
ইলিয়াস আলাভী সমসাময়িক আফগান কবিতার জগতে এক স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর। এই তরুণ কবি সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে ইরানে শরণার্থী হিসেবে বেশকিছু বছর কাটানোর পর এখন একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। গত দুই দশকে তার কবিতা তাকে আফগানিস্তানের আধুনিকতাবাদী আন্দোলনে অগ্রণী কণ্ঠে পরিণত করেছে। তার অনন্য সৃষ্টি “অনিবার্য সরলতা” (সাহেল-ই মমতানে’) মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরের রাজনীতি এবং অবিচার, প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে, যা আলাভিকে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর করে তোলে।
আফগানিস্তানের দয়াকুন্ডিতে ১৯৮২ সালে জন্মগ্রহণকারী আলাভী ২০০১ সালে ইরানের মাশহাদে আফগান শরণার্থীদের জন্য দোর-ই-দারি সাহিত্য সমিতির সদস্য হিসেবে তার কাব্যজীবন শুরু করেন। তিনি ২০০৮ সালে কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন, তার প্রথম কাব্য সংকলন, “আমি দিবাস্বপ্নের নেকড়ে (‘মন গর্গ-ই খিলববি হস্তম’), ইরান, তাজিকিস্তান এবং আফগানিস্তানে বেশ কয়েকটি মর্যাদাপূর্ণ কাব্য পুরস্কার পায়, তাদের মধ্যে ব্রডকাস্ট পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড (২০০৯), বার্ষিক বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ইয়ং পোয়েটস (২০০৯) এবং সিমোরগ পিস অ্যাওয়ার (২০১২) ।
তাঁর কবিতা ইতিহাসের নৃশংস মুহুর্তগুলির স্মারক , বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের। তিনি দেশ,রাজনীতি, যুদ্ধ, বর্ণবাদ এবং প্রেমের মতো গভীর বিষয়গুলিকে তুলে ধরেন সহজ এবং আপোষহীন কাব্যিক ভাষায়।
কথোপকথন
আমি আমার বোনকে বলেছিলাম :
কাবুলের বাজারগুলো থেকে দূরে থেকো
দূরে থেকো শহরের চত্ত্বর থেকে
সেই এলাকা থেকে যেখানে উঁচু কার্যালয়।
সে আমাকে বলেছিলো :
কিন্তু এখানে, হাওয়াতেও ধুলোর মত মৃত্যু বয়
যদি তুমি তোমার জানালা বন্ধ করে রাখো
তবু সে তোমার ঘরে ঢুকে আসবে ঠিক।
আমরা মরে যাই
আমরা মরে যাই
যেনো কবিরা লিখতে পারেন তাদের কবিতা
আমরা মরে যাই, যেনো এক মধুর খেলা চলছে
এক মা তার জীভ দিয়ে চাটছেন তরুণ কোনও সৈন্যের বুটগলো
বাবা সটান দাঁড়িয়ে আছেন সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া ছবিতে কর্তাব্যক্তিটির পাশে
প্রতি সন্ধ্যায় অজস্রবার মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে
অজস্রবার আমার বোনেরা চিৎকার করছে
অজস্রবার, যেনো এক মধুর খেলা চলছে
ঠিক এগারোটায় আন্দোলনকারীরা উত্তেজনা নিয়ে বসছে টিভির সামনে
কালও তারা রাস্তায় নামবে
তারা রঙিন ব্যানারগুলোকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করবে
তারা গাইবে
তারা নাচবে
তারা স্লোগান দেবে
আর আমরা মরে যাবো
যেনো এ সময়ের আলোকচিত্রী জিতে যায় পুরস্কার!
কোথায় আমার দেশ?
কোথায় আমার দেশ?
একটা কাঠের টেবিল
যেখানে আমরা চা খাই
একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলি ইমিগ্রেশনের পুলিশটি ধরে নিয়ে যাবার আগে।
কোথায় আমার দেশ?
ইজিয়ন সমুদ্রে ভাসমান এক জরাজীর্ণ নৌকায়
ঢেউয়ের ফণায় আমরা নেচে ওঠার পূর্বে
বৃদ্ধ নাবিক জপ করছে
"ও মেঘ শান্ত হও
ও হাওয়া শান্ত হও "
কোথায় আমার দেশ?
