বাজারে যেতে যেতে বয়স বেড়ে গেল । এখনো দরদাম করে এটা সেটা কেনার ধরণটা রপ্ত হল না । রোজই কিছু না কিছুতে ঠকে আসি । বেশি দামের ডাল নিতেই , মাপের হিসেবে কম দিয়ে দিল । দিল বিস্কুটের পিঁপড়েধরা প্যাকেট । পচা কুমড়ো । হেরে যাওয়ার লটারিটিকিট । মিয়োনো হাসির এড়িয়ে যাওয়ার উত্তরে: আমার গদ গদ আবেগ — নিজের কাছেই কেমন যেন বেকায়দায় ফেলে দেয় আমাকে ।
ঠিক করি , আর নয় । অনেক হয়েছে । কিছুতেই পচা টমেটো একশ টাকা কেজি দরে কিনব না। হঠাৎ আমাকে চিনে উঠতে না-পারা ঝন্টুমামাকে মনে করিয়ে দেব না , আমি ভালোদির মেয়ে — সেই সে বার ….
পারি না । বাজার আমাকে চিনে গেছে । সুযোগ বুঝে গছিয়ে দেবেই ফালতু পোকাধরা । রঙ করা নকল । ঠকাবেই । কখন যে তুলে নেবে পার্স । ভেঙে দেবেই দেবে মন ।
মন ভেঙে যাওয়ার পর দেখতে পাই নিজের বেকুব মুখখানি এমন করুণ , পালানোর পথ না-পাওয়া ! এ বাজারের কোনো শেষ বা শুরু নেই নাকি ? নিজের বাইরে পা রাখলেই যে বাজার । ঘরে বাইরে সর্বত্র ফড়েদের চিৎকার তুমুল । রঙ করা মুলো আর হাইব্রিড কইমাছ প্যাট প্যাট করে এমন চেয়ে আছে , যেন কাঁচাই গিলে খাবে আমাকে । নিজেকে কেবল খাদ্যবস্তু মনে হয় । এ খানিক কামড় দেয় । ও খানিক খাবলে , ছিঁড়ে নেবে । বাজারের কী প্রকান্ড সমাজ ! সমাজমাধ্যম । চেষ্টা করি বেশ চালাকচতুর ভাবে হাঁটব । আধুনিক হয়ে উঠব ননস্টিক কড়াই কিনে । অথচ বোকামি কড়াইয়ের গা ছাড়ে না । সমাজ কেবল শুষে নেয় যা কিছু স্বতঃস্ফূর্ত আর স্বাভাবিক । মাতব্বর বলে ওঠে , খেজুরের গুড়ের থেকে খেজুরে-আলাপেই কাজ হয় আজকাল । স্টেজে উঠলেই মুখস্ত বলতে হবে স্তব-স্তুতি । পিঠ চাপড়ে দেওয়ার সময় পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হবে । গাধা তো । বয়ে নিয়ে যাবে বেশ । বয়ে নিয়ে যাবে কার যেন কর্মফলের ব্যাগ । লন্ড্রি থেকে কাচিয়ে আনা দায়িত্ব কর্তব্য । কবে কোন উপকারের দেনার বোঝা । ব্যাংকের চোখ রাঙানো ফাইল পত্তর । ম্লান হলুদ বাল্বের নিচে আটা ভাঙানোর কলে মাগনায় ওভার টাইম খাটা … ইত্যাদি । তা ভাল।
তবে হাওয়া কোন দিকে বইছে কিছুতেই আরেক ধরণের বোকারা টের পায় না । ক্যাবলাকান্ত থতোমতো মুখ নিয়ে একবার এ দলের জলের বোতল এগিয়ে দেয় তো একবার ওই পার্টির পিপে খুলে তেল ঢেলে আসে খানিক । ঠিক মত পাঁকাল মাছটিকে বাগে আনতে পারে না । নাকানি চোবানি দস্তুর মতো খেতে খেতে নাটবল্টু খুলে যায় । হাওয়া খুলে যায় চাকার । বোকারা বুঝতেই পারে না বাজার আর সমাজ দুজনে মাসতুতো ভাই । তোলা তুলবে নীলাভ স্বপ্নটুকু । স্টেজ পাইয়ে দেবে , খবরের কাগজের নিজস্ব ভাষার গন্ডিতে বেঁধে দেবে দর , টেনে দেবে রেখা । বোকারা কেমন না জেনেই চালান হয়ে যায় লোভের কাছে । বিখ্যাত কোম্পানির লেবেলের কাছে। এই সব বোকারা নিজেদের চালাক ভাবে খুব । ভাবে কেউকেটা টেউকেটা । সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক এরা শিখতে চায় দ্রুত ।
