
এক কথায় বলা যেতে পারে – তাঁর কবিতা, অবিনির্মাণের কবিতা। ফুল কোথায় সেখানে -- শুধুই পাথর, নারী নেই -- আছে ক্ষতবিক্ষত দেশ, আছে রুদ্ধ মাতৃভাষা, আছে মরুঝড় আর বিদ্যুৎচমকিত ক্ষীণ প্রেমাভাস। পরাজিত ঈশ্বর সেখানে নরকের দিকে হাত তুলে দোয়া করেন – কোনো প্রশ্নবিদ্ধ পুরুষের এক ছিন্নভিন্ন প্রতিকৃতি যেন তিনি! পাহাড়ের চুড়োতে পাথর তুলে নিয়ে যেতে চাওয়া স্বপ্নতপ্ত সিসিফাস ছত্রে ছত্রে উপস্থিত সেখানে। সিসিফাস যেন কবির দ্বিতীয় ভূমি। আদুনিসের কবিতা তাই বিনোদনের কবিতা কিছুমাত্র নয় --পথশ্রমে লিপ্ত এক শ্রমণের গহন দিনলিপি সেগুলো : “আমি বিদ্যুৎ আর বজ্রপাতের কথক”।
তাঁর রুচির এই ভিন্নতা বুঝে নিতে তাঁর আবহকে কিছুটা জানা জরুরি। আদুনিসের মাতৃভূমি, সিরিয়া। এ হল সেই দেশ, মেসোপটেমিয়ার পরেই আদিতম সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল যেখানে। চাষাবাদের পদ্ধতি যে গুটিকয়েক জায়গায় শুরু হয় – সিরিয়া ছিল তার অন্যতম। খ্রীষ্টজন্মের দু' হাজার বছরেরও আগে এখানে লিপির সন্ধান পাওয়া যায় | কত বর্ণ. কত জাতি যে এই দেশের ক্ষমতা পাবার জন্য উদগ্রীব ছিল -- যেন তা এক স্বপ্নের দেশ ! এখানকার লোককথায় আজও সেই জাদুবাস্তবেরই ছোঁয়া পাওয়া যায়।
অথচ আশ্চর্য এই যে, একসময় যে দেশ ছিল সভ্যতার এক পীঠ, সেই দেশই গত একশো বছরে পৃথিবীর অশান্ততম জায়গা হয়ে দাঁড়ায় - গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা, শিশুহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংস – কী হয়নি সেখানে ! আদুনিসের প্রথম পর্বের লেখা অন্ধকূপের এই দমবন্ধ ব্যথারই প্রতিলিপি। কেমন সেই সময় : “নতির আর মরীচিকার, মূর্তি আর কাক-তাড়ুয়ার এই যুগ ; লালসা আর শাশ্বত পতনের এই যুগ!”
