================================================================

================================================================
অসম-উত্তর সময়ে, আমরা কেউই জানি না আগামীকাল আমাদের এ’রাষ্ট্রের নাগরিক মানা হবে কিনা৷ তবু ‘দেশ’ নামের বিমূর্ত ধারণাকে ঘৃণা করতে পারি না৷ হয়ত এ আমার সীমাবদ্ধতা যে, আমার কাছে দেশ মানে কমিউন বা যৌথ খামারের মতোই এক যূথবদ্ধতার ধারণা৷ প্রথমটির সঙ্গেও একাত্মবোধ করি, দ্বিতীয়/ তৃতীয়টির মতো৷ বাগধারায় যা ‘পায়ের তলায় মাটি’, তা কোথাও গিয়ে ‘দেশের মাটি’-র সঙ্গে মেশে আমার একান্ত ব্যক্তিগত বোঝাপড়ায়। পনেরই অগাস্ট নামক ফিকে দিনে পথের মোড়ে ‘সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে’ ইত্যাদি শুনলে আবেগী হওয়াও আটকাতে পারি কই? ‘কালেকটিভ আনকনশাসে’ সেঁধিয়ে যাওয়া এই ভালবাসা আমার ক্ষেত্রে উপশমযোগ্য নয়। কিন্তু যা বলি, যা ভাবি, কালের নীতি অনুযায়ী তা ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে যায়৷ এ অসহায়তা ভাবায় দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহের সংজ্ঞা নিয়ে৷ আর ভাবার হিংসার ভাল-মন্দ নিয়ে।
সোজা কথা সোজা ভাবে বলা ভাল৷ আজকের ভারতের প্রেক্ষিতে সংবেদনশীল ও ধান্দাহীন কোনো মানুষের পক্ষে রাষ্ট্রবাদী হওয়া সম্ভব নয়৷ রাষ্ট্রের এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা সে করতে পারে বা নিতে পারে। যেমন, ধরা যাক, একজন সৎ সরকারি কর্মচারী চাইবেন রাষ্ট্রীয় সুবিধা সর্বাধিক মানুষকে পাইয়ে দিতে৷ অথবা, ধরা যাক, গৃহহিংসায় কাতর কোনো মেয়ে হয়ত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি প্রশাসনের দরজায় কড়া নাড়বেন, কারণ রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার প্রত্যাশা করার সাংবিধানিক অধিকার আছে তাঁর৷ রাষ্ট্র এসব ক্ষেত্রে এমন এক ব্যবস্থাপনা, যা নাগরিকের জীবনপথ সুগম করে, বা তার করা উচিত, অন্তত তেমনই কথা ছিল। কিন্তু এর বাইরেও রাষ্ট্রের এক হিংস্র ভয়াল মুখ আছে৷ গণতন্ত্রের কাজ ছিল, সে মুখের কুঞ্চিত ভুরু টেনে সোজা করা, শক্ত পেশি ঢিলে করে দেওয়া। এক কথায়, ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের রাগ ও প্রতিশোধস্পৃহায় লাগাম পরানো। এই টানাপোড়েন সর্বকালে সব সরকারের আমলেই চলেছে৷ কিন্তু এ আমলের সঙ্গে তফাত হল, শুধু আইনি ভাবে নয়, সাংস্কৃতিক ভাবে বিরোধাভাস-কে একঘরে করে দেওয়ার এমন সর্বাত্মক চেষ্টা হয়নি আগে। ‘ইয়ে অ্যান্টি-ন্যাশনাল হ্যায়’, ‘উও আর্বান নক্সাল হ্যায়’ ইত্যাদি ট্যাগ হরির লুটের বাতাসার মতো বিলি হয়নি। দেশ আর রাষ্ট্র নাকি আলাদা, দেশকে ভালবেসে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়া যায়— এইসব ধারণার ধারাবাহিকতা ফলত আমরা উত্তরাধিকারে পেয়েছিলাম।
