
সে ছিল দুই বেণির ঘোর কিশোরী বেলা। এখনকার মতো এক্সট্রা ক্যারিকুলার বোঝা চাপিয়ে দেবার বাধ্যতামূলক রেওয়াজ আসনপিঁড়ি হয়নি তখনও। হলেও আমার মা-বাবাকে যে তাতে কাবু করা সহজ হতো না, সে বিলক্ষণ জানি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, অর্থাৎ খোদ নিজে যেটা পছন্দ করে করতে চেয়েছি সেকাজে উৎসাহ পেয়ে সামনে এগোনোর একটা আবহাওয়া ছিল আমাদের বাড়িতে। যে কারণে খুব ভেবে চিন্তেই নিজস্ব তালিকায় পছন্দকে স্হান দিতে হতো। অবাধ স্বাধীনতা মানেই যা খুশি তা নয়– এই বোধটা আমাদের মধ্যে গেঁথে দেবার জন্য ওই অনুশীলন। সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাই বিপথে পা বাড়ায়নি আমার-আমাদের চাওয়া বা ইচ্ছেরা।
সময়ের ঢেউ নিরন্তর বর্ণিল কার্নিভ্যালের সাজে আমাদের সামনে উপস্হিত হয় না। অনেক রঙের স্তর সময় তার ভাঁজে ভাঁজে জমিয়ে রাখে। ধূসর, কালো, গাঢ়কালো, বেগুনি, সবুজ, গাঢ় সবুজ, পার্পল রঙের জলফড়িংয়ের ওড়াউড়ির ফূর্তি ফূর্তি রেশটুকু বড়বেশি জীবন্ত হয়ে ঝুলে থাকতে দেখি স্মৃতি জুড়ে। দুঃখ শোকের ধূসর-কালো রংটুকু সরিয়ে উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে যেসব স্মৃতির আনন্দ– তা থেকে আলগোছে তুলে নিলাম কবিতা পড়ার প্রহরটুকু। বাড়িতে অবাধ স্বাধীনতা’র আবহাওয়া ছিল বলেই হয়তো পড়ার বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে ‘আউট বই’ পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়নি। কৈশোরেই কবিতার প্রতি একটা আকর্ষণ আসন পাতে ভেতর বাড়ি জুড়ে। কবিতার প্রতি আজন্মের ঘোর তৈরির সেই শুরু। সে বড় সুখের সময়।
“বীর পুরুষ”, “লিচুচোর”, “নদীর স্বপ্ন”, “কবর” ইত্যাদির গণ্ডি পেরিয়ে বালিকার মন একদিন আটকে গেল এক কবিতার বইতে। বলা ভালো বিশেষ এক কবিতার পাতায়। এর আগে একবার জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়বার চেষ্টা করে দারুণ ভাবে ব্যর্থ হয় সে। আজো তিনি মেয়েটির বোঝা না বোঝার চৌহদ্দিতেই থেকে গেছেন। একটা ভয় ছিল হয়তো কবিতা তার পাতের খাদ্য নয়। কিন্তু যে কবিতার কথা বলা হচ্ছে, ওটা এমন একটা সহজিয়া লেখা যে প্রথম দেখাতেই বার দুয়েক পড়ে ফেলা হলো। আজো মেয়েটির প্রিয় কবিতার তালিকায় সেটি রয়ে গেছে।
” গলির মোড়ে একটা গাছ দাঁড়িয়ে
গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া
আঁকাবাঁকা কতকগুলো কাঠির কঙ্কাল
শূন্যের দিকে এলোমেলো তুলে দেওয়া,
রুক্ষ রুষ্ট রিক্ত জীর্ণ
লতা নেই পাতা নেই ছায়া নেই ছাল-বাকল নেই
নেই কোথাও এক আঁচড় সবুজের প্রতিশ্রুতি
এক বিন্দু সরসের সম্ভাবনা
ঐ পথ দিয়ে
জরুরি দরকারে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি ক’রে।
ড্রাইভার বললে, ওদিকে যাব না।
দেখছেন না ছন্নছারা ক’টা বেকার ছোকরা