সিরিয়ার লাটাকিয়ার কাছে এক অজ গ্রাম কোয়াসাবিনের এক কৃষক পরিবারে আদুনিস অর্থাৎ আলি আহমেদ সৈয়দ ইসবারের জন্ম হয় ১৯৩০ সালে। ১৪ বছর বয়সে প্রথমবারের জন্য ইশকুলে যাবার সুযোগ পান তিনি। তাঁর ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য ১৯৫৫ সালে একবছর তাকে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। ছাড়া পাবার পর তিনি বেইরুত চলে যান এবং লেবাননের নাগরিকত্ব নেন। ১৯৫৭ সালে তিনি 'কবিতা' নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬০ নাগাদ সুফি ভাবধারার আদলে এক সুক্ষ স্যুরিয়ালিজম মিশিয়ে নতুন এক কবিতাধারা গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতি আবার তাঁকে প্যারিসে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে।
আদুনিসের বাবাও ছিলেন একজন কৰি এবং পণ্ডিত মানুষ – গ্রামের মানুষ তাঁকে “শেখ" উপাধি দেয়। হয়তো আদুনিসের কবিতা লেখার শুরু বাবার প্রভাবেই। তবে তিনি যা শুনেছেন বা শিখেছেন, নিজের লেখায় তার ছায়া পড়তে দেননি। আরবি কবিতায় তাঁর স্বর তাই একেবারেই ভিন্ন। কী গঠন, কী ভাব, সবদিক থেকেই তাঁর কবিতা আধুনিক।
এখানে যে কবিতাগুলির বাংলা তর্জমা করা হয়েছে, সেগুলি ১৯৬১ সালে রচিত তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ 'দামাসকাসের মিহ্যারের গান’-এর তৃতীয় পর্ব 'মৃত ঈশ্বর’-এর ইংরেজি ভাষান্তর থেকে নেওয়া। এই বইটি যেন তাঁর আত্মবিস্ফোরণের পদাবলি যেখানে কবিতার “আমি' এক “অভিশপ্ত মিহ্যার"। সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলে আবার তাকে স্বপ্নজাত করে নেবার আর্তি এই কবিতাবইয়ের প্রতিটি পঙ্ ক্তিতে । সে “নিরুপায় / আগুনের এই পথ ছাড়া, / প্রত্যাখ্যানের এই নরক ছাড়া, /এই পৃথিবীটা যখন/ নিছকই এক বোবা গিলোটিন / অথবা এক ঈশ্বর।”
ভালোমানুষ ঈশ্বরে তাঁর কাজ নেই, সেই ঈশ্বর মৃত – এক ভুলে-ভরা পথের পথিক তাঁর রচিত ঈশ্বর : “বাঁকা কথার নবি /ভ্রমণের নবি যে আমাদের কাছে আসে/ বৃষ্টি-হাওয়া নিয়ে /হতাশা নিয়ে এবং আমি তো জানতাম তুমি আসবে,/আমরা সবাই জানি তুমি এক মরণপথের নবি./ তাই ঝুঁকে দাঁড়াই। আর ঘোষণা করি, " বিজিত যারা আমাদের কাছে আসে আগুন আর নির্বাসন ঝরিয়ে,/আমরা খুশি তোমাকে পেয়ে, ঈশ্বর ও সখা তুমি পাথরের এই আয়নায়"
একাকী মানুষের দিকে তাকিয়ে আদুনিসের কবিতা উচ্চারণ করে লক্ষ মানুষের বেদনা। সেই ব্যক্তি-মানুষের স্বর যেন এক সমস্বর। সে এক হয়েও অনেক।
