পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়। ফজরের আযানের পর থেকে হাঁটছে জয়নব বেগম—হাতে একটা দড়ি, দড়িতে বাঁধা একটা গোরু। তার মন-মেজাজ আজ এতটাই ফুরফুরে যে নেচে নেচে গান গাইতে মন চাইছে, কিন্তু অভ্যাস না থাকায় গাইতে পারছে না। তাই মনে মনেই গাইছে, আর মাঝে মাঝে গুনগুন করছে।
মাইল পাঁচেক পথ শেষ হয়ে গেছে, তবু ক্লান্তি লাগছে না তার। কেবল বড়ভাই কলিমুল্লার মুখটা মনে পড়ছে। আর কেমন এক ভালো লাগা তৈরি হচ্ছে। সে যাচ্ছে ভাইয়ের বাড়িতে। গোরুটাকে যখন সে ভাইয়ের হাতে দেবে তখন কেমন হবে সেই দৃশ্য সে ভাবতে পারছে না। খানিকটা দ্বিধা আর ভয়ও লাগছে। আবার লাগছেও না, হাজার হলেও বড়ভাই, একমাত্র বোন সে। ছোটবেলায় বাপ-মা মরার পর কোলে-পিঠে করে বড় করেছে, ইশকুলে পড়িয়েছে, বিয়ে দিয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় সে মাত্র কিনতে পেরেছে গোরুটা, গায়ের রং ধবধবে শাদা, পুকুরের মতো টলটলে চোখ। অনেক রাত পর্যন্ত গোরুটাকে নিজ হাতে গরমপানি আর সাবান দিয়ে ঢলে ঢলে গোসল দিয়েছে। তারপর ভুষি আর বড় ছেলেটাকে দিয়ে ঘাস কেটে এনে খাইয়েছে।
গোরুটা সস্তায় পেয়ে গেছে বলা যায়। হাট থেকে কিনতে গেলে অনেক বেশি টাকায় কিনতে হতো। এই টাকা জোগাড় করতে গত ছয় বছরে তার জান কয়লা হয়ে গেছে। মানুষের ঘরে ঘরে কাজ করে, ধান-চাল ঝেড়ে, উঠান লেপে, ঘরের শাকপাতা, সুপাড়ি, ফল, জঙ্গল থেকে লাকড়ি কেটে হাটে বিক্রি করে অনেক কষ্টে তিনটা ছেলেমেয়ে বড় করেছে, আর খেয়ে না খেয়ে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছে। সেই গোরু আজ তার হাতের দড়িতে বাঁধা, যাচ্ছে ভাইয়ের বাড়িতে।
বছর তিনেক আগের কথা। একদিন অনেক ভয়ে ভয়ে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলো সে। ভাই বাড়িতে ছিলো না সেদিন। ভাইয়ের ছোট ছেলেটা তাকে উঠান থেকেই বিদায় করে দিয়েছিলো গালমন্দ করে। এখনো কানে বাজে ছেলেটার কথা, ‘তোমার মতো চোরনির জায়গা আমাগো বাড়িত নাই…’।
ভাইপোর মুখে এমন কথা শুনে সে আর সেইদিন এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি। কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গিয়েছিলো। সেইদিনের ছেলে, ফুফুর কাছে কিচ্ছা না শুনলে যার ঘুম আসতো না, ছয় বছরে বেড়ে মাথা ছাড়িয়ে গেছে! সেই ছেলের মুখে যদি ‘ফুয়াম্পা’ ডাক শোনার বদলে ‘চোরনি’ ডাক শুনতে হয় তাহলে কেমন মরে যেতে মন চায় তা আর ভাবতে পারে না সে, তার চোখ ফেটে পানি আসে আর দুই চোখ হয়ে যায় যেন পানির নহর। ছয়বছর আগের সেই রাতের কথা এখনো পরিষ্কার মনে আছে তার।
একদম দিশাহারা আর নিরুপায় হয়ে ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলো সে। ঘরটা যে করেই হোক বাঁচাতেই হবে, নাহয় তিনটা ছেলেমেয়ে নিয়ে তার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। অবশ্য ভাইয়ের অবস্থাও যে খুব ভালো, তা কিন্তু নয়। ভাইয়ের সম্বল বলতে একবিঘা ধানী জমি। ওইটা দিয়েই সারা বছর তাকে খেয়ে না খেয়ে চালিয়ে নিতে হয়। তারপরও সেইদিন রাতের খাওয়া-দাওয়া করার পর ভাইয়ের পায়ের কাছে পিঁড়িতে বসে কথা বলার প্রস্তুতি নিলো। ভাই মনে হয় বুঝতে পারলো কিছু বলতে চায়। তিনিই প্রথম কথা বললেন, ‘জয়নব মনে হয় আমারে কিছু কইবার চাস?’
