
‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ’-এর জন্ম ১৯১১ সালে শিয়ালকোটের এক স্বচ্ছল জমিদার পরিবারে।সুলতা্ন মুহম্মদ খান(তখনকার প্রতিষ্ঠিত আইনজ্ঞ)আর সুলতান ফাতেমা’র সন্তান ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ মাত্র দু’বছর বয়সে পিতাকে হারান।পিতা সুলতান মুহম্মদ পাকিস্তানের ‘এলিট’ সমাজে সক্রিয় ছিলেন।পাকিস্তানের জাতীয় কবি আলাম্মা ইকবাল ছিলেন পারিবারিক বন্ধু।‘ফয়েজ’ ১৯১৬ সালে ‘মৌলভি ইব্রাহিম শিয়ালকোটি’ এবং ‘স্কচ মিশন হাইস্কুল’-এ উর্দু,ফার্সি এবং আরবী ভাষায় পড়াশোনা করেন।লাহোরের সরকারি কলেজ থেকে উর্দু ভাষা এবং ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে অমৃতসর এবং লাহোরের কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।
ফয়েজ শিক্ষক ছিলেন ঠিকই,তবে জীবনের পাঠাশালায় আমৃত্যু একজন অনিসন্ধিৎসু ছাত্রও ছিলেন।ছাত্রাবস্থাতেই ধীরে ধীরে বামপন্থী দর্শনে আকৃষ্ট হতে থাকা ‘ফয়েজ’ ছিলেন আদ্যন্ত রোমান্টিক একজন মানুষ।প্রেম আর বিপ্লবকে সাহিত্য’র পরিসরে একসঙ্গে বইবার ক্ষমতা তাঁর সহজাত ছিল।পড়া যাক ‘ফয়েজে’-এর কিছু রোম্যান্টিক পংক্তিঃ
১.
কর রহা হ্যায় ঘম-এ-জাহাঁ কা হিসাব
আজ তুম ইয়াদ বে-হিসাব আয়ে
সারা দুনিয়ার কষ্টের হিসেব করছিলাম আজ বে-হিসাব মনে পড়ল তোমায়
২.
জানতা হ্যায় কি উও আয়েঙ্গে
ফির ভি মশরুফ-এ-ইন্তিজার হ্যায় দিল
জানি ও আসবে না
তবুও অপেক্ষায় ব্যস্ত এ হৃদয়
৩.
আউর কেয়া দেখনে কো বাকি হ্যায়
আপ সে দিল লাগা কে দেখ লিয়া
আর কী দেখার বাকি আছে
তোমায় এ হৃদয় দিয়ে দেখলাম তো!
৪.
দোনো জাহাঁ তেরি মহব্বত মে হার কে
উও যা রহা হ্যায় সব-এ-ঘম গুজারকে
আকাশপাতাল তোমার প্রেমে বিসর্জন দিয়ে
সে চলে যাচ্ছে এক কষ্টের রাত পেরিয়ে
৫.
তুমহারি ইয়াদ কে যব জখম ভরনে লাগতে হ্যায়
কিসি বহানে তুমহে ইয়াদ করনে লগতে হ্যায়
তোমার স্মৃতিল ক্ষত সেরে ওঠার সময়েই
কোন না কোন বাহানায় তোমা্কেই মনে করতে থাকি
৬.
উও বাত সারে ফসানে মে জিস কা জিক্র না থা
উও বাত উন কো না-গওর গুজরি হ্যায়
যে কথা গল্পতেই ছিল না কখনোই
সেই কথাটাই তার অপছন্দে রয়ে গেল
৭.
আয়ে তো ইয়ুঁ কি জ্যায়সে হমেশা থে মেহেরবান
ভুলে তো ইয়ুঁ কি গোয়া কভি আশনা না থা
আসতে যখন, মনে হত তুমি কতই না ভালবাসছ
আর ভুললে এমন ভাবে যে, মনে হল যে কোনোদিন ভালবাসাই ছিল না আমাদের
৮.
