এক
দুর্গা বললেই আমার চোখে ভেসে ওঠে, পথের পাঁচালীর সেই ছোট্ট মেয়েটার চেহারা। যে তার ভাইয়ের হাত ধরে রেলগাড়ি দেখতে ছুটে যায়। তার মৃত্যুশায়িত অনুজ্জ্বল দুটি চোখ। গভীর ও মজা এক দিঘীর আদল।যেখানে তরঙ্গ নেই। মাছেদের সাথে অসহায়তা ঘুরে ঘুরে পাক খায়। মনে পড়ে ইন্দির ঠাকুরুণের কথা। বালবিধবা ভাইয়ের সংসারে গলগ্রহ। তবু সংসারের মায়া যেন তাঁকে ছাড়তে চায় না। তাঁর কাঠ হয়ে মরে পড়ে থাকার দৃশ্যটা মনে পড়ে। তার সাথে ঢাক, আলো ও উৎসবের দশভূজাকে যেন মেলাতে পারি না। যুগ যুগ ধরে নারীকে পায়ের নীচে রেখে চারদিন ধরে তার পুজো ও তার অনুষঙ্গে উৎসবকে গ্লোরিফাই করে তাকে দেবী বানিয়ে দেওয়ার কোনও Justification ও খুঁজে পাই না। বিসর্জন বরং আমার কাছে অনেক যৌক্তিক। মনে হয়, যেন বলা হলো চারদিন ধরে তোমায় তোল্লাই দেওয়া অনেক হয়েছে, এবার নিজের আসল পরিচিতিতে ফিরে যাও। আমরাও ফিরে যাই আমাদের পুরোনো অভ্যাসে। ফিরে যাই ঠিকই কিন্তু ঐ রুগ্ন ও অনুজ্জ্বল দুটো চোখ আমায় হন্ট করে সারাবছর। বিশ্বাস ও তথ্য আমায় চুপিচুপি জানায় , এই ধর্ষকামী দেশে, দুর্গারা জন্ম নেয় শুধু ঝরে যাওয়ার জন্য।
যাই হোক, সম্পাদকের অনুরোধে এই উৎসব সংখ্যায় লেখার শুরুতেই কিছুটা অপ্রীতিকর কথা বলে ফেললাম। সেজন্য সবাই ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন আশাকরি। আসলে আমার কোনও উৎসব নেই। পরিবারের কথা ভেবে অংশগ্রহণ হয়তো করতে হয়, কিন্তু আনন্দিত ঠিক হতে পারি না। কারণ অনেক। পরে কখনও বলা যাবে।
দুই
আর্যদের ভারত প্রবেশের আগে এই দেশের মূল নিবাসীদের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিলই। তবে তখন মূলত প্রকৃতিকেই মাতৃজ্ঞানে পুজো হতো। তবে তা দশহাত ও প্রহরণধারী দূর্গার রূপে নয়। যখন বেদ রচিত হলো, তখনও দুর্গার কোনও অস্তিত্ব বেদে দেখা যায় না। বেদে শুধুই পুরুষ দেবতা ও শক্তির জয়জয়কার।
তবে বাঙালীর দুর্গাপুজোর এই বর্তমান রূপ ও উৎসব হিসেবে তার পালন প্রথমে আমরা দেখতে পাই সপ্তদশ শতকের শেষভাগে। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে, পলাশীর যুদ্ধের পরের সময় থেকে। ইংরেজ প্রভুদের খুশী করতে বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করেন জমিদার সম্প্রদায়। সেই সময়, পুজোর চারদিন জমিদারবাড়ীতে সর্বসাধারণের প্রবেশ ও অংশগ্রহণ অবারিত থাকলেও সেই পুজোকে ঠিক সর্বজনীন পুজো বলা যাবে না। সেই সময় ইংরেজ প্রভুদের খুশী রাখতে লক্ষ্ণৌ, বেনারস থেকে নামী বাইজি আনাতেন জমিদারবাবুরা। নাচগান ,খানাপিনার ব্যবস্থা হতো। খুব খুঁটিয়ে যদি লক্ষ্য করা যায় তবে দেখবেন এখনও পুজোর পরে যে বিজয়া সম্মেলনী হয় এবং ডিজে সহযোগে চটুল নাচগান চলে, তা আর কিছু নয়, ঐ কালচারেরই সংক্ষিপ্ততম রূপ।
