
কাশ ফুলের হেলদোলে কোনো তফাৎ নেই। তফাৎ নেই শরতের গণ হূজুগে। তবু, ‘কী যেন একটা ফেলে এসেছি পাশের ঘরে’- এই লব্জ ইলিয়াসের গল্পের হলেও শারদ উৎসব সম্পর্কে পরিস্কার লেগে যায়। কী যেন একটা ফেলে এসেছি- এ প্রশ্ন বয়স নির্বিশেষে আপামর বাঙালির। ‘আমার পুজো:একাল সেকাল’- এই শিরোনাম আমাকে কেউ উসকে দিলে আমার অবস্থান হবে রেল লাইন লক্ষ্য করে ছুটে যাওয়া অপুর মতো। কাশফুলের দোলে দোদুল, স্টিম ইঞ্জিনের হুস হুস ধোঁয়া সবই যেন ফেলে আসা এক সোনালী অতীত। কোন্ শারোদোৎসবের পাঁচালি’র নিশান আমার হাতে পতপত করে উড়বে- এ প্রশ্নের জবাব সাময়িক উহ্য রেখে আমি একটা সময়যানে চেপে খানিকটা সফর সেরে নিই।
ক্লাস এইটে’র ‘অপু’ তখন ‘বেতার জগত’ হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে ব্যস্ত সে বছর পুজোর গান নিয়ে মান্না,হেমন্ত, সন্ধ্যা বা আরতি- কে কী করলেন। সালটা ছিল উনসত্তর। সত্তর দশক ছুঁই ছুঁই। পুজোর হাওয়া লেগেছে আপামর বাঙালির হৃদয়ে। নতুন কথা ও সুরের তুমুল খোঁজ শুরু হয়ে যায় মাস তিনেক আগে থেকেই। মাঝের প্রস্তুতির সময় প্রচুর পরিকল্পনার মধ্যে অপুর মাথায় ছিল মান্না বা হেমন্তর গান বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে আগে সে গলায় তুলে নেবে। পুজোর ছুটি যত এগিয়ে আসছে তত ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চ কাঁপিয়ে রেওয়াজ চলছে এসবের। হঠাৎ সব ছাপিয়ে ষষ্ঠীর সন্ধে থেকে বাজতে শুরু করল- ‘মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে..’। মান্না দের ‘ ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বল না..’কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসল।
এ তো গেল পুজোর গানের কথা। পুজো সাহিত্য অবশ্যই আর একটু সংখ্যালঘুদের চর্চা। তখন বাড়িতে হকারের দৌলতে চলে আসত ‘প্রসাদ’, ‘সিনেমা জগত’ বা ‘নবকল্লোল’। এর পাশাপাশি থাকত ‘অমৃত’। একটু আড়ালে ‘এক্ষণ’। আর দেশ-আনন্দে ছিল এলিট পাঠকদের হাতের ছাপ। ছিল শিশু কিশোর সাহিত্য। শিশুসাথী বা শুকতারা।
কিন্তু, পুজো মানে তো সাহিত্য নয়, এক প্রাণের উৎসব। খুশির উৎসবে সামিল হতে বাজার ভিড়ে ভরে যায়। জামাকাপড়ের ব্যাপারটা চক্রাকারে ঘুরে চলে রেডিমেড- টেলর- রেডিমেড- এই ভাবে। তখন এত ব্র্যান্ডের রমরমা ছিল না। যা এখন দেখা যায়। কাটা কাপড়ের বড় বড় থানে লেখা থাকত রেমন্ডস বা ভিমল। বড় টেলাররা বোর্ড ঝুলিয়ে দিত- অর্ডার ক্লোজড। তখন মাথায় হাত। ‘হলিউড টেলর্স’ এর মতো বিখ্যাত কাটাররা ফিরিয়ে দিলে তখন পাড়ার হাবুলদা’র ছোট্ট ‘বিশ্বাস টেলর্স’-এর কাঁচিই ভরসা। মেয়েদের পোষাকেও একই অবস্থা। শাড়ির দোকানের উপচে পড়া ভিড় ঠেলে একটু সামাল দিতেই চাপ পড়ত লেডিজ টেলরে। ক্যাপ বন্দুকের ফটাফটের মাঝে সব দিক