
কবিজীবন
যে-লেখা হারিয়ে গেল, তুমি তার মৃদু অহংকার
স্বস্তির নিঃশ্বাস থেকে ফুটে-ওঠা ঘাম
তোমাকে তৎপর করে, মুক্ত করে রোজ
ঝরে যাও, অংশত বিষ—
সম্পর্ক ভাঙার ফলে, হারানো লেখার ফলে, যার
প্রতিটা ছন্দের ভুলও প্রাণবন্ত হয়ে যেত
ভেঙে যাচ্ছে সারল্য তোমার
প্রকৃত
তোমাকে এড়িয়ে যেন ভালো থাকি, কত ভালো থাকি
যেভাবে দেওয়াল ভেঙে ভালো থাকে দিনমজুরেরা
আরেকটি দল এসে নতুন দেওয়াল তোলে বলে
ইদানীং কোনো জমি বেশিদিন ফাঁকা থাকছে না
নইলে বাগান হত, কিনারে পুষ্করিণী ঠিকই
ঘাটের বাজুতে বসে সব কষ্ট ধুয়েমুছে শাদা
কেন যে দিনের শেষে বহুতল সাড়া ফেলে গেল
যেদিকে তাকাই শুধু ভাগীদার, তোমাকে চেনে না
ভণিতা
দুজনের বাড়ি চাইছে। তোমরা চাইছ। শুভদিন
এভাবেই চলে আসে। হলুদে নিখিল হয় ত্বক।
আমার বিষণ্ণ স্নানে শ্বাস ফেলে ক'জন পাঠক
তারপর, চোখ বোজে। রাধাঅঙ্গে কবিতা বিলীন।
এসব লেখার পরও যদি ছন্দে হয়ে থাকে ভুল
আমাকে গোবিন্দ দিও। দাসে রইল তোমাদের ঋণ।
পথনির্দেশ
সাধুটি রঙের মোহে লাল।
তাঁর পূর্বজন্ম এই দোলের সকাল
কুয়াশা বিচ্ছিন্ন করে আমাদের, কুণ্ডে ভরা ছাই
আবির ছুঁইয়ে তাঁকে যদি-না জাগাই
সব পুণ্য বৃথা, নষ্ট। তোমাকে হবে না পাওয়া আর।
সাধুটি ভিড়ের। তাঁকে দোল দিচ্ছে অপরিচিতার
সন্তানকামনা, বোবা ছেলেটির পেতে-দেওয়া জিভ...
তোমাকে রঙে না-নিলে, ধরে নেব, তিনিও অশিব
ষষ্ঠী
নাই-ছোঁয়া জল মাথায় ছোঁয়ায় মা—
আয়ুর বহর বেড়েই চলে, বিপদ আসে না
মায়ের মা নেই, জল ছোঁয়াবে কে—
সে-কোনকালে নাইয়ের লেজুড় গর্ভে ছিল যে
নাইকিশোরী বুড়িয়ে গেল চোখের সামনে, বা
আমার নাইয়ের জলে মায়ের আয়ুই বাড়ে না!
চরিত্রায়ণ
'মসৃণতা গিলে-গিলে জিভে তোর স্বাদ থাকবে না—'
খরস্রোতে পাতি জিভ। বাণ ফুঁড়ি। চরিত্র টাঙাই।
'এত ব্যবহৃত, লালা শুকিয়ে না-আসে কোনোদিন!'
জিভজন্তু খুন করে, দাঁতের আদিমে ফিরে যাই
মধ্যযুগ
কাউকে বলিনি, তাই, মহাকাব্য হয়েও হল না।
অতিসাধারণ কিছু দিনরাত্রে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে
এই পর্বে, নামহীন, থিতু হল। বেওয়ারিশ পুথি।
মহাফেজখানা ঘেঁটে এমন অজস্র ছেড়ে যাওয়া
যে-কেউ উদ্ধার করে। টীকা লিখে প্রশংসা কুড়োয়।
কিছুই হল না। শুধু, তোমাকে নায়িকা পেতে চেয়ে
আরও কত লেখা হল। নায়ক যে-যার মতো ক'রে।
সমাচার
তারাও কারো বাবা-মা। তারাও তারা নিজেরাই।
অনেকদিন কথা নেই। বলার কিছু ছিল না।
সহজ, ভারি সহজই। শ্বাসের নেশা। বিরহ।
ফুরিয়ে এলে ভেবেছে, আরাম পেল জীবনে।
আরাম এত স্বাভাবিক? জড়িয়ে ধরে কাঁদা না?
তাসের দেশে এভাবে খরিদ করো আরামও?
আগুন দেখে ফেলেছি। তারাও তারাপৃথিবী।
নেভার মতো হাওয়া নেই। জ্বলার মতো কাঠও না।
প্রত্যর্পণ
এই পারে বসে কেউ দাঁড় ঠেলল, আর
হুগলি উজাড় করে ঢেউ ভাঙছে পিঁড়িতে তোমার
কেন যে এসেছ, কেন পাঁচটি সিন্দুরফোঁটা গেয়ে উঠল বিবাহমঙ্গল
চারদিকে এত কলসি, কানি ভেঙে পড়ে যায় সোহাগের জল
কোথায় মিশেছে তবে? ওই হুগলি, পাটকল, জেটি-ভাঙা শামুকের চর
পুরনো কুঠির দায়ে শ্যামবর্ণ মেলেছে বহর
অথবা কাহিনি লক্ষ্মী, কার স্পর্শ পেলে অচিরাৎ
সব ঢেউ সরে যাচ্ছে—ধারাবিন্দু, পথশ্রম
পিঁড়িতে পৌর্ণমাসী রাত
রাতেরও বিন্যাস ধূর্ত, জলে নামল দুটি মুখ, প্রক্ষালনে অপবিত্র দূর
জটায় সংকেত ফোটে কোনো এক গাঁয়ের বধূর
ভূগোলবিচ্ছিন্ন সেই জনখণ্ড; লেখো সম্প্রদান—
কুশের আংটি পরে ঠেলেছি বিস্তর তীর্থ
সেই পুণ্যে তোমাদের অতীতপুরুষ যেন দিব্যলোকে শীঘ্র ফিরে যান
পারলৌকিক
যে ফেরে লেখার কাছে, কিংবা যে ফেরে না, আলোয়
তাকেও বিষণ্ণ লাগে, আত্মঘাতী হাওয়া ঘোরেফেরে
অন্য কেউ শ্বাস নিলে এই জন্মে এতটা হত না
অথচ যে-দংশন অবশ করেছে, তাকে ছেড়ে
নীলকণ্ঠ লেখাটিকে ফুল দেবে, সন্ধ্যাদীপ দেবে
এমন গেরস্তভাষা কই আর, অন্ধকার স্বরে
যে শুধু বিরতি নিল, কোনোদিন ফিরেও এল না
অন্ন ও ব্যঞ্জন ঢাকা পড়ে থাকে রাতের শহরে
কে এসে উচ্ছিষ্ট করে, কারাই-বা তৃপ্তি করে মাখে
সপিণ্ডকরণ শেষে হরি হরি খাওয়ায় আমাকে

তন্ময় ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। প্রকাশিত কবিতার বই—দীপাবলি নাকি শবযাত্রা (২০১৮), বেইমানির যা-কিছু চিরাগ (২০১৯), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্মনসগোচর (২০২৩)।
Facebook Comments Box

1Comment
November 25, 2023 at 11:50 am
খুবই ভালো লাগল এই গুচ্ছ কবিতা। অনেকটাই আলাদা। অভিনন্দন জানাই কবিকে।