
একজন কবি যখন বুঝতে পেরে যান কবিতা কীভাবে লিখতে হয়, তখন হয়তো তাঁর বেঁচে থাকার আর প্রয়োজন থাকে না। কবি ইয়েটসের মৃত্যুর পর কথাটা বলেছিলেন তাঁর বান্ধবী ডরোথি ওয়েলেসলি। একজন প্রকৃত কবি তাঁর সমগ্র জীবন এই অনুসন্ধানেই কাটিয়ে দেন যে কবিতা কীভাবে লিখতে হয়। আমরা দেখতে পাই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর শেষ কবিতাটি নিয়ে কী সংশয়ের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত অদলবদলে এগিয়ে যেতে হয়। শুনতে পাই নব্বই ঊর্ধ্ব মণীন্দ্র গুপ্তের আক্ষেপ, ‘আয়ু যখন সমাপ্ত হয়ে এলো জীবনকে তখন সবচেয়ে অসমাপ্ত অপ্রস্তুত বলে মনে হয়— এ এক গভীর প্যারাডক্স। আমার অসমাপ্ত জীবন, আমার অপ্রস্তুত মুখ, প্রতিবিম্ব হয়ে আমার কবিতাও অসমাপ্ত আর করুণ হয়ে আছে।’ আবার ‘হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…’ কবিতাটিরও অনেকগুলো পাঠ আমরা পেয়েছি জীবনানন্দের ডায়েরি থেকে। বারবার লিখেও সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না হয়তো। শক্তি চট্টপাধ্যায়ের কাটাকুটি ভরা কবিতার খাতাগুলোর কথাও আমরা জেনেছি তাঁর মৃত্যুর পরে। অবশ্য ডরোথির ওই কথাটা বলার কারণ হচ্ছেন স্বয়ং ইয়েটস। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন একবার বান্ধবীকে বলেছিলেন, এখন এই শেষ সময়ে এসে তিনি স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছেন কবিতা কীভাবে লিখতে হয়। আইরিশ ওই কবি এক সময় লান্ডনে প্রিমরোজ হিলের ফিত্জরয় রোডে বসবাস করতেন। ১৯৫৭ সালে লান্ডন কাউন্টি কাউন্সিল ২৩ নম্বরের ওই বাড়িতে কবির নামাঙ্কিত ফলক জুড়ে দেয়। তাই হয়তো পরবর্তীতে আরও একজন কবি আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেখানে থাকতে। হ্যাঁ, তিনি সিলভিয়া প্লাথ। জীবনের সবচেয়ে করুণতম সময়ে এসে উঠেছিলেন ওখানে। এক দিকে স্বামী টেড হিউজের পরনারী আসক্তির মতো বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে পুরনো মানসিক অবসাদ, ইনসোমনিয়া। বিবাহ বিচ্ছেদ। ভেবেছিলেন ফলকটি তাঁর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে। তাই বিচ্ছেদের তিন মাস পর, ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে ওই বাড়ির একটা ফ্ল্যাট পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেন তিনি। সঙ্গে দুই সন্তান। আড়াই বছরের ফ্রিদা আর প্রায় এক বছরের নিকোলাস। কিন্তু সেই বাস মাত্র তিনটে মাসও পেরুতে পারল না। ফেব্রুয়ারি ১১, ১৯৬৩। সবকিছু কি পরিকল্পনা মাফিকই করেছিলেন প্লাথ? নির্ধারিত সময় সকাল ৯ টায় এসে হাজির হওয়ার কথা নার্সের। ছেলেমেয়েদের দেখাশোনায় সাহায্য করতেই রাখা হয়েছিল তাকে। কিন্তু নার্স ঘরে ঢুকতে পারছিলেন না কিছুতে। দরজা তো খুলছে না কেউ। পরে এক লোকের সাহায্যে ঢুকে গেলেন ভিতরে। ঢুকেই দুজনে দেখতে পেলেন প্লাথের নিথর দেহ। গ্যাস চুল্লিতে মাথা ঢোকানো। মৃত। মাত্র ৩০ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। আগের মাসেই প্রকাশিত হয় উপন্যাস দ্য বেল যার। আর, গত অক্টোবরেই লিখছিলেন জীবনের সেরা কবিতাগুলো। পৃথিবী থেকে প্লাথ যখন নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছিলেন, তখন সকাল। পাশের ঘরে ফ্রিদা আর নিকো, ঘুমাচ্ছে। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কিছু। কারণ, টেপ, টাওয়েল আর কাপড় দিয়ে ঘরটি সিল করে দিয়েছিলেন প্লাথ। খুব সকালে নীচের ফ্ল্যাটের থমাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কখন বেরুবেন তিনি। একটা চিরকুটও রেখেছিলেন তার জন্য। লেখা ছিল ‘ডাক্তার হার্ডারকে খবর দিন’। সঙ্গে ফোন নাম্বারও লিখে দিয়েছিলেন ডাক্তারের। সেই সময়ের তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘প্লাথ তাঁর মাথাটিকে যতটা সম্ভব চুল্লির ভিতর দিকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি নিশ্চিত মৃত্যুই চেয়েছিলেন।’ প্লাথের অসুখটার নাম ছিল ক্রনিক ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশান। মাত্র ৮ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। তখনই লেখেন কবিতা, Father, this thick air is murderous. / I would breathe water. সেই বয়স থেকেই অবসাদে আক্রান্ত হওয়া শুরু হয় তাঁর। তবে, আত্মহননের ওই চেষ্টা, প্রথম চেষ্টা ছিল না। ১৯৫৩ সালেও একবার অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে, মৃত্যুর স্বাদ নিতে চেয়েছিলেন। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়ে পরবর্তীতে লিখেছিলেন, ‘যাকে বিশ্বাস করেছিলাম এক শাশ্বত বিস্মৃতি, আনন্দের সাথে সেই ঘূর্ণায়মান অন্ধকারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছি আমি।’ না সেটাও অবশ্য প্রথম না। ১৯৫০ এ একবার যখন কবি ডিলান থমাস গিয়েছিলেন নিউইয়র্কে। প্রিয় কবির সঙ্গে দেখা করতে দুই দিন তাঁর হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করেছিলেন প্লাথ। কিন্তু ডিলান কোন ফাঁকে চলে গেলেন, বুঝতে পারেননি। এর কয়েক সপ্তাহ পর, প্লাথ চাকু দিয়ে নিজেই নিজের পা কেটে বিক্ষত করেন। বলেন, ‘পরীক্ষা করে দেখলাম, নিজেকে হনন করার যথেষ্ট সাহস আমার আছে কিনা।’ ১৯৫৮ সালে প্লাথ যখন বোস্টনে রবার্ট লোয়েলের একটি ক্রিয়েটিভ রাইটিং সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন, তখন সেখানে পরিচয় ঘটে অ্যান সেক্সটন আর জর্জ স্টারবাকের সঙ্গে। লোয়েল আর সেক্সটন দুজনেই তাকে জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে লিখতে উৎসাহিত করেন। বেশ খোলামেলাভাবেই সেক্সটন আর প্লাথ তাদের অবসাদ আর আত্মহননের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলেন। সেক্সটন তাকে উৎসাহ দেন একজন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে। “সিল্ভিয়ার মৃত্যু” নামে ১৪০ লাইনের একটি এলিজি আছে সেক্সটনের। প্লাথের মৃত্যুর পরপরই লিখেছিলেন কবিতাটি। প্লাথকে উদ্দেশ্য করেই জানতে চাইছিলেন, কোথায় পৌঁছে গিয়েছিলেন প্লাথ? কীভাবে পেলেন আত্মহননের শক্তি! বিভিন্ন চিঠিপত্রে ছিল তাদের বন্ধুত্বের আলাপচারিতা, কাটানো মুহূর্তের কথকতা, মৃত্যুর জন্য আবেগী আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। ওই ঘটনার প্রায় এক যুগ পর, সেই সেক্সটন, ১৯৭৪ এর ৪ঠা অক্টোবর, লাঞ্চ করতে করতে পরবর্তী বইয়ের পাণ্ডুলিপি (দি ওফুল রয়িং টুওর্ড গড) নিয়ে কথা বলছিলেন কিউমিনের সঙ্গে। পরের মার্চেই