‘
‘লেখা’ এবং ‘না-লেখা’, কবিতায় একই সঙ্গে লিখিত হয়। সুতরাং শুধু ‘লেখা’-র প্রকরণ শিখে নিলেই কবিতা লেখা যায় না, যতদিন না সেই রহস্যময় ‘না-লেখা’-র শক্তি কবিতাপ্রয়াসীর আয়ত্তে আসছে। লেখকের মেধা এক্ষেত্রে প্রায়শই তাঁকে ধোঁকা দিয়ে চলে। একেকজন তরুণ কবির লেখা পড়ি, কী দারুণ ছন্দের হাত, কী বিচিত্র সব বিষয়ে তাঁদের প্রাজ্ঞ আনাগোনা…! চমকপ্রদ লাইন লিখতে ইতিমধ্যেই বেশ পটু হয়ে উঠেছেন তাঁদের কেউ কেউ! চুপচাপ তাঁদের লেখা লক্ষ করতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই দেখতে পাই— লেখকের আসল অসুখটা বসন্তগুটির মতো ক্রমশ তাঁর কাব্যশরীর ছাপিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে। শুধু তরুণ কবিদের কথাই বা বলি কেন, যে সমস্ত প্রবীণ কবি, প্রাত্যহিক যোগব্যায়াম বা প্রাতঃকৃত্যের মতোই নিয়মিত ‘কবিতা’ প্রসব করে চলেন, তাঁদের লেখাতেও এই একই অসুখ।
তরুণ কবিদের নিয়ে তবু খানিকটা আশাবাদী হবার সুযোগ আছে। এখনও বিশ্বাস রাখা যায় যে, আজকের তরুণ কবিরাও কেউ কেউ, একদিন ঠিকই বুঝবেন, কবিতা লেখার জন্য তরোয়াল খেলার মতো কব্জির মোচড় দেখানোর কোনও প্রয়োজন পড়ে না। শূন্যে অস্ত্রচালনার মহড়া দিতে দিতে তাঁরা যখন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বেন একদিন, তার কিছুকালের মধ্যেই হয়তো তাঁদের পরিচয় ঘটবে এক ‘Nothingness’-এর সঙ্গে। ‘…Till love and fame to nothingness do sink’। এর থেকেই জন্ম নেয় ‘না-লেখা’-র শক্তি। অনেকটা বাকসংযমের শক্তির মতোই। এই ‘না-লেখা’-র শক্তি লেখককে শুধুই উস্কানি দিয়ে চলে না লেখার। এমনকি একটি বাক্যের একটিও বাড়তি শব্দকে সে বরদাস্ত করতে চায় না। লেখককে সে বাচাল ব’লে, মিথ্যুক ব’লে, কল্পনাবিলাসী ব’লে তিরস্কার করেই চলে অনবরত।
এই ‘না-লেখার’ শক্তিই প্রকৃত লেখালেখির প্রেরণা। এই ‘না-লেখার’ শক্তিই প্রকৃত শক্তিশালী লেখাকে আর পাঁচটা গড়পড়তা লেখা থেকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু তার জন্য কবিকে গর্ভস্থ সন্তানের মতোই লালন করতে হয় সেই ‘না-লেখাকে’। একটা-দুটো লাইনের ঝলক দেখামাত্র খাতাকলম টেনে বসলে সেই লেখা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বানানো ব’লে বোঝা যায়। কবি যত প্রতিভাবানই হোক না কেন, তার সেই লেখা যত ‘বড়’ পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়ে থাক না কেন, সেই নির্মিতি আড়াল করা সম্ভব নয়। পাঠকের চোখ থেকে সমকালীন মোহের ঠুলি খসে গেলেই তার চোখে স্পষ্ট ধরা দেয় কবির বাচালতা, কবির মিথ্যাচার। কিছুদিন ছন্দচর্চা করলে, দেশ-বিদেশের কবিতা পড়লে, একজন কবিতাপ্রয়াসী খুব সহজেই কবিতার মতো দেখতে কিছু একটা প্রসব করতে শিখে নেয়। এই অর্জন তার মধ্যে যে আত্মতুষ্টি ও আত্মশ্লাঘার জন্ম দেয়, তা-ই তার কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু। এই আত্মতুষ্টির টোপে পড়ে সে ক্রমশ কবিতা আর অকবিতার ফারাক ভুলে যেতে থাকে, গুলিয়ে ফেলতে থাকে। প্রকাশকের দাবি সামাল দেওয়া, পাঠকের আবদার সামাল দেওয়ার তাড়নায় তাকে লিখে চলতে হয় বইয়ের পর বই। এমন কত ‘বড়’ কবির কত অকবিতায় ঠাসা অতিকায় সব কবিতাসংগ্রহ, কবিতাসমগ্র, তাঁরই সামগ্রিক কবিকৃতির সামনে পাহাড়প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখা যায়। অবাক লাগে শুধু এটা ভাবতে যে, অর্থ যশ ক্ষমতার মোহ কতদূর প্রকট হলে একজন লেখক কবিতার মূল শর্তটিকেই উপেক্ষা করতে পারে!