হিংসার ভাল-মন্দ নিয়ে সন্দীহান হয়ে পড়ার শুরু, বোধ করি, কলেজবেলায়। বাইরে তখন মাওবাদের ভূত, ক্লাসের ভিতরে শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’। নাটকে সেনাপতি ম্যাকবেথ যখন রাজদ্রোহী ম্যাকডোনাল্ডের বুক থেকে মাথা পর্যন্ত চিরে দিচ্ছে আর তার মুণ্ডু নাচাচ্ছে তলোয়ারের আগায়, তখন নির্মমতার বর্ণনায় কেমন বমি পেয়ে গেল। বুঝলাম, মাওবাদী হওয়া আমার হল না৷ কিন্তু অবাক হওয়া বাকি ছিল। বিজয়ী ম্যাকবেথ রাজসভার ফিরল। রাজা-মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র সকলেই সে কি খাতির করল তাকে! সভার মতে ওসব কীর্তি নির্মমতা নয়, বরং ‘বীরত্ব’। তা হবে হয়ত। আমিই হয়ত দুর্বলস্নায়ু। কিন্তু এরপর ম্যাকবেথকে পেয়ে বসছে সিংহাসনের লোভ, আর সে হয়ে উঠছে রাজহন্তা। অমনি মন্ত্রী-সান্ত্রী-পাত্র-মিত্র রে রে করে উঠছে: ‘কি হিংস্র! কী নির্মম!’ হিংসা বিষয়ক এ দ্বিচারিতায় শেকসপিয়রের অবশ্য মন নেই। তাঁর ফোকাস চরিত্রে, তার টানাপোড়েনে, উত্থান-পতনে। কিন্তু আমি মনে মনে ঘটনা দুটোকে তুলনা করি। এক, ‘শত্রু’-কে চিরে ফেলে ক্ষান্ত হওয়া গেল না, শব থেকে মাথাটিও ছিঁড়ে নিতে হল। দুই, ঘুমন্ত রাজার বুকে বিঁধিয়ে দেওয়া হল ছুরি। কোনটি বেশি নির্মম? তুলনাই বাতুলতা, কারণ ফল একই। কিন্তু, ঘৃণার প্রকাশ যেন প্রথমটিতে বেশি, নয়? এত হিংসা কীভাবে কার ছাড়পত্র পেল? তাহলে কি হিংসার ভাল-মন্দ বিচার মানবিক নৈতিকতার ভিত্তিতে হয় না? হয় রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার ভিত্তিতে?
আরও পরে জানলাম, কোহলার নামের এক সায়েব শিক্ষাবিদ নৈতিক বিকাশের ধাপসমূহ বুঝতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শৈশবের নীতিবোধ গড়ে ওঠে শাস্তির ভয়ে বা পুরস্কারের আশায়৷ তারপর কৈশোর থেকে প্রাপ্তবয়স পর্যন্ত নীতিবোধকে আকার দেয় একে একে নানা প্রতিষ্ঠান— প্রথমে পরিবার, তারপর সমাজ, শেষত সেই পথ বেয়ে নীতিমালার নিয়ন্তা হয় রাষ্ট্র। কোনটা খুন আর কোনটা দেশরক্ষা, কোনটা দেশপ্রেম আর কোনটা দ্রোহ, সবই নির্ধারিত হয় এইমতো। কোহলার অবশ্য বলেন, এর পরেও একটা ধাপ আছে, তা সবাই পেরোয় না। পেরোতে চায়ও কি? সে ধাপ হল, প্রচলিত নীতিকে প্রশ্ন করার ধাপ। সে ধাপের ঝুঁকিও অনস্বীকার্য। ঝুঁকি বাড়ে ধাপে ধাপে। পরিবারের অবাধ্য হলে মারধোর, তিরস্কার, বড়জোর ‘ত্যাজ্য’ করা। আর রাষ্ট্রের অবাধ্য হলে? সুদীর্ঘ বা আজীবন হাজতবাস, যা আসলে ‘দেশের নিরাপত্তা-সুনিশ্চিতকরণ’। এনকাউন্টার, যা ‘খুন নয়’। ধর্ষণ, যা ‘নারী-নির্যাতন নয়’।
ভারতীয় ক্রিমিনাল আইন ব্যবস্থা, বিশেষত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আইনকানুন, মূলত ঔপনিবেশিক আইনগুলির উত্তরসূরি। এর মধ্যে ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ পাকড়ানোর অধুনা আইন ইউএপিএ নিয়ে শেষবার আলোচনা হয়েছিল, যদ্দূর মনে পড়ে, ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পর৷ স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুকে ‘বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড’ বলেছিলেন অনেকে। বিচারের সমালোচনা হয় আইনের নিক্তিতে। কিন্তু আইন-ই যদি ব্যক্তির উপর অত্যাচার বা হত্যার অনুমতি বা প্ররোচনা দেয়? তাহলে বিচারবিভাগীয় হত্যা নাকি আইনবিভাগীয় হত্যা বলা হবে এটিকে?