আবার পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দুর্গাপুজোকে মাধ্যম করেই ইংরেজ বিরোধীতা ও বৈপ্লবিক মতার্দশের প্রচার প্রসার বেড়ে ওঠে। দেবীকে দেশমাতৃকার ভূমিকায় উপস্থাপন করা হয়। এবং মায়ের শৃঙ্খলমোচনে পথে নামেন হাজার হাজার যুবক যুবতী।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে জমিদার শ্রেণী দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে পুজোয় তাঁদের সেই প্রভাব প্রতিপত্তি আর থাকে না। কিন্তু দুশো বছরের কলোনিয়াল শাসনে ততোদিনে দুর্গাপুজো বাঙালির এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ফলে পুজো চলতে থাকে। আবির্ভাব হয় বারোয়ারী পুজোর। সর্বজনীন কথাটা এই সময় পুজোর সাথে ওতপ্রোত হতে থাকে। সময়ের নিয়মে ও মানুষের রুচির প্রভেদে এই পুজোর বহিরঙ্গে কিছু বিবর্তন এসেছে শুধু। খোলনলচে বদলে যায়নি।
তিন
নিজের কথা বলি। আমার বেড়ে ওঠা শিলঙ পাহাড়ে। বৃষ্টিবহুল স্থান হওয়ায় শিলঙ এ শরৎকাল সেই অর্থে নেই। শরতের আকাশ, পেজাঁ তুলোর মতো মেঘ প্রায় নেইই। কাশফুল তো পাহাড়ে দেখাই যায় না। পুজোর সময় থেকেই আস্তে আস্তে শীত নামতে থাকে শহরে। যাই হোক, পুজোয় যেমন সবাই নতুন জামাকাপড় পায়, আমিও পেতাম। বাড়তি হিসেবে বেশ কিছু অতিরিক্ত জামা মামাবাড়ী থেকে। তবে তা নিয়ে কোনওদিন তেমন উদ্দীপ্ত হয়েছি মনে পড়ে না। পোশাক নিয়ে আমার তেমন হেলদোল ছিল না কখনও। মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে যেতাম। প্রথমে মা বাবা ও পরে বন্ধুদের সঙ্গে। বিয়ের আগে তৎকালীন প্রেমিকার সঙ্গেও বেশ কয়েকবছর। শিলঙে সে সময় প্রায় তিরিশ চল্লিশটা পুজো হতো।এখন হয়তো সংখ্যাটা বেড়েছে। ছোট শহর তাই তিনদিনেই প্রায় সব প্রতিমা দেখে নিতাম। তবে দুটো বিষয় খুব আনন্দ দিতো। প্রথমত এই সময় স্কুল ও কলেজে বেশ আট দশ দিনের ছুটি থাকতো। আমার মতো ল্যাদ খাওয়া লোক তাতে খুশী হবেই, সন্দেহ কি? আর ছিল বন্ধুদের সাথে অফুরান আড্ডা। এখন বন্ধুরা যে যার মতো ছিটকে গেছি। ভীষণ মিস করি সেই দিনগুলি।
মদ্যপান নিয়ে একটু না বললেই নয়। কলেজের দিনে এই সময়ে মদ্যপান একটা বিশাল ব্যাপার। প্রায় সারা বছরের অপেক্ষা। অন্য সময় হতো না এমন নয়, তবে কালেভদ্রে। এই সময় অন্তত দুদিন তো হতোই।
শিলঙের পুজো বেশীর ভাগই সাবেকি। কলকাতা ও চন্দননগর থেকে কারিগর আনা হতো বড়ো পুজোগুলোয় । প্রতিমার বৈশিষ্ট্যও মোটামুটি একই। শোলার কাজের প্রতিমা হতো বড়োজোর। আমরা যে সময় বড়ো হয়েছি, সেই পাহাড়ি শহরে থীমের পুজোর চল হয়নি তখনও। স্থানীয়দের সঙ্গে ঝামেলার কারণে পুজো নিয়ে কয়েকবছর অনিশ্চয়তাও ছিল বেশ। হবে কি হবে না এমন ভাব। এমনও হয়েছে পুজো ও কারফিউ একসাথে। কারফিউয়ের বিরতিতে পুজো দেখতে বেরিয়েছি।
