আজ আমার বিয়ে হতে পারতো এবং এ অঞ্চলে নতুন একটি জিনিস আবিষ্কারের জন্য আমি নন্দিত হতে পারতাম। এমন কিছুই হলোনা, আমি তাই সবুজ রঙের নেইলপলিশের বোতল হাতে ভ্যাবাচ্যাকা চেহারায় বসে আছি। এই টিয়া সবুজ রঙের নেইলপলিশ আমার তৈরী। গেলো কয়েকদিন, কয়েক রকম সবুজ রং, স্পিরিট, থিনার ঘেটে এই সবুজ রঙের নেইলপলিশ বানিয়ে নামহীন এক বোতলে ভরে রেখেছি, আজ সুফিয়াকে দেব বলে। তাক লেগে যাবে সবার। তা কিসের কী? আজ দিনটাই ভণ্ডুল হলো।
সুফিয়া এ অঞ্চলের বড়লোকের মেয়ে। সৈয়দপুরে বড়লোকের বাড়ি বললেই সবাই আঙ্গুল তুলে সুফিয়াদের সাদা দোতলা বাড়িটাই দেখায়। ওদের বাড়ির নাম ছিল বড়বাড়ি। সেখান থেকে লোকজনের মুখে মুখে বড়লোকের বাড়ি নাম হয়েছে। কেউ আড়ালে বলে চামারের বাড়ি, খচ্চরের বাড়ি। এর কারণ সুফিয়ার দাদা। সুদের ব্যবসা করে, দালালি করে নাকি সে বড়লোক হয়েছিলো । ঠিক উল্টো তার পুত্র, মানে সুফিয়ার বাপ। বাপের রেখে যাওয়া সুদের ব্যবসার টাকা খাচ্ছেন, কিন্তু মুখভর্তি ন্যায়নীতির বুলি। যেন মুখ ভর্তি ন্যায় নীতিকে পানের মতন চিবুচ্ছেন, আর মাঝে মাঝে সেই নীতির তিতারস মুখ থেকে ছিটাচ্ছে। কারো গায়ে, কারো পায়ে তো কারো মাথায়। আজ তাই হলো। মায়ের পুরোনো দুই ভরির সোনার চেইন, দুই হাড়ি দই মিষ্টি, তিনজন পাড়ার আতত্মীয়, আর পকেটে সবুজ নেইলপলিশ নিয়ে সুফিয়াদের বাড়ি গেলাম। সুফিয়ার সাথে আমার গেল কয় বছর প্রেম। আমার বিএ পাশ ডিগ্রি ছাড়া আর কোনদিন দিয়ে আমি সুফিয়ার থেকে এগিয়ে নেই। কোন ক্ষমতা নেই, ঝকঝকে চমক নেই। তবু বড়লোকের ইন্টারমিডিয়েট পাশ ফিটফাট মেয়ে সুফিয়া কেনো আমার প্রেমে পড়লো, কে জানে?
সুফিয়া বলেছিলো, “আব্বা আমার বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল। তোমারে পছন্দ হলে দেখবা আজকে আকদ করায় দিবে কিন্তু। তুমি আবার আব্বার মুখের উপর কথা বলোনা।” মুখের উপর কথা বলার মতন ঘটনা ঘটেনি। বরং পান চিবানোর ভঙ্গিতে, ন্যায় নীতি চিবুতে চিবুতে, সুফিয়ার আব্বা জানালেন, আমার মতন দুই নম্বরি ভেজাল কারবারের ব্যবসায়ীর সাথে উনি মেয়ের বিয়ে দিবেন না।” আমি ফিরে এসেছিলাম। আসার আগে বলে এসেছিলাম, “আমি দুই নম্বরি কারবার করিনা।”
এই কথাটি আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, যে আমি দুই নম্বরি না। আমার তো নিজেকে একজন শিল্পী মনে হয়, একজন শিল্পী কি দুই নম্বরি হয়? আমার কাজ তৈরী করা, সৃষ্টি বললে বেশি ভালো শোনায়। আমি নানা রঙের জিনিস বানাই। মাথা ঠান্ডা করার তেল কিংবা মাথা ব্যথা কমানোর ঝাঁঝালো বাম, কোল্ড ক্রিম, ট্যালকম পাউডার আর লেমন ফ্লেভার ভ্যাসলিন, সুগন্ধি, নানা রকম নেইলপলিশ, এমনকি চর্মরোগের জন্য টাইগার মলম, কী বানাতে পারিনা আমি? এই যে সবুজ রঙের নেইলপলিশ এইটা ও আমার বানানো, এ অঞ্চলে প্রথম।
সৈয়দপুর বড়বাজারে আমার দোকান। দোকানের কোনো নাম নেই। সবাই পাইকারি শখের দোকান নাম চেনে। শখের জিনিস তৈরী করতে যা উপকরণে আমার দোকানে ঝিকিমিকি সাজানো। এলাকার মেয়েদের কাছে আমার এ দোকান স্বপ্নপুরী। শখের জিনিসের ব্যবসায়ীদের কাছে ও। মাসের শুরুতে আর পনের তারিখে গ্রস আর প্যাকেটের হিসাব করে করে এলাকার পাতি ব্যবসায়ী-ফেরিওয়ালারা আমার থেকে জিনিস কেনে। আমি আদর মাখিয়ে তাদের ব্যবসায়ী বলছি বটে। তারা প্রতিদিনের খেটে খাওয়া মানুষ। নিজের তৈরী শখের জিনিস ফেরি করে এখানে ওখানে। আমার দোকান থেকে উপকরণ কেনে, নানা রকম খালি বোতল কৌটা, নানা রকম লেবেল, লাল নীল রঙিন রাংতা, কাগজ আর স্টিকার। তারপর নিজের বাড়ি যেয়ে যেয়ে, কেউ সেই উপকরণ মিলিয়ে মিশিয়ে কেউ চুলের তেল বানায়, তো কেউ কোল্ড কিংবা পমেট ক্রিম, ব্রণ কমানোর পাউডার, নানা