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে
চোঙা প্যান্ট, চোখা জুতো, রোখা মেজাজ, ঠোকা কপাল
ওদিক দিয়ে গেলেই গাড়ি থামিয়ে লিফট চাইবে,
বলবে হাওয়া খাওয়ান। …”
(“ছন্নছাড়া”, কবি: অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)
বলতে গেলে ওই “ছন্নছাড়া”ই মেয়েটির ভেতর বাড়িতে সিঁদকাটা শুরু করে। সেই শুরু হলো কবিতার পিছু নেওয়া, সাধ্যমত তার পায়ে পায়ে ঘোরা। তারপর যা হবার তাই হতে থাকলো। বেনোজলের মতো হু হু করে ঢুকে কবি কিংবা কবিতা মেয়েটির মাথা চিবিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। মেয়েটি কিন্তু কোনোভাবেই কবিতা বুঝিয়ে সমঝদার ছিল না। এখনও নয়। ‘ভালোলাগে তাই ভালোবেসে যাই’ অবস্হার এক নিরুপায় উদাহরণ বলা যায় হয়তো। তাই যখন সে প্রথম “ঈশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ” পড়ে ফেললো, তখন এক অপার্থিব ভালোলাগায় হৃদয় তাহার নাচিয়া উঠিয়াছিল বুঝি। আরে কী দারুণ পড়তে!
‘সে যদি তোমাকে অগ্নিতে ফেলে মারে?’
বিনা চেষ্টায় মরে যাব একেবারে
— ‘সে যদি তোমাকে মেঘে দেয় উত্থান?’
বৃষ্টিতে, আমি বৃষ্টিতে খানখান
— ‘সে যদি তোমাকে পিষে করে ধুলোবালি?’
পথ থেকে পথে উড়ে উড়ে যাব খালি
— ‘উড়বে?– আচ্ছা, ছিঁড়ে দেয় যদি পাখা?’
পড়তে পড়তে ধরে নেব ওর শাখা
— ‘যদি শাখা থেকে নীচে ফেলে দেয় তোকে?’
কী আর করব? জড়িয়ে ধরব ওকেই
বলো কী বলব, আদালত, কিছু বলবে কি এরপরও?
— ‘যাও, আজীবন অশান্তি ভোগ করো!’
(“ঈশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ” কবি/ জয় গোস্বামী)
যেচে যে অশান্তিকে ডাকে তাকে স্বয়ং ঈশ্বরও মুখ ভেংচান। কিন্তু যিনি কবি, তিনি কোথাও
‘ঈশ্বরও তো বটে! তাই যেন কবিতার গড়ন বদলে যায়-
‘এসো শান্তি, পিড়ি দিলাম
আজন্মের মতো থিতু হয়ে বসো শান্তি’
এতো ভারি মজার জগৎ হে! শান্তি অশান্তিতে কেমন চাঁদের হাট জমিয়ে বসে আছে। সবটা না বলে অল্পকথার চাদরে কেমন বিস্ময় ঢেকে রাখার জগৎ এই কবিতা! শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, “কবিতার একটা নিজস্ব আবরণ আছে। তার ভেতরে আচ্ছন্ন রেখে অনেক কথা বলে নেওয়া যায়, অনেক আত্মপ্রসঙ্গ, কত বলেছিও হয়তো। কিন্তু গদ্যে নিজের বিষয়ে লিখতে ভয় হয়, গদ্য এত সরাসরি কথা বলে, এত জানিয়ে দেয়।”
(“কবিতার মুহূর্ত” /শঙ্খ ঘোষ)
কবিতার এই পৃথিবীটা অন্য এক অদেখা জীবন যেন। যে জীবন আমার নয়, কিন্তু হতেও তো পারতো! ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’ হতে না পারা’র, দেখা না হওয়া’র আক্ষেপ যতটা, তারচে’ বেশি বুঝি আকর্ষণ। সে আকর্ষণের ঘোরে কেমন জড়িয়ে মড়িয়ে যেতে থাকে মেয়েটি। মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করে কবিরা কতটা অনায়াসে অন্যের ভেতর বাড়িতে হানা দিয়ে বুঝে নিতে জানেন তাদের গোপন গহীনকে!
