আহমেদ ভাইকে দেখে আপনার মায়া এবং মেজাজ খারাপ দুইটাই হবে। লোকটা একেবারেই সাধারণ। নিরীহ ও ভীতু ধরণের। যে কীনা ছিনতাইকারীর সাথেও মধুর গলায় কথা বলে এই ভেবে যে তাকে হয়ত ভালো ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেবে। তিনি এমন একজন যাকে সুযোগ পেলে বাসের হেল্পারও অপমান করতে ছাড়ে না। কারণ সে জানে এই লোকের মুরোদ নেই কিছু করার। এরকম লোক দেখলেই চেনা যায়। সারাদিনে সে কারণে-অকারণে গালি খেয়েছে গরীব হেল্পার হওয়ায়। এবার সে নিজে সেই সুযোগটা ছাড়তে রাজী না। চালাক মানুষেরা সুযোগের অপেক্ষা করে। কিন্তু আহমেদ ভাই এইসব হিসেব বোঝে না। কারণ তিনি একজন বোকা।
বর্তমান পৃথিবী চালাক মানুষদের পৃথিবী। চারিদিকে গিজগিজ করছে বুদ্ধিমান আর চালাক মানুষ। সবাই এখন ইন্টারনেট চালায়। নিজের ভালো বুঝে। যার যার সাধ্য মতো ছলাকলা মুখস্ত করে। সার্ভাইবাল অফ দা ফিটেস্ট এর নিয়ম অনুযায়ী বোকা লোক এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবেনা। তবুও কিছু কিছু বোকা লোক থেকে যায়।
তখন নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। আমার বসার জায়গা হয়েছে আহমেদ ভাইয়ের পাশের টেবিলে। প্রথমদিন টুকটাক কথা হলো। আগে কোথায় ছিলাম, এখানে কেমন লাগছে ইত্যাদি। প্রথম দেখে লোকটাকে ভালোই লাগলো। তালপাতার সেপাইর মতো দেখতে, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, চোখটা পরিষ্কার আর হাসিটা সুন্দর। দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের সময়ে বললেন, ‘চলেন আপনাকে ক্যান্টিনটা দেখিয়ে আনি।’
এখানে অফিস থেকে দুপুরের খাবার দেয়। এমপ্লয়ীদের জন্য নিজেদের বাবুর্চি রান্না করে। বেতন থেকে অল্পবিস্তর কিছু টাকা কেটে নেয়। তাও ভালো। বাসা থেকে প্রতিদিন খাবার বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে হবে না। খাবারের চেহারা দেখলাম ভালোই। মাটন, রাইস, সালাদ।
খেতে বসে আহমেদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগছে খাবার?’
বললাম, ‘ভালোই তো।’
তিনি তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যেন খাবার ভালো হওয়ার পেছনে তারও কিছুটা অবদান আছে।
‘তবে বুঝলেন এরা চিকেনটা ঠিক ভাবে রান্না করতে পারেনা। মাছের মশলা দিয়ে মুরগী রান্না করে। যেদিক চিকেন দেবে সেদিন বুঝবেন। আমাদের মেসের বুয়াও মুরগী রান্না করতে পারে না। মুরগীতে আলুও দিতে চায় না। মুরগী রান্না করতে হবে মাখা মাখা। এরা এক মন ঝোল রেখে দেয়।’
আমি হেসে সম্মতি জানিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলাম। বাবুর্চির হাতের রান্না যথেষ্ট ভালো।
যা বুঝলাম, লোকটা ভোজনরসিক। কথা হয়ত কিছুটা বাড়তি বলেন। হিসাব করে কথা বলার ব্যাপারটা জানেন না। এবং কিছুটা বোকাটে আর সরল। যে লোক পরিচয়ের দ্বিতীয় দিনে বলে যে তাদের মেসের বুয়া ভালো মুরগী রান্না করতে পারে না, সে যথেষ্ট সরল।