রকম সুগন্ধি। তারপর সেই লেবেল বসিয়ে, রঙিন কাগজ মুড়ে আসেপাশের বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করে। কেউ কেউ নিজের মনপছন্দের নাম জুড়ে দেয় তার লেবেলের গায়ে। ম্যাডোনা থেকে আলিবাবা, সব নামেই জিনিস পাওয়া যায়। রহমত ভাই তো শহরের নিভিয়া ক্রিমেরে অনুকরণে তার তৈরী কোল্ড ক্রিমের নাম রেখেছে নাভিয়া। খুব খেয়াল করলে বোঝা যায়। কাঁচের ঢাকনাওয়ালা কাঠের পাতলা বাক্সে জিনিস ভরে, মঙ্গল আর শুক্রবারের হাটে, আর বাকি দিনগুলো গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে ফেরিওয়ালারা।
আমার এই পাইকারি দোকান আমার দাদার আমলের। আব্বা দেখভাল করলো সারাজীবন। আর আব্বা চলে যাওয়ার পর এখন আমি। যা আয় রোজগার হয়, আম্মা, ছোটবোন আর আমার একটা সংসার দিব্বি চলে যায়। দোকানের সাহায্যের জন্য একজন লোক ও রেখেছি। প্রতি মাসের ১৪ তারিখ আর ৩০ তারিখ, ঢাকার চকবাজার থেকে জিনিসপাতি চলে আসে। বাধা লোক আছে, সেই আব্বার আমল থেকে। বেশিরভাগ সময়ে ঠিক সময়ে মালপত্র সময়মতোন চলে আসে। আর জিনিসপাতি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার পর দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। পরিচিত আসে পাশের ফেরিওয়ালা, ব্যবসায়ীরা গুনগুন ভিড় জমায়। জিনিসপাতি বেচা হয়, হিসাব কিতাব রাখা হয়। দোকানের পাশে ছোট্ট চৌকি আর বেঞ্চি পাতা। উনুনে কেতলি গরম, টগবগে। সবার জন্য চায়ের ব্যবস্থা থাকে। লাল, চা, গুড় চা। যে যেমন চায়। দাদা-আব্বার আমল থেকে এই নিয়ম। খদ্দের আমাদের লক্ষী, কাছের মানুষ। এরা কেনাকাটা করে বলেই আমরা বেঁচে আছি। এদের কতটুকু সমাদর করা যায়, করি। এই পাঁচ গ্রামের মানুষ, যারা নানারকম রং, আর উপকরণে শখের জিনিস বানায়, এরাই ধরতে গেলে আমার আতত্মীয়। এদের সাথেই প্রতিদিনের সখ্য। সেই সম্পর্কের সুবাদে আমি শিখে ফেলেছি, নানা রকম শখের জিনিস তৈরির কলা কৌশল। সবাই বলে, এখন আমি নাকি এই ফেরিওয়ালাদের চেয়ে ঢের ভালো জিনিস বানাই। আমার ও খুব ভালো লাগে। বেচা বিক্রির ফাঁকে রাত জেগে আমিও নানা রকম শখের জিনিসের সরঞ্জাম নিয়ে বসি। শিল্পী যেমন রং তুলি দিয়ে নানা রকম ছবি অনেকে, আমি তেমন এটা সেটা ওটা মিলিয়ে তৈরী করি এ অঞ্চলের শখের জিনিস। আমার তাই নিজেকে শিল্পী মনে হয়।
কারো কাছে শখ, কারো প্রয়োজন। কখনো শখ আর প্রয়োজন মিলেমিশে যায়। এই যেমন নারিকেল তেল, আর তিলের তেলের সাথে এক মুঠ আমলা পাউডার, পিপেরমেন্টের গুঁড়া, তিন ফোটা সুগন্ধি আর পাঁচ ফোটা সবুজ রঙ মিশিয়ে মাথা ঠান্ডার তেল তৈরী করি। এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া, রোদে ফাটা জমিতে দিনভর পুড়তে থাকা তপ্ত মাথার তালুর মানুগুলোর জন্য এ তেল প্রয়োজন বটে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঠান্ডা তেলে ভেজা চুলে কেমন বরফ শান্তি জমে। ‘ঠান্ডা তেল’ নামেই এ তেল চলছে। আমার শখের জিনিসপাতির কোন নাম রাখিনি। পাইকারি ব্যবসার ফাঁকে এগুলো বানাই। দোকানের এক কোণে রেখে দেই, কোন দিন মন চাইলে হাটে যেয়ে জিনিস বিক্রি করি। আমার খদ্দের বাধা। আমাকে খুঁজে নিয়ে মাথা ঠান্ডার তেল, কিংবা মাথা ব্যথার বাম এটা সেটা যা চায়, আমি সময় নিয়ে বানিয়ে দেই।
এই যেমন সুফিয়া সেদিন সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি পরে, আমার দোকানের পাশ দিয়ে তার খালার বাড়ি যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টুকটুক করে গল্প করে। প্রায়ই দিনই এমনই হয়, আলাদা করে দেখা করবো কোথায়? আসা যাওয়ার পথে, টুকরো টুকরো কথা, যখন তখন, এই তো আমাদের প্রেম।
সেদিন বলেছিলাম, “নতুন শাড়ি নাকি? সুন্দর তো।”
