
আমি আমি এখনও অব্দি বেশি কিছু রচনা করিনি । আমি এযাবৎ কিছুই রচনা করিনি তাও নয় । প্রত্যহ ভেবেছি, বেঁচে থেকে নিজেকে ছাড়া আরও ভালোভাবে আর কী রচনা সম্ভব ? বরং আকাশে যেখানে অন্ধকারে অবিরল বৃষ্টি ঝরে, সেখানে নিঃসঙ্গ ও জনহীন বাস্তবতার নিকটে করুণার গ্রাম, সে-স্থানেই অকারণ হেঁটে যেতে যেতে পেয়েছি নিবিষ্ট কিছু পথ, যাতে মৃত্যুর পরে সুনির্দিষ্ট ও লক্ষণীয় কিছু নিরন্তর লিখে চলা যায় । এইসব পথে চিরদিন আমার পেছনে হাঁটে গোলাপ, নূপুর । এইসব পথে বয় চিরদিন দুপুরের ভাবানুগামীতা । নিষ্ফলা সংসার আসলে এক নাজায়েজ বন । সন্ন্যাস সে-বনের উঠোনে নাজায়েজ বুলন্দি । থাকি, তবে লক্ষ রাখি রোদ যেন চোখে না বেঁধে । আলো যেন কখনও অন্ধ না করে দেয় দর্শনীয় হাজার যোজন । বৃষ্টির ময়ূর যেন মুছে না ফেলতে পারে ধ্বনি ও লিখনগুলি, কান্নার কল্কা আঁকা শিশুর মাদুর আর সেইসব যা এখনও স্পর্শ করিনি । কিন্তু করতে চাই । দেখতে চাই । আঙুলে চোখ টিস টিস করে । ছুঁতে চায় আঙুল সবেদা ! পূর্ণ ফল ! দেখতে চাই সে-ফলের পেকে ফেটে যাওয়া — স্পর্শের বাগানে রক্ত গড়িয়ে কীসের টানে কাছে আসে ! বাকি কাজ ঢেউয়ের শিখরে উঠে নেমে নিষ্ফলা নামের মেঝেন, সেই করুণ মেয়েটি, যাঁর হাতে তার, চোখে আলোর সোহাগ — তিনিই সারেন । তাঁকে বিশ্বাস করেছি । ভবিষ্যতের দিকে পৃথিবীতে আজ পাহাড়ে প্রান্তরে খাদে উচ্চকিত মরুময়তায় যত মৃতদেহ পড়ে আছে যতগুলি চোখ বা পাঁজর, প্রিয় মুদ্রা, অননুকরণশীল নাচ— কাচ পায়ে লাগে, কাচের মতন কিছু রক্তে ভিজে ছায়াপথ ঘুরে তবু বসে থাকে বনান্তে কুটিরে । ফেরে কঠোর পায়ের রাগী দাগ আকাশে আকাশে একি ! আমাকে পেরিয়ে হাহাকার ভবিষ্যতের দিকে যায় । গীতাঞ্জলি যাকে শব্দ দিয়ে ধরা যায় না তাকে আলো দিয়ে ধরি বানাই অনুবাদভোগ্য ভাষা, গীতাঞ্জলি বিরহের গুচ্ছ গুচ্ছ ধান কেটে তোমার পাতার তৈরি অলীক গোলায় তুলে রাখি । এই আমার কাজ । মূর্ছিত হবার বিদ্যা যে আমাকে শিখিয়েছে সেই মেয়েটির ঘ্রাণ, শরীর, মেখলা— অনতিক্রমণীয় ক্রমবিকাশের বিফলতা, কখনো ভুলি না । পরিক্রমা ঘরে ঢুকে ঘড়ি খুলে রাখি । ঘরে বিশাল প্রান্তর আর বিশ্বস্ত পিপুল । দূরে কাছে বনের নীলিমা দেখা যায় । বোনা পাখি কয়েকটি, খুবই ব্যস্ত । সরস কুকুরছানা গোটা পাঁচ ছয় সাত । আর ঘাস, ঘাসের অন্দর থেকে পোকাদের নগরের গুঞ্জন শুনে আমি কীভাবে শল্ক খুলে খুলে এলিয়ে পড়ি ত্রিভুবনান্তে, কীভাবে হাতের কাছে কালপুরুষের ধনু পড়ে থাকে জলদ, রক্তিম — বোঝা দুরূহ, তবে অনুভব করি ভ্রূপল্লব থেকে সরে যাচ্ছে কালি বা কৌশল । চোখও পলকহীন দেখে, পতিত দানার গায়ে জলের রেখায় নাম লেখা আছে আমার ও মশাটিরও, সেই যেটি গত রাতে কিছুতেই ঘুমোতে দেয়নি — অন্নাভাবে কেঁদে গেছে অলীক কুকাব্য ঘিরে টানা । মনে পড়ে যায়, দলমতনির্বিশেষে পাহাড়ে নদীতে পাওয়া সমস্ত ফসিল যেন অতীতের নয়, আগামীর দারুণ মস্করা । সমাধিমন্দির জলে জলে উল্টোরথ, প্রতিবার ভয় করে কে জানে কী চাইতে কী ! খুঁজে পাব মণিপদ্ম ও পাদুকা ? সমাধিমন্দির খুবই অপরিসর কোনোভাবেই দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না