জয়নব সঙ্গে সঙ্গেই বললো, ‘হয়, কইবার লাইগাই তো আছি আপনের কাছে। আপনে ছাড়া তো আর কেউ নাই আমার দুনিয়ায়। ভাইজান, আপনে তো সবই জানেন। আলিমের বাপটাও মইরা গেলো। তার চিকিৎসার খরচা জোগাইতে জমি-জমাও সব গেলো। আপনের কাছ থিকাও কম নিই নাই, শেষমেশ ঘরটাও বন্ধক রাখছিলাম। আমার সব শেষ। এখন ঘরটা ছাড়াইতে না পারলে আমাকে পোলা-মাইয়া নিয়া রাস্তায় নামতে হইবো।’
কলিমুল্লা অসহায় নতচোখে বললেন, ‘তুই তো আমার অবস্থা জানোস। আমারও কিছু নাই। দুইটা হালের গোরু আছে। ওই দুইটা না থাকলে না খাইয়া মরতে হইবো।’
ভাইয়ের কথা শুনে তার চোখের সকল আশার আলো নিভে এলো যেন। তারপরও সে প্রায় মরিয়া হয়েই বললো, ‘টাকা প্রায় জোগাড় করে ফালাইছি, ভাইজান। অল্প কিছু বাকি। আর কোনো কূল না পাইয়া আপনার কাছে আইছি।’
এই কথার পর কলিমুল্লা বোনের হাত ধরে কেঁদে ফেললো, ‘বইন রে, আমি পারলে তোরে কেমনে ফিরাইতাম। তুই তো আমারে চিনস…’
ভাইয়ের এমন কথার পর তার আর বলার কিছু রইলো না। সেই রাতে রাতভর ঘুম এলো না তার, দিশেহারা লাগছিলো। চোখের জলে মাথার বালিশ ভিজে একাকার। ফজরের আজানের আগে তার মাথায় চিন্তাটা এলো। সে জানে যে ভাইয়ের গোয়াল ঘরে দুইটা গোরু বাঁধা আছে। ওখান থেকে একটা গোরু সে নিয়ে বিক্রি করে দিলে তার ঘরটা বাঁচবে। পরে সময়সুযোগ বুঝে ভাইকে আরেকটা গোরু সে কিনে দেবে। কিন্তু ভাইয়ের ঘরে চুরি করবে এই কথা ভেবে নিজের মুখে কাপড় গুঁজে চিৎকার করে কাঁদলো সে আরো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গোয়াল ঘরের দিকে যেতে যেতে কী যেন ভেবে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ভাইয়ের ঘরদোর উঠান সব ঝাঁট দিলো। তখনো কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। ফজরের আজান পড়লে ভাই উঠে মসজিদে গেলো। তারপর দিন শুরু হয়ে গেলো।
সারাদিন ভাবীকে নানা কাজে সাহায্য করলো সে। ভাইয়ের চারটা ছেলে-মেয়েকে ধরে আদর সোহাগ করলো। এইভাবে সে সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকলো। এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সে জানে যে তাকে ঠিক মাগরিবের আজানের সময়ই গোরুটা নিয়ে বের হয়ে যেতে হবে ভাইয়ের ভিটা থেকে। তখন লোকজন কম থাকবে বাইরে।
মাগরিবের আজান শুরু হতেই সে বের হলো ঘর থেকে। গোয়াল ঘর থেকে শাদা গোরুটা নিয়ে সে পেছনের ক্ষেতের আইল ধরে হাটের দিকেই হাঁটা দিলো। তার চারপাশে যেন দশদিগন্তে নানা স্বরে আজান বেজে চলেছে, ‘আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাললাহা…’ বলে মুয়াজ্জিন যেন নানা দিক থেকে দিনের মৃত্যু ঘোষণা করছে আর ‘হাইয়া আলাল ফালাহ…’ বলে তাকেই ডাকছে।