১৯০৮ সালে লর্ড মিন্টো চালু করেছিলেন ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট, ১৯০৮’। তখন বঙ্গভঙ্গের পর বাংলা উত্তাল। সভা-সমিতি-মিটিং-মিছিল বন্ধ করা দরকার পড়েছিল। আবার, ১৯১৯ সালে রাওলাট আইন এসেছিল, যার বলে পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি চালাতে বা স্রেফ সন্দেহের বশে বিনা বিচারে দু বছর পর্যন্ত ব্যক্তিকে আটক করে রাখতে পারত। মজার কথা হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনুরূপ নানা আইন বহাল রইল বা নতুনভাবে প্রবর্তিত হল। যেমন, ব্রিটিশরা ১৯৪২ সালের আন্দোলনকে দমন করতে এনেছিল ‘আর্মড ফোর্স স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স’, যা পরবর্তীকালে ‘আর্মড ফোর্স স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের’ রূপ নিয়েছে। আফস্পা। সেই কুখ্যাত আফস্পা, যে আইন এখন কাশ্মীরে প্রয়োগ হচ্ছে, অতীতে উত্তর -পূর্ব ভারতে প্রয়োগ হয়েছে৷
ষাট আর সত্তরের দশকে ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ দমন করতে এসেছিল ‘ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৬২’। ‘মেইনটেইনেন্স অফ ইন্টার্নাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ১৯৭১’ বা ‘মিসা’ যখন এল, তখনও পাকিস্তান আর চীনের ভয়কেই কারণ হিসেবে দর্শানো হল। অথচ আসল টার্গেট অন্তর্দেশীয় ক্ষোভ, বিশেষত নক্সাল আন্দোলন দমন। ১৯৬৭ সালে পাস হয়েছিল ‘আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট/ ইউএপিএ, ১৯৬৭’, যা আমাদের পরিচিত ইউএপিএ-র আদিরূপ। ২০০৪ সালে ‘প্রিভেনশন অফ টেরোরিজম অ্যাক্ট/ পোটা’ তুলে দেওয়া হল। কিন্তু পোটার কিছু ধারা যোগ করে ‘সংশোধন’ করা হল ইউএপিএ-কে। মিসা-য় আটক অর্চনা গুহ রুণু গুহনিয়োগীর অত্যাচারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কিন্তু নিজে নক্সালও ছিলেন না, ছিলেন নক্সালের বোন। তিনি একইভাবে অত্যাচারিত অনেকের একজন ছিলেন মাত্র। ক্রমে জাতীয় সুরক্ষার নামে তৈরি হয়েছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট/ এনএসএ এবং ন্যশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যাক্ট/ এনআইএ, আরও কত কী!