গুলোঁ মে রংগ ভরে বাদ-এ-নও-বাহার চলে
চলে ভি আও কি গুলশন কা কারোবার চলে
ফুলে ফুলে রঙ, বয়ে যাচ্ছে নতুন বসন্তের বাতাস
এবার চলেই এসো যাতে বাগান বাগিচা হতে পারে
৯.
না জানে কিস কে লিয়ে উম্মিদ-ভর বয়ঠে হ্যায় হম
এক এইসি রাহ পে যো তেরি রাহগুজর ভি নহিঁ
জানি না কার জন্য আশায় বসে আছি
তাও এমন একটি রাস্তায় যা তোমার রাস্তাই ছিল না
১০.
আপকি ইয়াদ আতি রহি রাত ভর
চাঁদনি দিল দুখাতি রহি ভর
সারারাত তোমার কথা ভেবেছি
সারাটা রাত চন্দ্রালোক,সয়েছি
১১.
ও আ রহে হ্যাঁয় ও আতে রহেঁ হ্যাঁয় আ রহে হোঙ্গে
শব-এ-ফিরাক ইয়ে কহ কর গুজার দি হমনে
ও আসছে ও আসবে ও এসে পড়ল বলে
বিচ্ছেদের রাত এভাবেই কেটে গেল আমার
১২.
উঠ কর তো আ গয়ে হ্যাঁয় তেরি বজম সে মগর
কুছ দিল হি জানতা হ্যায় কি কিস দিল সে আয়ে হ্যায়
তোমার সভা থেকে উঠে এলাম তো ঠিকই
শুধু হৃদয়ই জানে যে কী এক হৃদয় নিয়ে ফিরে এসেছি
অনুবাদ করেছি, ভাবানুবাদই বলা যাক, আমার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে। তবুও ‘ফয়েজ’-এর আপাত সরল উচ্চারণের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন মেধাবী রোমান্টিক কবিকে চিনে নিতে কোনও সমস্যা হয় না।ব্যক্তিগত স্তরে আমার এটাই মনে হয় যে রোমান্টিক নয়,যার মধ্যে পাগলামি নেই,সে কবিতা লিখতে পারবে না।কবিতা কল্পনার অনুসারী।কেঠো যুক্তি,হিসেবি চাল,অনুকরণের আলসেমি কবিতার শত্রু।পাণ্ডিত্যও কবিতাকে বাধা দেয়,’ফয়েজ’ পণ্ডিত মানুষ ছিলেন আবার কবিও!এই বিস্ময়ের ধাক্কাটা নিয়েই এগোন যাক ফয়েজের জীবন ও কবিতা নিয়ে।
‘গজল’ চোদ্দশ শতকের কবিতাঙ্গিক।রুমি আর হাফেজ বাহিত হয়ে,গ্বালিবে পরিস্রুত হয়ে বিংশ শতাব্দীর মুক্ত-আঙ্গিকে’র আবহে ফয়েজের কলমে হয়ে উঠেছিল তীব্র,প্রতিবাদে সংহত,সুরা আর সাকি বিযুক্ত এবং ঈশ্বরভাবনা তথা অলৌকিক-চেতনা থেকে প্রায় মুক্ত অনন্য সৃষ্টি্র সমাহার!তবে সাবেকি গজলাঙ্গিকের বাইরে গিয়ে ‘ফয়েজ’ ‘নজম’-এর পরিসরেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন।‘গজল’ হল ন্যূনতম পাঁচটি পংক্তির ‘দ্বিপদী’ বা ‘শের’-এর উপস্থাপনায় রচিত কবিতা যেখানে ‘দ্বিপদী’ গুলো বিভিন্নার্থেই প্রয়োগ করা যেতে পারে।গজলের প্রথম ‘দ্বিপদী’কে বলা হয় ‘মাতলা’ আর শেষেরটিকে ‘মাক্তা’ এবং প্রতিটি পংক্তি হল ‘মিশ্রা’।তবে সাধারণভাবে প্রথম দুটি অভিধা কবি বা ‘শায়র’ ছদ্মনাম বা ‘তখল্লুস’ ব্যবহার করলেই প্রযোজ্য হবে।।‘নজম’ একটিই ‘থিম’কে কেন্দ্র করে রচিত হয়।‘নজম’-এর পরিসর অনেকতাই বিস্তৃত,বলা যেতে পারে ‘অল ইনক্লুসিভ’।সাধারন মানুষের জীবন এবং সমাজের যাবতীয় এই পরিসরে লেখা হয়।উর্দু সাহিত্যে ‘নজম’-এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম।উর্দু ভাষার প্রায় সব আধুনিক ‘শায়র’ই ‘নজম’-এর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