অবশ্য বোকাদের আছে রকমফের । কেউ বা নিয়তিকে খণ্ডাতে পারে না । যেমন আমি । সীমিত ক্ষমতা নিয়ে ,তুচ্ছ নাম নিয়ে , প্রচন্ড লাফালাফি করি । পাউডার মাখি । যেন স্টেজে উঠলেই আমি কেট উইনস্লেট । স্টেজে উঠলেই বুঝি বিনোদিনী দাসী আমি । নয়ত আমিই ফ্রিদা কাহলো , কমলা দাস কিংবা অমৃতা প্রীতম । হায় ! একটা বাহবা , একটা লাইক আমাকে কেমন আমার থেকে কিনে নেয় । আমার ছোটবেলা থেকে , মায়াবতীমেঘ-রঙা মন খারাপ থেকে , ইচ্ছের থেকে । আমাকে কিনে নেয় অচেনা অজানা মানুষদের হাততালির শব্দ । লাল নীল কমেন্ট । ফোঁপড়া বন্ধুত্ব আর চোরাবালির হাতছানি । আসলে প্রমোদের ভিড়ের ভিতরে যে হতাশার ঘুণপোকা বীজ রেখে যায় , তা বুঝতে পারিনি বোকা বলেই তো । লিখিনি মন দিয়ে চিঠি । কেবল ঠিকানায় পৌঁছতে চেয়েছি । আকাশ ছোঁয়া ঠিকানায় । সামান্য আমার মুখখানা কেমন খাপছাড়া লাগবে সেখানে ভেবেও দেখিনি । কেবল পৌঁছতে চেয়েছি । চেয়েছি ‘ স্টার ’ হতে । যত স্টার হতে চেয়েছি তারা ভরা আকাশ ভুলেছে আমাকে । ‘ক্লান্তি নামে গো ’গানটি ভুলেছে । তোমার আমার বিরহের অন্তরালে সেতু বাঁধার গানটিও ভুলে গেছে আমার কথা । আমাকে ভুলে গেছে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া লক্ষ্মী পুজোর আল্পনা -উঠোন । সবুজ চোখের বেড়াল ছানা । হলুদ খাতার ফুটনোট । মেঘেরা । লুকোচুরি খেলা । আর একটা পুরোনো দৈনিক বসুমতী । লাল হয়ে আসা ‘জারি বোবাযুদ্ধে’র পাতা । লজেন্স ওয়ালা আর চিনতে পারে না দেখে । আসলে পাউডারে পাউডারে মুছে দিচ্ছি নিজেকে । নিজেকেই বাস্কেটের ভিতরে দিচ্ছি ছুঁড়ে … বল । কঙ্কালের ভয়ঙ্কর সাদা হাসির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি । নিলাম হয়ে যাচ্ছে আমার সত্যি যা-কিছু ।
বোকা আমি । বড্ড । বুঝেও বুঝিনি , কখনো Munch -এর মতোন একটি কাল ব্যাপী আর্তনাদ আঁকতে পারব না । ভ্যানগঘের মতোন রাত্রির আকাশে আঁকতে পারব না সুরেলা যোগাযোগ নক্ষত্রমন্ডলীর ।
তেমন প্রতিভা কই আর যে রুখে দেবে সময়কে ? যে কবিগুরুর মতো ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে ’ পঠিত হবে ? সামান্য ক্ষমতাটুকু নিয়ে স্টেজে উঠে বোকার মতন খরচ করে ফেলি নিজেকে । সময় নষ্ট হয়ে যায় । বাজার থেকে , হাততালির জেল থেকে , একটু অন্যরকমে যদি পালাতে পারতাম !