আসলে তার সরল হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। জটিল হতে হলে যেসব যোগ্যতা থাকা লাগে তার কোনোটাই তার নেই।
আরো আবিস্কার করলাম, অফিসে তাকে খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয় না। স্বাভাবিক। এসব কর্পোরেট অফিসে আপনার ভেতরে সদরঘাট থাকলেও সমস্যা নেই, কিন্তু উপরে ফিটফাট থাকতেই হবে। আহমেদ ভাই মন খুলে কথা বলেন বলে অনেকেই তাকে ‘পাতলা’ ভাবে। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে হ্যালো বললেও অন্যরা যেন অনিচ্ছার সাথে তার উত্তর করে।
বিনয়কে মানুষ দুর্বলতা মনে করে, খারাপ লোককে ভাবে শক্তিশালী। এজন্য পাবলিক প্লেসে কাউকে অন্যায় করতে দেখলেও কেউ প্রতিবাদ করতে চায় না। হয়ত তাদের ধারণা, যেহেতু লোকটার অন্যায় করার সাহস আছে, তার মানে হয় সে নিজে পাওয়ারফুল বা তেমন কারো কাছের লোক। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যদি। কিন্তু একজন নিরীহ ভালো মানুষকে নিয়ে এসব দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কায়দামতো তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেও কোনো সমস্যা হবে না।
বোকা লোকের সাথে মেশাটাও বিপদজনক। অন্যরা তখন আপনাকেও বোকা ভাববে। তাই আমিও আহমেদ ভাইয়ের সাথে একটা দূরত্ব রেখে চলি। যেন অন্যরা চট করে আমাকে বোকা না ভেবে বসে।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত হিসাব তার কিছুই যায় আসে না যেন। আসলে তিনি এইসব কিছু বুঝতে পারেন না। প্যাঁচ বুঝতে হলে মাথায় প্যাঁচ থাকতে হয়। তার সেটা নাই।
বরং দেখেছি অনেকভাবেই তাকে অপদস্থ করার একটা ঝোঁক আছে যেন সবার মধ্যে। কে তাকে সবচেয়ে বেশি অপদস্থ করতে পারছে এটা নিয়ে যেন একটা গোপন প্রতিযোগীতাও চলে অফিসে। তারা তাকে নিয়ে মুখ টিপে হাসে নিজেদের মধ্যে।
দেখা গেলো অফিসের সবাই মিলে পিকনিক ট্যুরে যাচ্ছে। বাস ভর্তি হয়ে গেছে। বস বললেন, ‘আহমেদ, তুমি এক কাজ করো। পরের গাড়িতে আসো। তাছাড়া ঐ গাড়িতে আমাদের একজনের থাকা দরকার।’ ব্যস, তিনি হাসিমুখে নেমে যাবেন- যেন কিছুই হয়নি। অথচ আমার নিজেরই অপমান লাগতো। পরের গাড়ি মানে অফিসের স্টাফদের সাথে গাদাগাদি করে যেখানে পিকনিকের সব সরঞ্জাম বহন করা হচ্ছে। তাতে তার কিছুই অসুবিধা হতো না। স্টাফদের সাথে তার সত্যিকারের ভালো সম্পর্ক। বলা ভালো স্টাফরা তাকে নিজেদের একজন মনে করতো। তারাও সবকিছু বুঝতো। বুঝতেন না কেবল আহমেদ ভাই।
তারপর পিকনিকের সময় যত রকমের কাজ আছে সবই আহমেদের ঘাড়ে। পেঁয়াজ আনা হয়নি। আহমেদ ভাই ছুটে গিয়ে পেঁয়াজ যোগাড় করবেন। সাউন্ড সিস্টেম কাজ করছে না? আহমেদকে ডাকো। কিন্তু তিনি খেয়েছেন কিনা সেটাও কারো জানার আগ্রহ হতো না।
‘কি সাকিব, খিচুড়িটা কেমন ফাটাফাটি হয়েছে, না?’
‘একেবারে দারুণ। আমি তো দুই প্লেট সাবাড় করে দিয়েছি। আপনি কয় প্লেট?’
