================================================================
================================================================
(সমকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠীর প্রতিরোধের অতি-সংক্ষিপ্ত আলেখ্য)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমরা নূতন যৌবনের দূত/আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত/আমরা নূতন যৌবনের দূত..’। ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্য তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই বইয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত করেছিলেন যাঁরা ‘নূতন যৌবনের দূত’ তাঁরা কখনওই তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ হতে পারেন না। সামাজিক সমস্ত খোপে যাঁরা অনায়াস সেঁধিয়ে যেতে পারেন তাঁদের দিয়ে ‘বিপ্লব’ হয় না। নতুন যৌবনের কান্ডারীদের হতে হয় ‘চঞ্চল’ এবং অবশ্যই ‘অদ্ভুত’। এই ‘অদ্ভুত’ শব্দটির ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘ক্যুইর’। আধুনিক সমালোচকেরা বলেন ভারতবর্ষের (পৌরাণিক লেখাগুলো ছেড়ে বলছি) প্রথম ‘ক্যুইর-টেক্সট’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’। এবং তৎসঙ্গে সেই ছোটগল্পটি, ‘গিন্নি’ যেখানে আশু নামক বালকটি বোনের সঙ্গে খেলনাবাটি খেলেছিল বলে পন্ডিতমশাই তার নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘গিন্নি’। সাহিত্যে এই গল্প ‘আওয়াজ দেওয়া’ (নেম-কলিং) ও সমকাম-বিদ্বেষ (হোমোফোবিয়া)-এর প্রাচীনতম উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছরেই (১৮৬১) ভারতবর্ষে ধারা ৩৭৭ সংযোজন করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। সমগ্র উপমহাদেশেই পুরুষদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা এমনকি সেনাবাহিনীতেও এসবের প্রবল উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ভীত ব্রিটিশ এই ধারা চালু করেছিলেন। এই ধারা আসলে ইউরোপের ‘অ্যান্টি সোডোমি ল’ (পায়ুকাম-বিরোধী আইন)-এর প্রতিফলনে নির্মিত একটি নতুন আইন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রথম থেকেই সমকাম-বিদ্বেষী। কিন্তু এইসব আইন, অত্যাচার যেমন সেই সময় বিশ্বজুড়ে তৈরি হচ্ছিল তেমনই খুব আশ্চর্যজনকভাবে গড়ে উঠছিল প্রতিরোধ।
১. গোড়ার কথা
ইউরোপে সমকাম-বিরোধী যেসব আইন তৈরি হয়েছিল সেগুলি আসলে ছিল পায়ুকাম-বিরোধী। এই আইনগুলির মূলে ছিল খ্রীষ্টধর্ম। যে-কোনও আব্রাহমীয় ধর্ম যথা- খ্রীষ্ট, ইসলাম এবং ইহুদি-তেই পায়ুকাম নিষিদ্ধ। আর আমরা জানি যা নিষিদ্ধ হয় তার ভালোরকম যাপন থাকে বলেই বারণ থাকে। এই আইনগুলি চালু ছিল কারণ পায়ুকাম, লিঙ্গলেহন বা অন্যান্য যে-কোনও উৎপাদনহীন যৌনতাকেই তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে প্রকৃতিবিরূদ্ধ বলে ধরা হত। সাথে যারা প্রথাগতভাবে এগুলির চর্চা করত তাদের জুটত সপাট অপরাধীর তকমা। তবে ১৭৮৯ সনের ফরাসি বিপ্লব বলা চলে প্রথম সমস্ত রকম পায়ুকাম-বিরোধী আইন থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়। কিন্তু সেই সময়ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ প্রগতিশীলতা দেখাতে পারেনি। ইংল্যান্ডে ভিক্টোরীয় সমাজে ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার অধিকার ছিল সমাজবিরুদ্ধ। যদিও শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন নাটকে আমরা পুরুষ কখন নারীর ভূষণ নিচ্ছে আর নারী কখন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে পুরুষে, তার চকিত চলাফেরা দেখি (‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’, ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’, ‘টুয়েল্ফ্থ নাইট’ দ্রষ্টব্য) তবু ইংরেজ সমাজে সেগুলি অপরাধ হিসেবেই ধরা হত। