
আশ্বিনের শারদ প্রাতে
আকাশে শরৎ, বাতাসে শরৎ। পুজো এসে গেল। ষষ্ঠীর সকাল। সকাল থেকেই পাড়া কাঁপিয়ে ডিজের ধামাকা শুরু হয়েছে। বিরামবিহীন। কান ঝালাপালা। জীবন অতিষ্ঠ। নিখিলবাবুর মন খিঁচড়ে রয়েছে। কোথায় শরতের পুজোগন্ডার দিনে একটু ফুরফুরে মেজাজে কাটাবেন! তা নয়। মাথার ভেতর যেন দশটা মহিষাসুর লাফাচ্ছে। নিখিলবাবুর দেশের পুজোর কথা মনে পড়ে গেল। সেই পূণ্য শারদপ্রাতের মধুর ঢাকের বোলে ডাকের সাজের মা দুর্গার আরাধনার সাবেক শান্ত মেজাজ। যেন প্রাণের আরাম, মনের শান্তি।
.
দেশের বাড়িতে এখনও জ্যাঠতুতো ভাই শান্ত থাকে। পুজো অবশ্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবু গ্রামের পুজোর সেই সুন্দর ভাবটি তো আছে। সেই বা কম কী! নিখিলবাবু গিন্নিকে ডেকে বললেন, “চল, কাল সকালে ট্রেন ধরে বন্দীপুর যাই। ক-দিন এই ভূতের নেত্যকে ফাঁকি দিয়ে শান্তিতে দিন কাটিয়ে আসি। শান্ত আমাদের দেখলে খুব আনন্দ পাবে।” গিন্নি বলল,” সেসব দিনকাল কি আর আছে। তা যেতে চাইছ, চল।”
.
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে নিখিলবাবু চমকে ওঠেন। বসে বসেই বলেন, “ভেতরে আসুন। দরজা খোলা।” হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে সে আর কেউ নয় স্বয়ং শান্ত। “আরে শান্ত, তা হঠাৎ কী মনে করে। আরে, আমরাই তো শহরের এই গ্যাঞ্জাম ছেড়ে তোদের শান্ত গ্রামে যাব ভাবছিলাম।” “আর গ্রাম!” শান্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “ডিজে আর বাজির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে এলাম গো। সেই চতুর্থী থেকে শুরু হয়েছে। এখানে শহরে কদিন আরামে কাটাব বলে এলাম আমরা। কই গো তোমরা ভেতরে এস।” হাঁক ছাড়ে শান্ত।
.
পিলপিল করে চারজন ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তর বউ ঘরে ঢোকে। নিখিলবাবু হতবাক। কী করবেন ভেবে পান না৷ ওদিকে মাইকে তারস্বরে বেজে চলেছে, আ জা, আ জা, ম্যায় হু প্যার তেরা…
.
.
কুহক
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। ধড়মড় করে নিখিল জেগে ওঠে। দেওয়াল ঘড়িতে রাত দুটো। এত রাতে কেউ তো ফোন করে না। কে হতে পারে? নিখিল একটু অস্বস্তি বোধ করল। আজ আবার তো তাকে চিনতেই পারবে না নিখিল। সকাল থেকে ফোনে এমন একটা গ্যাঁড়াকল হয়ে আছে যে কোনও ফোন কলই আইডেন্টিফাই করা যাচ্ছে না।
.
ঘটনার সূত্রপাত দুপুরে। অফিসে একবার তিস্তাকে ফোন করতে গিয়েই আবিষ্কার করল ব্যাপারটা। তিস্তা ক-দিনের জন্য মায়ের বাড়ি গেছে। ওকে কল করতে গিয়ে নিখিল বুঝতে পারল ওর ফোনের কনট্যাক্ট লিস্টটা কোনোভাবে উড়ে গেছে। কাউকেই কল করা যাচ্ছে না। আর ফোন এলেও বোঝা যাচ্ছে না কে করল। কী যে আপদ হল। কিছুতেই ঠিক করা গেল না। কাল ওদের সফট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার অশোকের কাছ থেকে ঠিক করে নিতে হবে। ও আজ ব্যস্ত।
.
না চিনেই নিখিল অভ্যেসবশত ফোনটা ধরল। ওদিকে একটা হাস্কি গলার স্বর। মেয়ের। এত রাতে কোনও মেয়ে তো ফোন করে না। কে হতে পারে। অফিসের সুপর্ণা। ওর গলা কী এরকম? তাও এত রাতে। “কী গো, আমাকে ছাড়া রাত কাটছে কী করে।” নিখিল বলে, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। “সে কী এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে। তুমি নাকি আমাকে কখনো ভুলবে না। কত প্রতিশ্রুতি কত লাভ-লেটার।” নিখিল হতভম্ব। অস্ফুটে বলল, কে আপনি। চি-ন-তে তো পা-র-ছি না। ” তুমি সেবার দীঘায় কী বলেছিলে। মনে নেই? শুধু আমি আর তুমি। ভুলে গেলে।”
.
নিখিল এবার ঘামতে শুরু করেছে। এ যা বলছে তার কোনও মাথামুন্ডু নেই। ও বলল, আপনি পরিচয় দিন। সামনে আসুন। ওদিক থেকে খিলখিল হাসি। “ঠিক আছে, আসছি সামনে। কিন্তু দেখলেই কি সবাইকে চেনা যায়?” ফোন দপ করে অফ হয়ে গেল। নিখিলের চোখ পড়ল ঘরের কোণে পর্দার পাশে। আবছা অন্ধকারে সেখানে একটা অবয়ব ফুটে উঠছে। কে ও? তিস্তা? সুপর্ণা? নাকি অন্য কেউ। তীব্র উত্তেজনায় নিখিল হতবাক! তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। চোখ বেরিয়ে আসছে। নিখিল কি তার সংজ্ঞা হারাচ্ছে?