আদুনিসের অন্য দু'একটি বই, দিনরাত্রির চলাচল ও রূপবদল (১৯৬৫), মঞ্চ আর আয়নাগুলো (১৯৬৮), আলোচনাগ্রন্থ সুফিবাদ ও অধিবাস্তববাদ (১৯৯৫) ইত্যাদি। শুধু যে নিজের কবিতা লেখা তা তো নয়, ওভিদ, স্যাঁ জন পার্স আরবিতে অনুবাদও করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত সতেরোটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর কবিতা। পেয়েছেন অনেক সম্মান। Guardian-এর মতে আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠ জীবিত কবি তিনি।
'দামাসকাসের মিহ্যারের গান'
পর্ব : মৃত ঈশ্বর
আলাপ
আমি এই ভোরের আভাস আর শেষের দিনের – অশনির মুখে আমি নিজের মুখটি রাখি আর স্বপ্নকে বলি তুমি আহার্য হও। পৃথিবীর ত্বক আমি ধুয়ে সাফ করি, বড় করি প্রজাপতি পতাকার মতো, তাতে নিজের নামটি লিখি।
একটি গাছ নাম বদলে আমার সঙ্গ নেয়, পাথর আমার স্বরে শরীর ধুয়ে ফেলে, আমারই পাতায় ভূমি পাতাঝোরা হয় – এরা সব আমারই সেনানী এবং আমার অস্ত্র হল ঘাস।
আমি দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, আমার এ'মুখ কুঁদি হাওয়ায় পাথরে, আমার এ মুখ কুঁদি জলের উপরে, সীমানাতে আমার আবাস। ঢেউয়ের মুখোশ পরি আমি -- সাগর আমার যমজ, আমারই অপর।
দূরের দিকেতে চলি, তবু দূর দূরে থেকে যায়। পৌঁছোতে পারিনি আমি, তৰু উজ্জ্বলতা ছুঁয়েছে আমায়। আমিই সুদূর, দূরত্বই আমার স্বদেশ।
আঁধারে আঁধার এক দেশ ছেড়ে আমি চলে যাই, ডিমের মতোই পূর্ণ, যে দেশে কোথাও কোনো সূর্যোদয় নেই, হাওয়ারও চলন নেই সে এমন দেশ।
অশ্রুর মতোই বন্ধু এক দেশ গড়ি আমি।
পৃথিবীর গায়ে যারা বিস্ফোরক গাঁথে, জ্বলন্ত কয়লায় ঠাসা, অঙ্গারের মতো পূর্ণ, দিগন্তে সীমানারেখা এঁকে দেয় যারা, রক্তপাত না হওয়া অবধি মারে আর ধর্ষণ করে, ছায়া খোঁজে যারা প্রজাপতির ডানায় --
তাদের দিয়েছি আমি আমার এ'নাম। আমি দৌড়ে যাই, ঈশ্বর যেন বা হন আড়াল আমার। আমি অধিকার করি, আক্রমণ করি, ওদের শরীরে যবে হাত নেমে আসে, দস্তানার মতো যত আচার বিচার, দু'হাতে গলাই আমি | স্বপ্নবীজ হয়ে থাকি, অন্তর্বাসী মানুষের সুসংবাদ আনি। (ফিরে দেখো অরফিয়ুস, এই পৃথিবীতে তুমি হাঁটতে শেখো)।
আমি আকর এবং আমিই লুব্ধক। পৃথিবীকে নিশ্চয়তা দিই আমার স্থিতিতে, বিশ্বকে গুড়িয়ে দিই ধুলোর মতন তার পরিচয় দিতে। পাথরে আঘাত করি সমস্ত শক্তিতে, উপেক্ষার স্রোত বয়ে যায়, ধুয়ে দেয় জগৎশরীর, ডেকে আনে অস্বীকারের বান, তার আদি পরিচয়।
গুহাগুলোর সঙ্গেই কথাবার্তা হয়, পর্বতশ্রেণীকে দিই কথার আদল, শূন্যতাকে করে নিই সুরেলা এক গান, ঈথারের সঙ্গে আমি নাচ জুড়ে দিই, পাথরের বুকে রাখি জগৎবাসনা। আমার আয়ুষ্কালের মন্ত্র লিখে যাই আর চূর্ণ করি টেবিল-ঘড়িটা, রোপণ করি হে যত ছিন্ন হাত ও পা আমার বিস্তারে, দূরত্ব আমার যষ্টি, পথরচয়িতা --