তিনদিন পর কুরবানির ইদ। ইদের আগের দিন পর্যন্ত এখন প্রতিদিনই কুরবানির গোরুর হাট বসে। এমন হাটে বিক্রি করলে ভালো দাম পেয়ে যাবে এই ভেবে হাঁটতে হাঁটতে সে হাটের প্রায় কাছাকাছি চলে এলো। আর হাটে ঢোকার আগেই গোরুটা সে বিক্রি করে দিতে পারলো, ফলে হাটে বসার হাসিলও দিতে হলো না তাকে। গোরুটা বিক্রি করে হাতে টাকা পাওয়ার পর মুহূর্তেই যেন তার মাথা ও বুকের উপর থেকে পাহাড় সমান একটা পাথরের ভার নেমে গেলো রাস্তায়, নিজেকে তার তুলার মতো হালকা মনে হলো, যেন চাইলেই বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারবে। সে টাকার বান্ডিলটা বোরকার ভিতর কোমরে শক্ত করে শাড়ির আঁচলটা দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে নিলো। আগামীকাল সকালেই ঘরটা ছাড়িয়ে নেবে সে।
ছয়বছর আগের সেইদিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে দিন শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারলো না জয়নব বেগম। সন্ধ্যার দিকে তার পায়ের পাতায়, গিঁটে ক্লান্তি এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো যেন। এর মধ্যে দুইটা নদী পার হয়েছে সে। গোরুটা একবার হাত থেকে ছুটেও গিয়েছিলো, ধরে বশে আনতে তার সমস্ত শক্তি যেন শেষ। পান্তাভাত খেয়ে বের হয়েছিলো ঘর থেকে, এরপর পানি ছাড়া আর কিছু খায়নি। ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েই খাবে একবারে।
শীতকালের দিন ছোট, কিছুক্ষণ পর অন্ধকার নেমে আসবে। সেই কখন থেকে হাঁটছে সে গোরুটাকে নিয়ে! একটা গাড়ি দিয়ে যে গোরুটা নেবে সেই সামর্থ তো তার নেই। সে ভাবলো বাকি পথটা যদি গোরুটার পিঠে উঠে যাওয়া যেতো তাহলে তাকে আর হাঁটতে হতো না। ভাবতে ভাবতে সে চেষ্টা করলো। পড়ে গেলো কয়েকবার। কিন্তু অবশেষে উঠতে পারলো। গোরুর গলার দড়িটা সে ঘোড়ার লাগামের মতো করে ধরলো। তারপর পিঠে একটা হালকা চাপড় দিয়ে বললো, ‘যা যা…’
গোরুটা নিজের মতো হেলে দুলে চলতে শুরু করলো বিলের মাঝখান দিয়ে। তার আরাম লাগছে বেশ। গায়ে বাতাস লাগছে ঠান্ডা। আর ছোটবেলায় ভাইয়ের মুখে শোনা বোরাক ঘোড়ার কাহিনি মনে পড়ে গেলো তার, নবি করিম বোরাক নামের একটা সুন্দর ঘোড়ায় চড়ে মেরাজে গিয়েছিলেন, আল্লাহ্র সঙ্গে দেখা করতে। ছোটবেলায় তাদের বাড়ির বেড়ার দেয়ালে বোরাক ঘোড়ার বড় একটা ছবি ছিলো। তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সেই ঘোড়াটার গায়ের রংও শাদা ছিলো, দুইটা বিশাল ডানা ছিলো। ঘোড়ার মুখটা খুবই সুন্দর একটা মেয়ের মুখ। মেয়ের মুখ কেন সেই প্রশ্ন ছোটবেলা থেকেই তার মাথার মধ্যে আটকে আছে। ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ভাই বলতে পারেনি।
