
অরুণিমা সান্যাল এভাবেই বলতে ভালোবাসেন। প্রাথমিকভাবে কিছুটা বোল্ড মনে হলেও, ধীরে ধীরে সয়ে যায়, তারপর অভ্যেস হয়ে যান তিনি! আর সেই অভ্যেসে রয়ে যায় এক প্রতীক্ষা। কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষা…!
প্রথম আমি যখন তাকে দেখি, বলা ভালো যেদিন প্রথম দেখি, কালো আর লালের কম্বিনেশনে শিফনের শাড়িতে তিনি , বেশ নড়ে চড়ে বসেছিলাম। শাড়ি পরার স্টাইলে শারীরিক ঔদ্ধত্য প্রকট এবং সেই উদাসিন ঔদ্ধত্য আরও রহস্যময় লেগেছিল পেন্সিল হিলের নিখুঁত পদক্ষেপে। আমি ভেতরে ভেতরে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলাম আর অনুভব করছিলাম বেশিদিন ধরে রাখা যাবেনা সে দেওয়াল!
চৈত্রের দুপুর সেদিন, খসখসে চারপাশ, ডিপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে উদাসী বাতাস, সে বাতাসে তখন নেশা লাগে। ডায়াসে দাঁড়িয়ে আমাদের চঞ্চল চোখ দেখেই সম্ভবত, ঠোঁটের কোনে সামান্য কৌতুক টেনে তিনি বললেন- অ্যাম আই লুকিং প্রিটি? ওহ,রাদার বোল্ড…’ ! উত্তর ছিল না কারও মুখেই, আর শোনার আগ্রহও বিন্দুমাত্র ছিল না তার। এরপর ভণিতা না করেই বলেছিলেন – ওয়েল, টুডে লেট মে স্টার্ট মাই ডিসকাশন অন ওয়েটিং ফর গোডো..,তারপর ডান হাত কিছুটা তুলে বোর্ডে লিখলেন- ওয়েটিং ফর গোডো , পাশে ব্র্যাকেটে স্যামুয়েল বেকেট, আর দুটো এরো চিহ্ন দিয়ে লিখলেন – ভ্লাদিমির (ডিডি) এবং এক্সট্রাগন (গোগো), এবার আমাদের দিকে আবার সেই কৌতুকমাখা হাসি ঝুলিয়ে – এক্সিসটেনশিয়ালিজম, হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া…?
হ্যাঁ,শুরুর দিন থেকে আজ অবধি একই রকম রয়ে গেলেন তিনি, অরুণিমা সান্যাল! মাঝে অন্তত কুড়িটা বছর। বয়েস বেড়েছে কিন্তু সেটা নেহাৎই ‘নিউমারিক্যালি ট্রু’, আর ওনার ঠোঁটের কোনায় সেই একই রকম হাসি আর ‘নিউমারিকালি ট্রু’ শুনে এই এতোদিন পর মনে হলো নতুন করেই আবার প্রতিরোধটা গড়ে তোলা জরুরি এবং সফলতার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য জেনেই…!
অরুণিমা আজও সেই একই ভঙ্গিমায় ডান হাত কিছুটা তুললেন,কোমরের ভাঁজ সামান্য বেড়েছে, চায়ের কাপ ঠোঁটের কাছাকাছি এনে আবার সেই কৌতুকমাখা হাসিতে বললেন – ‘এখন তো নিজেও ক্লাসে পড়াচ্ছো ,চঞ্চলতা কমেনি দেখছি, একই রকম ছটফটে…’! আমি লজ্জা পাই, চোখ নামাই। পাল্টাননি অরুণিমা এবং আজও অনেকদিন পর একই অনুভূতি- কিছু একটা প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত ঘটবেই, ঘটতেই পারে।
বহুকষ্টে নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগ করা, সময় চেয়েছিলাম, প্রথমটায় মনে করতে সামান্য কয়েক মুহূর্ত তারপর সেই একই কেতায় – ‘ওয়েটিং উইথ আ কাপ অফ টি, হাতে কিছুটা সময় নিয়ে এসো…’! আমার মনে আবার সেই চৈত্রের খসখস,উদাসী বাতাস,শিফন আর ধনেখালির ছবি।
আজ মুগ্ধতা নিয়ে শুনছি বেশি, বলছি কম। বেশ ক’টি বইয়ের আলমারিকে পশ্চাৎভূমিতে রেখে আড্ডার মাঝেই শান্ত আভিজাত্যে পরিস্কার বাংলায় বলে উঠলেন — ‘আসলে তো এক অপেক্ষাই বুঝলে, আর এই অপেক্ষাতেই একটা জীবন, একটা গোটা জীবন। এই অপেক্ষাটাই আসলে বেঁচে থাকা, বেঁচেবর্তে থাকা…!
কুড়ি কুড়ি বছরের পর আজ আমি অনুভব করি, আসলে কিছুই ঘটেনা, সত্যি সত্যি ঘটার কিছু নেই, যা থাকে তা শুধুই সম্ভাবনা আর অপেক্ষা, অনন্ত অপেক্ষা। ওয়েটিং ফর…!
