কি বুঝে ও প্রসঙ্গে আর কথা তোলেনি। ছোটঠাকুরদার পরে আর কেউ আসেনি। রুরুদের পরিবারও এখন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। শুধু রুরু আসে। ফিরে ফিরে আসে। ওর ইচ্ছে করে স্মৃতিগন্ধমাখা পথে হেঁটে ওদের বংশের প্রথম পুরুষের পরিবারকে খুঁজে বের করতে। ঝুমকো জবা আর হলুদ কমলা গাঁদাফুলের বাগান পেরিয়ে ধর্ম এবং সমাজের কাছে পর্যুদস্ত এক বাবার সামনে গিয়ে বলতে, আত্মার সুখই প্রকৃত সুখ গুরু। আপনার ছেলে আপনাকে খুব ভালোবাসত।