আবার ক্রমশ ইউএপিএ-ও বিবর্তিত হয়েছে রাষ্ট্রের চোখে ‘দ্রোহের’ সংজ্ঞার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। বিশেষত ২০১৯ সালে ইউএপিএ-তে নতুন ভাবে যখন শাণ দেওয়া হল, তখন বলা হল, সংগঠনের পাশাপাশি কোনো সংগঠনহীন ব্যক্তিকেও ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দেওয়া যাবে। আরও বলা হল, ‘দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’- এই সাধারণ নীতি ইউএপিএ-র ক্ষেত্রে খাটবে না৷
ভীমা-কোরেগাঁও মামলার সূত্রে ২০১৮ সাল থেকে ইউএপিএ-তে অভিযুক্তের সংখ্যা বেড়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিল ষোলোয়, যাঁদের মধ্যে সবশেষে গ্রেফতার হন সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ঝাড়খণ্ডের ফাদার স্ট্যান স্বামী। স্মরণ করানো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ৯০% প্রতিবন্ধী অধ্যাপক জি এন সাইবাবা ২০১৭ সালে ইউএপিএ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। চিকিৎসক হিসেবে সাধারণ মানুষ ও মাওবাদীর তফাত করেননি বলে ইউএপিএ-তে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন বিনায়ক সেন, তবে তিনি জামিনে মুক্ত। আদিবাসী অঞ্চলে স্কুল চালাতেন সোনি সোরি, ইউএপিএ সহ একাধিক আইনে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। তাঁর অবর্ণণীয় নির্যাতন নিয়ে বিস্তারে লেখার পরিসর এখানে নেই৷ কিন্তু যোনিতে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়ার গল্পটুকু বোধ করি সবার জানা।
পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯ সালে মাওবাদী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কিছুক্ষণ পরেই কলকাতা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল গৌর চক্রবর্তীকে, অথচ ২০১৬ সালে মুক্তি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত নয়। মাওবাদী কর্মী সুদীপ চোংদার মারা গেছেন হেফাজতেই। লালগড়ের ‘সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’-র মুখপাত্র ছত্রধর মাহাতো এবং সেই সংগঠনের অন্যরা ইউএপিএ-তে প্রথম ‘দোষী’ সাব্যস্ত হন পশ্চিমবঙ্গে। এর আগে এই রাজ্যে এই ধারা প্রয়োগ করা হলেও, কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি। ২০১৭ সালে ভাঙড় আন্দোলন চলার সময়েও ইউএপিএ-র যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা গেছে। সেসব মামলা এখনও চলছে।
ভাঙড়ের মামলাগুলি আবার আমার পরিসরে ‘ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক।’ নিকটজনেরা অভিযুক্ত হওয়ায় শুনানিতে যেতে হত— তাদের বেইল হওয়ার আগে পর্যন্ত৷ সে’সময় আমার পাঁচ বছরের মেয়ে প্রথম প্রশ্ন করে, ‘পুলিশ কি তবে খারাপ লোকেদের ধরে না?’, ‘পুলিশ কি নিজেই খারাপ?’ চরমপন্থী হলে চূড়ান্ত রাষ্ট্রবিরোধী নিদান দিতে পারতাম, যেমন, ‘পুলিশ মানেই খারাপ আর পুলিশবিরোধী মানেই ভাল।’ কিন্তু তা নই বলে উত্তর দিতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়লাম৷ কাজ চালানোর জন্য যা বললাম, তার মানে দাঁড়ায়৷ ভাল আর মন্দ প্রেক্ষিত অনুযায়ী বদলে বদলে যায়। অথচ পুলিস বেচারাকে ভাল-মন্দের এক অনড় সংজ্ঞা মেনে কাজ করতে হয় তো! সে তেমন কিছু বুঝল না। কিন্তু আমি বুঝলাম, কোহলারের তত্ত্ব মেনে তার এখন পুলিসকে নেহাতই মন্দের শাস্তিদূত হিসেবে দেখার কথা৷ অথচ ভাঙড় তাকে অকালে ঘেঁটে দিল।