উঁচু সিমেন্টের দেয়ালে আটকে থাকা তরবাত -ই - জামের ক্যাম্প
কাটাতারে বেড়ায় ছেঁয়ে রাখা
দীর্ঘ সারি
একটা রুটির, একটা চিঠির, লজ্জার।
আমার দেশ
লন্ডনের বার থেকে দূরে
অন্তরীত কুয়াশায় ধোঁয়ায় অন্ধকারে
যে মানুষগুলো লড়ছে ছায়ার সাথে
ধূসর বর্ণে, হারাচ্ছে চোখ
নিশ্বাস বিষাক্ত বিষাক্ত নিশ্বাস
আর নামিয়ে রাখা কাপে নামিয়ে রাখছে তাদের ব্যথা।
তাল-ই - সিয়াহ
কুয়েত্তা
ইস্তানবুল
নাওয়ারু
মানুস দ্বীপ
আমার দেশ হয়তো পুরো আল -খলিল
তারা অপেক্ষা করছে ক্ষুধার্তের মত আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট
কোথায় আমার দেশ?
ভাবি আঙুরগুলো যদি মদ হত
ভাবি আঙুরগুলো যদি মদ হত
পৃথিবীটা হত মাতাল
রাস্তাগুলো পরস্পর ধাক্কা খেত
একে অন্যের মুখোমুখি আছড়ে পড়ত
প্রধানমন্ত্রী আর ভিখিরিরা।
ভাবি সীমান্তগুলো যদি মাতাল হত
আর মোহাম্মদ আলীর সাথে তার মায়ের দেখা হয়ে যেত সতেরো বছর পর
অথবা আমিনা তার সন্তানটিকে ছুঁতে পারতো সতেরো বছর পর।
ভাবি আঙুরগুলো যদি মদ হত
আমু নদী নিয়ে আসতে পারতো তার সুদর্শন পুত্রদের
হ্যান্ডকোশ পাহাড় মুক্ত করে দিতে পারতো তার কন্যাদের
এক মুহূর্তের জন্য
বন্দুকের মানে আলাদা হত
ছুরি, পরে থাকতো খোলা
কলম "যুদ্ধ " কে লিখতে পারতো "যুদ্ধবিরতি "।
ভাবি পাহাড় যদি পৌঁছে যেতে পারতো অন্য পাহাড়ের কাছে
সমুদ্র ছুঁতে পারতো আকাশ
চুরি করতে পারতো চাঁদ
বাঘ আর হরিণ একসাথে খেত জল।
আমি ভাবি একদিন মাতলামি হয়তো স্পর্শ করবে সমস্ত কিছু
জানালাটা ভেঙে ফেলবে দেয়াল
আর তুমি
যখন সেই সুবাতাস জড়িয়ে ধরবে শক্ত করে
আমাকে স্মরণ কর।
ও আমার প্রিয়
আমার সুদূরতম বন্ধু
আমার সংগে আরও এক পেয়ালা পান করো
সেই সমস্ত দ্রাক্ষাক্ষেত্রে
যেখানে উপচে পড়ছে আঙুর।
আমার কবিতা
আমার কবিতা
তুমিও নির্বাসিত
একদিন তুমি ছুটে বেড়াও ধোঁয়াচ্ছন্ন ফালুযায়
একদিন তুমি নিক্ষেপিত হও পারস্যের কোনও কারাগারে
অন্যদিন হয়তো গুয়েনতানামোয়
তোমার পঙতি
ভেঙে চুরমার, টুকরো ছড়িয়ে চারিদিক
আমার কবিতা
তুমিও ক্ষুধার্ত
বাকওয়া সমভূমির তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের মত যে অপেক্ষা করে আছে আগন্তুকের
শাহনাজের মত যে একটুকরো ঠান্ডা রুটির অপেক্ষায় হয়ে আছে চাতক
প্রধানমন্ত্রীর মত যে আমাদের বেচে দিয়েছে এক টুকরো গরম রুটির জন্য
ও আমার কবিতা
তুমিও গৃহকাতর
আর এই শীতলতা আমাদের হত্যা করতে যাচ্ছে।
( বাকওয়া আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশে অবস্থিত দুর্গম সমভূমি যেখানে অনেক আগন্তুকেরই মৃত্যু হয়েছে নতুবা পথভ্রষ্ট হয়ে মারা গেছে)