‘ফয়েজ’ ১৯৪১ সালে এই ‘নজম’-এর মাধ্যমেই তাঁর সমাজ সচেতন সত্ত্বাটিকে প্রকাশ করেছিলেন এই ভাবেঃ
‘বোল কি লব আজাদ হ্যায় তেরা বোল জবাঁ অব তক তেরি হ্যায় তেরা সুতওয়াঁ জিস্ম হ্যায় তেরা বোল কি জাঁ অব তক তেরি হ্যায়’ ‘কথা বলো,তোমার শব্দরা স্বাধীন এখন বলো,এখনো ভাষা তোমারই আছে এখনো তোমারই আছে অমলিন তোমার শরীর বলো,এখনো জীবন আছে হে তোমার’
আমৃত্যু লড়াকু ফয়েজের কলম শত অত্যাচারেও স্তব্ধ হয়নি।বরং কারারুদ্ধ অবস্থায় তিনি তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ‘গজল’ আর ‘নজম’ রচনা করেছিলেন যা পরে তাঁর কাব্যগ্রন্থে সঙ্কলিত হয়।পড়া যাক ‘ফয়েজ’-এর কিছু অসামান্য পংক্তিঃ প্রথম নজমটি’র চতুর্থ পংক্তি পড়তে গিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত’র কথা মনে পড়তে পারে।সুভাষ ‘ফয়েজ’-এর চেয়ে আট বছরের ছোট ছিলেন আর ‘ফয়েজ’ ছিলেন তখনকার প্রগতিশীল বামপন্থী কবিদের কাছে ‘আইকনিক ফিগার’। দুজনের মধ্যে পরিচিতিও ছিল, তাই হয়ত এই সাযুজ্য। তবে, আমরা অসাধারণ দুটো কবিতা পেয়েছি, পাঠক হিসেবে এটাই আমাদের লাভ, তাইনা? যাইহোক, এবার একটু অন্য মেজাজের ‘ফয়েজ’ পড়া যাকঃ
‘আ গঈ ফস্ল-এ-সকুঁ চাক গরেবা বালোঁ সিল গয়ে হ্যায় হোঁট,কোই জখম সিলে ইয়া না সিলে দোস্তোঁ বজম সাজাও কে বাহার আঈ হ্যায় খিল গয়ে জখম কোই ফুল খিলে ইয়া না খিলে..’ ....... ভাবানুবাদঃ ......... ‘এসেছে শান্তির দি্ন বিষন্ন বন্ধুরা সেলাই আটকেছে ঠোঁট, ক্ষত আছে যেমন তেমন মিছিল সাজাও বন্ধুরা, বসন্ত এসেছে ফুল ফুটুক না ফুটুক, আঘাত ফুটে আছে..’ 'ফয়েজ’ কে পাকিস্তান সরকার দু বার কারারুদ্ধ করে।অদম্য ফয়েজ কারান্তরালে বসেই লিখেছিলেন এমন অসামান্য পংক্তিঃ "ও যব ভি করতে হ্যায় তুক্ত-ও-লব কি বখিয়াগরি ফজা মে ঔর ভি নঘমে বিখরনে লগতে হ্যায়’’ দবে-এ-কফস পে অন্ধেরে কি মুহর লগতি হ্যায় তো ফয়েজ দিল মে সিতারে উতরনে লগতি হ্যায়"। .......... ভাবানুবাদঃ …….. "সে না বলা কথাগুলো যখন বলে ওঠে চারপাশে ঝরে পড়ে অজস্র সুর ও সংগীত আর কারাগারের দরজায় যখন ছায়া নামে সন্ধ্যার ফয়েজের হৃদয় জুড়ে জন্ম নেয় অজস্র তারার প্রতিভা!"