তার সহসা অদ্ভুত একটা চিন্তা মনে এলো, মনে হলো এই গোরুটাও যদি বোরাকের মতো উড়তে পারতো! আহা কেমন মজা হতো! এই ভেবে সে কল্পনার রাজ্যে ডুবে গেলো। সহসা তার কল্পনার জাল ছিঁড়ে গেলো হট্টগোলের শব্দে। দেখলো গোরুটা তাকে হাটের উপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর হাটভর্তি লোকজন। অন্ধকার বলে তার দিকে কেউ খেয়াল করছে না। তার মনে প্রবল আনন্দ হচ্ছে। একটু পরেই ভাইয়ের মুখ দেখতে পাবে। গোরুটা ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলবে, ‘ভাইজান এই লও তোমার গোরু ফেরত দিলাম। এইবার মাফ কইরা দেও, তোমার এই অভাগী বইনডারে…’ বলেই সে ভাইয়ের দুই পা জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। হাজার হলেও ভাই, সে জানে নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দেবে!
দুই ঘণ্টার হাঁটাপথ গোরুটা তাকে উড়িয়ে মাগরিবের আযান হতে হতেই ভাইয়ের বাড়ির ঘাটায় নামিয়ে দিলো। কেউ টের পেলো না। বাড়ির উঠানে সে এসে যখন পৌঁছে তখন আযান শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে কোরান তেওয়াতের শব্দ। যেই শব্দ সবকিছুকে যেন স্তব্ধ করে রেখেছে। তার বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। ধুলা, আগরবাতির ধোঁয়া, আতরের গন্ধ, কুয়াশা সব মিলে তাকে ঘিরে সন্ধ্যার গায়ে যেন অদ্ভুত এক কাফন জড়ানো। সে আরও কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে কুয়াশার চাদর ঠেলে খোলা ভাইয়ের ঘরের দরজার সামনে এলো, দেখলো পৃথিবীর সব থেকে অযাচিত সেই দৃশ্য। উত্তর-শিথান করা ভাইয়ের লাশ শোয়ানো গলা পর্যন্ত কাফনে ঢাকা। চোখের উপর দুইটা বরইপাতা। মাথার কাছে বসে ভাইয়ের হাফেজ ছেলেটা কোরান তেলাওয়াত করছে।
এতক্ষণে জয়নব বেগমের কানে ঘরের ভিতর পর্দার আড়াল থেকে কান্না আর বিলাপের শব্দ ভেসে এলো। তার চোখে পড়লো ঘর ভর্তি পাড়া প্রতিবেশী। তার চারপাশেও লোকজন আসা যাওয়া করছে। তার হাত থেকে দড়িটা খসে পড়ে। সে দুহাতে কপাল চাপড়ে ‘ভাইজান গো’ বলে উঠানে বসে পড়ে। আর তখনই তার পাশ ঘেঁষে প্রায় লাফ দিয়ে তার চুল, পরনের কালো বোরকা আর উঠানের ধুলা উড়িয়ে শাদা গোরুটা উত্তর দিকের কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে ছুটে গেলো। আর সহসা তার চারপাশ কাচের দেয়ালের মতো ঝন ঝন শব্দে ভেঙে পড়লো যেন, সে ভাইয়ের নামে আরো গগনবিদারী চিৎকার করে ছুটে যাওয়া গোরুটার পেছন পেছন ছুটতে থাকে, আর ঢুকে পড়ে ঘন কুয়াশা কাফনে মোড়ানো একটি শাদা সন্ধ্যার পেটের ভিতর একা, একা একা।