বিশ্বের বিরাটে দেখো মন্ত্রমুগ্ধ আমি, আমার গোপন ঝাঁপি খুলে দিই তাদের : “শোনো হে বিশ্ববিরাট, মন্থর সময়কে আমি শান দিয়ে নিই,ঘড়ির কাঁটাকে আমি তাড়না করি, মাথায় ডাঙশ মারি যেন কোনো বিছে, উপড়ে ফেলি লোকালয়, মুলতুবি রাখি, সাগরকে শ্বাস নিতে অনুমতি দিই, বলি তুমি নাচো।
" শোনো হে বিশ্ববিরাট, প্রতিটি পায়ের ছাপ আমার কাছেই শেখে দূরত্ব-বিজয়।"
পাথরের আয়না
ঈশ্বরের দুটি তালুর নীচে নগ্ন,
কত বছরের বালির পোশাক পরনে,
আমি আমার মৃত্যুর সঙ্গে খেলছিলাম,
অন্যের রাজ্যপাট গড়ে দিচ্ছিলাম আমি
আমারই ধুলো থেকে।
বাঁকা কথার নবি,
ভ্রমণের নবি যে আমাদের কাছে আসে
বৃষ্টি-হাওয়া নিয়ে,
হতাশা নিয়ে এবং আমি তো জানতাম তুমি আসবে,
আমরা সবাই জানি তুমি এক মরণপথের নবি,
তাই ঝুঁকে দাঁড়াই
আর ঘোষণা করি, " বিজিত যারা আমাদের কাছে আসে
আগুন আর নির্বাসন ঝরিয়ে,
আমরা খুশি তোমাকে পেয়ে, ঈশ্বর ও সখা তুমি
পাথরের এই আয়নায়।"
ভ্রমণযাত্রার নবি হে,
তোমাকে নিয়ে খুশি আমি, ঈশ্বর ও দোসর আমার
পাথরের এই আয়নায়।
আজ মেঘের কাছে তোমার নামে গান শোনালাম।
মহাকাশ আর আমার হৃদয়ের মধ্যে আমি এক ঘের দিয়ে নেব,
যেখানে দূরান্তের তারারা ঘুমোয়,
একটা ঘের দিয়ে নেব যার মানুষের আর আকশের মতো মুখ।
আমি মেঘেদের কাছে গান গাই --
আমার মুখ হল পাথর, আমি তাই পাথর ছাড়া অন্য কারোকে পুজো দিই না।
সেই গানটা
হয়তো নিশ্চুপ না হয় দমবন্ধ অক্ষরে লেখা,
কিংবা বোবা,
অথবা মাটির তলার গোঙানির কোনো এক ভাষায় --
মৃত্যুর জন্য আমার এই গান,
জিনিসপত্রের রুগ্ন উল্লাসের জন্য আর সেই জিনিসগুলোর জন্যেও,
প্রত্যাখ্যানের জন্য আমার এই গান --
সন্ত্রাস এবং শ্রুশ্রূষার শব্দে,
অসুখের শব্দে।
এই শেষবার
এই শেষবার, শেষ একটিবার
আমি স্বপ্ন দেখি শূন্যতার মধ্যে দিয়ে আছড়ে পড়ছি --
রঙের এক দ্বীপে আমি থাকি,
থাকি এক মানুষের মতো,
আমি মানিয়ে নিয়েছি অন্ধ আর দৃষ্টিমান যত দেবতার সঙ্গে,
এই শেষবার।
দ্বিতীয় আবাস
আমি দ্বিতীয় আবাসের দিকে বেরিয়ে পড়েছি,
আমার পতাকা আর বাতাস চলেছে আমার সঙ্গে।
দিন মরে যায়,
সারি সারি বলির ক্যারাভান পিছে টেনে আনে,
সারি সারি বাড়িঘর তারও পরে।
একটি স্বীকারোক্তি
রাতের মৃতদেহ আর আমার ছিন্ন দুটি হাত, তাছাড়া কিছু নেই
দিনের আচরণে,
চোখের পাতার নীচে পাথর ছাড়া কিছু নেই।
কত কতবার আমি গোঁয়ার ঈশ্বরের কাছে হাত পেতেছি,
ফলেদের কাছে,