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের যে স্বাধীনতার এমনকি বাঁচার অধিকার থাকতে পারে তা তখনও ইউরোপীয় সমাজ উপলব্ধি করেনি। এইসব মানুষদের জুটেছে মারাত্মক হেনস্থা ও হিংসা। সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার ওপর থেকে অপরাধের তকমা সরানোর প্রথম ওকালতি করেন জেরেমি বেনথাম। তাঁর মত ছিল সমকামিতা কোনও অপরাধ হতে পারে না কারণ এর মধ্যে ক্ষতিকর কোনও উপাদান নেই। যা থেকে সমকামী-রপান্তরকামী মানুষদের অপরাধী মনে করা হয় তা হল সমাজের কুসংস্কার কিছু যেগুলি ধর্মীয় শিক্ষা অর্পণ করে থাকে। এরপর ১৮৯৭ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে প্রথম তৈরি হয় ‘সাইন্টিফিক-হিউমানিটেরিয়ান কমিটি’ যা সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকারের কথা প্রচার করতে শুরু করে। এবং এই কমিটি বহু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে। পাশাপাশি এখানে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা নিয়ে ব্যাপক হারে গবেষণাও চলতে থাকে।
২. চিকিৎসা বিজ্ঞান
ঐতিহাসিকভাবে জার্মানিতেই ‘হোমোসেক্সুয়াল’ শব্দটির উৎপত্তি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং দু’টি বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়টায় জার্মানির চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যে-ভাবে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তাও এতগুলো বছর আগে যে এখন অবাক হতে হয়। পরবর্তী সময়ে বৈজ্ঞানিক চেতনায় এই বিশেষ যৌনতাকে বুঝতে এই আলোচনা, গবেষণাগুলি সাহায্য করেছিল মারাত্মক। সামাজিকভাবে প্রচুর ‘গে বার’ (সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ব্যবহৃত পানশালা যা সেই সময় তাদের সাংস্কৃতিক ‘প্ল্যাটফর্ম’ও বটে) গজিয়ে ওঠে বার্লিন শহরে এই সময়। নয়া শতাব্দীতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করে। কিন্তু এই গবেষণাগুলি কোথাও সমকামী-রূপান্তরকামী আন্দোলনের খানিক ক্ষতিও করে দিচ্ছিল। সবকিছু গবেষণার বিষয় হয়ে গেলে যেমন মানবিক চেতনা, আবেগ- এসবের মূল্য কমে যায় এবং মানুষ সত্ত্বাটিই গিনিপিগে পরিণত হয়, এখানেও তেমনই হচ্ছিল। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা হরমোনের নিরিখে বিচার্য হচ্ছিলেন। কোথাও একটা ‘হেটেরোনর্মাটিভিটি’ (বিসমকামিতাই স্বাভাবিকের তত্ত্ব) কাজ করত আর সেখান থেকেই সব গবেষণার বিষয় বস্তু পর্যালোচিত হত। এর মধ্যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা এমনকি সমকাম-বিদ্বেষও কাজ করত। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ১৯৭৩ সালে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতাকে ‘মানসিক রোগ’-এর তালিকা থেকে সরিয়ে দেন। তাঁরা মত দেন সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা আসলে এক রকমের যৌন প্রকার। বিভিন্ন যৌনচাহিদার একটি। কোনও রোগ নয়। কোনও হরমোনের কারসাজি নয়। কোনও অপ্রাকৃতিক, অস্বাভাবিক যৌনাচার নয়। অথচ এর কুড়ি বছর পরেও ধীরেন্দ্রনাথ নন্দী বাংলায় ‘মনের বিকার ও তার প্রতিকার’ নামে যে বই লেখেন তাতে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতাকে ‘বেস্টিয়ালিটি’ (অজাচার), ‘পেডোফিলিয়া’ (বালকামিতা), ‘নেক্রোফিলিয়া’ (শবকামিতা) প্রভৃতি মানসিক রোগের সঙ্গে একই তালিকাভুক্ত করা হয়। বাংলার জনমানসে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানগত বিদ্বেষ ছড়িয়েছিল এই বই।
৩. ‘গে লিবারেশন মুভমেন্ট’
গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ‘মুক্তির যুদ্ধ’ শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে স্টোনওয়াল-ইন পানশালায় পুলিশি জুলুমের বিরোধিতায় সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা বাধ্য হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তারা সশস্ত্র প্রতিবাদ করতে শুরু করে। বছরের পর বছর তাদের ওপর যে অত্যাচার চলেছে, পুলিশি হেনস্থা-হিংসা চলেছে, সামাজিক বয়কট চলেছে (এমনকি, সাধারণ পানশালায় তাদের মদ ‘সার্ভ’ করা হত না!) সেসবের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান গ্রহণ করে। দিনের পর দিন অবস্থান চলতে থাকে। সামাজিকভাবেও তারা ‘মুক্তির ডাক’ দেয়। যুগের পর যুগ সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের যে অন্তরালবর্তী (‘ক্লোসেট’) হয়ে থাকতে বাধ্য করা হত সেইসব গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তি পেতে তারা বেরিয়ে আসার আহ্বান (‘কল টু আউট’) জানায়। সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা তখন আর কোনও যৌনাচার শুধু নয়, সমকামী-রূপান্তরকামী একজন ব্যক্তি। এবং তার অবস্থান একেবারেই রাজনৈতিক। উনসত্তরের নিউইয়র্ক শহরের সেই স্টোনওয়াল রায়ট (দাঙ্গা)-এর আঁচ পশ্চিম ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আজকের সারা বিশ্বের সমস্ত ‘গে প্রাইড প্যারেড’ সেই সশস্ত্র সংগ্রামের ফসল। সেটা একটা প্রবল সামাজিক বিপ্লবের সূচনাও বটে।
৪. এইডস মহামারী
বিক্ষোভ, বিপ্লব, প্রতিবাদ কর্মসূচী যা করতে পারে না রোগের প্রাদুর্ভাব তা করে দিতে পারে। আশির দশক এইচআইভির দশক। এইডস যখন পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় মহামারীর আকার নেয় তখন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা সব আগল ভেঙে সকলের নজরে এসে পড়ে। এইচআইভির সূত্রপাত অনেককিছুতেই হতে পারে; এই রোগ বহু আগেই আফ্রিকাতে ছিল কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় দেখা যায় পুরুষ-পুরুষ যৌনতা বিশেষত পায়ুকামের মধ্যে দিয়ে এর সূচনা। সেটা নিরাপদ যৌনতা (‘সেফ সেক্স)-এর যুগ নয়। হু হু করে যুবকেরা অসুস্থ হতে শুরু করে এবং একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায়। প্রতিটি হাসপাতালে ‘এইডস ইউনিট’ খুলতে হয়। বিজ্ঞানী-চিকিৎসকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। ১৯৮১ থেকে এই মহামারীর সূত্রপাত এবং ১৯৮৩ সালে এইচআইভি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। সমকামী-রূপান্তরকামী সমাজ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ তাদের প্রতি যুগ যুগ ধরে যে বিদ্বেষ সমাজে ইতিমধ্যেই মজুত ছিল তা কয়েকশো গুন বেড়ে যায়। তারা একঘরে হতে থাকে। হাটের মাঝে তাদের পরিচয়ের গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়ে যায়। এইডসের অন্য নাম হয় ‘গে ক্যানসার’। তারপর দেখা যায় এইডস সংক্রামক নিশ্চয়ই কিন্তু তার মানে এই নয় তা চুম্বনে, ছোঁয়াছুয়িতে কিংবা একসাথে খাওয়া দাওয়া করলে ছড়াবে। একমাত্র অনিরাপদ যৌনাচার থেকে এইডস ছড়াতে পারে, একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে ছড়াতে পারে এবং সংক্রামিত মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যেও। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের থেকেও এইচআইভির সংক্রমণ মহিলা যৌনকর্মীদের মধ্যে বেশি। ড্রাগ-অ্যাডিক্টদের মধ্যেও ভালোরকম উপস্থিত। এইডস মহামারীকে শুধুমাত্র সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা আসলে সমাজে বহু যুগ ধরে গ্রোথিত সমকাম-বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নয়। এই বিদ্বেষ মোকাবিলার জন্য সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদেরই সমস্ত বাঁধা ভেঙে প্রতিরোধের প্রথম সারিতে উঠে আসতে হয়। আজ ‘অ্যান্টিরেট্রোভিয়াল’ ওষুধগুলির জন্য যে-কোনও আক্রান্ত মানুষ বহুদিন বেঁচে থাকতে পারছে। এমনকি ‘প্রেপ’ ওষুধের ফলে এইচআইভি সংক্রমণও বিশেষত সমকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠীতে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
