
এক
মন্দিরের বারান্দায় সেই সকাল থেকে উচ্চগ্রামে একটার পর একটা গান বেজেই চলেছে। ভজন, কীর্তন থেকে শুরু করে হালের হিন্দি, কোনোটাই বাদ নেই এই গানের তালিকায়। ছেলেপুলের একটা বড় জটলা সব সময়েই লেগে থাকে মন্দিরে এই পাঁচ দিন। পূজায় বাড়ি ভরা ছেলেমেয়ে নাতি নাতনির আগমনের আরাম আরাম আবহ ছাড়িয়ে রণজয়ের কানে এই মাইকের আওয়াজ বড় তারস্বরে বাজে। কী সব সাউন্ড সিস্টেম আর কত কী যে লাগে এদের! পূজার সেই ধূপ-ধুনা-অঞ্জলির বড় আপন আপন দিনগুলো এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় কি? অন্তত রণজয় খুঁজে পান না তেমন সহজ পূজার দিনগুলো।
নাড়ুর ভাগ নিয়ে রীতিমতো হল্লা শুরু হয়ে গেছে টোটো আর টুবাইয়ের মধ্যে, তার ছেলে আর বড় মেয়ের ঘরের নাতি নাতনি দুটো। দুজনের দুই মুঠো ভরা নারকেল নাড়ু, তবু ওরা চেঁচামেচি করছে কেন রণজয় বুঝতে পারেন না। তিনি জানেন এদের থামাতে অপারগ তিনি, এখনই হল্লা করছে আবার একটু পরেই ঠিকঠাক মিলেমিশে যাবে। বছরে এক কী দুবার বাচ্চাগুলোর দেখা হয়, আর তখন ওরা এমনি শোরগোলে মেতে ওঠে। মহুল এসে টোটো আর টুবাইকে আলাদা করে দিয়ে কাচের বয়ামটা তুলে ঘরে নিয়ে গেল। নাতি নাতনিদের মধ্যে মহুল সবার বড়, মেয়েটা এই বয়সেই কেমন দায়িত্বটায়িত্ব বুঝে নিতে শিখে গিয়েছে। মুহূর্তেই শোরগোল থেমে গেল পিচ্চি দুটোর। বাড়ির অন্য বাচ্চারা একজনও আশেপাশে নেই, মন্দিরে বা অন্য কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেছে হয়ত। পায়ের তলায় সর্ষে লাগিয়ে ঘোরে একেকজন। আর ঘুরবেই না বা কেন, এই পূজার সময়টাতেই তারা সব শহরের খোলস ছেড়ে ফেলে নিজেদের স্বাধীনতার সবটুকু উপভোগ করতে পারে।
পূজার দিন ক’টা রণজয়ের কাছেও পরম আনন্দের। তিনি অঞ্জলি দিতেও যান না, বিকালে বাড়ির চারপাশে গড়ে ওঠা মেলায়ও তার কাজকর্ম তেমন নেই কিন্তু এই যে বাড়ি ভরা ছেলে মেয়ে নাতি নাতনির দল হইহুল্লোড় করে বেড়ায়, সেই আগেকার দিনের মতো একেকজনের পছন্দের খাবারে ভরে ওঠে এ বাড়ির খাবারের টেবিল, বিভিন্ন শহর থেকে আসা ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের হাতের রান্না পায়েশটা, চাটনিটা রীতিমতো আঙুল চেটেপুটে খায়, বিকালে মেলা থেকে আানা মুগের পাঁপড় কি রং দেয়া গুড়ের জিলাপি খেতে খেতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কথায় হেসে গড়াগড়ি খায় একজন আরেকজনের গায়ে- এই সব দেখতে দেখতে প্রাণ ভরে ওঠে তার। করবীও তার সমস্ত কাজ সামাল দিয়েও কেমন হাসিখুশি থাকেন এই কয়দিন। বছরের বাকি সময় এত বড় বাড়িটায় তারা বুড়োবুড়ি আর চিনুবালা ছাড়া আর থাকেই বা কে? ছেলেমেয়েরা বেড়াতে এলেও নিজেদের সুবিধামতো একেকজন আসে, ভাইবোনদের নিজেদের মধ্যে সারা বছর তেমন করে দেখাসাক্ষাত হয় না বললেই চলে। সারা বছরের এই পাঁচ ছয়দিন তাই এই পরিবারের সবার কাছেই পরম আরাধ্য। এবার বড় জামাই অবশ্য ছুটি পায়নি এখনো, একেবারে দশমীতে আসবে হয়ত।