রেডি হলে তবে পঞ্চমীর মুখোমুখি হত মানুষ। কুমোরটুলির রাস্তা থেকে সারি সারি দশভুজা পা বাড়াত নির্দিষ্ট মণ্ডপে। তারপর মাইকে পুজোর বাংলা গান, আলোর রোশনাইতে পায়ে পায়ে, আর প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে তুমুল আড্ডায় কেটে যেত প্রথম তিনটে দিন। মন খারাপের নবমীর সকালে লম্বা লাইন খাসির দোকানে। পারিবারিক খাওয়া দাওয়ার এই রাতটা কাটতে না কাটতেই ঢাকের তালে বিষাদের বোল শুরু হয়ে যেত। অনেক একান্নবর্তি পরিবারে সিদ্ধির রেওয়াজ ছিল। আমার ‘অপু’ সেরকম এক সৌভাগ্যবান বলে দাবি করতেই পারি যে দুধেল সিদ্ধির ঘোরে কোনো এক বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় অনর্গল হাসির ফোয়ারায় খান তিরিশেক রুটি সাবাড় করে পারিবারিক খাদ্য সংকট বাধিয়ে ফেলেছিল।
সিদ্ধি, হাসি আর খিদে মিলেমিশে সে ছিল এক তুরিয়ানন্দের রাত। হালকা নেশায় চোখের সামনে হাজির হত সেই মেয়েটা। সেবার পুজোয় যাকে অপু মন ও শরীরে ছুঁতে পারিনি। ভগ্ন হৃদয়ের নিজেকে ছোট্ট টোকা মেরে সামাল দিয়েছিল সে-‘আসছে বছর আবার..’
শরতের মেঘে মেঘে বহু বছর পার হতে অপু কোনো এক সকালে হলুদ পাখি হয়ে শিস দিয়ে উঠতেই সময়ের রূপান্তর ঘটে গেল চকিতে। চার হাতের যৌথ জীবন শরতের উৎসবকেও যেন বদলে দিল অজান্তে। সময়যান আশির দশক ছুঁয়ে ফেলেছে তখন। রং বদলেছে জীবনের ও জীবনকে জড়িয়ে থাকা উৎসবের। রঙ নিয়ে খেলার ছলে রঙের কোম্পানি ঘোষণা করে দিল সেরা পুরস্কারের 7ঘোষণা। কে সেরা ? কেন সেরা ? যা ছিল সাবেক প্রতিমারূপ তা বদলে গেল আধুনিকতার মোড়কে নানা ব্যঞ্জনায়। যত বেশি বাহ্যিক সাজসজ্জা ও দেবিমুখের হরেক আর্টফর্ম, তত বেশি পুরস্কারের সম্ভাবনা। রমরমা বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেল পুজো মণ্ডপগুলো। এক একটা পুজো সংগঠকদের সারা বছরের কাজ হয়ে গেল শারদ উৎসবের পরবর্তী পুজোর আইটেম চর্চা। যা থেকে একটা পপুলার লব্জ বাঙালির উৎসব আঙিনায় ঢুকে পড়ল- ‘থিম’। বড় আকর্ষণীয় বিষয়। যার অন্দরমহল জুড়ে রয়েছে তাবৎ শিল্পীর ভাবনা ও হাতের ছোঁয়া। তদ্দিনে হুড়মুড়িয়ে এসে গেছে বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির ঢক্কানিনাদ। কে কাকে টপকাবে ? কীভাবে দৌড়ে হারাবে ? সমগ্র জীবনটাই তো আরো বেশি করে প্রতিযোগিতার ঘোড়া হয়ে গেছে তখন।
তো,বারোয়ারি পুজোর ঠাকুর তৈরির যুগে সাবেক রমেশ পাল, রাখাল পালরা ভ্যানিস। এদের জায়গা নিল সনাতন বা ভবতোষরা। কোন পাড়ার কোন পুজোর কেমন থিম তা যেন মুখস্থ হয়ে গেল। এত করেও কিন্তু টলাতে পারেনি উত্তরের সাবেক একচালা ডাকের সাজের বাগবাজার বা দক্ষিনের ম্যাডক্সকে। সেকাল সেকালেই রয়ে গেল, সময়ের কাঁটা থামিয়ে রেখে- এও তো এক মস্ত কৌলিন্য। যতই দাপাদাপি হোক ‘থিম’ বাবুদের। এই নব্য পুজো সংস্কৃতি ঐতিহ্য’র ধার না ধারলেও আর যাই না পারুক থিম কেন্দ্রিক একটা ইন্ডাস্ট্রি অন্তত করে উঠতে পেরেছে। সজ্জাশিল্প বা ইন্টেরিয়র ডেকরেশন পুজো অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক জোয়ার এনেছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