‘অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’
(“নিঃসঙ্গতা” কবি/আবুল হাসান)
এমন করে যখন কবিতার শব্দগুলো অন্যের গোপন কথা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে তখন না চমকে থাকা যায়! এই একান্ত নিজস্ব অনুভূতির সুলুকসন্ধান যে কবি অকপটে বলে দেন তাঁকে ভালো না বেসে উপায় থাকে! ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কতশত কবিতাই না কথা কয়ে গিয়েছে মেয়েটির মনের ভেতর। তার মধ্যে অনেকেই তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের কারো সাথে দেখাও হয়ে যায় বইকি! তখন যেন পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। দীর্ঘ অসাক্ষাতের ক্ষোভহীন সে দেখা, বড় আরামদায়ক, স্বস্তিময়। মানুষের মতো ক্ষত সৃষ্টি কিংবা ক্ষোভ ঝাড়ায় একদমই পটু না নির্বাক কবিতারা। বিনা বাক্য ব্যয়ে আশ্রয় পাওয়া যায় কবিতায় কিংবা বই’য়ের পাতায়।
প্রেম ভালোবাসা জিনিসটা বুঝি আজীবন অশান্তি ভোগের মতো ব্যাপার স্যাপার, “ঈশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ” পড়া কিশোরির তা জানা হলেও যুবতীটি বেমালুম ভুলে বসে থাকে। আসলে প্রেম যদি হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ে এসে পড়ে তাকে রুখে এমন সাধ্য কার! সময়ের সাথে সাথে ‘তিনি’ এলেন। সে বালক আবার কবিতা লিখিয়ে। হা রে, রে রে রে রে আমায় রাখিস বেঁধে কে রে’র উচ্ছ্বাসে তার পায়ে লুটিয়ে পড়া বাকি মাত্র। পড়া গেল না, কারণ তারা দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। তিনি ওপারে, মেয়েটি এপারে। আন্তর্জালে কথা/কবিতা চালাচালিই ভরসা মম এহেন দূরত্বে। বালক জানায়:
“তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশিরকণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে,
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।”
(“তোমায় আমি” কবি/জীবনানন্দ দাশ)
মেয়েটির ডাকাবুকো উত্তর উড়ে যায়:
‘তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো ?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিয়ো, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিয়ো, রেখো।’
(“অমীমাংসিত সন্ধি” কবি/হেলাল হাফিজ)
দুই মন একে অন্যকে শুধায়:
‘- ওটা কি আঁকলে? ওটা তো একটা হৃদয়।
– হ্যাঁ, এটা হৃদয়। যেখানে তুমি আছো অসীম
মমতায়, চিরন্তন ভালোবাসায়।
এবার বলো আর কি চাই তোমার?
– সারাজীবন শুধু ওখানে থাকতে চাই’
(“কথোপকথন -১” কবি/পূর্ণেন্দু পত্রী)
সময়ের রোদে প্রেমের শিশির শুকিয়ে যেতেও সময় লাগে না। সোনার হরিণ ধরবে বলে বালক কবি চলে যায় তার নিজস্ব পথে। মেয়েটা সে ভালোবাসার ঘোরেই ডুবে থাকে। মনে মনে আওড়ায়:
‘অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে’
(“হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে” কবি/জয় গোস্বামী)
‘আমার কথা গাছের মতন পুঁতে
তোমাকে তার ছায়ায় রেখে যাবো
রোদের কাঁধে কাঁধ মেলাবে হাওয়া
জলের ভিড়ে তোমায় খুঁজে পাবো’
(প্রেম/সৈকত কুন্ডু)
কিছু বাঁধন আছে যা আপাত ছিন্ন মনে হলেও সত্তার সাথে জুড়ে থাকে আজীবন:
‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা।’
(“চলে যাওয়া মানে প্রস্হান নয়” কবি/রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)
জীবনের পথ এঁকেবেঁকে কিংবা সোজা চলে, তারই একটা কোণে দাঁড়িয়ে ভাবে মন:
‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না!’