৫. ভারতীয় প্রেক্ষিত
আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতের মত পিতৃতান্ত্রিক ও সমকাম-বিদ্বেষী দেশে প্রথম সমকামী-রূপান্তরকামী আন্দোলনের শুরুয়াৎ কিন্তু এইডস সচেতনতার হাত ধরেই। ১৯৯২ সালের ১১ই অগাস্ট স্বাধীনতার প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর ‘এইডস ভেদভাও বিরোধী আন্দোলন’ (এবিভিএ) নামক এক সংগঠন দিল্লির পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করে। সেই প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল মূলত কনটপ্লেসের সেন্ট্রাল পার্ক থেকে পুলিশের বেআইনি গ্রেফতার ও হেনস্থার বিরুদ্ধে। পুলিশ ধারা ৩৭৭-এর ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষকে তখন হেনস্থা করত। এর আগের বছর এবিভিএ একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করে যার নাম ছিল ‘লেস দ্যান গে’। এই গণ-রিপোর্টে আঁকা ছিল ভারতে সমকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠী কী ধরনের হেনস্থা-হিংসার শিকার হয় তারই একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা। আবার ১৯৯৪ সালে এবিভিএই প্রথম দিল্লি হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করে যেখানে ধারা ৩৭৭-এর সাংবিধানিক যোগ্যতাকে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু এবিভিএ-এর পরিচালক সিদ্ধার্থ গৌতমের অকালপ্রয়াণের ফলে সেই মামলা আর চালানো যায়নি এবং ২০০১-এ এসে তা নাকচ হয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে কলকাতায় ভারতের প্রথম ‘প্রাইড’ মিছিল বের হয়। মাত্র পনেরো-সতেরো জনের অংশগ্রহণের সেই মিছিলের নাম ছিল ‘ক্যালকাটা রেনবো প্রাইড’। সেই মিছিল আয়তন, আড়ম্বরে ক্ষুদ্র হলেও তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আজ ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে বছরের বিভিন্ন সময় সংগঠিত এত ‘প্রাইড প্যারেড’-এর প্রত্যেকটিই কলকাতার সেই প্রথম মিছিলের কাছে ঋণী। ১৯৯৯ সালে কলকাতায় ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্থাপনা হয় কলকাতায়। ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’ মূলত ক্যুইর-নারীবাদীদের নিয়ে কাজ করলেও সমগ্র বাংলার সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকারের লড়াইতে, সমাজে সচেতনতা গড়ে তোলার সংগ্রামে তাঁদের অবদান প্রশ্নাতীত। নব্বইয়ের দশকটা সূচনা হলেও দু’হাজারের প্রথম দশক থেকে চাকা ঘুরতে শুরু করে ভারতীয় সমকামী-রূপান্তরকামী আন্দোলনের। ২০০১ সালে লক্ষ্ণৌতে ধারা ৩৭৭ প্রয়োগ করে আবার একটি পার্ক থেকে কিছু সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি লক্ষ্ণৌতে স্থিত ‘ভরসা’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যা সমকামী-রূপান্তরকামীদের নিয়ে কাজ করত তাদের অফিসে চড়াও হয়ে পুলিশ বিভিন্ন জিনিস বাজেয়াপ্ত করে এবং অভিযোগ করে সেখানে নাকি মধুচক্র চলত। এরপর লয়ার্স কালেক্টিভ এবং নাজ ফাউন্ডেশন নামক দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই বছরই দিল্লি হাইকোর্টে ৩৭৭ ধারার বৈধতা নিয়ে মামলা করে। সেই মামলার দরুন ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট ধারা ৩৭৭-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে ভারতীয় সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের মধ্যে একটি সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে ২০১৩ সালে দিল্লি হাইকোর্টের সেই রায় উল্টে দেওয়া হল। ভারতীয় সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ওপর আবার নেমে এল ধারা ৩৭৭-এর বিভীষিকা। ভারতবর্ষে পুনরায় তাদের ‘অপরাধী’ হয়ে যেতে হয়।
৬. আজও কেন প্রতিরোধ জরুরি?
সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার বিরোধ আজও পৃথিবীতে মারাত্মক রকম উপস্থিত। আর এর গভীরে আছে ঘৃণা। অকারণ ভীতি। আসলে যা ‘আমাদের মত’ নয় তাকেই আমরা অপর বানিয়ে ঘৃণা করতে শিখি। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা প্রথম হেনস্থার শিকার হয় তাদের পরিবারে। তারপর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তথা নানা শিক্ষাঙ্গনে তারা হিংসার শিকার হয়। আমাদের সমাজে লিঙ্গ-যৌনতাকে একরৈখিক ভাবার একটি সুপ্রাচীন প্রবণতা আছে। প্রাচীন শিক্ষার মূল যে ছিল ধর্মগ্রন্থগুলি তাতেও নারী এবং পুরুষ-এই দু’টি সত্ত্বার বাইরে ভাবা হয়নি এবং বিসমকামিতাকেই প্রামাণ্য যৌনতা হিসেবে ধরা হয়েছে। তার কারণ বিসমকামিতা উৎপাদনশীল। কিন্তু মানুষ যে দ্রব চরিত্রের সত্ত্বা সেটা সমাজ উপলব্ধি করতে অপারগ। এটা অশিক্ষা আর নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। এই অশিক্ষা থেকেই সংখ্যাগুরুর হিংসার শিকার হতে হয় সংখ্যালঘুকে, বিসমকামীর অত্যাচারের বলি হতে হয় সমকামী-রূপান্তরকামীদের। কেমন হয় সেই হেনস্থা-হিংসার চরিত্র? প্রথমত, সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের যে-কোনও রকম প্রতিনিধিত্ব মুছে দেওয়া। ভেবে দেখলে বোঝা যায় সমাজের কোনও ক্ষেত্রেই আজও সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষের দৃশ্যমানতা নেই। রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমা, খেলাধুলো- কিছুতেই নয়। এই ভারতবর্ষেই দেখুন তো ক’জন ঘোষিত সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ বিধানসভা, লোকসভা কিংবা রাজ্যসভার সদস্য? ক’টা সিনেমা আজ অবধি সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে তৈরি হয়েছে? সাহিত্যের কথা যদি ধরা যায় এই যে ফি-বছর এত উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা পূজাবার্ষিকীগুলোতে প্রকাশিত হয় তার মধ্যে এতগুলো বছরে অনুপাতিক হিসেবে ক’টা নির্মিত হয়েছে সমকামী-রূপান্তরকামী জীবন নিয়ে? সমকামী-রূপান্তরকামীদের কোনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ আছেন কি? খেলাধূলায় আজও সাহস করে কোনও খেলোয়াড় নিজের লিঙ্গ-যৌনতার কথা খোলসা করে বলতে পেরেছে কি? আজও তা সম্ভব নয় কারণ সেই স্বীকারোক্তির পরে তাদের জীবনে কী অসহনীয় হেনস্থা-হিংসা নেমে আসবে সে বিষয়ে তারা অবহিত। কিন্তু পৃথিবীটা শুধু নারী-পুরুষ দ্বৈতসত্ত্বা এবং কেবলমাত্র তথাকথিত বিসমকামীদের হয়ে থাকবে সেটাও তো চলতে দেওয়া যায় না। অতএব, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পথ থেকে সরে আসলে চলে না। আজও পৃথিবীতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অনেক সমানাধিকারের লড়াই বাকি আছে। ভারতবর্ষে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট ধারা ৩৭৭-এর স্থায়ী অবলুপ্তি ঘটিয়েছেন, এই ২০২৩-এ সমকামী-বিবাহ সংক্রান্ত মামলার শুনানি হয়েছে পাঁচ সদস্যের এক বেঞ্চের নিকট যাতে প্রধান বিচারপতি নিজে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু আপামর জনসাধারণের মন থেকে সমকাম-বিদ্বেষ বিনষ্ট করতে হলে আজও বহু পথ চলা বাকি।
বিপ্লবী কবি সুব্বারাও পাণিগ্রাহী লিখেছিলেন, ‘হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ?/আমাদের মেরে ঠেকানো যাবে না জনজোয়ারের ঢেউ।’ যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ওপর অত্যাচার সংগঠিত হয়েছে। নেমে এসেছে অকথ্য হেনস্থা-হিংসা। সেগুলি আজও চলছে। প্রতিনিয়ত তাদের এক বিদ্বেষপূর্ণ সমাজের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এটাও সত্যিই যে তাদের প্রতিরোধ জারি আছে। সমানাধিকারের এক পৃথিবী কোনওদিন স্থাপিত হবে কি না কিংবা সত্যের ভোর কোনওদিন আদৌ আসবে কি না জানা নেই কিন্তু এই ক্লান্তিহীন লড়াই শেষদিন অবধি থামবে না।