ভালো কথা। কিছু মানুষের জীবিকা নিশ্চিত হলে ‘থিম পুজো’ স্বাগত। দেবীপক্ষ পিতৃপক্ষ সব গুলিয়ে দিয়ে প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ফিতে কাটার হুড়োহুড়ি দেখতে সংসারি অপু কিঞ্চিত এড়িয়ে গেলেও নতুন প্রজন্ম এখনো এই হুজুগকে সম্বল করেই এ যুগের শারদোৎসবকে গ্রহণ করেছে।
থিম আসলে উদার বাজার অর্থনীতির ঝাণ্ডা নিয়ে ঞপ্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছে। পেয়েছেও তাই। তালে তাল দিয়ে এসেছে উৎসবের আনুসাঙ্গিক আর সব কিছু। বাজারে চেপে বসেছে ব্র্যান্ড ভ্যালু, ডিজিটাল ধামাকা ইত্যাদি। পুজো বাজার বলতে বাঙালি যা এককালে বুঝত তা এখন আমূল পাল্টেছে। অনলাইন এবং অ ন লা ই ন- এই দৈরথ এখন রীতিমতো দস্তুর। নামী দোকানগুলোয় ‘লাইনেই আছি দাদা’ বলে ভিড় ঠেলে পারিবারিক পুজোবাজারের যে রোমাঞ্চ এককালে ছিল তা এখন প্রায় অন্তর্হিত। এর চেয়ে ঢের সুবিধে ড্রইং রুমে বসে অনলাইন বায়না। এতে বাঙালির প্রাচীন শাড়ি ব্যবসায় বা, ফুটপাতের হকার হরিপদ সাপুইয়ের পরিবারে কী দুর্দশা নেমে এল তা ভেবে ফেলার সময় কোথায় নব্য বাঙালির।
সে যাক গে। সময় এমনই অন্তর্ঘাতময় নিষ্ঠুর। আজ যা পরম শান্তির ছবি তা কাল বদলে গিয়ে কুৎসিত মানসিক পীড়ন আনবে কিনা কেউ নিশ্চিত নয়। বাঙালির প্রাণের উৎসবও অপুর ইচ্ছে অনিচ্ছে নির্ভর থাকবে না চিরকাল।
থেকে যাবে শুধু পায়ের তলার সর্ষে বা চরৈবতি। চিরকাল বাঙালি হাওয়া বদলের পক্ষে। যে বাঙালি এককালে সপরিবারে ‘পশ্চিমে’ যেত চেঞ্জের স্বাদ নিতে তা এখনো অম্লান। বেড়ানোর একাল সেকাল একই আছে। হাওয়া বদল না হলে বাঙালি সামনে এগোতে পারে না। শরৎ-হেমন্তের মহাসন্ধিক্ষণ তাই বাঙালি জীবনের পরম উত্তেজনার। যা সম্ভবত বদলাবে না কাল থেকে কালান্তরে। যেখানে পাহাড়, নদী,সমুদ্রের ভেদাভেদ নেই। শুধু হোটেল সংস্কৃতি বদলে হয়েছে হোম স্টে। সে যাই হোক। ব্যস্ত জীবন থেকে কটা দিন বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার এই রেওয়াজে মরচে পড়ার কোনো লক্ষণ অন্তত নেই।
এক জীবনে অনেক বয়স পেরোতে হয় অপুকে। শিশু-কিশোর থেকে যুব-প্রৌঢ় এক মিলিয়ে যে বিপুল সময়খণ্ড সেখানে যত দিন যায় তত মনে হয় কী যেন একটা ফেলে এসেছি কোথাও। কী ফেলে আসা সেই মহার্ঘ অনুভব তা উৎসবের মহাকাল ঘেঁটে খোঁজ চালাবে আমাদের মনের অপু। ‘আসছে বছর আবার..’-আগমনী থেকে শুরু করে প্রতি শারদোৎসবের শেষ লগ্নে এসে থাকবে সেই একই আকুতি।