(“তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না” কবি/আবুল হাসান)
ঈশ্বরের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজীবন অশান্তি ভোগের অভিশাপ মাথা পেতে নেবার পরও মাঝেমধ্যে আলটপকা অভিমান এসে ধরাশায়ী করে ফেলতে চায়। অভিমানী মন অস্ফূটে বলে ওঠে:
‘একটি কথা বাকি রইলো থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।’
(“একটি কথা” কবি/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
কেউ চলে যেতে চাইলে তাকে আটকে রাখা ঠিক নয়। মানুষ চলে গেলেও পেছনে রেখে যায় স্মৃতি। ‘সে চলে গেছে বলে কী গো স্মৃতি ও হায় যায় ভোলা’ মেয়েটি একে বড় সত্য মানে। স্মৃতিআঁকড়ে থাকা তার নাছোড় মন আওড়ায়:
‘সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।’
(“শাশ্বতী” কবি/সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
বাস্তবতা এসে যখন চোখ রাঙায় মেয়েটি তখন আড়মোড়া ভাঙে। সামনে খোলা বইয়ের পাতার অক্ষরগুলো ভৎর্সনা করে ওঠে। নিজের ভাবেই আচ্ছন্ন মেয়েটি কুণ্ঠিত পায়ে কাজে ডুবে যেতে চায়। কাজের ফাঁকে আন্তর্জালিক সংবাদপত্র খুঁড়ে স্বার্থপরতাকে সাথে নিয়েই বেছে নেয় নিজের স্বদেশ। দূরের বিষণ্ন স্বদেশের ভালো না থাকার কথা জেনে মেয়েটা কী কষ্ট পায়? নাকি অপরাধ বোধে ভোগে ঠিক স্পষ্ট হয় না। অসহায় নিরন্তর প্রার্থনায় ঝুঁকে তার মনপ্রাণ। স্বজন আর স্বদেশ ভাবনায় বুকে ব্যথা জেগে ওঠে:
‘স্বদেশ তুমি বিষণ্নতার বুকের কাছে আর ঘেঁসো না।
চতুর্দিকের নষ্ট জলে আর ভেসো না,
স্বদেশ তুমি ঘরে থাকো,
বাইরে গেলে অনেক বিপদ ঘরে থাকো।’
(“নিজের স্বদেশ” কবি/আবুল হাসান)
এদেশের আকাশ কালো করে ভোর বেলাতে বৃষ্টি হলে দেশের সোঁদা মাটির গন্ধ পাবার জন্য মেয়েটির মন কেমন কেমন করে! নিশ্চিন্ত সুখের জীবন কাটাবে বলে পরিবারের সবাই তারা এই প্রবাসে ডেরা বেঁধেছে। মাটি থেকে উপড়ে নেওয়া গাছ যেমন দ্বিতীয় জীবন পায় বদ্ধ টবে। মেয়েটি একে উদ্বাস্তু জীবন বলে। “সুতো কাটা কাঙ্গাল ঘুড়ির মতোই যেন বৈরি আকাশে তার ওড়াউড়ি।” অন্যেরা হয়তো মুখ টিপে হাসে, ভাবে এ তার সুখের দুঃখ বিলাস। কে যেন জানতে চায়:
‘যে পথ দিয়ে চলে এলি সে পথ এখন ভুলে গেলি
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার।’
আশৈশবের প্রিয় শহর, বন্ধু স্বজন, পরিচিত পাড়া, হাতের তালুর মতো চেনা পথঘাট, চেনা আকাশের জন্য মনটা বড় উচাটন হয়। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে দূরালাপনীর অদৃশ্য সুতো ধরে মেয়েটি যেন বাংলাদেশের কাছে চলে যেতে চায়। ঈদ,পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস অথবা অমর একুশের জমজমাট বইমেলার খবর জানতে চাইলে বন্ধু স্বজনের আনন্দ ধ্বনি যখন দূরালাপনী ফুঁড়ে কানে আসে মেয়েটি কেমন এক অযাচিত ঈর্ষায় আক্রান্ত হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ের পরিচিত একটা কবিতার লাইন এসে তাকে ঈর্ষাতুরা করে দেয়:
‘ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।’
(“বন্দী শিবির থেকে” কবি/ শামসুর রাহমান)
জীবন বড় অদ্ভূত। কেবলি আলো ছায়ার লুকোচুরি চলে এর ভাঁজে ভাঁজে। ঈর্ষাতুরা মেয়েটি সেই অদ্ভূত চক্রে পড়ে অন্য রকম হয়ে ওঠে। বহুদূরের দেশ কোনো প্রাপ্তির আনন্দে ভাসছে হয়তো। মেয়েটির মনও নেচে ওঠে তার ছন্দে। বাতাসে ভাসিয়ে দেয় মনের কথা:
‘তোমার আনন্দে আমার জেগে ওঠা।’
কিংবা বন্ধুদের নানান কর্মসূচী, কার্যক্রমে সশরীরে থাকতে না পারার অক্ষেপ দীর্ঘশ্বাস হয়ে ছুঁতে চায় স্বদেশের মাটি: ‘দাসেরে করিও ক্ষমা’
দ্রোহ কিংবা ভালোবাসায়, আনন্দ অথবা বিষণ্নতায় সবতেই মেয়েটি কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে চায়, পায়ও। আকাঠ মেয়ের যদিও জানা নেই কবিতার সঠিক সংজ্ঞা। জানা নেই কবিতা সংক্রান্ত অ্যারিস্টটালের বিখ্যাত প্রস্তাব আর তার উত্তরে শিষ্য প্লেটোর উগ্র উষ্মার উত্তর। সে কেবল মনের আনন্দেই কবিতা পড়ে। ফুল শুঁকে গন্ধ নেবার মতো করেই সে কবিতাকে অনুভব করতে চায়। কবিতা কাকে বলে? যতটা মেধায় একজন কবি কবিতা লিখেন, সেটার পাঠক হিসেবে কতটা মেধা ধারণ করতে হয়? ইত্যাদি ইতং বিতং মেয়েটির নেই। তবে রাজশেখরের “কাব্যমীমাংসায়” কবিতার জন্ম রহস্যের মজার বিবরণটি জেনে মেয়েটি হেসেই বাঁচে না! একটু বলার লোভ সংবরণ করা যাচ্ছে না কিছুতেই:
‘পুরাকালে সরস্বতী পুত্র কামনা করিয়া হিমালয় পবর্তে তপস্যা করিয়াছিলেন। সন্তুষ্ট মনে ব্রক্ষ্ণ তাঁহাকে বলিলেন, “আমি তোমার পুত্র সৃষ্টি করিতেছি” তাহার পর সরস্বতী কাব্যপুরুষ কে প্রসব করিলেন।’
মেয়েটি ভাবে, একজন কবি যতক্ষণ একটা কবিতার জন্ম দিতে থাকেন ততক্ষণ সেটি একান্তই কবির নিজস্ব সম্পদ। যে মাত্র তিনি তা পাঠকের সামনে তুলে ধরলেন, তখন আর সেটি কেবল মাত্র কবির সম্পদ থাকে না। তা পাঠকের হয়ে যায়। যা ছিল কবির অত্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, নিজস্ব অনুভূতির প্রকাশ,তা পাঠকের সামনে আসা মাত্রই কবি তার ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার হারান। কবিতার একদম নিগূঢ় গল্পটা হয়তো কেবল মাত্র কবিই জানেন। কিন্তু তাতে পাঠকের খুব বেশি যায় আসে না। পাঠক তখন যার যার মতো করেই একটা গল্প ভেবে নেন। কবিতার মজা এখানেই।
তবে সব কবিতার ক্ষেত্রে এমনটা প্রযোজ্য হয় না। কবি যখন বলে ওঠেন,
‘কাঁদো কাঁদো তুমি, কাঁদো ঈশ্বর
কেঁদেছিল মাটি, কেঁদেছিল ঘর
কেঁদেছিল শাখা চিৎকার করে
মানুষই তো দেশ তাই মনে করে।
একবার শুধু কাঁদো তুমি আর
যেন কেঁদে ওঠে ঐ কাঁটাতার,
সীমান্ত নেই দু’চোখের জলে’
(“দেশ” কবি/সৈকত কুণ্ডু)