কত কতবার আমার দৃষ্টি উপোসি গাছেদের ভিজিয়ে দিয়েছে,
কত কতবার আমি মাড়িয়ে গিয়েছি চোখের ছেঁড়া পাতা
কোনো ঈশ্বরের আলিঙ্গনের আশায়,
আল্লাহ আর দিনের এই ধারালো খাঁজগুলোর আলিঙ্গনের আশায়।
একটি প্রার্থনা
প্রার্থনা করেছিলাম ছাইয়ের মধ্যেই থাকো তুমি,
প্রার্থনা করেছিলাম কখনো জেগো না, দিনের আলোয় চোখ রেখো না --
তোমার রাতগুলো কেমন কখনো তো খোঁজ রাখিনি, কখনো কালোর সঙ্গে ভেসে পড়িনি।
ফিনিক্স, আমি প্রার্থনা করেছিলাম
জাদুটোনা শান্ত হোক আমাদের
দেখা হোক আগুনে আর ছাইতে।
প্রার্থনা করেছিলাম পাগলামি হোক সারথি আমার।
ভ্রমণকারী
ভ্রমণের সময়, আমি মুখটাকে রেখে এসেছিলাম
লন্ঠনের কাচের ওপর।
আমার মানচিত্র এমন এক দুনিয়া যার কোনো স্রষ্টা নেই,
প্রত্যাখ্যান আমার নীতিমালা।
বিদ্যুৎচমক
সবুজ বিদ্যুৎচমক,
আমার বধূ আছে রৌদ্রে আর উন্মাদনায়,
চোখের পাতায় তার পাথর ভেঙে পড়ে,
সবকিছুর মানচিত্র বদলে দাও তুমি।
আমি তো তোমার কাছে এসেছি আকাশহীন এক বিশ্ব থেকে,
যত ঈশ্বর তত গিরিখাদ সেখানে,
হাওয়ার আর শকুনের ডানায় ডানায়।
বীজের ওপর ধুলোঝড় ছুঁড়ি আমি,
আগত মেঘেদের দিকে নতজানু হই,
তাই বদলে দাও সবকিছুর মানচিত্র,
আমার ছবি সেই রৌদ্রে আর উন্মাদনায়,
ওহে সবুজ বিদ্যুৎচমক।
নৈঃশব্দ্যের পরে
নৈঃশব্দ্যের পরে আমি কেঁদে উঠলাম কথারা যেখানে পৌঁছোতে পারে না,
কেঁদে উঠলাম আমি : তোমাদের মধ্যে কে আমাকে দেখতে পাচ্ছ,
আকারহীন এই ছিন্ন অবশেষ, মৃতবৎ এই অবশেষ
নৈঃশব্দ্যের নীচে?
আমি কেঁদে উঠলাম হাওয়ারা যাতে আমার কণ্ঠস্বরে ফুলে ওঠে,
যাতে সকালগুলো
আমার রক্ত আর গানের ভাষা হয়।
আমি কেঁদে উঠলাম : তোমাদের মধ্যে কে আমাকে দেখতে পাচ্ছ,
এই নৈঃশব্দ্যের তলায় যেখানে পৌঁছোতে পারে না ভাষা ?
আমি কেঁদে উঠলাম আমি যে একা নিশ্চিত হতে -- অন্ধকারের সঙ্গে একা।
দৈব নেকড়ে
সকালের পোড়া মুখটা পলাতক
আর আমি সেই চাঁদের মরণ।
রাতের ঘণ্টা আমারই মুখের নীচে থমকে গেল
আর আমি সেই নতুন দৈব নেকড়ে।
শিশুর পা
আমি তোমাকে দিই এক দৈত্য আর ধোঁয়া,
ধূসর ঘোড়া
ড্রাগন ফল আর আগাছা খেতে দিই তোমাকে।
আমি তোমাকে দিই যত বাতাস আর দরজা,
দিই খেলনাবাটি,
স্বপ্ন আর হলুদ রঙের খাতা,
অক্ষর আর লেখালিখি,
জ্ঞান আর প্রবাদের ঘরে --
সূর্য, মেঘের জিনবুড়ি আর ঝরনাগুলো,
শিশুর পা।
বজ্রপাতের পাথর
বজ্রপাতের পাথর আমি
আর সেই ঈশ্বর হারিয়ে যাওয়া চৌরাস্তা খুঁজে পায় যে।
আমি নির্বাসিত পতাকা
পলাতক মেঘ আর দুঃসহ বৃষ্টির চোখের পাতা থেকে।
আমিই সে যে এগিয়ে চলে বন্যা আর আগুন হয়ে,
সেই ভবঘুরে যে ধুলোতে আকাশ মেশায়।