ব্যাস, খিলখিল হেসে কথা ছুড়ে দিলো, “এই তুমি এমন সবুজ শাড়ির মতন নখ পলিশ বানাইতে পারোনা? ইন্ডিয়ার নায়িকারা এমন রং নখে লাগায়। আমি সিনেমায় দেখসি।”
আমি সেদিন থেকেই প্রাণপণ চেষ্টা করে, সবুজ নেইল পালিশ বানানোর কাজে লেগেছিলাম। কারণ এটুকু আমি পারি, এতটুকুই ক্ষমতা আমার। কয়েক দফা স্পিরিট, থিনার আর রং নষ্ট করে, অবশেষে টিয়া রঙের নেইলপলিশ বানিয়েছিলাম, সেদিন সুফিয়াকে দেব বলে। দেয়া হলোনা। কারণ সুফিয়ার বাবা আমাকে দুই নম্বর বললেন। আর আমি বিশ্বাস করিনা যে আমি দুই নম্বর।
সেদিন থেকে যোগাযোগ ও করিনা সুফিয়ার সাথে। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, আজকাল এই পথ দিয়ে যেতেও দেখিনা ওকে। আমার শরীর জুড়ে কেউ যেন দুই নম্বরির সাইনবোর্ড পিন দিয়ে দিয়ে গেঁথে দিতে চাইছে, আর আমি দৌড়ে পালাচ্ছি। সুফিয়ার থেকে, নিজের থেকে। তাই খুব করে কাজে মন দেই। সামনে দূর্গা পুজো। আসে পাশে অঞ্চলের হিন্দু বাসিন্দারা হাটে দোকানে ভিড় করে এ সময় শখের জিনিস কিনতে। ঈদ আর পুজো,ভালো ব্যবসার এই তো সময়। তাই মন প্রাণ ঢেলে দেই তাতে। সিঁদুর, সিঁদুর-সাদা রঙের পলা, কাঁসার থালা, তামার গয়না জোগাড় করে আনি চকবাজার থেকে এ সময়ে। কিছু দোকানে রাখি। কিছু ফেরিওয়ালারা কেনে। এ সময়ে আমার হাতের তৈরী লাল নেইলপলিশের চাহিদা বাড়ে। দোকান সামলে একা পেরে উঠিনা। আমি দোকানের কাজের সহকারী আর ছোটবোনটা মিলে রাত জেগে নেইলপলিশ বানাই। বোন বলে, “দাদা নখ পলিশের একটা কোম্পানি নাম দাও। সবাই কেমন নাম দেয়।”
কোনো নাম তো মাথায় আসেনা। তাই সোনালী চিকচিক স্টিকার লাগিয়ে দেই বোতলের গায়ে, নামহীন। এমন করেই চলছে, বিক্রিবাট্টা, দোকান সামলানো। পূজার দিনেও দোকান খুলে রাখি সকাল বেলা। বড়বাজারের মোড় ছাড়িয়ে মাঠ, সেখানে পূজার মণ্ডপ। মেয়ে,ছেলে, ছোকরা, বুড়ো, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান, কেউ পুজো দিতে যায়, কেউ তামসা দেখতে আর গান-বাজনা শুনতে। মাইক ফাটিয়ে দিন রাত গান চলছে। উৎসব তো খুব আসেনা এ অঞ্চলে। তাই যে কারো উৎসব কেমন সবার উৎসব হয়ে ওঠে। পূজা মণ্ডপ থেকে আসা যাওয়ার পথে লাল নেইলপলিশ, তেল, পলা চুরি, সিঁদুর, বিক্রি চলছেই।
দুপুরের আগে দিয়ে পাড়ার মালতির সাথে সুফিয়া দেখি যাচ্ছে মণ্ডপের দিকে। একবার তাকায়ও না। আমি ডাকিনা। প্রায় ১০দিন পর দেখলাম। বুক ধড়াস করে উঠলো। প্রেমে পড়বার পর, যখন ওকে দেখতাম আশেপাশে, আমার মুখটা যেন নতুন তেলের বোতলের ছিপির মতন আটকে থাকত। টেনেটুনেও মুখ খুলে কিচ্ছু বলতে পারতামনা। ধড়াস ধড়াস বুকের ডাক সবাই যেন শুনতে পেত। ওকে দূরের মনে হতো। আজ ও কেমন দূরের মনে হলো। মন ভার হলো। ঘন্টা দুয়েক পর, বিকাল হবো হবো সময়ে ভাবলাম দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাই। চারপাশের গুনগুন নিভে যাচ্ছে। যে যার বাড়ি ফিরছে ক্লান্ত টানা টানা পায়ে। আর অমন সময়ে দেখি, মণ্ডপ থেকে ফিরছে সুফিয়া। একাই ফিরছে, মালতি কই কে জানে?
ঘুরে তাকিয়ে একদম দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“তুমি আমারে যাওয়ার সময় দেখোনি?”
-“দেখসি।
“ডাকলানা ক্যান?”
-সাথে মালতি ছিলো, ভাবলাম বেড়াইতে যাও, তাই আর … “
যেন এক কলসি উপুড় করা রাগ আর ক্রোধ শরীর মেখে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সুফিয়া। চোখ কাঁপছে, শরীর ও। সবটুকু রাগ ঝপাৎ করে ছুড়ে দেয় আমার দিকে। আমি নড়ে উঠি। কিন্তু কিছু বলিনা। আমি এমনই। আমি কাজ করে যাওয়া মানুষ। কথার উপর কথা কেমন করে বসাতে হয়, আমি জানিনা।
“এই যে এত্তদিন দেখা সাক্ষাৎ নাই, বিয়ের কথাও পাকা করতে পারলানা, আব্বার দৌড়ানি খাইয়া ফিরা আসলা, চেদভেদ নাই তোমার?”