দেশভাগের ব্যথা বহন করতে না হলেও একটা সার্বজনীন বেদনাবোধ অনেকের মতোই মেয়েটির মনকেও আর্দ্র করে। দেশ ছাড়বার কষ্টটা বুঝি বা পথ পেয়ে কেঁদে ওঠতে চায়। কী জানি!
কিংবা সুবোধ সরকারে “রূপম” কবিতার কথাও মনে পড়ে। যেখানে পাঠককে নিজের মতো করে নতুন কিছু ভেবে নিতে হয় না। কারণ তা আমাদের অনেকেরই খুব চেনা গল্প। যা কিছুটা সার্বজনীনও বটে। আসুন দুয়েক ছত্র পড়ে নেওয়া যাক “রূপম” থেকে:
‘রূপমকে একটা চাকরি দিন—এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু’-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে।’
(রুপম/সুবোধ সরকার)
অরাজক সময় পৃথিবীর অনেক দেশকেই কোনো না কোনো ভাবে বইতে হয়-হয়েছে-হচ্ছে। সময়ের পৃক্ষাপটে কিছু কিছু কবিতা বড় সত্যি হয়ে ওঠে দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে:
‘সে বড় সুখের সময় নয়,
সে বড় আনন্দের সময় নয় তখনই
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে,
দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ
ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভেতরে বাড়ি, পায়ের ভেতরে পা,
বুকের ভিতরে বুক
আর কিছু নয়…..’
(সে বড় সুখের সময় নয়/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
যেকোনো দেশের সাধারণ মানুষ চায় শান্তি আর নিরাপদময় একটা জীবন। ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলো সেসব পূর্ণের আশা জাগিয়ে জনগণের ম্যান্ডিটে ক্ষমতায় গিয়ে তাদের সে বাগাম্বড়কে অসারই করে তোলে না শুধু; সময়ে সময়ে বরং জনগণের জীবনকে এমন একটা দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যখন সাধারণ জনগণের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকে। আর কে না জানে, এমন মানুষের বুকে দ্রোহের আগুন কতটা বিদ্বেষ নিয়ে জ্বলে ওঠে! কবিতা তখন জনগণের হয়ে জানান দেয়:
‘বুকের ভিতর লুকিয়ে আছে তীব্র আগুন
পুড়িয়ে দেবো, পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।
রুপেল পালক গুটাও এখন
কৃত্রিমতার নীল কারুকাজ
জঠর জ্বালায় পুড়িয়ে দেবো, সতর্ক হও।
……………
সাপের ফনায় হাত রেখেছো
হাত রেখেছো বাঘের গায়ে-
ঘরে তোমার লালিত সুখ, আজম্ম সাধ
পুড়িয়ে দিবো, পুড়িয়ে দিবো, সতর্ক হও। ‘
(“পুড়িয়ে দেবো নীল কারুকাজ” কবি/রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)
নিরুপায় অসহায় মানুষের অধিকার রক্ষায় দুনিয়া জুড়ে কতসব সংঘ গড়ে উঠেছে। কিন্তু হাস্যকর ভাবে অনেক সময় দেখা যায় সেসব সংঘ মজলুমের পাশে নেই। গিয়ে দাঁড়িয়েছে জালিমের পাশে। মানুষের শুভ অশুভের বোধ যখন হারিয়ে যায় তখন আসলে পৃথিবীর কোনো সংঘই পারে না মনুষ্যত্ব রক্ষার ঠিকেদারী নিতে। মেয়েটি ভাবে, এ কথা কবির মতো অকপটে আর কে বলার সাহস রাখেন?