তাই সর্পদেহে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে রইলাম । বাইরে আয়তচোখ আনন্দ নয়, বিষাদমহিম উচ্ছলতায় দেখছিল এই জগৎ । জগন্নাথও দেখছিল, যা ভাবছে তার কোনেকিছুই কাজে লাগছে না, কোনোকিছুই নয়নপথে নেই, বন্ধু নেই । বুদ্ধ অকরুণ হাসিমুখ । সর্বত্র কর্তারহিত বাক্য কিংবা পদ সর্বত্র বিকল্প এক অনুধাবন — পুষ্প ও নৈবেদ্য কাকভোরে দংশে গেছে ক্ষমাহীন বুশ ভাইপার । বরফের উপরে বরফ বরফের উপরে বরফ, তার উপরেও । নীচে কানা স্রোত, তরল, চিরসময়ের । তুষারযুগের কিংবদন্তীর দিকে ধীরে সরে যাচ্ছে দলটা । সবাই নিশ্চুপ, ম্যামথ ! কেবল টাস্কের সংগে অন্য টাস্ক মাঝে মাঝে ঘষা লাগছে । গতিহীন হয়ে পড়ছে লোমশ শিশুরা বুড়োরা তাদের ঠেলছে সামনের দিকে এর মাঝে তুমি-আমি পাখি, আমাদের ডাভটেল জোড় অঘটনই, নিখাদ অসহনীয় ফাঁকি । সামনে যেতেই হবে, যেতে হবে দলে দলে, প্রবল একাকি বিশাল একটা বই বিশাল একটা বই খোলা পড়ে আছে ওই বটের ছায়ায় ছায়ার বাইরে রোদ, আলোর পায়ের শব্দ, রং, ঝুমঝুমি … সুপারিশই কাব্য মূলত এবং পাঠক দায়বদ্ধ মার্সিনারি — হাতে এস এল আর, চিপ বুকে না মাথায় ক্ষণে ক্ষণে এই চিন্তায় হেসে ফেলি । বিশাল একটা বই, ফিকে রাত আর চাঁদ উঠেছে ঠিক সেই বটের মাথায় । জ্যোৎস্নাভেজা জামা খুলি, এরপর আত্ম ব্যাপারটাই বেশ হাস্যকর, ক্লান্তিকর ঘোলা তলোয়ার । ছুঁড়ে দিই ঝোপের আগুনে… সারাদিন যায় । ব্যক্তিগত পুনর্লিখন অমর স্থানাংক ছেড়ে কতদূরে যেতে পারে নীল জলরঙে আঁকা রানি মৌমাছি মাপতে বসি রাত্রির গভীর ছায়ায় । ক্ষতগুলো ঢেকে রাখবে কুয়াশা ও মেঘের শিশুরা — চোয়াল শক্ত করে ভাবি । ট্রেন আসবে উত্তরের দোটানা থেকে কান্না চেপে পরাধীন কচ্ছপের মতো, তোমার স্মৃতির কাছে দাম চাইবে হাওয়া— এরকমই ঘটে থাকে । কিন্তু আজ ঘটল না । কেন ? কেন চাঁদ রইল ঠোঁটের জিম্মায় ? জিভ বিষ্ফোরণে বিষ্ফোরণে ছুঁয়ে এল আকাশ-পাতাল ? সমস্ত নিথর । দুঃখ ভোল, স্নানে যাও । ভিজে চুল, ভাতের থালার পায়ে মাথাকে নামাও । দেখা হতে পারে নৌকো নিয়ে বাড়ি ফিরছ, অফুরন্ত মাঝদরিয়ায় । আফিম দিয়ে জ্বালানো মস্ত ফ্যালাস, বাতিঘর, রক্তমাখা আলো দেখলে বুঝবে ওটা আমার শহর, দেশ, রাজধানী । ওখানে নেমো না । আমি বহুদূরে আছি, নির্বাসনে । কোন দেশে ? নাম তো জানি না । তবে দেখা হতে পারে । পাল তোল, তীক্ষ্ণ ক্রেংকার আর ডানার ধড়ফড় আর রক্তের দাগের দিকে চিরকাল নৌকোকে ভেসে যেতে দাও ।

শুভাশিস মণ্ডল
জন্ম ১৯৬৭র ডিসেম্বরে । পশ্চিম বর্ধমানের কয়লাখনি অঞ্চল রানিগঞ্জে । স্কুল ও কলেজ পুরুলিয়া শহরে । বিজ্ঞানের স্নাতক । জীবিকা প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকতা । বিবাহিত । এখনও পর্যন্ত পাঁচটি কবিতার বই বেরিয়েছে । নির্বাপিত, জেলিশরীরের দেবতারা, ‘চোখে চোখ, একটু হাওয়া’, ‘অভিভূত, অসংকলিত’, আবার নতুন করে বর্ষাকাল । কলকাতা বইমেলা ২০২৪কে সামনে রেখে সম্প্রতি অহিরা প্রকাশনা থেকে জেলিশরীরের দেবতারা বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ চলছে ।
Facebook Comments Box