২০২০ সালে ইউএপিএ ধারায় দিল্লিতে গ্রেফতার হন জেএনইউ-র ছাত্রনেতা উমর খালিদ, জামিয়া মিলিয়ার মীরাণ হায়দার, সাফুরা জারগার ও আরও শয়ে শয়ে মানুষ। এঁদের কেউ কেউ জেলে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। সফুরা জারগার ছিলেন অন্তঃসত্তা, তা সত্ত্বেও গ্রেফতার আটকায়নি। গ্রেফতার হয়েছিলেন নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা এবং আসিফ ইকবাল তানহা। অভিযোগ ছিল দিল্লি দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার, অথচ তাঁরা সিএএ-বিরোধী সভা-সমিতি করেছিলেন মাত্র। শেষোক্ত তিনজনের জামিনের সময় দিল্লি হাইকোর্ট স্পষ্ট বলেছে, ‘ইদানিং সামান্য আইন ভাঙার ঘটনা, যেমন জটলা করা, বক্তৃতায় দুটো সরকার-বিরোধী কথা বলা, চাক্কা জ্যাম করা ইত্যাদিকেও ইউএপিএ-র আওতায় ফেলা হচ্ছে, যা কাম্য নয়৷’
উমর খালিদ আজও জেল খাটছেন। কোভিড কালে আরও যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সিদ্দিক কাপ্পান বা মহম্মদ জুবেইরের নাম আমরা জানি, কারণ এঁদের অন্তত অর্থানুকুল্য ও যোগাযোগ ছিল আইনি লড়াই লড়ার মতো। অসরকারি সূত্রে খবর, এনআরসি আন্দোলন ও দিল্লি দাঙ্গার সূত্রে আসলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রায় হাজার দুই মানুষ। তাদের মধ্যে অন্তত দেড় হাজার জন, অধিকাংশই সংখ্যালঘু, এখনও বন্দি। এদের নাম আমরা জানি না।
রাজনৈতিক প্রতিশোধস্পৃহার উদযাপন হিসাবে স্বাধীন, বৃহত্তম গণতন্ত্রে বন্দিত্ব ও অত্যাচারের উদাহরণ অগণিত। ভুক্তভোগীদের কেউ রাজনৈতিক কর্মী, কেউ আদৌ কোনো রাজনৈতিক দল করেন না (যেমন স্ট্যান স্বামী নিজে)। মিল এক জায়গাতে। তাঁরা মানুষের স্বার্থে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এঁরা সকলেই ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত হলেও, নিষিদ্ধ দলের নেতা-কর্মীদের নাম সমাজকর্মীদের সঙ্গে নেওয়াটা ঠিক হল কিনা। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ২০১১ সালের একটি রায়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ ‘অরূপ ভুঁইয়া বনাম আসাম সরকার’ মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য-পদ নিলে এবং সেই নিষিদ্ধ ভাবনা পোষণ করলেও কোনও ব্যক্তিকে আইনের চোখে অপরাধী বলা যায় না, যতক্ষণ না তিনি সাধারণ মানুষকে হিংসাত্মক কার্যকলাপে উৎসাহিত করছেন বা স্বয়ং আইনশৃঙখলা ভেঙে হিংসার আশ্রয় নিচ্ছেন।
২০১৯ সালে সজল আওস্তি সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থ মামলা করেন এই মর্মে যে ইউএপিএ আইনটিই অসাংবিধানিক। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারা (সমতার অধিকার), ১৯ নং ধারা (বাকস্বাধীনতার অধিকার) এবং ২১ নং ধারা (জীবনের অধিকার)-কে তা খর্ব করে। প্রকৃতপক্ষে, বাকস্বাধীনতার যে অধিকার সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি দিয়েছে, তা সরকারের সমর্থক বা সরকারি নীতি-প্রবক্তাদের জন্য তো প্রয়োজনীয়ই নয়৷ এই ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করাই হয়েছিল তাঁদের জন্য, যাঁরা অপ্রিয় এবং ভিন্নমত পোষণ করেন।
ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত দুজন হিন্দুত্ববাদী নেতা, সম্ভাজি ভিডে ও মিলিন্দ একবোতে কিন্তু মুক্ত। একই ভাবে দিল্লি দাঙ্গার জেরে অনুরাগ ঠাকুর অধরা থাকেন। এই পক্ষপাত আবার ফেরত নিয়ে যায় শুরুতে বর্ণিত সেই ‘ম্যাকবেথ’ ক্লাসে, ‘ভাল হিংসা’ আর ‘মন্দ হিংসা’-র রাষ্ট্রীয় সংজ্ঞায়। ‘গোলি মারো সালোকো’ হয়ে যায় দেশপ্রেমের স্লোগান, অথচ সোনি সোরির যোনিতে পাথর প্রবেশ করানো হয় ‘সন্ত্রাস দমন’। ইউএপিএতে বন্দি মানুষকে আমরা হিংস্র ‘অপর’ ভাবতে শিখি। অপরত্বের নাম দিই ‘আর্বান নকসাল’ বা ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’। চাপা পড়ে যায় এই তথ্য যে ‘আরসেনাল কনসাল্টেন্সি’-র ডিজিটাল ফরেন্সিক রিপোর্ট অনুযায়ী ভীমা-কোরেগাঁও অভিযুক্তদের কম্পিউটারে ভুয়ো ডকুমেন্ট প্লান্ট করা হয়ে থাকতে পারে। এই রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার কাল হতে পারে অন্য কেউ, কারণ দ্রোহীকে হত্যা করার চেয়েও বেশি জরুরি দ্রোহকে হত্যা করা।
ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিল নয়টি বিরোধী দল, যাদের মধ্যে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিআইএম সকলেই ছিল। সকলেই নিজের রাজত্বকালে ও নিজের পরিসরে ইউএপিএ ব্যবহার করেছে। বিরোধীপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে গণতান্ত্রিক ব্যবহার প্রত্যাশা করব, অথচ শাসক হিসেবে বিরুদ্ধমত সহ্য করব না— এমনই দ্বিচারিতাই বোধ করি তাদের নীতি।
কথার শুরুতে যদিও ছিল সহিংসতা নিয়ে দোলাচলের কথা, তবু এযাবৎ আলোচনায় মনে হয় বোঝা যায়, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’-রা সকলেই ‘সহিংস’ নন। ফাদার স্ট্যানের অশক্ত হাত জলের গেলাস তুলতে পারত না, বন্দুক দূরস্থান। তবু স্ট্র দেওয়া হয়নি বৃদ্ধকে, কারণ রাষ্ট্রমতে তিনি হলেও হতে পারেন সন্ত্রাসবাদী। বস্তুত ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ধৃত অনেকেই ছিলেন ষাটোর্ধ্ব ও দুর্বলশরীর। তাঁদের চিন্তা ও বাক্-ই এক্ষেত্রে ছিল মূর্তিমান দুর্বিনয়।
এ দেশে সংবিধানের উনিশের এক ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকার করেছে। কিন্তু সেই ধারা শর্তহীন নয়। উনিশেরই দুই ধারায় লেখা আছে শর্তগুলি, এবং তারা সুবিধের নয়। নাগরিকের মতামত স্বাধীন— যদি না তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, সুরক্ষা, দেশের আইন, সরকার, জনসাধারণের নৈতিকতা ও বিশ্বাসের পক্ষে অবমাননাকর হয়।
আপাতভাবে শুনতে ভালই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব যদি জনমানুষের বিবিধ বৈচিত্র্যময় যাপন ও মননের উপর স্টিমরোলার চালিয়ে অর্জিত হয়? তার চেয়ে বড় কথা, ‘যাহাই সরকারের বিরোধিতা, তাহাই রাষ্ট্রের অপমান’ বলে চালিয়ে দেওয়াটাও কঠিন কিছু নয়। সেই অজুহাতে একসময় দেশে এসেছিল এমার্জেন্সি, যখন প্রেসের স্বাধীনতা খর্ব করে ইন্দিরা গান্ধী নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ ছিল, আছে আর তাই থাকবে।’