যেটা প্রকাশ হওয়ার কথা। এরপর, বাড়ি ফিরে মায়ের পুরনো পশমের কোটটা চড়িয়ে নিলেন শরীরে। খুলে ফেললেন হাতের সমস্ত আংটি। গ্লাসে ভদকা ঢেলে নিজেকে পূর্ণ করে চলে গেলেন গ্যারেজে। শাটার ফেলে নিজেকে আবদ্ধ করে নিলেন একেবারে। এরপর চেপে বসলেন গাড়িতে। চালু করে দিলেন ইঞ্জিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো গ্যারেজ ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। কার্বন মনোক্সাইড বিষে ভরে গেল কবির ফুসফুস। সমাপ্তি হলো জীবনের। আশ্চর্য যে আগের বছর এক সাক্ষাৎকারে তাকে বলতে শোনা গেছিল, ওই বইয়ের (দি ওফুল রয়িং টুওর্ড গড) কবিতাগুলো মাত্র ২০ দিনে রচনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে ২ দিন গেছে হতাশায় আর ৩ দিন নষ্ট হয়েছে মানসিক হাসপাতালে। আরও বলেছিলেন, কবিতাগুলো কেবল তাঁর মৃত্যুর পরই প্রকাশ হতে পারবে। ৪৫ বছর বয়সেই নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন। বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগছিলেন তিনি। ভয়ানক বিষণ্ণতা আবার কখনও অস্বাভাবিক উন্নত মেজাজ। দুটো অবস্থাই প্রায় সপ্তাহ খানেক স্থায়ী হোতো। কখনও নিজেকে অসম্ভব উদ্যমী, আনন্দিত বোধ করতেন। অথবা উল্টোভাবে কখনও প্রচণ্ড খিটখিটে আচরণ করতেন। কোনোরকম পরিণতির কথা চিন্তা না করে আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন। আবার যখন অবসাদ ভর করতো, তখন কারও চোখের দিকে তাকাতে পারতেন না। জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক হয়ে উঠতেন। মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও করতেন। মিলান কুণ্ডেরা মানসিক এই অবস্থাটিকে চিহ্নিত করেছেন দুর্বলতার ঘোর হিসেবে। ‘মানুষ সেই মুহূর্তে নিজের দুর্বলতা বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে এবং হাল ছেড়ে দেয়। দুর্বলতার মদে মাতাল হয়ে ওঠে সে। দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠতে ইচ্ছে হয় তার।’ সেক্সটনের কবিতাগুলো খুবই ব্যক্তিগত। স্বীকারোক্তিমূলক। মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতেই কি এইরকম কবিতা লিখতেন চাইতেন তিনি? অবশ্য কিছুদিন পরই বুঝতে পারলেন, হচ্ছে না। কবিতা হচ্ছে কিন্তু সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। Thief!— How did you crawl into, Crawn down alone Into the death I wanted so badly and for so long, The death we said we both outgrew, The one we wore on our skinny breast, The one we talked of so often each time, We downed three extra-dry martinis in Boston… [Sylvia’s Death] প্লাথের মৃত্যুর ঘটনাটাই আসলে সেক্সটনকে ধীরে ধীরে মৃত্যু আর আত্মহননের দিকে আরও আবিষ্ট করে তোলে। তাঁর থেরাপিস্ট ডাক্তার মারটিন ওরনে-কে একবার বলেছিলেন, “সিলভিয়ার মৃত্যু আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে, যেন আমিও সেটা চাই। যেন এমন কিছু একটা সে নিয়ে গেছে যেটা আমার ছিল।” এ জন্যই হয়তো তিনিও চেখেছিলেন একই বিষের স্বাদ। ছোট্ট সিলভিয়ার পৃথিবীর হাওয়া আর ভালো লাগছিল না। সে চেয়েছিল হাওয়ার বদলে জল শ্বাস নিতে। জলকেই আপন