আমি চাকরী সূত্রে দুবছর অসমে ছিলাম। শিলচরের পুজো দেখেছি পরিবার নিয়ে। শিলঙের পরিবেশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। রাস্তা জ্যাম, হাজারে হাজারে লোক। অনেক পুজো হয়। জাঁকজমক ও প্রচুর। আমি যেহেতু ভীড় পছন্দ করি না, ফলে ভালো লাগেনি বললেই চলে। লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দেখা আমার কাছে সেই প্রথম।
চেন্নাইয়ে পাঁচ বছর ছিলাম। কিছু নির্দিষ্ট বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা ছাড়া পুজো হয় না। পরিবেশ আশ্চর্যরকম শান্ত। আমি এক আধবার গিয়েছি। কলকাতায় আস্তানা হওয়ার পর কলকাতা চলে আসতাম সে সময়ে।
কলকাতায় প্রথম কয়েক বছর পরিবার নিয়ে পুজো দেখতে বেরিয়েছি। শিলচরের সেই ভীড়ের অভিজ্ঞতা এখানে বহুগুণ। তবে থিমপুজো, বিশেষত যে থিমে সোস্যাল মেসেজ দেওয়ার উদ্দেশ্য দেখেছি, আমার ভালোই লেগেছে। এই উপলক্ষ্যে একটা সদর্থক বার্তা পৌঁছয় জনসাধারণের কাছে।
শেষে বলি, সময়ের সাথে সাথে বিবর্তন এসেছে পুজোয়। আসারও কথা। প্রতিমার অবয়বেও এসেছে পরিবর্তন। আমি পরিবর্তনের পক্ষে। তবে সম্ভবত গতবছর বা তার আগের বছরে যেভাবে একটা পুজোর পরিচালন সমিতি মহাত্মা গান্ধীর আদলে অসুরের মুখ রেখেছিল তা খুবই ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় ও অনভিপ্রেত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশীরভাগ পুজো হলেও আমি এই উৎসবের এই কটা দিনকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা উচিৎ বলে মনে করি। যেমন অনভিপ্রেত, পুজোর জন্য সরকারী অনুদান শহরের ক্লাবগুলোকে।
তবে ভালো দিকও নেই তেমন নয়। কিছুটা ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে বাঙালী। আমার বাড়ীর উল্টোদিকে পুজো হয়। পুজোর চারদিন বাংলা গানই চলে। রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি পুরোনো আধুনিক ও ভাটিয়ালী। ভালোই লাগে শুনতে।
এবং কার্ণিভাল।এই বিষয়টা আমার ভালোই লাগে। ইউনেস্কোর হেরিটেজের তকমা পাওয়ার আগে পরে যাই হোক। বিভিন্ন পুজো কমিটির সুশৃঙ্খল এক শোভাযাত্রা। যদিও আমার যাওয়া হয়নি কখনও।
আমাদের অফিস করতে হয় পুজোয়। পুরো সময় হয়তো নয়। তবে করতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। পরিবার নিয়ে বাড়ীর সামনের পুজোয় রাতে যাবো বড়োজোর। বাকি সময় বাড়ীতেই। ভীড় পছন্দ নয় আমার। ফলে প্রতিবারের মতো পুজো কাটবে এভাবেই। তবে বন্ধুরা যদি আসে, জমিয়ে আড্ডা হবে। সবাইকে উৎসবের আগাম শুভেচ্ছা। ভালো কাটুক দিনগুলি।