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে ? শত্রুতায় কী লাভ বলুন ?
আধিপত্যে এত লোভ ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর…
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলোনা !’
(“জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন” কবি/আবুল হাসান)
জীবনের প্রতি কোনো বৈরাগ্য নেই মেয়েটির, বরং বাঁচতে চায় সে ‘বাঁচার আনন্দেই।’ তারপরও মৃত্যু নিয়ে তার রয়েছে ভীষণ রোমান্টিকতা। সেকারণে তাকে ‘রোমান্টিক এফ ডাবল ও এল’ ভাবে অনেকেই। কিন্তু তাতে তার কিছুই যায় আসে না। অলটাইম ফেবারিট দাড়িওয়ালা বুড়োর প্রভাবেই কি তার এই রোমান্টিকতা? কি জানি! মাত্র ষোল বছর বয়সে মৃত্যু নিয়ে ভানুসিংহের পদাবলীতে সে কবি লিখেছিলেন,
‘মরণ রে তুঁ হুঁ মম শ্যাম সমান’
তারুণ্য কিংবা যৌবনের দারুণ দাপুটে সময়েও তিনি তার চিরসখা মৃত্যু’র কথা ভুলে থাকেন না। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষণেই তাকে স্মরণ করেছেন, সময় দিচ্ছেন কবিতার খাতাকে। লিখছেন,
‘একদা নামিবে সন্ধ্যা বাজিবে আরতি শঙ্খ
অদূরে মন্দিরে,
বিহঙ্গ নীরব হবে উঠিবে ঝিলস্নীর ধ্বনি
অরণ্যে গম্ভীরে
সমাপ্ত হইবে কর্ম সংসার সংগ্রাম শেষ
জয় পরাজয়
আসিবে তন্দ্রার ঘোর পান্থের নয়ন পরে
ক্লান্ত অতিশয়৷’
(“প্রতীক্ষা”/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তো? মেয়েটির খুব রাগ হয়। তিনি বিখ্যাত লোক বলেই মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখবার স্বাধীনতা পেয়ে যান। নিজের ভাবনা অন্যকে জানান দেন। আর মেয়েটি অতি সামান্য একজন বলে তারটা ভাবনা ‘আদিখ্যেতা, উটকো বিলাস!’ মামদো বাজি যেন। মেয়েটি অভিমান মুছে নিজের রোমান্টিকতা আঁকড়ে থাকে। যদিও মৃত্যর পর তাকে জাগতিক কোনো কিছুই আর ছুঁতে পারবে না তারপরও ভারি আনন্দ দেয় এই ভাবনা, একদিন সে ফিরে যাবে স্বদেশের মাটিতে, মাতৃজঠরের নিরাপদ অন্ধকারে। গিয়ে বলবে:
‘আমি আবার ফিরে এলাম, আমাকে নাও
ভেজা মাটির বৃষ্টি তুমি আমাকে গ্রহণ করো আমাকে নাও, আমাকে নাও!’
