আপনি যদি একটু চালাক হতেন!
তাতে কি হত বুলিক ?
চোখ নামিয়ে হেসে ফেলে বুলিক। সহজ হাসিটা ম্লান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মুখে। বৃষ্টি নামার আগে নুয়ে পড়া গাছের পাতার মতো ওর চোখের পাতাগুলো নরম কোমল হয়ে গেছে। ওরা যেখানে বসে আছে, সেই বারান্দার তিনটে সিঁড়ির নীচে টুকরো উঠান। উঠানের এক কোণে কাগজের টুকরো, ভাঙ্গা কাপ পিরিচ, মাটির ভাড়, চিপসের খোসার স্তুপ। একটি সন্ধ্যামালতি গাছ লকলক করে বেড়ে উঠেছে সব ময়লাকে আড়াল করে। একা একটি গাছ। ডালপালা ছড়িয়ে কেমন ঘনছায়ার আশ্রয় গড়ে তুলেছে। যেন একটি বাড়ি। বুলিকের দাদাবাড়ির ঘরগুলোর মতো। স্নেহ, মায়া মমতার পাশে ঈর্ষা কাতরতায় ভরা বাড়িখানি। সে বাড়ির উঠানে দাঁড়ালে যে কোন ঘর থেকে মায়াময় আদর ভেসে আসত, বুলিক এলি নাকি ! আয় আয়, কি খাবি তুই ? কিম্বা, কিরে বুলিক গরিব বলে নোয়া চাচিকে যেন চিনিস না ?
এই মহিলা ওর মামি ছিল। আইনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে বছর পনেরো আগে। তবু মামির জায়গায় মামি ঠিকই স্থির হয়ে আছে। সেই স্নেহ, মায়া, আদরের কিছুই হারিয়ে যায়নি। কাছে গেলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। অথচ কত দূরের !
চায়ের কাপ হাতে হাসছে তনুকা, তুমি কি আগের মতো চিনি খাও ?
না মামি। ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড, চিনি, কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি সব বাদ দিয়েছি। প্রেশার হাই। সুগার হাই।
তনুকা ঝিরঝির করে হেসে ফেলে, আজকাল বয়েস মেনে কারও অসুখবিসুখ হয় না রে। এই দেখো না আমাকে ! তোমাদের কত বড় অথচ প্রেশার সুগার কিচ্ছু নেই। কিন্তু ডাষ্ট এলার্জী থেকে কেমন অ্যাজমা হয়ে গেল।
বুলিক দেখে তনুকার চুলে সাদা রঙের উল্লম্ফন। কিছু চুলে রঙের আবছা প্রলেপ দেখা যাচ্ছে। কবে হয়ত রঙ করেছিল। আয়ুরেখার মাপ দেখাচ্ছে ফ্যাকাসে বাদামি চুলগুলো। চোখের কোণে রিংকেল সাইন। অ্যাজমার টানে গলা বসে গেছে ভেতরের দিকে। কত হল মামির বয়েস ? ও নিজেই পয়তাল্লিশ পেরিয়েছে এ বছর।
আপনার আর ক বছর চাকরি আছে মামি ?
চার বছর। ঠিক করেছি আগেই ছেড়ে দেব। একটু ঘুরব। কোথাও ত যাওয়া হয়নি তেমন। তোমরা সাজেক গেছ কখনও ?
হ্যা বলতে গিয়েও চুপ করে যায় বুলিক। গেল বছর কাজিনস গ্রুপের প্রায় কুড়ি জন পরিবারসহ ঘুরে এসেছে ওরা। আগের সম্পর্ক থাকলে নিশ্চয় মামামামিকে নিয়ে সবাই হইহই করতে করতে চলে যেত। এই মামামামি ওদের সবার প্রিয় ছিল। একটা সময় এই মহানগরীতে ওদের থাকা খাওয়ার সবটাই হত এই মামির বাসায়। নামমাত্র হস্টেল মেসে থাকত সবাই। তখন মামাও স্বাভাবিক ছিল। দুজনার সম্পর্ক এত ভালো ছিল যে, কে এলো, থাকলো, খেলো, চলে গেলো এগুলো নিয়ে মামার কোন টেনশন ছিল না। মামিই দেখত সব। দারুণ এক উষ্ণতা ছিল মামার বাসায়। নিজের বাবা মায়ের মতো চুম্বকীয় নির্ভরতা। ফ্রিজ খুলে এটা নিচ্ছে ওটা খাচ্ছে, ইচ্ছেমতো চা কফি বানিয়ে নিচ্ছে মামি সামান্যটুকু বিরক্ত হয়নি কখনও। যার পরীক্ষা সে হয়ত লাইট জ্বেলে ডাইনিং টেবিলে সারারাত পড়ছে। মামা একটু হাউকাউ করলেও মামি বলত, ‘ছাড়ো ত। ওরকম ফাঁকি আমরাও কত দিয়েছি। পরীক্ষার আগের রাতে না পড়লে আর পরীক্ষা কি !’ বুলিকের সবচে চালাক কাজিন, বড়খালার মেয়ে স্বর্ণা গোপনে অনুসন্ধান করে দেখেছে, মামি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী বন্ধু কারও কাছেই ওদের নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে না। এমনকি ওদের বন্ধুরাও বেড়াতে আসত। তারাও কখনও না খেয়ে এ বাসা থেকে ফিরে যায়নি। সবার কাছে মামামামি ছিল আইডল কাপল, ‘মেড ফর ইচ্ আদার।’