-“সুফিয়া, তোমার আব্বা আমারে গালিগালাজ করসে।” – খুবই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম। কারণ আমার ভেতরে কোনো রাগ জন্মাচ্ছেনা।
“তো কী করবে? আদর করবে?”
আমি কাউন্টারে জমে থাকা জিনিসপত্র গুছাতে থাকি। দোকান বন্ধ করতে হবে। দোকানের পিচ্চি ছেলেটা সারাদিন মণ্ডপে, মেলায় টইটই করছে। আজ আর তাকে পাওয়া যাবেনা।
সুফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আগের মতন কাঁপছেনা। কেমন কুঁচকে আছে চোখ, বিরক্ত বোধহয়।
“আমি গেলাম।” বলেও দাঁড়িয়ে থাকে।
ওর নখে পুরোনো লাল নেইলপলিশ কেমন পুরোনো মরিচার মতন ক্ষয়ে ক্ষয়ে আছে। সে দিকে তাকিয়ে মনে হয়। পকেটেই ছিলো। সেদিন থেকে পকেটে নিয়েই ঘুরি। সবুজ নেইলপলিশটা বের করে হাতে দেই।
“তোমার জন্য তৈরী করসিলাম। দেখোতো কেমন?”
নেইলপলিশ হাতে নেয়, চলে যায়। খুশি হয় কিনা বুঝতে পারিনা। পিছনে ফিরে তাকায়না। আমিও ডাকিনা। ডাকতে ইচ্ছে করে, তবুও। সেদিনের দুই নম্বরি গাল, আবার যেন এক বালতি আবর্জনার মতন গায়ে কেউ ঢেলে দিতে চাইলো। চারপাশে কেমন পচা গন্ধ, উফফ। আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। বাড়ি ফিরতে হবে।
পূজার পর একটু আস্তে ধীরে সময় যাচ্ছে। প্রতিবছরই এমন যায়। ফেরিওয়ালা আর পাতি ব্যবসায়ীরা এসময় একটু শুয়ে বসে গড়িয়ে নেয়। যাদের টুকরো জমিজমা আছে, ধান চাষ করে। কেউ জমি বর্গা নেয়। আমার টুকটুক করে যা বিক্রি হয়, আর তার ফাঁকে মাথা ঠান্ডার তেল বানাই। আর ভেসলিনের সাথে পিপারমেন্ট আর খানিকটা পানসে সবুজ রং মিশিয়ে মাথা ব্যথার জন্য একটা বাম বানাই। ভারী ঝাঁঝালো। মাথার দুপাশে একটু ঘষে দিলে, চোখে পানি চলে আসে। অল্প ব্যথা নিমেষে গায়েব। খুব চলছে আজকাল এ জিনিস। দিনদিন এ পৃথিবীর অহেতুক মানুষগুলো বাড়ছে, অযথা হাত পা নাড়ছে, আর বাড়ছে তাদের মাথা ব্যথা।
সেদিন খুব মন দিয়ে দোকানের ছেলেটাকে সাথে নিয়ে বাম বানাচ্ছিলাম। দোকান ফাঁকা। সুফিয়া এসে সামনে দাঁড়ায়। সেদিনের ক্রোধ রাগ শরীরে নেই। চোখ শান্ত। আমার চোখ যায় সুফিয়ার আঙুলের নখে, সবুজ টিয়া রঙে টুকটুক করছে। মনে যে কেমন দোলদোলানি আনন্দ হয়। সেটা চেপে বলি,
“এই গরমে বাইরে দাঁড়ায় থাইকোনা, দোকানের ভেতর আসো, বসো। ” এমন করে বলি যেন, প্রতিদিন দুপুরে ঠিক এ সময় সুফিয়া সামনে এসে দাঁড়ায়। যেন প্রতিদিন আমি এমন করেই বলি, “আসো, ভেতরে আসো।”
আসে, কী বলবে ভাবে, কিংবা যা বলতে এসেছে গুছিয়ে নিচ্ছে। আমি অপেক্ষা করি। আমার তো কোনো তাড়া নেই। সবুজ নেইলপলিশ মাখা কাঁচুমাঁচু হাতদুটোর দিকে বারবার আমার চোখ যায়। আমি বরফ ভাঙি।
“শরীর ভালো?”
আমাদের কথা এগোয়। একটু একটু করে টুকটুক অনেক। দোকানের ছেলেটা এক মনে ছোট ছোট কৌটোতে বাম ভরছে। ওকে চলে যেতে বলতে পারি। কিন্তু তাতে আলাদা আয়োজন তৈরী হয়ে যাবে কথা বলার। হয়তো দেখা যাবে, সেই আয়োজনে কথা খুঁজে পাচ্ছিনা। কতদিন পর তো সুফিয়ার সাথে এমন করে বসে টুকটুক কথা বলছি।
“আব্বা কিন্তু প্রায় রাজি, মন গলছে।”
– “আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি?”
“তুমি একটু আব্বার সাথে আবার দেখা করো। আব্বা তোমার লগে কিছু শলাপরামর্শ করতে চায়।”
-“কিসের পরামর্শ? বিয়ের?”
“আব্বা ঢাকা থেকে অরিজিনাল মালসামান এনে দিবে। বিদেশী কোম্পানির ক্রিম, সেন্ট, স্নো, নেইলপলিস। সেইগুলা বিক্রি করবা তোমার দোকানে।”
-“ক্যান?”
