================================================================

================================================================
বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে জন্ম আমার। ইস্কুলে ভর্তি হবার পরে দেখলাম, বছরে দুটো পরীক্ষা দিতে হয়, ষান্মাসিক ও বার্ষিক। এই দুটি পরীক্ষাতেই ক্লাসের সহপাঠীদের নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা বা লড়াই ছিল, পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড ও থার্ড হওয়ার জন্য। আমিও সেই লড়াইয়ে ছিলাম। এবং লড়াইয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় স্থান দখল করে স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে এই কৃতিত্বের দরুণ পুরস্কৃতও হতাম। তবে ষান্মাসিক পরীক্ষার জন্য কোনো পুরস্কার ছিল না, শুধুমাত্র বার্ষিক পরীক্ষার জন্য। তা আমি সেই নিতান্ত ছেলেবেলা থেকে ইস্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম তিনটি স্থানের মধ্যে একটি স্থান দখল করার লড়াইয়ে থেকে জীবনের একটা সারসত্য বুঝেছিলাম, যা কিছু দখল বা অর্জন, তা সম্ভব হয় একমাত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে। সেই যে কোন অতীতে মহাভারতের কবি উচ্চারণ করেছিলেন, যুদ্ধ বিনা নাহি দিব সূচগ্র মেদিনী, এটাই চিরকালীন অমোঘ এক উচ্চারণ, যার কোনো বিকল্প হতে পারে না। এবং সেই কৃতিত্বে বা অর্জনে ভাগ বসাতেও পারে না অন্য কেউ।
আমি যে ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম, সেই ইস্কুলের প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম, কেননা তাঁরা সবাই তাঁদের সাধ্যমতো আমাদের সেই স্তরে শিক্ষিত করে তুলতে সচেষ্ট ও যত্নবান ছিলেন। পরবর্তীকালের শিক্ষকদের সম্পর্কে অবশ্য বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকি, শিক্ষকদের মধ্যেও যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব থাকে। বিশেষত যেসব ছাত্র-ছাত্রী যেসব শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেটে পড়ে, তারা পরীক্ষার খাতায় যোগ্যতার থেকে বেশি বেশি নম্বর পায়, কেননা সেইসব শিক্ষক ইস্কুলের পরীক্ষার খাতা দেখে নম্বর দেন। আর সেই নম্বরের সূত্রেই নির্ধারিত হয় পরীক্ষায় প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান। এবং তুলনামূলকভাবে যোগ্যতররা উপেক্ষিত থেকে যায়।
আরও বড় হয়ে যখন সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন হই, তখন সচেতনভাবে অনুভব করি, একই খেলা এখানেও চলছে। এক শ্রেণীর কবি সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের লেখা প্রকাশিত হয় বড় বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত পত্র পত্রিকা ও সংবাদপত্রে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কবি সাহিত্যিকরা এইসব প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করে নিজেদের উদ্যোগে লিখে চলেছেন নিজেদেরই সৃজিত পত্র পত্রিকায় সংবাদপত্রে, যাকে লিটল অভিধায় অভিহিত করা হয়। বলা বাহুল্য, এই সাহিত্যক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা আছে এবং প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হবার লড়াইও আছে। তবে বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান হোক বা লিটল ম্যাগাজিন, তারা প্রতি বছর যেসব কবি সাহিত্যিকদের পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করে, তাঁরা প্রায় সবাই তাঁদের দীর্ঘদিনের চর্চা, শ্রম, অধ্যাবসায় ও স্বকীয়তার জন্যই এই অর্জনের অধিকারী হন। যদিও যাঁরা বা যে কমিটি এই পুরস্কার প্রাপকদের মনোনীত বা নির্বাচিত করেন, তাঁরা যোগ্য হলেও কতটা নিরপেক্ষ, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষত এর পেছনে যে রাজনৈতিক সমীকরণ কাজ করে, তার খবর আর কতজন রাখেন!