সংগীতসাধনার ক্ষেত্রে রেওয়াজের যে ভূমিকা, কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টা সেইরকম নয়। কেননা লেখা মানে তো শুধু খাতায়-কলমে লেখার সময়টুকু নয়। বরং কবি যেন প্রতিমুহূর্তেই কবিতার জন্য ওঁত পেতে থাকেন। জীবনের প্রত্যেকটা অণু-পরমাণু থেকেই তিনি আবিষ্কার করতে চান একটি নতুন কবিতার সূত্র। কিন্তু পেরে ওঠেন কি? জীবনের বেশিরভাগ দৃশ্য, শ্রাব্য, পাঠ্য আর ভোগ্যবস্তুই সাময়িক ঝলক দেখিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনও কোনও বিশেষ মুহূর্ত, জীবনের কিছু কিছু আশ্চর্য রসায়ণ, তার স্থানকালপাত্র সমেত সমকালীন অভিজ্ঞতার সারাৎসার পেরিয়ে আবহমান উপলব্ধির আলোর দিকে চলে যেতে চায়। সেই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য কবিকে অপেক্ষা করতে হতে পারে অনির্দিষ্টকাল। সেই অপেক্ষা এমনই পবিত্র ও নির্ভেজাল হওয়া আবশ্যক যে কবির অস্তিত্বের চারপাশে বল্মীকের স্তূপ গজিয়ে উঠলেও তাঁর ধ্যান ভাঙবে না। ‘বল্মীকের স্তূপ’ এখানে প্রতীক হিসেবেই লেখা হল। কিন্তু এই সমসাময়িক পৃথিবীতেও, খাস কলকাতার বুকে, এমন জাতকবির হদিশ আমি জানি, প্রতি বর্ষাতেই যাঁর মাথার ওপর চাল ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তিনি তাঁর একলা জীবনে বিশুদ্ধ কবিতার অপার্থিব আনন্দেই মজে থাকেন বছরের পর বছর। হাতে পয়সাকড়ি থাকলেও মাথার চাল সাড়ানোর কথাটি মনে থাকে না তাঁর। যদিও এমন কবির সংখ্যা আজ হাতে গোনা। অধিকাংশ কবিযশপ্রার্থী লেখক আজ কবিতা লেখার চেয়ে ‘কবি হয়ে ওঠার’ তাগিদে সময় দেয় বেশি। ফলে কবিতা লেখার জন্য সময় দেওয়া তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হরে পড়ে।
এখানে এসে কথাগুলো স্ববিরোধী মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ একবার বলা হচ্ছে ‘না-লেখার’ কথা, তারপরেই আবার বলা হচ্ছে কবিতা লেখার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেবার সপক্ষে। এইখানেই তো আসল কথাটা বলার। ওই ‘না-লেখার’ ছটফটানির আড়ালেই হয়তোবা রচিত হতে থাকে একেকটি নতুন কবিতা। কবির পক্ষে জানা সম্ভবই নয় কোন অবচেতনে সেই কবিতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। যখন সেই সুপ্ত ভাব ক্রমশ প্রকট হতে হতে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তখনই কবি সেই আসন্ন কবিতাটির সম্ভাবনা টের পান। সুতরাং ‘কবিতার মুহূর্ত’ ব’লে কোনও বিশেষ সময়কালকে চিহ্নিত করার প্রয়াস কোনও কবির কম্ম নয়। যতই বাবু শঙ্খ ঘোষ তা নিয়ে একটা বই নামিয়ে ফেলুন না কেন। প্রকৃত কবিতার আদিম উৎসটি চিহ্নিত করতে পারা বাস্তবিকই অসম্ভব। এমনকি তার আবির্ভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার যে আস্ফালন, তাও কোনও অবোধ কবিত্বের বিলাসিতামাত্র। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণাতীত কবিতার হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন হয় পবিত্র আর জ্ঞানপাপী, বেবাক আর প্রাজ্ঞ একটি আধার। যে আধার জীবনের ব্যাপ্ত ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে, ব্যাপক অধ্যয়নের ভিতর দিয়ে, ছন্দ সহ বিভিন্ন সব প্রকরণে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠার ভিতর দিয়ে নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত করে তুলেছে। আর এই প্রস্তুতিপর্ব চলতে পারে কবির গোটা জীবনব্যাপী। প্রতিটি নতুন কবিতা এই আয়ুক্ষয়ী আর রক্তক্ষয়ী প্রস্তুতির শর্তেই তাঁকে লিখে যেতে হয় আজীবন। সুতরাং কবিতা লেখা একটা পুরো সময়ের কাজ, না-লেখাও যার অবধারিত অংশবিশেষ। অর্থাৎ হাতে-কলমে গাদাগুচ্ছের লিখে চললেই শুধু লেখা যায় না কোনও সার্থক কবিতা।