“আব্বা চায়। তুমি এই দুই নম্বরি ব্যবসা … “
আমি কিন্তু এবার আর শান্ত নেই। সুফিয়ার সেদিনের ক্রোধ রাগ তিরতিরে সাপের মতন আমাকে এঁকেবেঁকে জড়িয়ে ফেলছে। টুকটুক করে কথা আর এগোয়না। বড় বিচ্ছিরি, নোংরা, গরম রোদের মতন গনগনে হয়ে যায় ভেতরটাও। আমি দুই নম্বরি না, আমি বিশ্বাস করিনা।
সুফিয়া চলে যায়, যাওয়ার আগে আমার জীবনে প্রথম শোনা অদ্ভুত এক কথা বলে যায়। আমার খেপে যাওয়া উচিত, সব কিছু ছুড়ে ফেলা উচিত, চিৎকার করে বলা উচিত, “হাতে তো আমার তৈরী নেইলপলিশই মাখসো, আবার আমারে অপমান করো?” কিছু বলিনা , করিনা। সুফিয়া চলে যায়। হাতে বাম মাখিয়ে কাজ করছিলাম, ভুলেই যাই। বাম মাখানো হাত চোখে ঘসি ভুলে। চোখ জ্বলে যায়, জলে একাকার। ভালোই হয়েছে দোকানের পিচ্চির সামনে এতো অপমান সহ্য করলাম, কোন লজ্জায় এখন তাকাই। জ্বলে যাওয়া চোখ নিয়ে বসে থাকি। বড্ড লজ্জা হয়।
এমন লজ্জার দিন এক গাঢ় দিন মিলেমিশে যায় প্রতিদিনে ঢাকা । আবারো কাজের দিন গড়িয়ে ফিরিয়ে আসে। দোকান ভরে যায় পাতি ব্যবসায়ী আর ফেরিওয়ালাদের দিয়ে। বাজারে গুঞ্জন শুনি, এক অরিজিনাল কোম্পানি ঢাকা থেকে এসেছে, অনেক টাকা, তারচেয়েও বেশি ক্ষমতা। চারদিকে ভনভন করে বলে বেড়াচ্ছে, বাজারের এসব সস্তা নকল দুই নম্বরি ক্রিম লোশন তেল মাখলে চামড়া পুড়ে যাবে, চুল ঝরে যাবে। রেজিস্ট্রেশন নাই, লাইসেন্স নাই। এসব জিনিসে ভরসা করা চলে?
তহুর আলী আমার পুরোনো খদ্দের, আব্বার আমল থেকে জিনিস কিনে আমার দোকান থেকে। তার হাতের তৈরী যেমন স্নো এই অঞ্চলের মানুষের কাছে খুব বিখ্যাত। শীতকালে তো ঠোঁটে গালে সেই লেমন স্নো মেখে সুরে বেড়ায় এ অঞ্চলের মানুষেরা। ছোট্ট শিশিতে নীল কাগজ মুড়িয়ে বিক্রি করে – তহুর ম্যাজিক নামে। লেমন স্নো এর উপকরণ আর কয়েক গ্রস কৌটা কিনতে এসেছিলেন আজ সকালে তহুর চাচা। কাজ সেরে বেঞ্চিতে দোকানের পাশের বেঞ্চিতে বসে রোদে পিঠ দিয়ে চা খাচ্ছিলেন।
চাচার সাথে আমার কৌতুকের সম্পর্ক। আমি বলি, “চাচা এই শীতকালে তো আপনি ম্যালা বড়লোক হয়ে যান। সারা মাসের কামাই এই শীতকালে …”
তহুর চাচা প্রতিবার যতটা খুশি হন এই কথা শুনে এবার হলেন না যেন। “নারে বাপ, অরজিনাল কোম্পানিওয়ালারা ঝামেলা শুরু করসে। আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে না হয় দ্যাখো।”
আমি হাসি, “চাচা এরা তো প্রায়ই আসে। নানা ধান্দা নিয়ে। খালি বড় বড় কথা কয় তারপর চলে যায়।”
তহুর চাচা আমার মতন নিশ্চিন্ত নন, “এবার নাকি দোকান খুলবে বড়বাজারে। অনেক ট্যাকা নিয়ে নামতেসে, আমাদের কারবার তাইলে শ্যাষ।”
তহুর চাচার কথা যে সত্যি হতে যাচ্ছে, বুঝলাম কয়েকদিনের মধ্যে। আমাকে চেয়ারম্যানের ডানহাত হাফিজ কাজী তার দোকানে ডাক দিলো। বাজারে চাল ডালের আড়ত আছে, আর প্রভাবশালী নেতা চেয়ারম্যানের সাথে খাতির। ‘এবার শীত কেমন পরবে’ “আম্মার শরীর কেমন’ ধরণের খুচরা অযথা আলাপ সেরে উনি কাজের কথায় আসলেন। শখের জিনিসের দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। অরিজিনাল কোম্পানি খোলা হবে। ওদের লাইসেন্স আছে, রেজিস্ট্রেশন আছে। আমাদের মতন ফুটো কারবার না।
নকল কাশিতে গলা পরিষ্কার করে হাফিজ কাজী বলে, “তোমরা মিয়া কী সব কাঁচামাল দিয়ে জিনিস বানাও, মানুষের চামড়া চুল তো সব জ্বইলা পুইড়া যাবো।”
-“তো এতদিন আপনি আর আপনার গুষ্টি, এ অঞ্চলের মানুষ কী মাখসে? এই শখের জিনিসই তো। আপনার দাদি নানি আম্মার চামড়া জ্বলসে?”
“আহা রাগ করো ক্যান? তখন মানুষ এতো বুঝতোনা, আর কোম্পানিওয়ালারা খাঁটি জিনিস দিয়া দোকান খুলবে। তখন তোমাদের জিনিস চলবে?”
-“আর এত্তগুলা মানুষ যে বেকার হবে?”