আমি বিদ্যুৎ আর বজ্রপাতের কথক।
চালচুলোহীন মুখে
চালচুলোহীন মুখে আমি ধুলোর কাছে প্রার্থনা করি
আর আমার দ্বীপান্তরী আত্মার গান গেয়ে উঠি,
শেষ না হওয়া এক জাদুর দিকে যেতে যেতে ;
একটা পৃথিবী পেরোই
আমার গানে ঝলসে গেছে সেটা
আর ভেঙে দিই সব সীমা।
একটা দেশ তৈরি করি আমি
একটা দেশ তৈরি করি যার বিদ্রোহ আর বিশ্বাসঘাতকতা আমারই সঙ্গে,
একটা দেশ তৈরি করি যা শিরায় শিরায় লুকিয়ে রেখেছিলাম।
আমার বজ্রপাতে আমি তার আকাশ এঁকেছি,
আমারই বিদ্যুতে আমি সাজিয়েছি তাকে।
বিদ্যুৎ আর ঢেউগুলো তার সীমানা,
চোখের পলক তার পতাকা।
বিশ্বাসঘাতকতা
বিশ্বাসঘাতকতার করুণা,
যে পৃথিবী আমার পায়ে পায়ে উঠে আসে
অগ্নিশিখা আর নরক হয়ে,
প্রাচীন মৃতদেহ হয়ে,
যাকে আমি বঞ্চনা করেছি এবং করেই চলেছি,
আমিই তো সে যে ডুবে গেছে, যার চোখের পাতায়
জলের গর্জনের প্রতি প্রার্থনা,
আর আমি হলাম সেই ঈশ্বর --
যে ঈশ্বর অপরাধের দেশকে দোয়া করে।
আমি সেই দেশদ্রোহী যে তার জীবন ভাসিয়েছে
সর্বনাশের পথে,
আমি বিশ্বাসঘাতকতার প্রভু।
কফিন
ভয় পেয়েছিলে তুমি ? তোমার পরাজিত মুখটা সরাও,
শয়তান, তারাদের ওপরে আমার সওয়ারি।
বোবা ওই পথে আমার তো কোনো ভয় নেই,
আমি মরুঝড়,
আমি যেন এক কফিন :
আমার মুখের নীচে খোঁড়া হয় আমারই কবর।
স্বপ্নগুলো তুমি কম্পিত চোখের পাতায় রাখো,
আর আমার গলায় এসে বসো,
শয়তান, তারাদের নীচে সওয়ারি আমার।
মৃত ঈশ্বর
আজ আমি শাবাথ-এর মরীচিকা পুড়িয়ে দিয়েছি, পবিত্র শুক্রবারের মরীচিকা,
আজ আমি জনগণের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিই, গৃহস্থালির মুখোশ,
পাথরের অন্ধ দেবতা আর সপ্ত-দিনের দেবতার জায়গা আমি
মৃত ঈশ্বরকে দিলাম।
অর্ঘ্য
আদিম যন্ত্রণার গুহায়
যেখানে এক ঈশ্বরকে আমি ভালোবাসি,
যেখানে প্রাসাদ-রমণীদের সঙ্গে আমার ভালোবাসা হয়,
যেখানে আমরা থাকতাম -- আমার বন্ধু উন্মাদনা আর আমি --
মাসগুলোর ভিতরে আমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি,
তাই মরুভূমি পেরিয়ে গেলাম
আমার পায়ের চিহ্ণ পিছনে রেখে।
এক প্রভুর নামে যিনি তার বই লিখে যান
প্রাচীন যন্ত্রণার সেই গুহার ভিতরে,
আমি এই শিখা জ্বালিয়েছি
আর উৎসর্গ করেছি এক পতঙ্গ।
আগুয়ান এই সূর্যদের নামে
আমি শোকসভা শুরু করলাম।
সিসিফাসকে
শপথ করেছিলাম জলের ওপর লিখব,
শপথ করেছিলাম বিশাল ওই পাথর পাহাড়ের ওপর তুলব
সিসিফাসের সঙ্গে।
শপথ ছিল সিসিফাসের সঙ্গে থাকার।
আমি আত্মসমর্পণ করেছি জ্বর আর স্ফুলিঙ্গের কাছে,
অন্ধ কলমদানিগুলোতে
শেষ একটা কলমের খোঁজ করছি আমি
ধুলোবালির একটা কবিতা লিখে যাব