আহমেদ ভাই যেন একটু থতমত খেয়ে যান। হাসেন। মোলায়েম হাসি। আমি সেই হাসি দেখেই বুঝে যেতাম অনেককিছু।
গ্রুপ পিকচার তোলার পর দেখা যেতো আহমেদ ভাইয়ের জায়গাই হয়নি ফ্রেমে, বা হলেও একেবারে কোণার দিকে। আবার দেখা গেলো সবাই সবার পছন্দের কলিগের সাথে ছবি তুলছে- আহমেদ ভাই সেখানে ভীড়ের মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু মুখে হাসির কমতি নেই। কখনো কখনো শুধুমাত্র নিজের কাছে খারাপ লাগার কারণে আমি গিয়ে বলেছি, ‘চলেন এইবার আমরা দুইজন ছবি তুলবো।’ শুনে তিনি ঝলমল করে ওঠেন। আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে আমার সাথে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাসি দেন।
কখনো কখনো মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। তাকে বলতাম, আপনি এতো ভালো মানুষ সেজে থাকেন কেন? এই যুগে নিজের প্রাপ্যটা আদায় করে নিতে হয়, বুঝলেন? আহমেদ ভাই হাসতেন। তার সেই বিখ্যাত মোলায়েম হাসি। কিছু বলতেন না। আমার গা জ্বলে যেতো।
একদিন অফিসে গিয়ে দেখি পাশের ডেস্ক ফাঁকা। আহমেদ ভাই এখনো আসেননি। অসুস্থ শরীরেও তাকে অফিস করতে দেখেছি। ভাবলাম হয়ত দেরি করে আসবেন। কিন্তু লাঞ্চ আওয়ারেও যখন এলেন না তখন তাকে ফোন করলাম।
অনেকক্ষণ রিং বাজার পর ঐপাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা ফোন রিসিভ করলেন। জানালেন, তিনি তার বড় বোন। সকালে অফিসে আসার সময় আহমেদ ভাইকে একটা মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়ে গেছে। রাস্তায় পড়ে ছিলেন। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে এনেছিলো। এক্সরে করানো হয়েছে। পা ভাঙেনি। কিন্তু খারাপভাবে মচকেছে। কালকে বাড়ি নিয়ে যাবে।
খুব মন খারাপ হলো। অফিস একেবারেই স্বাভাবিক। কারো মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। কেউ হয়ত খেয়ালও করেনি যে তার চেয়ারটায় আজকে সারাদিনে কেউ বসেনি। হয়ত কেউ জানেই না লোকটা একটা বাজে এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে। আমারও বলতে ইচ্ছা করলো না। কেমন একটা চাপা রাগ হলো সবার প্রতি। মানুষেরা এমন হয়! সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম হাসপাতালে।
তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। পায়ে ব্যান্ডেজ, মাথায় ব্যান্ডেজ। ঘুম ভেঙে আমাকে দেখেই মোটা-সাদা ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে তার বিখ্যাত হাসিটি হাসলেন। আমার মায়া হলো লোকটার প্রতি। এই সহজ-সরল লোকটা কখনোই কারো পেছনে লাগে না। পারলে সবটুকু দিয়ে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে। অথচ তাকেই কিনা এমন অবস্থায় পড়তে হলো।
তার পাশে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তিনি নিজের শরীরের চেয়ে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি সেটা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এটা-ওটা খাওয়ার জন্য বলছেন। আপেল কেটে দিতে বলছেন। হাসপাতালের ক্যান্টিনের চা-টা নাকি বেশ ভালো। তিনি খেয়েছেন। আমাকে যেন এনে খাওয়ায়। তার অতি আতিথেয়তায় আমি রীতিমতো বিরক্ত।
উঠি উঠি করছি এমন সময় কেবিনের দরজা খুলে গেলো। প্রথমে উঁকি দিলো অফিসের বসের মুখ, তার হাতের ফুল, তারপর ম্যানেজার সাহেব, তার হাতেও একটা কাগজের প্যাকেট- ফলটল বোধহয়। এরপরে অরু আপা। এরপরে খালিদ। এরপরে মোশাররফ ভাই। আস্তে আস্তে গোটা ঘরটা ভরে গেলো মানুষে। গোটা অফিসটাই যেন হাজির হয়েছে এক চিলতে এই কেবিনে।
একে একে সবাই এসে বসতে লাগলো তার মাথার কাছে রাখা চেয়ারটাতে। সবার মুখেই আন্তরিকতার ছাপ- যেন খুব কাছের আত্নীয় কাউকে দেখতে এসেছে। হাসিমুখে কথাবার্তা চলতে লাগলো। আবার কেউ কেউ যখন রসিকতা করলো গোটা ঘরটা হাসিতে ভেঙে পড়লো। আহমেদ ভাই সারাটা সময় মুখভর্তি হাসি নিয়ে খলবল করে গেলেন। তাকে দেখে কে বলবে আজকেই একটা ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়েছে তার। মনে হচ্ছে আজকে তার খুব একটা খুশির দিন। আনন্দে না আবার হার্টফেল করে বসে। এমন কেন লোকটা!
আহমেদ ভাইয়ের বেড আর সাইড টেবিল ভরে গেছে মানুষের আনা বিভিন্ন উপহারে। ফুল, ফল- আপেল, কমলা, আঙ্গুর, বেদানা, হরলিক্স এর বড় বয়াম, আজকের পত্রিকা- কি নেই সেখানে! দেখতে কেমন ভালো লাগে। আমার আর আগের সেই ক্ষোভটুকু থাকলো না। বুকের ভেতর যেন গলে যেতে লাগলো। মানুষেরা সুন্দর হলে কী সুন্দরই না লাগে দেখতে।
অকারণেই চোখের নিচে পানি এসে জমছে। দ্রুত করে বাইরের চলে এলাম। কী বিপদ! আমিও কি বোকা হয়ে যাচ্ছি নাকি এই লোকের সাথে থাকতে থাকতে।
পৃথিবীতে তখন সুন্দরীয় বাতাস বইছে।