করে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে দুজনেই হাওয়া-বিষে আলিঙ্গন করলেন মৃত্যু। অন্যদিকে আরও একজন কবি। এই দুই মৃত্যুর কিছুটা মাঝামাঝি সময়ে। হ্যাঁ, সে দিন ছিল ২০শে এপ্রিল, ১৯৭০। বোঝা যাচ্ছিল না সময়টা বিকেল না সন্ধ্যা; কিংবা দুপুর না সকাল। কারণ, প্যারিসের আকাশ তখন অদ্ভুত রকম বিমর্ষ; মেঘাচ্ছন্ন। মুহুর্মুহু নেমে আসছে বৃষ্টি। অন্য দিনের তুলনায় রাস্তা-ঘাটও অনেকটাই জন শূন্য। জন শূন্য গিওম এপোলিনের-এর কবিতার সেই ব্রিজ, প্যঁ মিখাব্য। আর, এরই মধ্যে ওই মিখাব্য ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন একজন। মাথাটা কালো ওভারকোটে ঢাকা। সিগারেট খাচ্ছিলেন, নাকি ঠাণ্ডায় ধোঁয়া বেরুচ্ছিল মুখ থেকে? —ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝ বরাবর এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গিয়ে থামলেন একেবারে কিনারায়। মাথার কোটটুকু সরালেন এক সময়। বৃষ্টির ফোটারা শেষ কয়েকটা মুহূর্ত স্পর্শ করলো তার চোখ, আর, তিনি সেই চোখেই স্থির তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ স্যেনের দিকে। চির বহমান স্যেন। ওর ওই জলরাশি কি ঘুনাক্ষরেও তখন জানতে পেরেছিল: আজকের এই মুহূর্ত ক’টাই, উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে মহাকালে? হয়তো না। কিন্তু— এর ঠিক ৫০ বছর পর, এমদাদ রহমান, আমার বন্ধু, ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন প্যারিসের অলি-গলি। কথা দিয়েছেন, একদিন যাবেন প্যঁ মিখাব্য। কয়েকটা ছবি তুলে পাঠাবেন আমাকে। স্যেনের ছবি। প্যঁ মিখাব্য’র ছবি। ভাবছিলাম, সেই ছবিগুলোর ভেতর দিয়েই স্পর্শ করতে চাইবো আমি ৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়া সেই মুহূর্তগুলোকে। শুনতে চাইবো ওই লাফিয়ে পড়ার আওয়াজটুকুও যখন স্যেন তার হৃদয় উন্মোচিত করে গ্রহণ করে নেয় তাঁকে। গত শতাব্দীর সবচেয়ে অভিনব আর প্রিয় কবি, পাউল সেলানকে। Without a word of warning and without leaving a note. But he had left a biography of Hölderlin open on his desk, with the underlined words: Sometimes this genius becomes dark and sinks into the bitter well of the heart. জল শ্বাস নিতে চেয়েছিলেন তিনিও? নাকি হৃদয়ের তিক্ত গহ্বরে তলিয়ে গেলেন সেলান। নয়তো জলেই কেন আত্মাহুতি। হৃদয়ের গভীরে কিছু ক্ষত জমা থাকে মানুষের, যা কখনো সারে না। সেরকমই কিছু ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেলান, যার থেকে মুক্তি ছিল না তাঁর। পুরষ্কার কিংবা মানুষের প্রশংসা আর ভালোবাসা পেয়েও প্রায়শই ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেন সেলান। এদিকে প্রয়াত কবি ইভান গলের বিধবা পত্নী তাঁর বিরুদ্ধে লেখা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আনেন। যদিও তা ছিল পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তবু বারবার ওই অভিযোগ আনতেই থাকেন ওই মহিলা। এমনকি সেলানের কবিতা যে তাঁর নিজস্ব, জার্মনির সমালোচকেরাও সেটা না-মানতে বা অস্বীকৃতি দিতেই ছিল অতি উৎসাহী। এইরকম বর্তমান, আর বুকের ভেতর অতীতের সেই গভীর ক্ষত নিয়ে ১৯৬৫ সালে সেলান নিজেকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। প্যারিসের সাউথার্ন আউটস্কার্টস এর একটি ক্লিনিক সেন্ট-জেনেভিএফ-দ্য-বুয়া তে। আর স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে তারা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এক রুমের একটি এপার্টমেন্টে চলে যান তিনি। কিন্তু, সেখানে থেকে, ধীরে ধীরে নিজেকে আরো বেশি অবরুদ্ধ আর অসহায় ভাবতে শুরু করেন। সে বছরই তাঁর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে ফরাসি কবি জঁ দ্যেভের [Jean Daive]। যিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন— In the solitude of the island, the donkey’s presence sometimes rends the air. He cries, he weeps, he brays. I hear him. And I hear within me a still living mass fall into the sea, into the Seine. সময়ের নৈঃশব্দ্যে আমরা ধুঁকে ধুঁকে আরও একজন কবিকে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখেছি। কবি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়রি থেকে জানা যায় তিনি লিখছেন, ‘আজ সকাল ৮ টায় শামশের আনোয়ার শামশেরকে মেরে ফেলল। আত্মহত্যা করার কথা থাকে, অনেকেই করে না। প্রয়োজনও থাকে না। কারণ মৃত্যু তো আগেই হয়ে গেছে, শামশের ভীষণভাবে বেঁচে ছিল। তাই কলকাতার সাহিত্য-সংসারে সে ছিল একজন প্রকৃত একঘরে কবি।’ শামশেরকে মেরে ফেলা হয়েছিল। অত্যন্ত কুৎসিতভাবে হৃদয় যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে করে মেরে ফেলা হয়েছে তাঁকে। কবিতার কাছেই খুন হলেন তিনি। সেটা ছিল ১২ই জুন, ১৯৯৩। কলকাতার পি.জি. হাসপাতালের বেডে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তবে এর মর্মান্তিক শুরুটা এক বছর আগের। ১৯৯২ এর অক্টোবরের এক রাতে হঠাৎ শ-দেড়েক ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেন কবি শামশের আনোয়ার। ঘুমের ওষুধগুলো মুখে নেবার আগের সময়টায় কেমন ছিল তাঁর মানসিক অবস্থা। কী ভাবছিলেন তিনি। তাঁর হৃদয়-মনের ভিতর দিয়ে কোনো ঝড় বয়ে যাচ্ছিল কি? এটা তো এক মুহূর্তের বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে এমন মনোবস্থার ভিতর দিয়েই তো যাচ্ছিলেন তিনি। ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড অবদমন কাজ করছিল তাঁর। হয়তো খাঁচায় বন্দী পশুর মতোই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। প্রচণ্ডভাবে গোটা সমাজব্যবস্থাকেই অস্বীকার করছিলেন। অস্বীকার করছিলেন সমসময়কে, চারপাশকে। ‘বেদনাতুর আলোকরেখা’ বইয়ের একটি গদ্যে কবি একরাম আলি লিখেছেন, ‘তাঁর সব চেষ্টাই ছিল বিরুদ্ধ চেষ্টা। দীর্ঘ মেলামেশার পরও তাই তাঁকে বুঝতে পারাটা ছিল মুশকিলের। তাঁর কাজই ছিল ভবিষ্যতের অর্থাৎ ধ্বংসের দিকে হেঁটে যাওয়া আর হেঁটে যাওয়া।’ মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় যে শামশের এই অন্ধকূপ থেকে আদৌ মুক্তি চান নি। রিপু নিয়ে খেলতে খেলতে, ধ্বস্ত হতে হতে তারই নেশায় পড়ে গেছিলেন। মাদকের মত নিষিদ্ধ নেশা। আত্মপীড়নের সুখ। নইলে কেউ কেনই বা লিখবে : “এ জটিল পুজো ছেড়ে কীভাবে তোমাদের কাছে যাব?