এবার অনেকটা সময় পেরিয়ে ১৯৮৫’র লাহোরে যাওয়া যাক।এক বছর আগেই ‘ফয়েজ’ প্রয়াত হয়েছেন।পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক জিয়াউল হক মহিলাদের পরিধান হিসেবে শাড়ি নিষিদ্ধ করে এক স্বৈরতান্ত্রিক ফরমান জারি করেন।লাহোর স্টেডিয়ামে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাকিস্তানি মহিলা শাড়ি পরেই প্রতিবাদ সমাবেশে শামিল হন।পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়িকা ‘ইকবাল বানু’প্রতিবাদের কালো শাড়ি পরে একটি ‘নজম’ গেয়েছিলেন।‘নজমটি’র স্রষ্টা ছিলেন ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ’।সদ্য মৃত ‘ফয়েজ’ তখন ‘ইকবাল’ পরবর্তী পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘শায়র’ বা কবি।ভুল হল, শুধু পাকিস্তানের নন,এই উপমহাদেশের উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘শায়র’ ছিলেন ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ’।তবে শুধুমাত্র কবিতাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না,তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বামপন্থী সাহিত্যধারার অন্যতম প্রবক্তা।১৯১৩ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত একাত্তর বছরের জীবনে ‘ফয়েজ’কে বহুবার কারারুদ্ধ করেছে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা। ‘ফয়েজ’ শিরদাঁড়া সোজা রেখে সৃষ্টি এবং প্রতিবাদ চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু।যে ‘নজম’টি মহিলাদের প্রতিবাদ সভায় ‘ইকবাল বানু’গেয়েছিলেন এবার পড়া যেতেই পারেঃ
হম দেখেঙ্গে .... লাজমি হ্যায় কি হম ভি দেখেঙ্গে উও দিন কি জিস কা ওয়াদা হ্যায় জো লহু-এ-অজল মে লিখখা হ্যায় যো জুল্ম সিতমকে কোহ-এ-গিরাঁ রুই কি তরহ উড় যায়েংগে হম মাহকুমোঁ কে পাঁও তলে যব ধরতি ধড়-ধড় ধড়কেগি আউর অহল-এ-হকম কে সর উপর যব বিজলি কড়-কড় কড়কেগি যব অর্জ-এ-খুদা’কে কাবে সে সব বুত উঠায়ে যায়েঙ্গে হম আহল-এ-সফা মরদুদ-এ-হরম মসনদ পে বিঠায়ে যায়েঙ্গে সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে সব তখত গিরায়ে যায়েঙ্গে বস নাম রহেগা আল্লহ কা যো গায়েব ভি হ্যায় হাজির ভি যো মঞ্জর ভি হ্যায় নাজির ভি উঠঠেগা অনল-হক কা নারা যো ম্যায় ভি হুঁ আউর তুম ভি হো আউর রাজ করেগি খল্ক-এ-খুদা যো হম ভি হ্যায় আউর তুম ভি হো। .. ভাবানুবাদ ..... আমরা দেখবো,আমরা নিশ্চয়ই দেখে নেবো সেই প্রতিশ্রুত দিনটিকে যা ঈশ্বরের খাতায় লিখে এসেছি অন্যায় অবিচারের পাহাড়গুলো তুলোর মতনই উড়ে যাবে একদিন শাসিত আমাদের পায়ের নিচে যখন দুনিয়া থর-থর কেঁপে উঠবে আর বিচারকদের মাথার উপর কড়-কড় বিদ্যুৎ নেচে উঠবে যখন খোদার আবাস কাবা থেকে সব মহিলা-মূর্তি ওপাড়ানো হবে পবিত্র আমরা,আল্লাহর বিচারে দোষীও আমরা সেই আমরাই বসবো মসনদে এবার সব মুকুট নামিয়ে আর মসনদ গুঁড়ো করে আমরাই বসবো তখতে শোনো শুধু নাম থাকবে ‘আল্লাহ-পাক’-এর যিনি দৃশ্য এবং অদৃশ্যও যিনি দৃষ্ট আবার দ্রষ্টাও আমিই আল্লাহ আমিই সত্য হাজার কন্ঠে বলে উঠবো সবাই যা আমি যা তুমি যা আমরা সকলে আল্লাহ’র সৃষ্টি এই আমাদের বলে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে আম-জনতা যা আমি যা তুমি যা আমরা সবাই আমরা দেখবো আমরা নিশ্চয়ই দেখে নেবো