পাঁপড় ভাজার সাথে দুই কাপ চা ট্রেতে করে করবী আসেন। মুড়মুড়ে পাঁপড় ভাজার সাথে র চায়ে এলাচের ঘ্রাণ দারুণ সঙ্গত দিচ্ছে। বারান্দার কোনার ইলেকট্রিক উনুনে বর্ণালি একের পর এক পাঁপড় ভেজে ডাই করে তুলছে। সেই ছোটবেলা থেকে তাদের বড় মেয়েটা রাঁধতে, খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসে। পূজা অথবা ছোটখাট আয়োজনের কুড়ি পঁচিশজনের অত অত মানুষের রান্নাও কেমন একা একা অনায়াসে তুলে ফেলত বর্ণালি। পর্ণা আর ঋতি রান্না অত ভালো না বাসলেও ঘরদোর গুছিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে রাখত সব সময়। রণজয় আর করবী এই বুড়ো বয়সের অখন্ড অবসরে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করেই কাটান অনেকটা সময়। তাদের মেয়েরা এখনো ছোটবেলার মতোই সহজ, আদুরে রয়ে গেছে। বরং রক্তিমের সাথে তেমন জানাশোনা হয়ে ওঠেনি তাদের, নিজেদের প্রথম সন্তান, একমাত্র ছেলে রক্তিমকে কেন যেন ঠিকঠাক বুঝেই উঠতে পারলেন না তারা কোনোদিন। এখনো রক্তিম কোথায় যেন একটু অচেনা, ওর বউ শিবানীও তাই। শুধু ওদের ছেলেমেয়ে দুটো দাদু-ঠাকমা আর পিসি, পিসতুতো ভাইবোন বলতে অজ্ঞান।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে করবীর চোখে পড়ে আজকের পত্রিকার শেষ পাতার দুই কলামের শিরোনামটা- ‘ষষ্ঠী পূজার রাতে বাগেরহাটের কদমভোগ গ্রামের দুর্গামন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর’। পেপারটা টেনে খবরটা নিঃশব্দে পড়েন তিনি। রণজয় আগেই পড়েছেন এই খবরটা। এখন প্রতি বছরই পূজার আগে থেকেই পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের পর্দায় এমন প্রতিমা ভাঙার খবর অনেকটা প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। প্রতিমা বানানোর শুরু থেকেই এই তান্ডব শুরু হয়। রণজয়ের বুড়ো হার্ট এসব খবর নিতে পারে না, তিনি মনে মনে এদেশে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। করবী পত্রিকা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলেন- পড়েছ খবরটা? এই নিয়ে এ বছর কটা মন্দিরে হামলা হলো বলো তো!
অত হিসাব মনে রাখেন না রণজয়, তার বুড়ো হৃৎপিন্ডে দম থাকে না এত। বহু বছর থেকে ডাক্তার চাপ নিতে নিষেধ করেছেন জোরেশোরেই। তবে তিনি নিশ্চিত জানেন আগেকার দিনগুলো ভালো ছিল। এমন বিদ্বেষ আর ঘৃণার বিষবাষ্প মিশে ছিল না কোথাও। ইলিয়াস, বাহার, মোজামরা তাদের পূজায় দলবেঁধে আসতেন, প্যান্ডেল বাঁধতেন, মায়ের হাতের নিরামিষ খেয়ে আহা আহা করতেন। তিনি নিজে প্রত্যেক শবে বরাতের রাতে রুটি, হালুয়া, মুরগির মাংসের আলুঝোল খেয়ে আসতেন ওদের বাড়িতে; সেমাই ঈদে প্রত্যেকের বাড়িতে বাঁধা নেমন্তন্ন ছিল। ইলিয়াস তো সেই কবেই অল্প বয়সে টুপ করে মরে গেল, বাহার আর মোজামও খুব বুড়ো হয়ে গেছে, দেখাসাক্ষাত হয়ই না আজকাল।
ঋতি প্লেটে করে আরও কিছু পাঁপড় নিয়ে আসে। হেসে বলে- রাতে একটা করে গ্যাসের অষুধ খেয়ে নিও তোমরা। এই বেলা পাঁপড় খাও আর কিছু।