(“প্রত্যাবর্তনের সময়” কবি/আবুল হাসান)
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে’ তারপরও মানুষের মতো করে বেঁচে থাকার আনন্দ উদযাপন করতে আর কেউ পারে কী? কেউ পারে না। মানুষের আছে ভালোবাসবার আশ্চর্য এক ক্ষমতা। ভালোবাসাহীন মনুষ্য জীবন কিছুতেই তাই যেন সে কাটাতে চায় না।
‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে…’
(“হৃদয়ের ঋণ” কবি/হেলাল হাফিজ)
শুধু মানুষের প্রতি প্রেমই জীবনের অংশ নয়। তার ভালোবাসার জন্য আছে বিপুল বিশাল পৃথিবীর যাবতীয় আয়োজন। তুচ্ছের প্রতিও তাই সে দেখাতে পারে অপার বিস্ময়, মুগ্ধ ভালোবাসা।
‘ আমি ভালোবাসি মেঘ… চলিষ্ণু মেঘ…ঐ উঁচুতে…ঐ উঁচুতে
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!’
(“রহস্যময় মানুষ” মূলকবি/বদলেয়ার, অনুবাদ: বদ্ধুদেব বসু)
মেয়েটি এমন ভালোবাসায় মত্ত থাকতে ভালোবাসে। তাই কোনো অচেনা সবুজ মাঠের কাছে রেখে আসে অকপট মুগ্ধতা। সে জানে গানের ভেতরে ডুবে গিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে আনতে। সেলুলয়েডের মাঝে ভালোলাগা সঁপে দিতে।
তার আছে নিজস্ব ভালোবাসা-ভালোলাগার জগৎ। কাজের পরিশ্রম শেষে ডুবে যাবার জন্য তার রয়েছে কল্পনার রাজ্য, পাঁজা খানেক বই। আর কবিতার অপার্থিব এক জগৎ। যে জগতে সে বার বার ফিরে ফিরে আসতে এতটুকুও ক্লান্তিবোধ করে না। তাই কবিতা বুঝুক আর নাই বুঝুক, কবি/কবিতার প্রেমে সে বার বারই পড়বে। বিশেষ করে আবুল হাসানের প্রেমে। বললেও শুনবে না:
‘পোড়ারমুখী দু’চোখের বিষ
ফের তুই প্রেমে পড়েছিস?’
মেয়েটির মনে হয় এভাবে আনন্দ কুড়িয়েই দিব্যি কাটিয়ে দেবে জীবন। কারণ সে মনে করে বার বার কবিতার প্রেমে পড়া এবং মরা তার জন্মগত অধিকার। সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। এমন কি ঈশ্বর, এমন কি কবি, এমন কি তাঁহাদের কবিতাও না! এমন এক ভুবন ডাঙার মতো অবাধ জগত না থাকলে মেয়েটি দমবন্ধ হয়ে মারাই পড়তো হয়তো!
‘আমি কি জানি না, এই বৈরি-পৃথিবীতে
শুধু তুমি ছাড়া কতটা দুর্লভ ছিল সুখ?
আমি কি জানি না, এই নিস্তরঙ্গ অকূল পাথারে
তুমি ছাড়া কতটা অসহ্য ছিল বাঁচা !’
(নির্মলেন্দু গুণ)
কবিতায় ঘোরাক্রান্ত থাকার সেই তুমুল সময় পেরিয়ে এসেছে মেয়েটি। কিন্তু আজও মুঠো আলগা হয়নি, মুঠো খুলে গড়িয়ে পড়েনি কবিতার জন্য জমানো ভালোবাসা। আগের মতো কবিতায় বুঁদ থাকার সুযোগটা হয়তো আজকাল কম; তবুও কোনো কোনো দিন কবিতার প্রহরে সে খুঁজে পায় অমলকান্তির রোদ্দুরের নরম স্পর্শ। কবিতার সেই একান্ত সময় তাকে ডেকে নেয় একান্তে। মন তাতে সঙ্গত দেয় সানন্দে–
‘চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর,
তুই থার্মোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল,
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন।’
** শিরোনামের জন্য কৃতজ্ঞতা- শ্রীজাত