ঘাস আর শরৎকালের জন্য।
শপথ করেছিলাম সিসিফাসের সঙ্গে বাঁচব।
এক ঈশ্বর তাঁর দৈন্য ভালোবাসেন
আমার পায়ের চাপে
ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া ঈশ্বরের কাছে --
আমিই সেই অভিশপ্ত মিহ্যার,
মৃতকেই আহুতি দিই আমি,
আহত নেকড়েদের প্রার্থনাগান গাই।
কিন্তু সেই কবরগুলো যারা
হাই তোলে আমার কথায়
আমার গানকে আঁকড়ে ধরেছিল সেই ঈশ্বরের সঙ্গে
যে আমাদের পথের পাথর উপড়ে ফেলে,
যে তাঁর দৈন্য ভালোবাসে,
এমনকী নরকের দিকে আশীর্বাদ করে যে।
তাই সে আমার সঙ্গে আমারই প্রার্থনা করে,
জীবনকে তার সারল্য ফেরাবে বলে।
একটি দৃশ্য
(একটি স্বপ্ন)
বজ্রপাত যেন পাথরগুলোকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল,
বিদ্যুৎ যেন আকাশের থেকে কৈফিয়ত চাইছিল,
সব কিছুর বিচার চাইছিল,
ইতিহাস যেন আমার চোখের সামনে নিজেকে ধুয়ে ফেলছিল,
আর দিনগুলো যেন ঝরে পড়ছিল আমার হাতে,
ঝরে পড়ছিল ফলের মতো …
হাওয়ার উন্মাদনা
দিনের গাড়িগুলোতে মরচে ধরে গেল,
ঘোড়াটাতেও তাই।
ওই উঁচু থেকে আমি আসছি,
কুঁকড়ে যাওয়া শিকড়ের দেশ থেকে,
আমার ঘোড়া একটি শুকনো কুঁড়ি,
আমার পথে পথে অবরোধ।
কোথায় ভুল, কী দেখে হাসছ তুমি ?
পালাও, আমি তোমার কাছেই আসছি
ওই উঁচু থেকে, আমার পরনে অপরাধ
হাওয়ার উন্মাদনা এনেছি তোমার জন্য।
তুমি নিরুপায়
কী হল? পৃথিবীর মুখচোখ ছিঁড়ে দিচ্ছ তুমি
বদলে আঁকছ অন্য একটা মুখ,
কী হল? তুমি নিরুপায়
আগুনের এই পথ ছাড়া,
প্রত্যাখ্যানের এই নরক ছাড়া,
এই পৃথিবীটা যখন
নিছকই এক বোবা গিলোটিন
অথবা এক ঈশ্বর।

দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য
পেশায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। অডিট এবং কোম্পানি ও কর বিষয়ক পরামর্শদান তাঁর কাজের পরিধি। কবিতাই তাঁর পাখির চোখ।শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আলোক সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত সহ বহু বিশিষ্ট কবির গহন সাক্ষাৎকার যেমন নিয়েছেন, সটীক অনুবাদ করেছেন এলিয়টের দুরূহ কবিতাত্রয়ী ‘বন্ধ্যাভূমি’, ‘ভস্ম-মাখার বুধবার’ ও চতুরঙ্গ’ সহ আরও বহু বিশিষ্ট কবির কবিতা। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ছোটো কবিতার আর্কাইভ ‘দেশ বিদেশের ছোটো কবিতা’। বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন।এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতা বইয়ের সংখ্যা ৭ টি। চেতন-অবচেতনের শান্ত ও স্রোতময় দরজাগুলোতেই তাঁর নিরন্তর মাধুকরী।
Facebook Comments Box