/ হে অখন্ড মন্দির! হে পতাকা!” (ব্যক্তিগত কাটামুন্ডের পুজো/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে)। আসলে তিনি বোধহয় জানতেন মুক্তি বলে কিছু হয়না। জানতেন এভাবে চলতে চলতেই দুম করে একদিন শেষ হয়ে যাবে খেলা। আর তাই বোধয় মেতে ওঠেন আত্মধ্বংসের খেলায়। ভাস্কর চক্রবর্তী তাঁকে দুর্লভ সশস্ত্র, আধুনিক কবি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। শামশের আনোয়ারের নিজেরই ভাষায়ই আমরা জানতে পারি, একজন খুনির সাথে একজন কবির এক জায়গায় সূক্ষ্ম মিল আছে। আসলে, খুনির মতো রাগ না থাকলে কবিতার টুটি চিপে ধরা যায় না। এই জন্যেই হয়তো তাঁর চরিত্র ক্ষুব্ধ, আক্রমণাত্মক আর দুঃসাহসিক। তেমনই তাঁর কবিতাও। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী আরও লিখেছিলেন, ‘শামশেরের সঙ্গে বন্ধুত্বটাই ছিল একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো। এতটাই উদ্দামতা, সজীবতা, দুঃসাহসিকতা ছিলো শামশেরের—এতটাই আক্রমণাত্মক, বিষণ্ণ আর ক্ষুব্ধ—এতটাই আন্তরিক ছিলো শামশের—এতটাই আন্তরিক যে, প্রকৃত শামশেরকে খুঁজে পাওয়াই ছিলো মুশকিল।’ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে দেখতে যেতেন প্রায়ই। চিকিৎসার খোঁজখবর রাখতেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইন্ডিয়াটাইমস-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আমরা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে বলতে শুনি – Shamsher Anwar was my friend. We used to spend a lot of time together. He was an eminent poet. We started writing around the same time. But Shamsher, at one point of time, thought he wasn’t contributing much and got very upset. I tried pulling him out of that state. Creativity makes you very difficult. I know I too can get very difficult at times. Having lost his mental balance, Anwar tried to commit suicide. No, he didn’t die. For one month, he was lying like a log on the hospital bed. I would sit by his bedside and the doctors gave up hope. We lost him eventually. But I’m still very fond of the name. Whenever I hear Anwar, I look around, there’s a happy feeling inside me. সৃষ্টিশীলতা আমাদের জীবনকে জটিল করে তোলে? মায়াকোভস্কির মৃত্যুর পর লিলিয়া ব্রিক বলেছিলেন, “আত্মহত্যার চিন্তা তাঁর মাথার ভেতর দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতোই বাসা বেঁধে ছিল। অন্য যে কোনও দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো এটিও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল তাঁর ক্রমান্বয়ে প্রতিকূল হয়ে ওঠা পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে…।” মানতে পারছিলেন না তিনি। একেবারেই অবাঞ্ছিত ছিল সেইসব অবজ্ঞা। লেনিনের মৃত্যুর পর থেকেই যা শুরু হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। প্রলেতারিয়েত লেখক সংঘ কিছুতেই তাঁকে, তাঁর খ্যাতি আর জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারছিল না। অপমান অপদস্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। তাঁর ফিউচারিস্টিক