“বেকার হবে ক্যান? ওরা নতুন কোম্পানির ওখানে কাজ করুক। জমিতে কাজ করুক। বাসা বাড়িতে কাজ করুক। লাগলে আমার আড়তে কাজ দিমু। কাজের অভাব? খালি ফাউল কথা।”
শরীর জ্বলে যায় আমার। চোখ মুখে কেউ যেন আগুন ছিটিয়ে দিচ্ছে। হাফিজ কাজী আর সুফিয়ার বাপের কণ্ঠ যেন এক, নকল, পানের পিকের মতন ছিটিয়ে দেয় ফাঁকা ন্যায়ের বুলি ।
আসেপাশে খবর নেই, কোম্পানিওয়ালারা মোটা অংকের টাকা দিয়ে দোকান খুলবে। সুফিয়ার বাপ চেয়ারম্যানের সাথে একাট্টা, আর আমার উপর তো তার বাড়তি ক্ষোভ আছে। হিসাব মিলাই, এই অরিজিনাল কোম্পানির ধান্দাতেই আমাকে আটকে দিতে চেয়েছিলো সুফিয়ার বাপ। সুফিয়ার সাথে বিয়ের আশা নেই, প্রেমই কী আর আছে? সে আমাকে খোঁজেনা, আমিও কেমন হারিয়ে যাচ্ছি।
শহরের অরিজিনাল কোম্পানি বড়বাজারে আমার একটা দোকান পরে ব্যবসা খুলবে। দোকান সাজানোর কাজ শুরু করেছে। আমার দোকানে শখের জিনিস তৈরির খেটে খাওয়া মানুষেরা ভিড় করে।
“আমাদের জিনিস দুই নম্বরি কেমনে হয়?”, “ভেজাল তো মেশাইনা”, “বাপ দাদার আমল থেকে এই জিনিস বানাই” “টাকা থাকলে তো রেজিস্ট্রেশন করে কোম্পানিই খুলে বসতাম।” “ওদের জিনিসের সাথে আমাদের জিনিসের পার্থক্য কী? খালি চকচকা কৌটায় জিনিস ভরলেই অরিজিনাল হয়, এহ।”
আমি শুনি। চুপ করে শুনি। কখনো ওদের সাথে নীরবে সহমত প্রকাশ করি, মাথা নাড়িয়ে। তহুর চাচা, দুই একজন মুরুব্বি আর আমাকে ডেকে চেয়ারম্যানের সাগরেদ হাফিজ কাজী দু’দিন আগে জানিয়ে দিয়েছে, “দোকান বন্ধ করো মিয়া। চেয়ারম্যান স্যারের হুকুম।” তহুর চাচা কে সাথে নিয়ে কয়েক বার চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করতে যাই আমরা, দেখা পাইনা। ফিরিয়ে দেয়, বুঝি, লাভ নেই।
প্রতিবাদের অসহায় মৃদুভাষা, ধূলোকণার মতন হাওয়ায় ভাসে, মিলিয়ে যায়। বড়বাজারে, মেরি এন্ড কোং নামের অরিজিনাল দোকান বসে আসর জমিয়ে। গোলাপি রঙের গন্ধ আর আভা, ও অঞ্চলের মানুষ আর দেখেনি কোনদিন। দোকানে জিনিসগুলোকে কসমেটিকস বলে ডাকে। অঞ্চলের মানুষ তাদের মতন করে বলে ‘কসমস্ট’। আমি সিরাজগঞ্জ থেকে গামছা, গজ কাপড় এনে বিক্রি করি অল্প করে। তাতে আমার মন নেই। এই কাজ আমি শিখিনি, বুঝিনি। আমার সবটুকু জুড়ে শখের জিনিস। তা হারিয়ে, আমার বুক হুহু করে, সুফিয়াকে দেখতে না পাওয়ার তীব্র কষ্টের চেয়েও খানিকটা তীক্ষ্ণ সে কষ্ট।
হাফিজ কাজী মুখে বলেছিলো কারো কাজের কমতি হবেনা। সবাই জানতো সে কথার কথা শুধু। তার বাকি কথার মতন ধোঁয়া, মিথ্যা। প্রায় সন্ধ্যায় শখের জিনিসের লোকজন আমার বাড়ির উঠানে এসে বসে। দোকানের সেই চায়ের কেতলি, এখন আমার উনুনে টগবগ করে। দোকানের সেই ছেলে চা বানিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাসে করে সবাইকে দেয়। সেই চায়ের চুমুকে আলাপ জমে আমাদের, ক্ষোভ, কষ্ট। একদিন তহুর চাচা বলে, “ধুর মিয়া, তোমরা এখনো জোয়ান, কিন্তু মনে বল নাই। দোকান বন্ধ রাখতে বলসে। ব্যবসা করা যাবেনা সেটা কী বলছে?”
“কী করা যায়?” গুনগুন আশা জাগে চারদিকে।
ঠিক হয়, চকবাজার থেকে সব কাঁচামাল, উপকরণ, আমার বাড়ি আসবে। সেখান থেকে আগের মতন যার যা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে যাবে।
কেউ কেউ ভয় পায়, “বাড়ি বাড়ি যেয়ে কিংবা হাটে যেয়ে আগের মতন বিক্রি করলে চেয়ারম্যান যদি ঝামেলা করে?”
“আমরাই তাইলে হাট বানাই।”
আশা গাঢ় হয়, “ক্যামনে ক্যামনে?”
“ইছামতির পাশে।”
ঠিক হয় ইছামতি নদীর ধরে, সপ্তাহে একদিন শখের জিনিসের ব্যবসায়ী গাউসুল মিয়ার ছোট্ট জমিতে আমরা বসবো জিনিসপাতি নিয়ে। গ্রামের মানুষজন সেখান থেকেই কিনবে। আমরা তো আর নিয়ম ভাংছিনা, দেখি কে ঠেকায়। দেশে কি আইন কানুন নাই নাকি।
প্রশ্ন ওঠে, “হাটের নাম কী হবে? শখের জিনিসের হাট?”
