দশভূজার কাছে হারিয়ে যায় কিশোর। চোঙায় বাজছে রোশন চৌকি। মাটির গায়ে রঙ। রঙের শরীরে ঘামতেল। ঘামতেলের উপর ডাকের সাজ। শিল্পীর হাতে ক্রমশ কেমন পুরাণ পুরাণ গন্ধ। আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণের গম্ গম্ মহিষাসুরমর্দিনী ছড়িয়ে পড়ছে নিহত মহিষ থেকে বেরিয়ে আসা সবুজ রঙের বডি বিল্ডার অসুরের
ওপর।
স্কুল আর স্কুল থাকে না। সনৎ সিংহের গান শুনতে শুনতে সিংহের হাঁ মুখ নির্মাণ ধরা পড়ে কিশোরের গণিত খাতায়। মন বসে না আর। স্কুলের চাতালে মূর্তি গড়া চলতেই থাকে। আর ষষ্ঠীর বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে চায়। কিশোর দ্যাখে কিভাবে খড়মাটির কাষ্ঠপুত্তলী জ্যান্ত দুর্গা হয়ে জাপটে ধরেছে তাকে। চোখ ফেরানো যায়। ওই যে সিঁড়িতে চেপে চক্ষুদান হলো তুলির
অপূর্ব মন্ত্রে। ছাঁচে বসিয়ে অবিকল এক মুখ ফিরিয়ে দিচ্ছে কুমোর কাকা। জরির পাড়ে ঝলমল করে
উঠছে ধূতি ও শাড়ি। হিমালয় আর দূরে নয়। এই রাত্রির শেষে কৈলাস পর্বত পেরিয়ে নেমে আসবে তারা।
ঝাড়বাতির আলো পড়বে ঘামতেলে। ঘেমে ওঠা দেবদেবীর ওপর এক বিরাট তালপাতার পাখায় হাওয়া করতে থাকবে পুরোহিত জেঠু । প্রসাদ নয়, কিশোর দৃশ্য গিলতে গিলতে নির্বিকার মাথায় আঁটা শিবঠাকুরকে লক্ষ্য করে। নজর রাখছে বেশ।
রক্তপদ্মগুলি মুখ খুলছে আঙুলের মহিমায়। কোথায় সন্ধি হচ্ছে দেবীর সঙ্গে নবীন কিশোরের। মাটির বাসনগুলি সংসারের হাতছানি দেয়। সে উপেক্ষা করে। ফিরে যায়
আরতিতে। ধূনোগুঁড়ো জ্বলন্ত ছোবড়ার ছড়িয়ে পড়তেই তার ভর হয়। নৃত্যের ছন্দে কেঁপে ওঠে পা। কোন স্বর্গীয় আবেশ এই ধূম্রজালে তাকে নিমগ্ন করে। ঢাকা আর কাঁসরের যুগলবন্দী যেন অনন্তকাল। অসংখ্য মালার সমারোহে দেবী কখন পরমেশ্বরী।
মঙ্গল প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত
সেই পরম প্রিয় মুখখানা কখন নিজের মা হয়ে ওঠে। ওমনি ওই কোলের ওম পেতে ছটফট করে ওঠে মন।
দিন রাত এই মাকে দেখার ব্যাকুলতা কখন যে ফুরিয়ে আসে বলে বোঝানো যায় না। মেলার কৃষ্ণনগরের পুতুল বিক্রেতা সেই কিশোরের চোখে মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী
দেখার কথা বলে একটা মায়ের মূর্তি গছিয়ে দেয়। কিন্তু মন পড়ে থাকে মন্ডপের চারপাশে। সার্কাস, ম্যাজিক, পুতুল নাচ, কথা বলার পুতুল, চিড়িয়াখানা, নন্দন কানন কলাভবন সব আকর্ষণ এড়িয়ে সে পালাতে চায়, কোথায় সে নিজেও জানে না।
অবশেষে সেই বিষন্ন মুহূর্ত চলে আসে। মেয়রা সিঁড়ি বেয়ে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে মাকে, মুখে গুঁজে দিচ্ছে সন্দেশ, চিবুক ধরে আদর করে বলছে, আবার এসো মা। আরঅস্থির হয়ে উঠছে কিশোর হৃদয়। অবশেষে ট্রাক এসে যায়। যুবকদের হাতে হাতে কাঁধে দেবী
চড়ে বসেন বাহনে। কিশোরের দিকে চাইবার সময় নেই তার। এতো তাড়া!
পুকুরের জলে গলে যাচ্ছেন দেবী ও তার পরিবারের সদস্যরা। এই দৃশ্য কেন যে সে দেখতে গেল। এই বিদায় তাকে বারবার রিক্ত করে যায়। চোখের জল কথা শুনতে চায় না। খড়মাটির কাষ্ঠপুত্তলী গেলি তো গেলি আর এলি না! ডাইরির পাতা ভিজে যায়। ফাঁকা চাতাল হুহু করে ওঠে। রঙ তুলিতেও ফুটতে চায় না হারানো মায়ের মুখ। ক্রমশ জল গ্রাস করতে থাকে আর সেই জলছবিতে মাথা ডুবিয়ে হারিয়ে যায় বিষাদ কিশোরের গল্প।
জলের মুখে প্রতিমা মা থাকে না । না জানা সাঁতারে ডুবে শেষে হয় ভিজে
কাঠামো । মোচড় দিলেও এ এক শাশ্বত কলা মোচা ছাড়ানোর পর
রব নিভে গেলে নীরবতার চন্দ্রমুখী পার্বতী খুঁজে হয়রান । রান আছে
চতুর্দিকে । কে রাখে ধরে যে আনন্দ হারিয়ে যায় জলে
লেখে নোলক হারানোর কথা সেই চলে গেলে অনুভবে হার হার লাগে ।
গেল বছরের নাক মুখ চোখ চোখে বসে আছে তবুও হৃদয়
দয়া ভুলে নির্দয় দয়াময়ীর শরীর নদীতে ভাসিয়ে আওয়াজ তোলে
আসছে বছর
জল থেকে আর উঠে আসে না একান্নবর্তী সংসার একচালা দুর্গার মতো , ফেরে না মেলায় হারিয়ে যাওয়া কিশোরের কান্না , আর পুজোর গান যার সঙ্গে থাকত বিনা পয়সায় আলপনা আঁকা গানের কথা লেখা বই আর শিল্পীর ছবি , একসাথে পাত পেড়ে খাওয়া । বড়ো হয়ে যাওয়া কিশোর কখন একটা খাঁচায় বন্দী । এ খাঁচা সোনার আর আলো আর শব্দ থিম পুজোর ভাবনা কেমন নিরেট যেন প্রাণহীন লাশ আমারা কয়েক দশক
ধরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি । কবির কল্পনায় কিশোরের দুচোখ জুড়ে হাসি:–
মন্ডপ উমা হয়ে গেলে
আর উপমা লাগে না
ভাবের ঘরে মেয়ে আনন্দ
ফোটায় নাড়ু দিতে দিতে
মেঘের ভিতরে কোথায় কে বাজায়
বিসমিল্লা সাতসকালেই
মায়েদের ভিতরে মেনকা গুঞ্জন
ছাইগাদা থেকে চোখ মেলছে
বিড়ালীর চার সন্তান
ঘুমিয়ে থাকা রাস্তা আড়মোড়া ভেঙে
মেগা স্ক্রিনে লিখে রাখে
আনন্দময়ীর আগমনে ভেসে যাক
বাংলার হৃদয়
ভাঙাচোরা সব পায়ে পায়ে ঢেকে
উড়ে যাক নীলকন্ঠ পাখি