সংবিধানের উনিশের দুই ধারার ওই শর্তদের আস্কারাতেই অমুক তমুক নানা ভাবাবেগে আঘাত সম্পর্কে, রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা ফৌজদারি দণ্ডবিধি, যার ভালর চেয়ে মন্দ প্রয়োগ বেশি— কিংবা, বলা ভাল, যথেচ্ছ। অথচ শ্রুতিমধুর, প্রশংসাব্যঞ্জক, ভাল ভাল কথা বলার জন্য বাকস্বাধীনতা লাগে না। শক্তিমানকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করা যাচ্ছে কিনা, সেখানেই বাকস্বাধীনতার পরীক্ষা, বা পরীক্ষা মতামত সহনের। ২০২০ সালের যে শেষ সমীক্ষা দেখেছিলাম ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’-এর, সে অনুযায়ী ভারত ১৮০ টি দেশের মধ্যে প্রেস স্বাধীনতার নিরিখে ছিল ১৪২ নম্বরে৷ অথচ গণতন্ত্র নাকি অন্তত তাত্ত্বিকভাবে বিরোধিতাকে স্বীকৃতি দেয়! ২০২০ সালেই দিল্লি হাইকোর্ট বলেছিল, যেখানে ‘ডিসেন্ট’ নেই, তা ‘ডেমোক্রেসি’ হয় কেমন করে? তার পরেও স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য অভিযোগ দায়ের হয় নানা ধারায়।
সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, ‘বন্দুকধারী হোক বা কলমধারী নক্সাল, তাদের দমন করতে হবে একইভাবে।’ ‘নক্সাল’ শব্দটি যেভাবে আলগোছে ব্যবহৃত হয় আজকাল, তার সঙ্গে নির্দিষ্ট মতাদর্শের যোগ সামান্য। রাজদ্রোহী যেকোনো কাউকে ‘নক্সাল’ দেগে দেওয়া যায়। ‘আর্বান নক্সাল’ দেগে অতিহিন্দুরা যখন গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় গৌরি লঙ্কেশকে, তখন উপুড় হয়ে পড়ে থাকা গৌরি লঙ্কেশের লাশকে বাকস্বাধীনতারই শব মনে হয়। প্রাণ হারান পানসারে, কালবুর্গি। অথচ বলা হয়, এঁদেরই ‘মত’ নাকি ছিল এত ‘হিংস্র’ যে তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর। তিস্তা শেতলবাদ, ভারভারা রাও….এঁরা সকলেই ভেবেছিলেন, মানুষের পক্ষে মতামত প্রকাশ করছেন৷ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকারে দাঁড়ি না টানলে রাষ্ট্রের বড় বিপদ৷ পরাধীন ভারতে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ছিলেন ভগৎ সিং, সূর্য সেন, প্রীতিলতা। আর ‘স্বাধীন’ দেশে?
১৯২৬ সালে, বেনিতো মুসোলিনির আমলে মার্ক্সবাদী সাংবাদিক গ্রামশিকে রায় শোনানোর সময় বিচারক নাকি বলেছিলেন, ‘বছর কুড়ির জন্য আমাদের এই মগজটির কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।’ আর ভারতবর্ষে বিচারক এম.আর শাহ এবং বিচারক বেলা.এম ত্রিবেদি বলেছেন, নব্বই শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যুক্ত এই অধ্যাপক রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারেন, কারণ তাঁর ‘মগজটাই বিপজ্জনক।’ আশৈশব পোলিওতে পঙ্গু, অন্ধ্রপ্রদেশের দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান সাইবাবা অর্থনৈতিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ছাত্রজীবন থেকে জড়িয়েছিলেন গণ আন্দোলনে। মাওবাদী ধরার নামে আদিবাসী উৎপীড়নের সরকারি প্রকল্প ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ যখন শুরু হয়, তিনি তখন ছিলেন বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে। তাই কি তাঁর মগজটি রাষ্ট্রের চোখে বেয়াড়া ও ভয়ানক? অমলাপুরম গাঁয়ের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই গরিব সন্তান হুইচেয়ারের অভাবে হামাগুড়ি দিয়ে পড়াশোনা করলেন চিরকাল। অথচ এত সংগ্রামে পাওয়া চাকরিটিও রইল না রাজদ্রোহের অভিযোগে। কোন তাড়না তাঁকে স্বার্থকেন্দ্রিক হতে দিল না? তা বোঝা স্বার্থনিবদ্ধ মানুষের পক্ষে দুষ্কর বলেই কি তিনি ‘বিপজ্জনক’?