এক্সপেরিমেন্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তাঁকে তাচ্ছিল্যই হয়ে উঠেছিল নৈমিত্তিক। প্রচণ্ড মানসিক পীড়নের ভেতর আর এগুতে পারছিলেন না তিনি। তাঁকে শেষবারের মতো প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল ১২ই এপ্রিল, ১৯৩০। কপিরাইট আইন বিষয়ক একটা মিটিঙে অংশগ্রহণ করেন সেদিন। এরপর ১৪ই এপ্রিল, প্রেমিকা, অভিনেত্রী ভেরোনিকা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসতেই পেছনে ঘরের ভেতর থেকে একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পান। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যান ঘরে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। মেঝেয় পড়ে আছে কবির রক্তাক্ত দেহ। গুলিটা করেছেন একেবারে হার্ট বরাবর। টেবিলে পড়ে আছে ডেথ নোট। কবির নিজ হাতে লেখা। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো লিখছিলেন। কারণ ডেথ নোটের কবিতাটা ছিল অসম্পূর্ণ। শেষ করারও সময় দেননি নিজেকে। “তোমাদের সবাইকে বলছি। মরে যাচ্ছি আমি। তবে এর জন্য দোষী করবে না কাউকে। কোনও কানাঘুষাও না। মৃত ব্যক্তির এসব খুবই অপছন্দ। মা, বোনেরা, কমরেডগণ, আমাকে ক্ষমা করবেন—মরার জন্য এটা একদম ভালো কোনও উপায় না (কারও জন্যেই এমন মৃত্যু সুপারিশ করব না আমি), কিন্তু আমার আর কোনও উপায়ও ছিল না। লিলি—ভালোবেসো আমায়। কমরেড সরকার, লিলি, মা, আমার বোনেরা আর ভেরোনিকা ভিতলদভ্না পোলনস্কায়াকে নিয়ে আমার পরিবার। যদি সম্ভব হয়, ওদের জন্য সুন্দর একটা জীবন উপহার দেবেন। আর এই কবিতা, যেটা শুরু করেছি এখানে, ব্রিকদের দেবেন। ওরাই এটার যা হয় করবে। …” And so they say – “the incident dissolved” the love boat smashed up on the dreary routine. I’m through with life and [we] should absolve from mutual hurts, afflictions and spleen ১৭ই এপ্রিল তাঁর ফিউনারেলে প্রায় ১৫০০০০ মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন, প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে। সোভিয়েত ইতিহাসে ওটা ছিল তৃতীয় বৃহত্তর ফিউনারেল। কবির সেই শেষকৃত্য যেন আজও চলছে। শোকাচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাদের। কিন্তু কেন একজন কবিকেও আচ্ছন্ন হতে হয় অবসাদে? কেন আক্রান্ত হন বিষণ্ণতায়? একের পর এক দুঃখ যন্ত্রণাই কি এর কারণ? আবার দুঃখের আগুনে পুড়েই তো কবির অনুভূতি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। জন্ম দেন খাঁটি কবিতার। আমরা অবশ্য ভুলে যেতে পারিনা যে একজন কবি একজন মানুষও। একজন সাধারণ মানুষের মতোই থাকতে পারে তাঁর মানসিক দুর্বলতা। কিছু ক্ষেত্রে সাধারণের চেয়েও দুর্বল আর স্পর্শকাতর হন তিনি। একটা পর্যায়ে তার কাছেও মনে হতে পারে খুবই অসম্ভব এই দুনিয়া, সহ্যেরও অতীত, সব কিছুই ক্যামন ভেঙে পড়ছে একে একে। দারুণ হীন মনে হতে পারে নিজেকে। কিছুকাল পূর্বেও যে বিষয়গুলো উদ্দীপিত করতে পারতো, আজ তা আর পারছে না। কোনও কিছুই আর সেভাবে তাঁকে আগ্রহী করে তুলতে পারে না। এমনটা হতেই পারে। তবে তা একদিনেই হয় না। ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে কবির অবচেতনে। তিনি বুঝতেই পারেন না, কী হচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যু হয় তাঁর। বুঝতে পারেন না, ঠিক কবে থেকে এর শুরু। ওই যে, হোল্ডারলিনের বায়োগ্রাফিতে যেটা লেখা ছিল: Sometimes this genius becomes dark and sinks into the bitter well of the heart. ব্যাখ্যাতীত এমন অনুভূতি নিয়ে কীভাবে তখন কথা বলা যায় কারও সাথে। তিনি নিজেই হয়তো ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না। কীভাবে এই অতলকে দৃশ্যমান করবেন যেখানে তলিয়েই যাচ্ছেন কেবল। যেখান থেকে মুক্তির আকুতি তো কোনোভাবেই কারও কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বোঝানো যাচ্ছে না যে ওটা তাঁর ইচ্ছাধীন আর নেই। বরং তিনিই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন। একেবারে অপরিচিত পথে। একেবারে ভিন্নভাবে। এই জন্যেই নিজেকে আড়াল করে ফ্যালেন কবি। এবং আরও নিমজ্জিত হতে থাকেন। এক সময় নেশার মতো হয়ে ওঠে। মৃত্যু আবেশে আবিষ্ট হন। কামনা করতে থাকেন, যেন ওটাই তাঁর মুক্তির পথ। মায়াকোভস্কি যেমন লিখেছিলেন তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না। জীবনের বিপরীতে এ’ এক প্রতিক্রিয়া, যা তাঁর কাম্য ছিল না। জীবনের বিষয়গুলো যেমন, তেমন করে স্বীকার করতে না পারা। আর সেগুলো পরিবর্তনে নিজেকে অক্ষম ভাবাই তাঁকে অনেক নিচে ফেলে দেয়। প্রতিদিনের একটু একটু মৃত্যু অবদমিত হয় তাঁর অভ্যন্তরে। কবি পতিত হন অন্ধ কূপে। যেখান থেকে পরিত্রাণের পথ একমাত্র দৈহিক মৃত্যুকেই মনে হয় তাঁর। বিকেলে সুবোধ বাবু এলেন না। জীবনানন্দ একাই বেরিয়ে গেলেন হাঁটতে। হাঁটতে লাগলেন ল্যান্সডাউন রোড দিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে গড়িয়াহাটা গোলপার্কের দিকে। তখন হেমন্ত কাল। পাতা ঝরছে চারদিকে। তিনি হাঁটছেন একা একা। ঝরা পাতা এসে পড়ছে তাঁর গায়ে। কী ভাবছিলেন তখন তিনি? মুক্তি? পুরো পথ ঘুরে আবার রাসবিহারী মোড়। বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম একটা প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মতো দ্রুত ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে তখন। ট্রাম এগিয়ে আসছে, তিনিও এগিয়ে যাচ্ছেন। …নিরন্তর বহমান সমুদ্রের থেকে খসে গিয়ে সময়ের জালে আমি জড়িয়ে পড়েছি যতদূর যেতে চাই, এই পটভূমি ছেড়ে দিয়ে— চিহ্নিত সাগর ছেড়ে অন্য এক সমুদ্রের পানে ইতিহাস ছেড়ে দিয়ে ইতিহাসহীনতার দিকে— মনে হয় এই আধ কণা জল দিয়ে দ্রুত রক্তনদীটিকে সচ্ছল অমল জলে পরিণত করতে চেয়েছি…
- [কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জয় গোস্বামী, শাহাদুজ্জামান]

ঋতো আহমেদ কবি, গদ্যকার এবং অনুবাদক। জন্ম ১৯৮০ সালের ময়মনসিংহ শহরের কালীবাড়ি বাইলেন। গ্রাজুয়েশন করেছেন শাহ্ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্প প্রকৌশলে। কর্মজীবনে বর্তমানে একটি টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিকল্পনা ও উৎপাদন বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। বসবাস করছেন ঢাকায়। প্রকাশিত বই- কবিতা: ভাঙনের মুখ হে অনন্ত অগ্নি জলের পাতাল অনুবাদ: ওয়াকিং টু মার্থাস ভিনিয়ার্ড আদিরসাত্মক সংস্কৃত কবিতা গদ্য: কবিতায় অভিনিবেশ