অথ রহস্য-রাক্ষস কথা ১ ঠিক দুপুরবেলা পানগাছের ছায়ারা হেঁটে বেড়ায়। যাঃ! তা আবার হয় না কি? হয়। যেবার চাঁদের শকটে করে ছেলেরা বারুদ নিয়ে এসেছিলো, স্বপ্নের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর, যশোর রোডের দুপাশের সেই গাছগুলিকে কারা কেটে কবে সাফ করে দিয়েছে- তারপর, কপালে ব্যান্ডেজ বেঁধে তবেই তো রক্তপড়া আটকালাম। ২ আজ আমার জন্মদিন। মন সকাল থেকে ধূপের ধোঁয়ার মতো এলোমেলো হয়ে উড়ছে, নানা ভালো চিন্তায়, সু-স্মৃতির ভিতর, একটা সুন্দর গন্ধও যেন টের পাচ্ছি, কিন্তু অন্য কারুরতো তা বোঝার উপায় নেই – তারা কেবল আমার মন-কে তাদের মতো করেই কল্পনা করতে পারে, তাহলে এই মর-পৃথিবী যা একটু একটু করে প্রতি মুহুর্তে বদলে যাচ্ছে তাকেও অনেকদিন পরে মনে হতে পারে- এ যেন কারুর কল্পনা, যেন মেঘের নিচে একটুকরো সোনার কল্পনা নিজে এসে ফিরে গেছে চাঁদের শকটের দাগের মতো অতিদূরের এক কল্পনায়। ৩ আমি মনে মনে লাউডগার হাত চেপে ধরি, তোমার তো চোখ নেই, তবু অতটা বুকে হেঁটে এসে আমার জানলার গ্রীলের গায়ে স্প্রিংয়ের মতো আঁকশি বের করে জড়িয়ে ধরে আলো খাচ্ছো কী ভাবে? চুপ করে থাকলে হবে না — কারসাজিটা বলো, তোমার তো মাথাই নেই, তবে এত বুদ্ধি কৌশল শিখলে কোথায়? সেই অন্ধকারেও কি গান আছে, ভালোবাসা, রিপু, জীবন-তিয়াশা ও অশ্রু- বলো, না হয় ফিসফিস করেই বলো ? ৪ নিজেকেই আজ বোঝাই, আলো তো কথা বলে না, অন্ধকার তারও কিছু ভাষা নেই, উত্তাপ,শীত তাদেরও কি ভাষা আছে কিছু? বৃক্ষ,নদী,পর্বত,ঝর্ণা বা সমুদ্র কি কাউকে কখনো বলেছে - ফিরে এসো আবার দু'দণ্ড ভালোবাসিয়া যেও! এই মর পৃথিবীর মৃত্তিকায় তোমার পায়ের ছাপের নিভৃতি দেখে খুব মায়া হয়েছিল কার? করুণ পতাকা উড়ছে গগনতলে,তাকে একটু দীর্ঘশ্বাস দিই, মৃত্যু যখন নির্বাক প্রজাপতির মতো এসে বসলো কপালে, তাকে কি করে বলি একটু অপেক্ষাও করতে পারলে না, ঘুম তো এমনিই এসে যেতো, তবু দুরাশায় থাকে গ্রহের ভ্রুকুটি, চন্দ্রাহত মেঘ যেন স্মৃতি, অপার কুয়াশা কুড়ায়, মদের ভিতর তৃষ্ণা লুকিয়ে থাকে বন্ধুর মতো, যন্ত্রনার কাঁটার লেবুবন যতই চেষ্টা করো না কেন, আজ আর কিছুতেই হিংস্র হবো না, শুধু নিঃশব্দে ভালোবাসবো তোমাকে - ধুলো, হাওয়া, অন্তরীক্ষ, পরাজয় ও আমার অরব-তীর্থজল,এবার তবে একটা চুমু খাও আমাকে, তারপর চলে যেও! ৫ 'রাক্ষস আহার করে এই বন', তবু মেঘ চুরি করে তাকে জল দেয়, এই জনপদে কবিতা কিভাবে হারিয়ে গেলো, জানি না। গান নিজেই তার সুর ভুল করে ফেলছে, হারানো স্মৃতি হাঁটছে অন্ধগলি পথে, সে সময় হে সু-সংবাদ প্রকৃতই মনুষ্য তুমি মৃদু মৃদু হাসো, যেন এ জগত পারাবার হলো একটা খেলা, লেখা কি তারও চেয়ে ঊর্ধ্বে? কঠিন সমুদ্রপিষ্ঠে এসে দাঁড়িয়েছ নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যেতে ঠিক আর ক'মিনিট বাকি ছিলো, তুমি জানো? শিস দিতে