কি যে হয়ে গেল। গেল পনেরো বছরে এটা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছে বুলিক। মামা কিভাবে যেন জড়িয়ে গেছিল মদ্য মাংস মহিলা গ্রুপের সঙ্গে। এ লাইনের কিছু বন্ধুও জুটে গেছিল। মামিকে যথেষ্ট সমীহ করত মামা। স্বর্ণা একবার মামির শাড়ি পরেছিল। ইউনিভার্সিটিতে কি এক অনুষ্ঠান আছে সে জন্য। এমনিতে মামার পকেট মারলে কিচ্ছু টের পায়না। কিন্তু সেদিন স্বর্ণাকে মামা জিগ্যেস করেছিল, ‘তোমার মামির পারমিশন নিয়েছ?’ স্বর্ণা প্রায় এক হাত মাথা নামিয়ে ‘জী মামা, শাড়িটা মামিই পরতে দিয়েছে’ বলে লিফটের দিকে ছুটে গেছিল। কারণ ও মামিকে বলতে ভুলে গেছিল। আর এটাও জানত, ওদের বকা খেতে দেবে না মামি। এরকম আরও কত কিছু ঘটনা আছে ওদের জীবনে এখানে মামি ত্রাতা হয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মামার এই বন্ধুরা সেগুলোকে অস্ত্র করে মামাকে স্ত্রৈণ বলে অনবরত স্লো পয়েজনিং করতে শুরু করেছিল। মামাও কেমন জানি বদলে যাচ্ছিল। বন্ধু-বন্ধুস্ত্রীদের সঙ্গ পেয়ে ধন্য হয়ে যেত। পৌরুষত্ব দেখাতে পিকনিক পার্টি বা গেট টুগেদার কিম্বা সাইড ট্যুরে গেলে মামা বন্ধুদের সামনেই মামিকে ধমকেধামকে হেনস্থা করতে শুরু করেছিল। আস্তে আস্তে অফিস ছুটির পর মামার ঠিকানা হতে থাকল আরেকজন বন্ধুর আশুলিয়ার অফিসে। সেখানে মামার জন্য আয়েসি ব্যবস্থা। ফিরতে মাঝরাত। খেয়ে এসেছি বলে মামা আবার ডুবে যেত মদ এবং পর্ন সাইটে। সংসারের সব দায়িত্ব মামির উপর চলে আসে। বুলকিরা তখন পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে গেছে। কেউ কেউ বিয়ে করে নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অশান্তির খবর ত চাপা থাকে না। দূর থেকে শুনে ওদের খারাপ লাগত। বেড়াতে যেতে চাইত না কেউ। মামির তখন হন্যে অবস্থা। বাচ্চাদের পড়াশুনা, ইশকুলে আনা নেওয়া, বাজার করা, ডাক্তারের কাছে যাওয়া, ঘর অতিথি সামলানো একাই করে যাচ্ছে। মাসের প্রথমে টাকা দিত মামা। একসময় অই টাকাও অনিয়মিত দিতে শুরু করল। স্রেফ বলে দিল,‘পারব না। নারী স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা করে বেড়াও। এখন চালাও সংসার।’ একটি উদ্বায়ী, অসুখি, উদ্ধত নালিশময় চরিত্রে ঢুকে গেল মামা।
রাগ ঝগড়া কান্নাকাটি থেকে মনোরোগ ডাক্তার দেখানো সবকিছু ব্যর্থ করে মামা একদিন বেরিয়ে গেলো। মামিসহ সবাই ভেবেছিল, এমন তো অনেকবারই গেছে। রাগ পড়লে ফিরেও আসে। কিন্তু এবারের ধারণা ভুল ছিল। অই বন্ধুরা আর বন্ধুস্ত্রীরাই মামাকে আর ফিরে আসতে দেয়নি।
সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে বুলিকের মনে হয়, মামি যদি একবার আনতে যেত, মামা সিওর ফিরে আসত।
যে চাকরির জন্য এত মৌমাছি ঘুরেছে মামার সামনে পেছনে সে চাকরিও চলে গেছিল। বন্ধুরাও নেই। ঢাকা ছেড়ে মফঃস্বল শহরের বাড়িতে আবার সংসার পেতেছে মামা। ফিরে আসার কোন পথ নেই। কিন্তু এভাবে একা মামিকে দেখতে ওর ভালো লাগে না। ছেলেমেয়েরা নিজেদের সংসারে থিতু হতে চেষ্টা করছে। মামি যে যার মতো করে সবাইকে থাকার স্বাধীনতা দিয়ে একাই আছে। ওর বউ মামিকে দেখলেই মন খারাপ করে জড়িয়ে ধরে। বুলিকের কাছে দুঃখ করে, ‘ইস্ এই মামিটা এত বোকা। যদি একটু চালাক হত!’
কেমন যেন লাগে বুলিকের,‘মামির এই একা থাকা সে কি মামার জন্য ?’
‘ধুর ! কি যে বলে। বরং ভালো আছি। অনেক শান্তিতে আছি।’
বুলিক অভিমানহত গলায় বলেই ফেলে, ‘আপনি যদি একবার মামাকে—
তনুকা জানে, আগে আড়ালে আবডালে আজকাল ওর সামনেই অনেকে ওকে বোকা বলে। ওর ক্লান্তি, ক্রোধ, রাগ, অভিমান, মুক্তি আনন্দ নিয়ে কেউ ভাবে না। জোঁকের মত সম্পর্ক কামড়ে ঝুলে থাকতে পারলেই সবাই ওকে চালাক বলত।
তবে কি ও সত্যি বোকা ?