আমরা কিন্তু একটা ব্যাপার কম বেশি সবাই জানি যে, যে বিশ্বে আমরা বসবাস করি, সভ্যতা বিকাশের প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে আজকের স্তরে উপনীত হয়েছি বিভিন্ন পর্যায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমীকরণের ধারাবাহিকতায় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের শাসকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়। আর একথাও নিশ্চয়ই জানি যে, বর্তমান বিশ্ব পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অর্থনৈতিক পুঁজির বা ক্যাপিটালের আরাধনায়। আর যাদের হাতে সেই পুঁজি বা যারা পুঁজির মালিক, তাদের কাছে তথাকথিত ‘দেশ’এর প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, বরং তাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘বাজার’। এই বিশ্ব এক বিশাল বাজার, বিশ্বের এক একটা অংশ এক একটা পুঁজিজোটের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে। এবং সেই এক একটা বাজারের অন্তর্ভুক্ত একাধিক দেশ বা দেশের অংশবিশেষ। আবার এইসব বাজারের দখল নিয়ে প্রতি মুহূর্তে চলছে বিভিন্ন পুঁজিজোটের অন্তর্দ্বন্দ্ব, আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ, লড়াই, যুদ্ধ এবং আপোস। আর যেহেতু বাজার, পুঁজিবাদী ভাবনায় তাই সবকিছুই গণ্য হয় পণ্য রূপে। আলমারি, ফ্রিজ, মোটরগাড়ি, চায়ের কাপ, জলের গ্লাস থেকে শুরু করে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্পকলা, ধর্ম সব সব কিছুই। হ্যাঁ, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র পুঁজির দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত পত্র পত্রিকা, সংবাদপত্র, বই, এমনকি তারা এইসব ক্ষেত্রে যেসব পুরস্কার প্রদান করে, তাও। এই পদ্ধতিতেই বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের বাণিজ্যের স্বার্থেই শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্পকলা, ধর্মকে স্পন্সর করে, চালনা করে, ব্যবহার করে, পুরস্কৃত করে। যাঁরা পুরস্কৃত হন এবং সম্মানলাভ করেন, তাঁরা তাঁদের যোগ্যতার জন্যই মনোনীত হন। এটা তাঁদের স্বীকৃতি। আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই। আর তাই পুঁজিবাদী গোষ্ঠীগুলির বাণিজ্যিক স্বার্থ সম্পর্কে অবহিত হয়েও আমরা পুরস্কার প্রদানের এই প্রচলিত রীতিকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো, আমরা স্রোতের বিপরীত প্রতি-স্রোতের কিছু ঘটনাও লক্ষ্য করছি। পুঁজিবাদী জোটের প্রতিনিধি ও মুখপত্র স্বরূপ যেসব রাজনৈতিক দল দেশের ও রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখল করে শাসকের ভূমিকা পালন করছে, তারা কিন্তু সব সময় নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে এবং তাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তারা জনগণকে মনে করছে, তাদের অনুগৃহীত। আর তাই তারা যদি শাসকশ্রেণীর কোনো কার্যকলাপ ও নীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে বা আন্দোলন করে, তবে শাসকশ্রেণী তা দমন করতে হিংস্র হয়ে ওঠে। নেমে আসে নির্যাতন ও অত্যাচার। কিন্তু যাঁরা সত্যিকারের সৎ ও প্রতিবাদী মননের মানুষ, তাঁরা প্রতিবাদ করবেনই। আমরা জাঁ পল সার্ত্রের নাম জানি, যিনি ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। আমরা কবি শঙ্খ ঘোষের কথা জানি, যিনি তৎকালীন শাসকশ্রেণী দলের প্রধানের হাত থেকে সরস্বতী পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ১৯৯৮ সালে। সম্প্রতি এরকম আরও কিছু ঘটনার কথা আমরা জানি, যাঁরা সরকারী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন তাঁদের বিভিন্ন কীর্তির জন্য, কিন্তু শাসকশ্রেণীর অন্যায় আচরণ ও শোষণের প্রতিবাদে তাঁরা সেইসব প্রাপ্ত পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, আমরা তাঁদের এই প্রতিবাদী সত্ত্বাকে স্যালুট জানাই। আর এখানেই শাসকশ্রেণী পড়েছে ফ্যাসাদে। তাদের মুখোশ আরও কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। মরিয়া হয়ে তাই তারা টেনে আনতে বাধ্য হয়েছে তাদের ফ্যাসিজিমের মুখ।
সম্প্রতি সংবাদপত্রে পড়লাম, “সংসদীয় প্যানেল বিস্তর ভাবনাচিন্তার পর ‘অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি’ ঠেকানোর পথ বার করেছে – অকাদেমি পুরস্কার দেওয়ার আগেই প্রাপকদের থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হোক যে, কোনো অবস্থাতেই তাঁরা এই পুরস্কার ফিরিয়ে দেবেন না”। অদ্ভুত প্রস্তাব! মুচলেকা দিয়ে পুরস্কার নিতে হবে? প্রাপকরা রাজী হবেন? এ তো সাংঘাতিক অসম্মান প্রদান পুরস্কার প্রাপকদের! শাসকশ্রেণী মনে করে, পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া মানে দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করা। তাই? কিন্তু প্রাপকরা যে পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন, তা তো অহেতুক নয়, তার পেছনে কারণ আছে। সরকারের অন্যায় ও জনবিরোধী আচার আচরণ ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা পুরস্কার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের এই প্রতিবাদ যদি দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করে, তাহলে সোচ্চারে বলতেই হয়, দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে মূলত সরকারের তথা শাসকের ফ্যাসিজিম নীতি ও কার্যকলাপ। আরও একটা কথা, এখানে অকাদেমি পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো জানি, এটা কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং স্বয়ং শাসিত একটি সাহিত্যসংস্থা। তাহলে এখানে সরকারী হস্তক্ষেপ কেন? ফ্যাসিবাদী মুখটা যে বড্ড বেশি উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে!
আমার জানা নেই, এরপর মুচলেকা দিয়ে দেশের কোন কোন সাহিত্যিক অকাদেমি পুরস্কার গ্রহণ করবেন আগামীতে। তবে অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শাসকশ্রেণীর অনুগত ও পদলেহনকারী সাহিত্যিক ও শিল্পী অনেকেই আছেন আমাদের দেশে। সব দেশেই থাকেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে শুধু এইটুকুই বলতে পারি, আপনাদের যোগ্যতা আছে, তাই আপনাদের মনোনয়ন হয়েছে। আপনাদের সেই যোগ্যতা ও সৃজন ক্ষমতার জন্য ধন্যবাদও জানাই। কিন্তু যেহেতু আপনাদের মেরুদন্ডটাই নেই, তাই আমাদের কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মান আশা করবেন না। আমরা নিরুপায়।