================================================================
================================================================
আমার এক প্রিয় কবিবন্ধু অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় ওর ‘কলকাতার খোয়াব’ বইয়ের একটা কবিতায় লিখেছিল ‘জন্মেই ঠকেছি আমি পঁচাত্তরে / হয়তো বা ঠকেই জন্মেছি’। এই ‘পঁচাত্তর’ শব্দটা আমাকে প্রবল ভাবিয়েছে একসময়। এই ‘পঁচাত্তর’-এর একটা পারিবারিক, রাজনৈতিক বাস্তবতা, তার আমূল চিত্রকল্প সমেত আমার মনশ্চক্ষুর সামনে ভেসে উঠত। কেননা আমিও জন্মেছিলাম চুয়াত্তরের আগস্টে। তার পরের বছর, অর্থাৎ পঁচাত্তরে আমার দাদু, মানে আমার মায়ের বাবা, তাঁর ছেলেদেরকে কংগ্রেসি আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টায় সমাজগড়ের বাড়ি বেচে, গান্ধীকলোনির চালু স্টেশনারি দোকান বেচে সপরিবারে নাকতলায় চলে এল রাতারাতি। আমার ঠাকুরদার পরিবার ছিল আদি কংগ্রেসি। কিন্তু শুনেছি আমার বাবা পালিয়ে বাঁচা আমার দুই মামা আর তার বন্ধুদের মাঝেমাঝে ওই বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সুযোগ করে দিত। আমার মা-মাসিরা পার্টির জন্য দিনের পর দিন রুটি বানিয়েছে অকাতর। রাতের পর রাত তারা শুনেছে কাদের যেন টেনে হিঁচড়ে কাটতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গলফ ক্লাবের জংলা নিঝুম মাঠে। ছোটোবেলায়, আমার নাকতলার মামাবাড়িতে অখণ্ড সোভিয়েত থেকে আসত Soviet Life Magazine ‘USSR’ । আমার শিশুমনে রঙের রায়ট লাগিয়ে দেওয়া সেই পত্রিকা, সেই পারিপার্শ্বিক, আমার অবচেতনে কিছু রাজনৈতিক সচেতনতারও দীক্ষা দেয়নি কি ?
যদিও সব সচেতনতার প্রকাশ একরকমের নয়। একসময় যাঁরা ছিলেন লড়াকু, তাঁরাই যখন ক্ষমতায় আসীন হয়ে দেড়-দশকের মধ্যেই পুরোদস্তুর শাসক হয়ে উঠতে লাগলেন, আমার ভালো লাগল না। শাসক-চরিত্রটাই আমার কাছে অপ্রিয়। পৃথিবীর যে যেখানে যখনই খুব বেশিদিন ক্ষমতায় থেকেছে, আমার কাউকেই ভালো লাগেনি। ন’য়ের দশকের মাঝামাঝি, আমার কলেজজীবনে তথাকথিত বিপ্লবী ক্ষমতাসীন পার্টির খাতায় নাম লিখিয়েও আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি। শাসকের পার্টি শুধু শাসনে থাকতে চায়। এর বাইরে তার কোনও রাজনৈতিক চরিতার্থতা নেই। শাসকদলের কোনও শাখা সংগঠন কখনও বিপ্লব করতে পারে না। এই সত্য ক্রমে ক্রমে আমার মনে দৃঢ়মূল হয়ে বসছিল। সেই প্রাকযৌবন আর প্রথমযৌবনের দিনগুলোয় আমার মনে যে মহাজাগতিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল, যে উদ্যম ছিল, যে স্বপ্ন ছিল, তা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে আমি লেখালেখির এক অস্পষ্ট অভিমুখ সবেমাত্র পেতে শুরু করেছি তখন। তারপর যতই অভিজ্ঞতা বেড়েছে, বেড়েছে পড়াশুনার ব্যাপ্তি, আমি ক্রমশই প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে বহুদূরে সরে যেতেই স্বস্তি বোধ করেছি আর মনে মনে বিশ্বাস করেছি যে আমার যাকিছু কথা, তা আমাকে লিখেই বলতে হবে। শিল্পের কিছু নিজস্ব শর্ত আছে। তার একটা একান্ত নিজস্ব ছাঁকনি আছে। সরাসরি কোনও সামাজিক রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া শিল্পের কাজ নয়।
এক প্রবীণ বাঙালি কবির রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক ভূমিকার বিস্তর খ্যাতি প্রায়শই শুনতে পেতাম তাঁর জীবৎকালে। তাঁর ‘মূল্যবান’ বিবৃতির জন্য হাপিত্যেশ করে থাকত সমগ্র মিডিয়াকুল। অনুব্রত মণ্ডলের লোকাল ‘উন্নয়ন’-এর প্রহসনকেও তাঁর প্রতিবাদযোগ্য বলে মনে হত এবং তা নিয়ে তিনি ‘কবিতা’ পর্যন্ত লিখতেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তাঁর এই ভূমিকা অত্যন্ত অকবিসুলভ। তাঁর সামাজিক সচেতনতামূলক অধিকাংশ লেখা শিল্পের ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে পারেনি বলেই আমার স্থির বিশ্বাস। পক্ষান্তরে পাবলো নেরুদা যখন বলেন ‘তুমি গাছের সব ফুল ছিঁড়ে ফেলতে পারো, কিন্তু বসন্তের আগমন রোধ করতে পারো না’, তার ভেতরে আমরা যে সামাজিক-রাজনৈতিক বার্তা পাই, তা এক সূক্ষ্ম শিল্প হয়েই আমাদের কাছে আসে। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদী কবির লোকাল রাজনৈতিক ছড়া কাটার মুদ্রাদোষ আমার কাছে চিরদিন হাস্যকর বলেই মনে হয়েছে। পাঠকের মনে হতে পারে, সব ছেড়ে আমি হঠাৎ কোনও বিশেষ কবিকে নিয়ে পড়লাম কেন। পড়লাম এই কারণে যে আমরা এই বাংলায় যাঁদের ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করছি ইদানিং, সেইসব বুদ্ধিজীবীদের পরিশীলিত আদিপিতা ছিলেন তিনি। যুগপৎ তিনি ছিলেন এক বুর্জোয়া বাণিজ্যিক পত্রিকার পরামর্শদাতা এবং এক বামপন্থী বিপ্লবী চেতনার পথপ্রদর্শক। এক নেংটি-তরুণ যখন সুবিধাজনক দূরত্বে থাকা শত্তুরের ত্রিশূলে কন্ডোম পরাতে গিয়ে ভক্তরোষের মুখে পড়ল, তখন সেই পোষ্য তরুণকে রক্ষা করার জন্য শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ তাঁর ‘মর্ত্যে অবতরণ’, আমাদেরকে রীতিমতো হাসিয়ে ছেড়েছিল। তবু তাঁকে নিয়ে দু’চারটে ভালোমন্দ কথা বলা যায়, কারণ তিনি অন্তত শাসকের সুবিধাভোগী ধান্দাবাজ ছিলেন না। বাকিদের নিয়ে তো কথা বলারই উপায় নেই। এই যে যেকোনও সামাজিক সংকটের দিনে বুদ্ধিজীবীরূপ সুবিধাজীবীদের ক্যামেরা-তাক-করে-এগিয়ে-আসা, বা ফোনে মিডিয়াকে নানান আলটপকা বিবৃতি দেওয়া, এসব সার্কাসের পরিণতি কী হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আজকের পশ্চিমবঙ্গ।
রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসঙ্গ উঠলে যেমন আমাদের মনে পড়ে স্থানীয় সরকারের দুর্নীতি, অত্যাচার, বঞ্চনার কথা, যেমন মনে পড়ে কেন্দ্র সরকারের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি, কাশ্মীরে ৩৭০ বিলোপ, দলিত নিগ্রহ সহ আরও নানান অবধারিত কুকর্মের কথা… সেইভাবেই কেন যে আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কোনও কথা বলে উঠতে পারিনি, তা কিন্তু ভেবে দেখার সময় এবার পেরিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধব্যাবসা, যুদ্ধের রাজনীতি, এই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তকে রাতারাতি মরুভূমিতে পরিণত করছে, ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে গোটা দুনিয়াকে, তা নিয়েই বা আমরা কিছু বলে উঠতে, করে উঠতে, পেরেছি কি আদৌ? মোদী-মমতার পতন হলে তার রক্তবীজ থেকে জন্ম নেবে আরও নতুন মোদী-মমতা। এটা ক্ষমতারই একটা চরিত্র। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার সেই চরিত্র নিয়েই আমাদের কথা বলতে হবে। আমাদের মানে সাধারণ মানুষকে।
বুদ্ধিজীবী নামক সুবিধাজীবীদের মুখাপেক্ষী না হয়ে, কথা বলতে হবে আমাদেরই। আর যদি শিল্পী হিসেবে, কবি হিসেবে আমাদের কাউকে কখনও কথা বলতে হয়, তাহলে অবশ্যই কথা বলতে হবে শিল্পের নিজস্ব ভাষায়, শিল্পের যাবতীয় শর্ত মেনে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াবশত যে শিল্প, তার ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শই প্রতারিত হতে থাকি। তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী কবি’-রা নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে এমন সব কাব্যগ্রন্থ আমাদের উপহার দিচ্ছেন ইদানিং যাতে প্রতিক্রিয়া জানানো হল বটে, কিন্তু কবি কী বলতে চাইছেন আদৌ বোঝা গেল না। অর্থাৎ বলাও হল আবার কিছুই বলা হল না। শিল্পের সঙ্গে তার দূরদূরান্তের কোনও সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক-সচেতনতার কী মহিমা! কিন্তু তার আগে যে মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক সচেতনতার মানে কিন্তু স্থানীয় কিংবা দেশীয় রাজনীতিই কেবল নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জাল বিস্তৃত, যার পুতুল হয়ে আমরা নাচছি শতকের পর শতক, তার খবরও আমাদের রাখতে হবে।
আমরা, যারা স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষে জন্মেছি, তারা আসলে ঠকেই জন্মেছি। নানাবিধ বঞ্চনার ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠেছি আমরা। একের পর এক সরকার এসছে-গেছে। নতুন নতুন রোগের নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে আমরা ক্রমশ মুমূর্ষু হতে থেকেছি। সুতরাং এই দেশের রাজনীতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার উদ্যম আমার নেই। শুধু মনে হয় এই রাজ্য, এই দেশ, যে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার সুতোয় নিরন্তর নাচছে, তার উৎসটাকে স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করতে পারা আমাদের আশু কর্তব্য। নিজের সন্তানকে ইংরাজি মাধ্যম শিক্ষায়তনে পড়িয়ে যখন আমরা বাংলা ভাষা বাঁচাও অন্দোলনে সামিল হই, তা যেমন হাস্যকর হয়ে পড়ে, তেমনই আমরা যখন মনে মনে সাহেব হতে চেয়েও প্রকাশ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠি, তাও সমান হাস্যকর বলেই প্রতিপন্ন হয়।