এই ‘নজম’টি বুঝতে না পেরে ভারতেও তথাকথিত হিন্দুওয়ালারা কানপুর আই আই টি’র ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ তুলে বিপুল হাঙ্গামা করেছিল।তাদের আপত্তি’র কারণ ছিল এই পংক্তিগুলোঃ
‘সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে সব তখত গিরায়ে যায়েঙ্গে বস নাম রহেগা আল্লহ কা যো গায়েব ভি হ্যায় হাজির ভি’
যা হয়,‘বস নাম রহেগা আল্লাহকা’ এই বাক্যেই এদের নির্বোধ মানসিকতা আটকে গিয়েছিল।পরের লাইনগুলোয় যে ইসলামে বর্ণিত ‘আল্লাহ’কেই অস্বীকার করা হয়েছে এই নান্দনিক শিক্ষা এদের ছিল না।হয়ত এদের মধ্য থাকা সাহিত্যপ্রেমী বা সরকারের আমলা স্তরের কেউ এদের বোঝায় যে ‘ফয়েজ’ কোনও মৌলবাদী কবি নয়।উর্দু সাহিত্যের বিশ্ববরেণ্য কবি।প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী পাকিস্তনে সরকারি সফরে গিয়ে ‘ফয়েজ’-এর মুখে একটি প্রিয় কবিতা শোনার জন্য সব প্রোটোকল ভেঙে ‘ফয়েজ’-এর বাসায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।
‘ফয়েজ’ ১৯৩৬ সালে সাজ্জাদ জাহিরের সংস্পর্শে এসে ‘প্রগতিশীল লেখক সংঘ’-এ যোগ দেন।এই সংগঠেনের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।‘প্রগতিশীল লেখক সংঘ’হয়ে উঠেছিল বামমনস্ক সাহিত্যিকদের প্রতিনিধিস্থানীয় সংগঠন।স্বাধীনতার লড়াই এবং মার্ক্সবাদী পথে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী ছিলেন অধিকাংশ সদস্য।সাজ্জাদ জাহির,মজাজ,মুলক রাজ আনন্দ,প্রেমচন্দ,ক্যায়ফি আজমি,ফিরাখ গোরখপুরি,প্রমোদ রঞ্জন সেনগুপ্ত,হীরেন মুখার্জি,অমর নাথ ঝাঁ,কিষণ চন্দর,ইসমত চুগতাই,মজরুহ সুলতানপুরি,রাজিন্দর সিং বেদী,সাহির লুধিয়ানভি সহ সারা ভারতবর্ষের প্রতিভাবান কবি,সাহিত্যিক এই আন্দোলনে যোগ দেন।
‘ফয়েজ’প্রচলিত উর্দু ঘরাণার প্রেম,ভালবাসা,সুরা,সাকি,নিঃসঙ্গতাকে কেন্দ্র করেই তাঁর প্রাথমিক লেখালিখি শুরু করেন।প্রেমে পড়েই বিয়ে করেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা অ্যালিসকে।যাইহোক সাম্যবাদী আন্দোলনের পুরোধা রোমান্টিক ‘ফয়েজ’-এর রচনার অভিমুখ ব্যক্তি থেকে সমাজের দিকে ঘুরে যায় অচিরেই।বৈপ্লবীক চেতনা ‘ফয়েজ’-এর লেখায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে।তিনি সাধারণ মানুষের সুখ,দুঃখ,আনন্দ,যন্ত্রণাকে নান্দনিক কিন্তু সহজ শৈলীতে লিখতে শুরু করেন।যা উর্দু সাহিত্যে একেবারেই নতুন ছিল।
‘ফয়েজ’-এর একটি বিখ্যাত ‘নজম’-এর অংশ পড়া যাকঃ