নিজেকে নিজের মতো করে যদি দেখাতে পারতাম আকাশ বাতাস পাহাড় সমুদ্র আর তাহিতি দ্বীপকে ! দেখাতে পারতাম মার । ঘা । কালশিটে । সেলাইয়ের দাগ । কান্না । এবং না-মরা স্বপ্ন । টলটলে এক ছোটবেলা । ঝাঁকড়া কদমগাছ । ঝেঁপে বৃষ্টি আসা । প্রেম আসা । আবেগের বন্যায় ভেসে একটু আলিঙ্গন করতে পারতাম যদি নিজেকেই ! ওই মাসতুতো দুই ভাইয়ের নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে ।
মুখোশের ব্যবহার জানে না কারা ?ওইই যে … ওই তো , দু একজন একদম নিজের মতোন করে বেঁচে থাকা । নিঃস্বার্থ ভালো- চাওয়া ওরাই তো । দিক না ভীষন বকুনি । আহ , কতদিন কেউ ভালোবেসে বকেনি আমাকে ! খুব খুব করে বকে দিয়ে ওরাই বলুক না হয় : যদি বোকাই হও হতে কি পার ‘টুয়েলফথ নাইট ‘ ’নাটকের সেই ‘ফেস্টে ’ র মতো । যে নাটক জুড়ে বলে যায় , “Better a witty fool than a foolish wit.” কিংবা ‘‘ Youth’s a stuff will not endure” — এমন সব অপূর্ব কথা ।
আরেকটি ধরণ আছে বোকাদের । ভ্যাবলাদের । যারা অদ্ভুত মতো হাসে , কেন হাসছে নিজেই বোঝে না । মুক্তো পেলেই ছড়িয়ে ফেলবে উলুবনে । এমনতর বোকা বোকা যারা , সব বুঝেও তারা তো নিজেকে ছেড়ে দেয় অনায়াসে । সেধে উপকার করে আসে । অপমানিত হবে জেনেও যেচে জিজ্ঞাসা করে কুশল । কিনতু ধার ধারে না নিত্য নতুন কৌশলের পাউডার মাখা বা মাখানোর । সরলতা আর বোকামি এক নয় যদিও । তবু কি একটা সম্পর্ক আছে যেন । সহজ সরল মানুষেরাও জগতের সমস্ত জট আর কূটকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন । হৃদয় তাঁদের আকাশ বা সমুদ্রের মতো ।
কেউ কেউ এমনও হন যে আহত হংসীর মতো হঠাৎ কোলে এসে পড়লে কোনো ব্যথা তিনি চমকে ওঠেন । জগতের সকল ব্যথায় তীব্র নীল হয়ে পড়ে তাঁর অন্তর । দুঃখের কারণ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন মাঝরাতে চুপি চুপি । রাজার পুত্র হয়েও ঝাঁপ দেন শত কষ্টের মধ্যে যেচে । বোকা তিনি ? তবে যে এমন মানুষটি যেখানে যেখানে পা রাখেন সেখানেই ফুটে ওঠে মনসিজ !
শীর্ণ আপেলবিক্রেতার মুখের দিকে চেয়ে আমাদের সিদ্ধার্থদা ইচ্ছে করে ঠকে এসেছিল টাকা । চালাকচতুর,স্মার্ট , চকচকেদের ভিড়ে বোকা টাইপের সিদ্ধার্থদা বেশ বেমানান । বিয়েবাড়ির ভিড়ে এক কোণে আড়াল খুঁজত । জানত ওকে নিয়ে মজা করা হবে , নানান ঠাট্টার কেন্দ্র হয়ে উঠবে সেই । একটু বোকা বোকা একটু ভীতু আর অনেক খানি ক্যাবলা সিদ্ধার্থদা লাস্ট ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরার সময় স্টেশনের গা ঘেঁষে ভিখিরিদের সংসার দেখত । মাইনে পেয়ে তখনকার কড়কড়ে একশো টাকা রেখে আসত ঘুমন্ত কোনো ভিখিরি মা আর শিশুর মাথার কাছে । আমাদের পিসিমনির মেয়ে , স্মার্ট , ডাকসাইটে সুন্দরী , যশোধরাদি সিদ্ধার্থদার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিল খুব ।
বোকাদের ইংরিজিতে বলে ‘fool ’ । আর ‘ ফুল বলে ধন্য আমি মাটির পরে ’। ফুলেরা তবে কি ‘fool’ ? পৃথিবীকে একটু সুন্দর করতে পারলেই কী খুশি ! ভূমির পরে ফুটেই তার চাওয়াটুকু সন্তুষ্ট। হও না ওই ফুলেদের মতোন । নিজেকে ঠকানো ঠিক নয় মোটে পাউডার মেখে । ফাঁপা হট্টমেলার ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে । ‘ধন্য আমি ভূমির পরে’র ভূমিটুকু বন্ধক রাখা নয় মোটেই ভাল। বাজারের কাছে , নষ্টের কাছে , অপচয়ের কাছে। সময়ের।