অথচ সব গ্লোবাল তরুণ কবিই আজ জানেন, রাইনের মারিয়া রিলকে নামের এক প্রখ্যাত জার্মান কবি তাঁদেরই মতো এক তরুণ কবিকে উপদেশ দিয়েছিলেন, মাঝরাতে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করতে, কবিতা কি আমাকে লিখতেই হবে? কবিতা না লিখলে কি আমার মৃত্যু ঘটবে? আমি জানি না, আজকের ‘প্রতিভাবান’ তরুণ কবি, প্রজেক্টের মতো করে আরেকটা নতুন ‘কাজ’ ‘নামিয়ে ফেলার আগে’ ওই কথাগুলো মনে রাখেন কি না। লাইনের পর লাইন দুর্বোধ্য দিশাহীন লোকঠকানো নিজের লেখাকেই তাঁর নিজস্ব-নির্জনে হাস্যকর বলে মনে হয় কি না।
ফেসবুকে কবিতার নামে যে নেত্য নিত্যকার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিফলিত হয়, এবং তার পাদদেশে যে পারস্পরিক চুক্তিভিত্তিক ‘আহা, উঁহু, অসাধারণ, অসামান্য, অলোকসামান্য…’ ইত্যাদি মন্তব্যসমূহ স্বর্ণাক্ষরে খচিত থাকে, তা দেখে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এই মিথ্যে ফেরেব্বাজির পাপ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব প্রত্যাহার করে নেব। কিছু কিছু তরুণ কবির লেখা ভালো লাগলেও, আজকাল রিঅ্যাক্ট করার বা মন্তব্য করার ঝোঁক থেকে নিজেকে সজ্ঞানে বিরত রেখে বরং তাঁর সঙ্গে দেখা হবার জন্য অপেক্ষা করি। দেখা হলে, তাঁর প্রাপ্য প্রশংসা, যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পেশ করার সুযোগ যেন আমি পাই। প্রতারক প্রশংসার চেয়ে যা আমার কাছে ঢের পবিত্র বলে মনে হয়।
নিজের পোস্টে লাইক বাড়াবার কৌশল হিসেবে যাঁরা অপরের লেখায় অভিসম্পাতের মতো ‘অসামান্য-অসাধারণ’ বর্ষণ করে চলেন, আমি তাঁদের মনে মনে ঘৃণা করতে বাধ্য হই। তাঁদের অনাত্মীয় ও শ্রেণিশত্রু বলে মনে করি। প্রকৃত কবিতাপ্রয়াসী তরুণরা আমার অভীষ্ট বুঝতে পারবেন বলেই আমার ধারণা। সঙ্গে এও আশা করি, মিথ্যে ‘আহা-উহুর’ মোহে অনর্গল, অর্থহীন, দুর্বোধ্য বাক্যরচনা লেখার তাগিদ থেকে তাঁরা নিজের সরল, পবিত্র, ব্যাপক সম্ভাবনাকে, বাঁচিয়ে চলতে পারবেন।
শোভন ভট্টাচার্য জন্ম ১৮ অগস্ট, ১৯৭৪, কলকাতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক। কর্মজীবনের গোড়ায় সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে একটি জাতীয় স্তরের বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত। প্রকাশিত কবিতার বই ‘ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রতি’ (২০০০), ‘এক প্রেমিকের ইচ্ছামৃত্যু’ (২০০৬), ‘জন্মের গহন অভিসার’ (২০০৭), ‘শনির জাতক’ (২০১০), ‘ধ্বংসে লেখা ধ্রুপদ’ (২০১৩), ‘যে আরতি মণিকর্ণিকার’ (২০১৫), ‘তমসার ফুলকিমালা’ (২০১৬), ‘গঙ্গাপানি পদ্মাজল’ (২০১৭), ‘মেঘশ্রুতি ও অন্যান্য মলহার’ (২০১৮), ‘কাব্যসংগ্রহ’ (২০২০), ‘জংলা মনের স্বর্গ’ (২০২২), ‘ব্যথামঞ্জরি’ (২০২৩)। গদ্যগ্রন্থ ‘লোকাল থেকে লোকান্তর’ (২০২৩)।