গুলমোহর গাছটিকে পৃথিবীর মনে হয় না। সে অপাপবিদ্ধ। হামেশাই আত্মীয়তা বহির্বিশ্বের সঙ্গে। গাছটির শিকড় ছুঁয়েছে ভৌমজলে। ওখান থেকেই জীবন পায়। বাড়ে। বাড়তে বাড়তে ফুল হয়। ঝরে। আবার ফুল… এভাবেই বারো মাস। একদিন এক সাহেবের ভূত ফুল কুড়ায়। তার ঘর কবরবদ্ধ। দেহ, মাটি এবং মাটির মঙ্গলে অপরিসীম স্তর। প্রতি স্তরই সাহেবের প্রিয়। মাটির অত্যন্ত কাছে ঘনিয়ে আসছে ফুলটির আঁশটানি গন্ধ। সাহেবের ভূত বুঝল, মনখারাপ গাছটির। মনখারাপ হলেই অমন অদ্ভুত গন্ধ ছেয়ে যায়।
কবরের বাইরে তখনও সকাল। আলোয় অসুবিধা হচ্ছিল সাহেবের। সে গাছটার হিতব্রতী। কথা বলতে চাইছিল। অথচ সন্ধে না হলে তার সূক্ষ্ম দেহও সমাধি ছাড়তে পারছে না। এরমধ্যে সাহেবের মনে পড়ে যাচ্ছিল মোহরের কথা। মনে পড়ছিল নদী। জল। নৌকাবিহার। জাহাজের ভোঁ। মোহর বায়না ধরেছিল, নৌকায় উঠবে। যিশুঘরের সামনে যে নদী, সূর্যঘড়ি মিলিয়ে তারা গেল সেখানে। পাড়ে পা এলিয়ে বসে নৌবাহী। ‘যাবেন?’ এই ঘাট যে ভ্রমণকারীর জন্য নয়, তা তারা জানত না। নাছোড় মোহর। উঠবেই সে নৌকায়। আর্থার শুধাল। একঘণ্টা নদী ঘোরানোর সওদা। ছোট নৌকা। অনুজন্মা ঢেউ দুলকি চলে ওদের জল চেনাল। খাঁটি জল। শান্তির ছায়া ঘিরে নৌকার ছাউনি। মোহর হাত রাখে আর্থারের হাতে। ওর ঘুম পায়। বুকে মাথা রাখে। শোনা যায় সাইরেন। জাহাজ আসছে। বড় জাহাজ। জাহাজ গেলে ছোট ঢেউয়েরও যৌবনপ্রাপ্তি ঘটে। মোহর জড়িয়ে ধরে আর্থারকে। তার ঠোঁটে কন্দর্পগন্ধ। নৌবাহীর বৈঠাযষ্টিতে জল লেগে। তা ছিটকে লাগে মোহরের ঠোঁটে। আর্থার জিভের আগল দিয়ে জলপান করে…
ততক্ষণে সন্ধে হয়েছে। পাতাল থেকে আর্থার ডাকছে গাছটিকে। গাছটি মাথা নাড়ায়। কবরের পাশেও যিশুঘর। নদী নেই। জল আছে, মাটির অনেক নীচে। আর আছে শাখাদের সত্যমিথ্যা। আর্থার গিয়ে বসে মিথ্যার শাখায়। দেখে, শহরটা অনেক বদলে গেছে। রাতেও বড় বেশি আলো।
গাছটি বলে, ‘সেদিনের মৃত্যু মনে আছে?’
—আছে। ভালোবাসাটাকে ওরা মেরে ফেলে তৃপ্ত হল।
—ভ্রূণটাকেও ওরা…
—ভালোবাসার মতো ঘৃণাও যে অন্ধ!
আঁশটানি গন্ধ অনেকটাই কম। আর্থার এসেছে মোহরের কাছে। পরজন্মে সে গুলমোহর। তবে, আর্থার এখনও… মোহর বলে, ‘ওই শাখাটি দেখছ, পল্লববেষ্টিত। ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহই ওই শাখার পাতা।’
আর্থার বলে, ‘ভূতকে ইন্দ্রিয় চেনানোর তুমি কে? তুমি শাখা। আমি তার ফল হব। যদি একজন মানুষ আমার মধ্যে থাকে এবং আমি তার মধ্যে, সে অনেক ফল দেবেই। আমাকে ছাড়া তুমি অসম্পূর্ণ। যদি তুমি আমার মধ্যে না থাকো, এমন একটি শাখার মতো শুকিয়ে যেও। আমি ভূত হয়েই তোমার মিথ্যা ডালে বসব। কারণ তোমাকে ভালোবাসাটাই একমাত্র সত্য।’
যেটুকু হাওয়া দিচ্ছিল, থেমে যায়। অদ্ভুত একটা অন্যমনস্কতা গুলমোহর গাছটির। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল ঘৃণা, হত্যা, খুন… থমকে যাওয়া হাওয়ায় ফুল ঝরে পড়ে আর্থারের কবরের ওপর।
Facebook Comments Box