নাহ সবার পছন্দ হয়না নাম। “নতুন কিছু ভাবো, শালাদের দেখায় দিতে হবে।”
আমার সুফিয়ার কথা মনে পড়ে। শেষ দেখা হবার দিনে ওই যে তীক্ষ্ণ শব্দে আমাকে আঘাত করেছিলো, যা আমি আগে কখনো শুনিনি।
আমি বলেছিলাম, “আমি দুই নম্বরি না।”
ও বলেছিলো, ” হ, তুমি হইলা দেড় নম্বরি। এক নম্বরি তো তুমি না, মুরোদ নাই। তাইলে তুমি দেড় নম্বরি।”
এতদিন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া শব্দেরা, আজ কেমন আদরে আরামে শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সুফিয়ার ছুড়ে দেয়া কষ্ট, তবে অস্ত্র হোক।
সবার বড্ড পছন্দ হলো সে নাম। দেখনেওয়ালা এক নাম বটে। ঠিকই তো আমরা এক নম্বরি না সত্য। কারণ আমাদের ক্ষমতা নাই, ওতো টাকা নাই। কিন্তু দুই নম্বরি তো কক্ষনো না। ভেজাল জিনিস তো বেচি না। তবে দেড় নম্বরিই সই।
ঠিক হলো, হাটের নাম হবে দেড় নম্বরির হাট।
ইছামতি নদীর ধারে সেই ছোট্ট টুকরো জমিতে প্রতি শুক্রবার আমাদের হাট বসে। লাল চকচকে ছিট কাপড়ে সাদা কালিতে ‘দেড় নম্বরির হাট’ লিখে কে এক ব্যানার বানিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে গাছের ডালে। বাতাসে পতপত করে উড়ে লাল কাপড়, আর আমরা এক কোণে বসে শখের জিনিস বিক্রি করি। আমি বড়বাজারের দোকানে তালা দিয়েছি। গামছা আর বিক্রি করিনা। ভালো লাগেনা। একদিনের হাটে যে খুব বিক্রি হয় তা তো না। তবে মনে শান্তি। আর আমার জন্য এ হাট বোধহয় প্রিয়জনের ক্রোধ, রাগ অবহেলার বিপরীতে এক টুকরো প্রতিবাদ। সুফিয়ার কথা মনে হয়। আমার দোকানের ছেলেটা মাঝে মাঝে সুফিয়াকে দেখে এখানে সেখানে।
“ভাইজান সুফিয়া আপা নখে সবসময় আপনার বানানো ওই সবুজ কালার নখপলিশ লাগায়। আমি দেখসি।”
সুফিয়ার সাথে আমার দেখা হয়না কতদিন। ও হাটে আসেনা। আমি ওর বাড়ির কাছে যাইনা। কেমন ইচ্ছে করে না দেখবার রাস্তাগুলো ধরে আমরা প্রতিদিনের পথ চলি।
সুফিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে, আমি সবুজ নেইলপলিশ বানানো শুরু করি। সোনালী রঙের নেইলপলিশের বোতলে সবুজ নেইলপলিশ। আসেপাশের গ্রাম ভেঙে মেয়েরা তা কেনে। অল্প টাকায়, এমন নায়িকাদের নখের রঙের মতন রং হয়, তারা বিশ্বাস করতে পারেনা। তারা বলে টিয়া নখপালিশ। হাতের আসে পাশে টুকটুক করে কেউ কেউ ঘুরে, বুঝি হাতে টাকা নেই। সবুজ নেইল পলিশের বোতল নিয়ে নাড়াচাড়া করে ফেরত যায়। মাজে মাঝে দুই একজনকে এমনি এমনি দিয়ে দেই। তাদের চোখের খুশির রং ঝলকে ওঠে, টিয়া রঙের নেইলপলিশের চেয়ে সেও রং অনেক উজ্জ্বল, দেখতে ভালো লাগে।
একা রাতে মনে মনে বলি, “সুফিয়া, তোমার নখের সবুজ রং, কেমন চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছি। এ রং তোমার একার আর না। তবু তোমার রাগ হয়না, হিংসা? তবু তুমি সামনে এসে দাঁড়াও না! লড়াই করোনা!”
গুনগুন শুনি অরিজিনাল কোম্পানি মেরি এন্ড কোং এর দোকানের কোল্ড ক্রিম মুখে দিয়ে জব্বর মিয়ার বাড়ির সকলের মুখ লাল হয়ে গেছে। মুখের চামড়া নাকি জ্বলে একাকাকার। জব্বর মিয়া প্রভাবশালী মানুষ। অনেক জমিজমা আর ক্ষমতা। মেরি কোম্পানির উপর খেপে ওঠে। খেপে ওঠে প্রাইমারি স্কুলের টিচার আপা ও। মেরি কোম্পানির জলপাই তেল মেখে চুল নাকি পড়ে যাচ্ছে। গ্রামে গুনগুন ওঠে, “শখের জিনিসয়ালারা তো বাড়িতে তৈরী নারকেল তেল দিয়ে মাথা ঠান্ডার তেল বানায়। কোনদিন তো চুল পড়েনি।” , আমরা শুনি, মানুষ বলে, “এতো তেল না কেরোসিন কেরোসিন।”, “মেরি কোম্পানি ডাকাত, এতো দাম জিনিসের!”
তহুর চাচা আমার উঠোনে বসে শলাপরামর্শ করে।
“শোন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। দেখো কতদিন ব্যবসা করতে পারে এরা। কোম্পানির নাম করে তো নকল জিনিস বিক্রি করে। আমাদের মতন দিল দিয়ে জিনিস বানায় না। আমাদের ছাড়া পারবে নাকি?”