‘লৌট যাতি হ্যায় উধর কো ভি নজর কেয়া কীজে অব ভি দিলকশ হ্যায় তেরা হুস্ন মগর কেয়া কীজে? ঔর ভি দুখ হ্যায় জমানে মে মুহব্বত কে সিওয়া রাহতে ঔর ভি হ্যায় হুস্ন কি রাহত কে সিওয়া মুঝসে পহেলি সে মুহব্বত মেরে মেহেবুব না মাঁগ!’ ... ভাবানুবাদ ..... ‘চলে যাচ্ছে দু চোখ অন্যদিকে কী করবো বলো এখনও তুমি কি মোহময়ী, কী করবো বলো ভালোবাসা জানি দুঃখদায়িনী, এই দুঃখ ছাড়া আরো কিছু আছে, কষ্টবিনাশি মুখের তফাতে রয়েছে অনেক স্বঃস্তি অনেক অস্তি যাতে লেগে আছে দুঃখী মানুষের মুখ সময়ধারায় পুরনো সে প্রেম, প্রিয়তমা আর চেওনা ফিরে’
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে পাকিস্তানের প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা হন ‘ফয়েজ’,প্রগতিশীল লেখক সংঘ এবং পাকিস্তানি কমিউনিস্টদের পত্রিকা ‘পাকিস্তান টাইমস’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন।রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের (রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা) অভিযোগে ১৯৫১ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।চার বছর জেলে থাকেন।এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি’র উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়।চরম দমন পীড়নের মুখে সংগঠন ভেঙে পড়ে।বামমনস্কদের অনেকেই ব্যক্তিগত লেখালিখি বা জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পার্টি’র আড়াল নিয়ে কাজ করতে থাকেন।১৯৫৫ সালে ‘ফয়েজ’ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে চলে যান দেশ ছেড়ে।ফেরেন ১৯৫৮,আবার গ্রেপ্তার হন কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচার করার অভিযোগে।জুলফিকার আলি ভুট্টো তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের উপর খাটিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন।ভুট্টো আইয়ুব খানকে বুঝিয়ে ১৯৬৫ সালে ‘ফয়েজ’কে তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রী করেন পাকিস্তানের।‘ফয়েজ’ ১৯৭২-এ আরেক দফা সংস্কৃতি এবং শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেন ভুট্টোর জমানায়।১৯৭১ ‘ফয়েজ’ বাংলাদেশে পাকি-সেনাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেকে বিপন্ন করেই জনমত তৈরি করেন পাকিস্তানের মাটিতে।১৯৭৪ তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি কর্মকান্ড থেকে সরিয়ে নেন এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সক্রিয় থাকেন আমৃত্যু।তবে ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে ফয়েজ আবার দেশান্তরী হন।মৃত্যুর দু’বছর আগে ১৯৮২ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন।নিগার পুরিস্কার,লেনিন শান্তি পুরস্কার এবং নিশান-এ-ইমতিয়াজ পুরস্কার তাঁকে বিভিন্ন সময়ে প্রদান করা হয়।‘ফয়েজ’ একাত্তর বছরের জীবনে ২৩’টি গ্রন্থ(কবিতা,গদ্য ইত্যাদি)রচনা করেছেন।অক্লান্ত যোদ্ধা,এই কবির নাদনিক সৃষ্টিতে এখনো আলোড়িত হয়ে চলেছে উর্দু-সাহিত্য’র রসগ্রাহক পাঠকরা।এবার ওঁর আরও কিছু লেখাংশ এবং একটি ‘গজল’-এর সম্পূর্ণ ভাবানুবাদ দিয়ে এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটিতে ইতি টানা যাকঃ
১.