দিতে নিশ্চিন্তে জানলার পর্দা সরাই, আরে এগুলিই তো কুসংস্কার, এখন বেশ দেখা যাচ্ছে মনের অতলান্ত পর্যন্ত, সেখানে নাইনও - ক্লক ফুলের গোলাপি আভা, যেন আমার লজ্জা ফুটে উঠলো এইমাত্র, কিন্তু আমি তোমাকে সব জানতে দেবো কেনো? শুধুমাত্র আমার পৌরুষ তোমাকে ছোটো একটা ধন্যবাদ দেবে, আর কিছু নয়! চায়ের দোকানে বসে লেখা নীরব আঙুল মূৰ্চ্ছা যাও অপরাহ্ণের ক্ষত তোমার অশক্ত করতলে। ছেঁড়া-পুতুল রাত্রি হলে আকাশবানী করে - গেরস্তের মাংস হয় না, অল্প কিছু হাড় হাড়েই কি তার রয়েছে যত অবিমৃশ্যকারিতা ? অরুণাভ ডিম নষ্ট হয়, চন্দ্রবিন্দু, কেবল শুধু আঙুরলতাই জানে কত সত্যের চোখে জল। এখন স্বপ্নই যদি সম্মান হয় – বিশ্বাস করো, চায়ের দোকানে বসে আর কখনো কবিতা লিখবো না ! অশ্রুপূত জল আপনি একটা সাপ, ৰাজপড়ার শব্দে চুরি করেছেন ব্রহ্মশির, এখন পদ্মবন ছাড়া আর কোথাও আপনার আশ্রয় নেই, আকাশবানী হয় : কবির সংসার মৃত পালকের মতো, সেখানে রুমালে করে অপমানের কাক ডেকে ওঠে প্রতিদিন, ফর্সা দেখতে কুয়াশার এক স্বপ্ন দেখা যায়, উদ্ভিদ ও কল্পনা থেকে ভেসে আসে মৃন্ময়, কন্ঠস্বর অনুমান করি ঈশ্বরীর, একমুঠো অপূর্বের ছায়া পড়ে লেখা সেখানে সোনায় তৈরি মনে হবে, ইর্ষা করো না, বামনগাছ কবির আঙুল কখনো ঘৃণা স্পর্শ করে না অশ্রুপূত জল এরপর বরফ ও বাস্প, কলমের কালি দিয়ে লেখা নেমে আসবে। ভুল বানানে পাখি যখন ডেকে ওঠে অন্ধকার, মেঘ ও কুয়াশা আমাকে নিয়ে তোমরা কি ভেবেছো তা জানি না, কিন্তু আমি মনে বানিয়ে নিয়েছি ভুল বানানে লেখা একটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের কিনারায় পাখিদের ভয়াবহ ডাক শোনা যাবে। পাখিদের ভয়াবহ ডাকের কুহক-কে আমি বহুবার অনুবাদ করতে চেষ্টা করেছি বাংলায়, পারিনি। না জন্ম নেওয়া সেই অনুবাদের ভ্রুণ যখন আমাকে ঘুমের ভিতরে বাবা বলে ডেকে উঠেছে - মুখফিরিয়ে নিয়েছি,কারণ বুঝতে পারি নি সে কি অন্ধকার, মেঘ না কুয়াশা? শুধু সত্য হলো এই আমি তাদের সূর্যকিরণের কাছে নিয়ে আসতে পারি নি। তাই আমার ভুল বানানে লেখা স্বপ্নের ভিতর সেই পাখিদের ভয়াবহ ডাক আজও ভেসে আসে।
সুব্রত সরকার
২৭ আগষ্ট, ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন দমদম এয়ারপোর্টের কাছে এক উদ্বাস্তু কলোনিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য শাখার স্নাতক। অবসরপ্রাপ্ত হিসাব নিরীক্ষক। কিছুদিন সাংবাদিকতার কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামাঙ্কিত পুরস্কার ও ১৯৯৮তে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার পেয়েছেন।
এছাড়া নানা বিদেশি ভাষায় তার কবিতার অনুবাদ হয়েছে।
Facebook Comments Box
1Comment
November 20, 2023 at 12:55 pm
সুব্রত সরকারের কবিতায় আমি বারবার এক সরল উচ্চারণ শুনতে পাই যা খুব গভীর এক সহজ-ভূগোল থেকে উঠে আসে ।