================================================================
================================================================
সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় শিক্ষা সংস্থানগুলি মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাস থেকে ডারউইন সাহেবের বিবর্তনের তত্ত্বটি অপ্রয়োজনীয় বিধায় ছেঁটে ফেলেছেন। যেমন ছেঁটে ফেলেছেন গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, পর্যায়সারণি ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে সিলেবাসের ভার কমানোর প্রক্রিয়াকে। গণতন্ত্র বা বহুত্ববাদের ঘাড়ে কোপ পড়ল কেন তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। কিন্তু পর্যায়সারণির মত নিরীহ নিউট্রাল একটা টেবিল কী দোষ করল! সম্ভবত কোল্যাটারাল ড্যামেজ। অন্য বিষয়ে সিলেবাস ছাঁটাইকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করতে রসায়ন সিলেবাসের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়টিই খাল্লাস। তবে এমনও হতে পারে, যে কর্তা বা কর্তারা সিদ্ধান্তটি নিলেন তাদের কেউ হয়তো স্কুল জীবনে ওই বিতিকিচ্ছিরি টেবিলটা নিয়ে খুবই নাজেহাল ছিলেন। সুযোগ পেয়েই তাই প্রতিশোধ তুললেন। হ্যাঁ, আমাদের ‘গতান্ত্রিক’ দেশের প্রশাসন এভাবেই চলে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ আধিকারিক কিংবা জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ সরকারি নীতির নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়।
যাই হোক, এ প্রবন্ধের আলোচনার বিষয় এটা নয়। তাই আসল কথায় ফেরা যাক। চোরের মন বোঁচকার দিকে প্রবাদটিকে সত্য প্রমাণ করে এই মুহূর্তে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি তাদের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ীই কাজ করে চলেছে। পৃথিবীর আর পাঁচটা মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে তাদের কোনো তফাত নেই। এই কলকাতার বুকে ক্রিশ্চানদের পরিচালিত একটি বিখ্যাত কলেজ রয়েছে যেখানে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ডারউইনের তত্ত্ব পড়ান হত না (এখন হয় কি না জানা নেই)। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইমরান খান বলেছিলেন ডারউইনের তত্ত্বের মত একটি আধাখ্যাচড়া তত্ত্ব মানুষকে শেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমেরিকা এবং ইউরোপের তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজেও এমন অনেক মানুষ এবং সংগঠন আছে যারা ওই ডারউইনের নাম শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। অর্থাৎ কিনা হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান নির্বিশেষে মৌলবাদীদের চক্ষুশূল ওই বুড়ো সাহেব। কিন্তু কেন? কী এমন করলেন তিনি যাতে এদের সকলের রাগ গিয়ে পড়ল ওঁর উপর। উত্তর জানতে ইতিহাস খুঁজে দেখতে হয় একটু।
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর “অন দ্য অরিজিন অফ স্পিশিস” অর্থাৎ, প্রজাতিগুলির উৎপত্তি ঘটল কীভাবে সেই বিষয়ক আলোচনা। আলোচনার ভিত্তি ছিল প্রকৃতিবিদ হিসাবে তাঁর দক্ষিণ আমেরিক, বিশেষ করে গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জে বিভিন্ন প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ। ডারউইনের আগে পর্যন্ত এই বিষয়ে মতামত যা ছিল তা হল বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের নিদান। বলতে গেলে সব ধর্মই মহাবিশ্ব পৃথিবী মানুষ ইত্যাদি নিয়ে বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে। কারণ সৃষ্টিকর্তা হিসবে নিজের নিজের ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ধর্মের গোড়া মারা যায়। প্রাগিতিহাস-ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে যখন প্রাচীন ধর্মগুলি সংহত হয়ে উঠছিল তখন লিপি-বলিয়ান মানুষ রচনা করে ফেলল ঈশ্বরমহিমা। সকলেরই বক্তব্য প্রায় এক গতে বাঁধা। ঈশ্বর নামে এক সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন সব কিছুর মূলে। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ সহ সমস্ত প্রজাতিকে। আজকে বিভিন্ন প্রজাতিকে আমরা যেমন দেখি তিনি ঠিক সেরকমই সৃষ্টি করেছিলেন। সৃষ্টির পর থেকে তাদের আর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ঘটার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ করবেটা কে? করলে যে তা হবে খোদার ওপর খোদকারি। আমাদের সাহেব অবশ্য এমন সব ছেলেভুলনো কথায় বেওকুফ বনার লোক ছিলেন না। দুনিয়া ঘুরে যা দেখেছেন বুঝেছেন তার ওপর ভর করে তিনি বললেন প্রজাতিগুলো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নিতে নিতে ক্রমবিবর্তনের পথে তাদের উদ্ভব। বহুকাল আগে এদের অস্তিত্বই ছিল না। তখন যারা ছিল, অর্থাৎ এদের পূর্বপুরুষরা, তারা ছিল একেবারে অন্যরকম।
হায় হায়! এ বুড়ো যে একেবারে গাছের গোড়ায় কুড়ুল চালায় গো! সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেননি? তাহলে তাঁর জন্য এত যে দেউল গির্জে মসজিদ, এত যে ধূপ ধুনো প্রদীপ সে সব মিথ্যে! বুড়োর কথা মানতে গেলে যে বিশ্বাসের হাঁড়ির ষোল আণাই বেবাক ফাঁকি হয়ে যায়। গোঁড়া ধার্মিকরা যে তাঁর কথায় একেবারে রে রে করে উঠবে সে কথা বুড়ো বিলক্ষণ জানত। তাই তত্ত্ব আবিষ্কারের পর চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে ছিল টানা বিশটি বছর। ধর্মের বিরুদ্ধে গেলে কী হতে পারে সে নিয়ে জিওর্দানো ব্রুনো বা গ্যালেলিওর উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে কিনা। চার্চের আঁতে লাগলে পুড়িয়ে মারা বা অন্যান্য অত্যাচারের ঘটনা ইউরোপে সেদিনও তো আকছার ঘটত।
ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে তথাকথিত ধার্মিকদের আপত্তি রয়েছে আরেকটা জায়গায়। ধর্মগ্রন্থগুলো জীবিতের রাজ্যে মানুষকে দিয়েছে এক বিশেষ স্থান। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে মানুষের স্থান বাকিদের ওপরে। কিন্তু সাহেবের শ্যেনচক্ষু পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করেই ছাড়ল যে এসবই মিথ্যে, মনগড়া। বাকি জীবকুলের থেকে মানুষ কোনোদিক থেকেই আলাদা নয়। সব ক্ষেত্রেই যেমন প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত হতে হতে এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে, ঠিক তেমনই বানর জাতীয় প্রাণী থেকে উদ্ভব ঘটেছে মানুষের। এ বড় সর্বনেশে কথা! শেষে কিনা বাঁদর! সাহেব আরও বললেন, বিবর্তন ব্যাপারটা আসলে একেবারে লক্ষ্যহীন। কোনো মহৎ উদ্দেশ্য পুরণে তা ছুটছে না। অর্থাৎ কিনা মানুষ প্রজাতিটির সৃষ্টির পিছনে কোনো ঐশ্বরিক ইচ্ছা-টিচ্ছা নেই। তাই রবি ঠাকুরের সেই যে গানটা, ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে’ আক্ষরিখ অর্থে নেওয়া যাবে না। তাছাড়া মানুষ সৃষ্টির পিছনে বিধাতার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই, এ কথা মেনে নিলে মানুষের আর বিধাতার প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি থাকবে না। ফলে পাপের ভয়ডরহীন মানুষ আর অনৈতিক কাজ করতে দুবার ভাববে না। সমাজে তৈরি হবে চরম বিশৃঙ্খলা।
কিন্তু এসব বলে যে ডারউইন সাহেবের বিরুদ্ধে খুব একটা সুবিধে করা গেছে তা নয়। তাঁর আবিষ্কারটি এতটাই মৌলিক যে আজ প্রায় ১৭০ বছর হতে চলল, তত্ত্বের গায়ে দাগটি পর্যন্ত কেউ লাগাতে পারেনি। সুদূর ভবিষ্যতেও কেউ পারবে তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বলতে কী, ঈশ্বরের ভূমিকাকে এ তত্ত্ব কোনো চ্যালেঞ্জ-ট্যালেঞ্জ করেনি, স্রেফ এটুকু প্রমাণ করে দিয়েছে যে জীবকুলের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা কোনো কালেই ছিল না। এমন তত্ত্বকে ধর্ম-ব্যবসায়ী এবং তাদের রাজনৈতিক সাগরেদরা যে মুছে ফেলার চেষ্টা করবে তাতে আর আশ্চর্য কী।
ফরাসি প্রহসনমূলক দৈনিক লে পেটিট লুনে-তে ডারউইনকে ব্যাঙ্গ করে অ্যান্ড্রি গিলের কার্টুন (১৮৭১?)