মকাম ‘ফয়েজ’ কোই রাহ মে যাচা হি নহি
যো ক্যু-এ-ইয়ার সে নিকলে তো স্যু-এ-দার চলে
চলার পথে ‘ফয়েজ’-এর কোনও লক্ষ্য ছিল না
প্রিয়তমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল ফাঁসিকাঠের দিকে
২.
জিন্দেগি কেয়া কিসি মুফলিস কি কাবা হ্যায় জিস মে
হর ঘড়ি দর্দ কে পায়বন্দ লগে যাতে হ্যাঁয়
জীবন কী সবহারানো মানুষের শতচ্ছিন্ন পোষাক
যে সব সময়েই তাপ্পি মেরে চলতে হবে?
৩.
এক তর্জ-এ-তঘাফুল হ্যায় সো উন কো মুবারক
এক অর্জ-এ-তমান্না হ্যায় সো হম করতে রহেংগে
না জানার ভাণ তো আছেই, থাকুক ওর কাছে
আমার আছে জানানোর ইচ্ছে, আমি জানাতেই থাকবো
৪.
নহি নিগাহ মে মঞ্জিল তো জুস্তজু হি সহি
নহি ভিশাল ময়স্বর তো আরজু হি সহি
গন্তব্য চোখে পড়ছে না, খোঁজই চলুক
দেখা যখন সম্ভবই নয়, ইচ্ছেটা থাকুক
৫.
কব ঠহরেগা দর্দ অ্যায় দিল কব রাত বসর হোগি
শুনতে থে উও আয়েঙ্গে শুনতে থে সহর হোগি
কখন থামবে হৃদয়জনিত ব্যথারা কখন যে ফুরবে এই রাত
শুনেছিলাম সে আসবে,শুনেছিলাম ভোরও হবে
৬.
না গুল খিলে হ্যাঁয় না উন সে মিলে না ম্যায় পি হ্যায়
আজিব রং মে আব কে বাহার গুজরি হ্যায়
ফুল ফুটল না,সে এল না,আমি পানও করিনি
এক আজব রঙের বসন্ত কাটল এবার
.....
সর্বশেষে এই সম্পূর্ণ গজলটি’র ভাবানুবাদ রইলোঃ
দোনো জাহাঁ তেরি মহব্বত মে হারকে
ও যা রহা কোই শব-এ-ঘম গুজারকে
বিরান হ্যায় ময়কদা খুম-ও-সাগর ওদাস হ্যায়ঁ
তুম কেয়া গয়ে কি রুঠ গয়ে দিন বাহারকে
এক ফুর্সত-এ-গুনাহ মিলি উও ভি চারদিন
দেখেঁ হ্যায়ঁ হম ভি হৌশলে পরবরদিগারকে
দুনিয়া নে তেরে ইয়াদ সে বেগানা কর দিয়া
তুঝ সে ভি দিল-ফরেব হ্যায়ঁ ঘম রোজগারকে
ভুল সে মুস্কুরা দিয়ে থে ও আজ ফয়েজ
মত পুছ বলবলে দিল-এ-না-কর্দাকারকে
ভাবানুবাদঃ
.....
ইহ আর পরলোক তোমার প্রেমে খুইয়ে ফেলেছি
একটি বিরহাতুর রাত কাটিয়ে কেউ একজন বিদায় চাইছে
পানশালা এখন একলা পানপাত্রও নির্জন-নীল
এই যে তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে,বসন্তও গেল
পাপের অবসরে আছি,পেয়েছি দিন চারেক
আল্লাহ’র সাহসও আমার দেখা হয়ে গেল
এই দুনিয়া ভুলিয়ে দিচ্ছে তোমার যা কিছু স্মৃতি-কথা
বেঁচে থাকার দুঃখ তোমার চেয়েও বেশি প্রতারক
ভুল করেই আজ আমার জন্য ও হেসেছিল আবার ‘ফয়েজ’
আমার আশ্চর্য-খুশি আমি বলে বোঝাতে পারবো না