অতি আগ্রহীরা বলে, “তহুর চাচা, ওদের লগে একদিন একটু বাহাস করে আসি। আমাদের ব্যবসা খাইতে বসছে।”
তহুর চাচা বিচক্ষণ মানুষ। “কইরোনা বাহাস, পরে এসে দেখব আমাদের হাটে এসে ঝামেলা করবে। থাকতে দাও ওদেরকে, ওদের মতন। “
হাফিজ কাজীর ডান হাত বশির মিয়া একদিন আমাকে খুঁজতে আসে।
“ভাই মাথার ব্যথা কমানোর বাম বানাইতা যে আসে নাকি দুই কৌটা?”
ভারী মজা পাই। “কেন বশির মিয়া বড়বাজারের কোম্পানি দোকান খুলে বসছে, ওদের কাছে যাও।”
“আর কইয়োনা ভাই, সর্বনাশ হইসে। তোমার বানানো বাম তো দিতাম ভাবীজানরে। তার মাইগ্রেনের সমস্যা। এখন কাজী ভাইজান তোমার লগে ঝামেলা করায় মেরি কোম্পানির বাম আইন্যা দিলাম। কাজ হয়না। বাড়িতে ঝগড়া শুরু হয়ে গেসে।”
“আমার কাছে বাম বানানো নাই রে ভাই।”
সত্যিই ছিলোনা। কিন্তু বশির মিয়াকে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথা অনুযায়ী যত্ন করে পিপারমেন্টওয়ালা বাম তৈরী করি, সাথে মাথা ঠান্ডা রাখার সবুজ তেল আর একটা সবুজ নেইলপলিশ। ঝুড়ি করে হাফিজ কাজীর বাড়ি পাঠাই। কখনো চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে তহুর চাচার বাড়িতে লুকিয়ে লোক যায়, তহুর ম্যাজিক যেমন স্নোয়ের জন্য। এমনকি সুফিয়ার খালাতো বোন এসে লুকিয়ে সবুজ নেইলপলিশ কিনে নিয়ে যায়। দোকানের ছেলেটা খবর দেয়, “ভাইজান খবর নিসি, এই নখপালিশ সুফিয়া আপা কিনতে পাঠাইসে।”
আমি হাসি, আমরা সবাই এক হয়ে নীরবে হাসি। আমাদের বাড়ির উঠোনে গোপনে এসে এ অঞ্চলের বড় মানুষের সাথে থাকা ডান-বাম মানুষেরা শখের জিনিস কিনে নিয়ে যায়। এতো দিনের অভ্যাস এসব জিনিসে , ওই শহুরে আলুনি জিনিসে তাদের পোষাচ্ছেনা। চেনা নারকেল ভাঙা তেলের গন্ধ, মেথির গন্ধ, আতরের গন্ধ, কর্পূর আর পিপার্মেন্টের গন্ধ ছাড়া তাদের যে পোষায় না।
ওরা এসে অনুরোধ করে, “কাউকে বলোনা।”
আমরা কাউকে বলিনা। আমরা আসে পাশে নানা রঙের শখের জিনিস ছড়িয়ে দিতে থাকি।
আমরা অনুমান করি এরপর কী হবে। হয় ও ঠিক। এমন দিন দিন যেতে যেতে, অনেকদিন পর একদিন চেয়ারম্যান খবর পাঠায়। কাঠ কাঠ গলার ভাব ধরে বলে, ” মিয়া তুমি এই অঞ্চলের লোক, তোমরা বাপ দাদার আমল থেকে এই ব্যবসা করে খাও। তাই চিন্তা করলাম, তোমাদের আবার সুযোগ দেই।”
ঠিক মতন কাজ করতে হবে, নকল কাজ করা যাবেনা নানা কথা বলে। আমি আমরা মাথা নাড়ি। আমার নাক ভরে যায় মাথা ঠান্ডা করার সেই সবুজ তেলের গন্ধে, আমার হাতে বানানো, মেথি মাখা তেল। চেয়ারম্যানের জপজপে চুল থেকে ভুরভুর করে ভেসে আসে সেই পরিচিত ঘ্রাণ।
শখের জিনিসের ব্যবসায়ী আর ফেরিওয়ালাদের ফুরসৎ নেই। দোকান খোলা হবে আবার । আবার হাটে হাটে ঘরে ঘরে হাঁটবে তারা। কাঠের বাক্সগুলো মুছে রাখা হয়। দোকান ঝাড়পোঁছ করতে করতে দোকানের ছেলেটা সময় পায়না। বড়বাজারের পাশ দিয়ে সুফিয়া হেঁটে যায় আবার, মাঝে মাঝে। আমরা এখনও কথা বলিনি, কিন্তু আমরা দুইজন তাকাই দুজনের দিকে, সেই প্রথম প্রেমের মতন, আবার। গলে যাচ্ছে তাপ, ক্রোধ। সুফিয়ার নখে মাখা সবুজ নেইলপলিশের দিকে তাকিয়ে আমি হাসি। ও হাসে, পেছন ফিরে, আমি দেখতে পাইনা, কিন্তু ঠিক আমি বুঝতে পারি।
রাতে বসে বসে সোনালী কৌটায় সবুজ নেইলপলিশ ভরি। ছোট বোন বলে, “ভাই এবার নখ পলিশের একট নাম দাও।” আমি লাল স্টিকার লাগিয়ে তার উপর লিখে দেয় সুফিয়া’স।
দোকানের কোনো নাম ছিলোনা। এবার নাম হবে। সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। সেখানে জ্বলজ্বল করে লেখা আছে দোকানের নাম – অরিজিনাল দেড় নম্বরি।