অধ্যাপক জিএন সাইবাবা, সাংবাদিক প্রশান্ত রাহি, ছাত্র এবং সাংস্কৃতিক কর্মী হেম মিশ্র, পান্ডু নরোতে, মহেশ তিরকি এবং বিজয় তিরকিকে ১৪ই অক্টোবর ২০২২ তারিখে বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ বেকসুর খালাস করেছিল। তারপর রাতারাতি ঘটল সুপ্রিম কোর্টে আপিল ও শুনানি। ১৫ই অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খালাসের আদেশ স্থগিত করল। জনসম্পদ তথা অরণ্যসম্পদের কর্পোরেট লুটে যাতে অসুবিধে না হয়, সে কারণে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হচ্ছিল যে ‘অপারেশন গ্রিনহান্ট’, তা তখনকার মতো থামানো গেলেও, বিজেপি পরিচালিত রাষ্ট্রে তা আরও নৃশংস রূপে ফিরে এসেছে ‘অপারেশন সমাধান প্রহার’ নামে। উল্লেখ্য, সাইবাবার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে পান্ডু নামে তেত্রিশ বছরের ছেলেটির ইতোমধ্যেই জেলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটেছে স্ট্যানস্বামীরই মতো। মৃত্যুর পরে বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ জানিয়েছিল, পান্ডুর ‘অপরাধ’ প্রমাণিত নয়।
স্ট্যানস্বামী বা সাইবাবা, কেউই কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে নেননি হাতে। তাঁদের বাক্ই সন্ত্রস্ত করেছে রাষ্টকে। ২০২১ সালে ‘স্পিকিং টাইগার’ প্রকাশ করেছিল সাইবাবার কবিতা ও চিঠি সম্বলিত একটি বই – ‘Why Do You Fear My Way So Much?’ একজন ৯০% পঙ্গু ব্যক্তি যখন সাত বছর জেলে কাটান, তখন ভয়ে ভেঙে পড়ার কথা তাঁরই। বদলে তিনিই উলটে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আমাকে এত ভয় পান কেন?’ রাষ্ট্র একাধারে ভীত ও ভয়ংকর, কিংবা হয়ত ভীত বলেই ভয়ংকর। কিন্তু ‘আমাকে এত ভয় পান কেন?’ — প্রশ্নটি শুধু রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে নয় হয়ত। নাগরিকেরই বা তাঁকে, বা তাঁদেরকে, বা তাঁদের বাকস্বাধীনতার প্রকাশকে এত ভয় কেন? জনমানুষের রাষ্ট্রের মুখের উপর তর্ক করতে, অবাধ্য হতে কেন এত ভয়?
আরেক রকম ভয় অবশ্য দেখিয়েছিলেন ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতো আরেক ধর্মযাজক। তিনি মার্টিন নিম্যোলার। সেই যে, সেই কবিতাটি যিনি লিখেছিলেন…সোশালিস্ট, ইহুদি, কমিউনিস্ট, ট্রেড-ইউনিয়ানিস্ট এবং আরও কত ‘অপর’-এর থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার পর, তাদের পাশে না দাঁড়ানোর পর…
‘Then they came for me
And there was no one left
To speak out for me.’
আর ভয় দেখান পঞ্জাবি কবি অবতার সিং পাশ। কবিতার নাম ছিল ‘সব তোন খতরনাক’। ‘সব চেয়ে ভয়ানক’। আনাড়ি অনুবাদে যার কটি পংক্তি এরকম দাঁড়ায়:
‘সবচেয়ে ভয়ানক সেই চাঁদ
যে প্রতি নরমেধের পর
শূন্য আঙিনায় আলো দেয়—
তোমার চোখ তাও জ্বালা করে না
সবচেয়ে ভয়ানক সেই দিগন্ত
যেখানে আত্মা অস্তাচলে যায়’
আমাদের ভয় করে না কেন? আমাদের ভয়ও কি রাষ্ট্র-চালিত?
*************
(লেখাটির শিরোনাম ঋণ: অবতার সিং পাশ)