তারা দুজনেই আরেকটা করে পাঁপড় তুলে নেন। বাইরে মাইকের আওয়াজ থেমেছে এতক্ষণে। বিকট শব্দ থেকে কান যেন স্বস্তি পেল হঠাত। চা পর্ব শেষ করে রণজয় ভাবেন একটু বাজারের দিকে যাবেন। যদিও বাড়ি ভরা আপনজনদের মধ্যে এই মহার্ঘ সময়টুকু তিনি একদম হাতছাড়া করতে চান না তবু আসলে গত কিছুদিন বাড়ি থেকে একেবারেই বেরোনো হয়নি, নিজেরও একটু আড়মোড়গা ভাঙা দরকার। বেরোবার মুখে করবী বললেন- শাক পেলে আসার সময় নিয়ে এসো। ছেলেমেয়েগুলো সব শাক খেতে ভালোবাসে। আর তাছাড়া কাল দশমীতে নিরামিষ ভাঙা হবে, সাথে শাক থাকলে ভালো হবে।
রণজয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বের হয়ে যান। মন্দিরের উঠান, আর সামনে বিষ্ণুপদর ফাঁকা জমিটায় বিভিন্ন দোকান বসেছে। মিষ্টি, জিলাপি, পাঁপড়ভাজার সাথে ঝালমুড়ি, একটা টেবিলজোড়া পান আর বাচ্চাদের কিছু খেলনাপাতির দোকান। এই কয়েকটা দোকানেই বাচ্চাদের ভিড়, খেলনার দোকানে প্যাঁ পোঁ করে বাঁশি পরখ করে দেখছে বাচ্চা ছেলেপুলের দল। তিনি মন্দিরের দিকে তাকান। মন্দিরের ছোট ঘরটার ভেতরে এখন আর পূজা হয় না। বিশাল বড় প্রতিমার জন্য বাইরে প্যান্ডেল করা হয়েছে। সেখানে মেঘের ভেতর সন্তানাদি আর মহিষাসুরসমেত ঝলমল করছে মা। দেবী দুর্গার দুই পাশে দুই অসুর উদ্ধত ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে দাঁড়ানো। এই মেঘের নকশাখচিত প্যান্ডেলজোড়া ঝলমলে দারুণ সুন্দর দুর্গাপ্রতিমাকে কি আপন লাগে রণজয়ের? না তো।
রণজয়ের কাছে দুর্গাপ্রতিমা মানে নরেনদার বানানো ছোট ছোট দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, একটামাত্র পীত রংয়ের অসুর আর মায়ের পায়ের নিচে সোনালি রংয়ের হ্যাংলাপাতলা সিংহ। একটামাত্র ম্যাড়ে সব মুর্তি বানাত নরেনদা, এখনকার মতো দেখনদারি সব আলাদা আলাদা মুর্তি নয়। রণজয়ের মনে আছে ষষ্ঠীর দিন যখন দীপন ঠাকুর পূজা শুরু করতে চলে আসত, তখনও নরেনদা মন্দিরের সামনের নারকেল গাছটায় বেঁধে দুর্গার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল বানাত। সেই প্রতিমার জৌলুশ এই আলো ঝলমলে মেঘবাহিনী প্রতিমার কাছে কিছুই নয়। কিন্তু সেই পূজা? সেই প্রাণ আর আবেগ? তখন মাইক বাজত না পূজার প্যান্ডেলে, সন্ধ্যাবেলায় উদ্ভট সব গান বাজিয়ে মডার্ন ড্যান্স নামের ততোধিক উদ্ভট নাচের প্রতিযোগিতা হতো না। এ বাড়ির পূজা যখন আরম্ভ হয়, তখন রণজয় কিশোর বয়স পেরিয়েছে, বিএ ক্লাসের ছাত্র, তবু তারা ছোটবড় সবাই মিলে সন্ধ্যাবেলায় আরতি করত। দীপন ঠাকুর সন্ধ্যার পূজা সেরে আরতি শুরু করত রোজ, তারপর একে একে ওরা সব ভাইবোন ধুনুচি হাতে আরতি করত। প্রতিযোগিতার কোনো বালাই ছিল না। অথচ এখন নাকি আরতি হয়ই না। তিনি নিজে প্যান্ডেলে না গেলেও ঘরে বসেই মাইকে ধুনুচি হাতে আরতির বদলে মডার্ন ড্যান্সের ঘোষণা শুনতে পান। কী অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে দিনদিন সবকিছু! রণজয় জানেন না এখনকার এত এত আলোর রোশনাইয়ের মধ্যে মায়ের চোখ হাসে কি না, বিসর্জনের বেলা সেই অনিন্দ্য মুখের কাজল কালো চোখ জলে ভরে ওঠে কি না!
দুই
এই মডার্ন ড্যান্স নামের অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি দেখতে ভালো লাগে না বর্ণালির। তবু পূজার ক’টা দিন সন্ধ্যার পর প্যান্ডেলে নিয়মিতই আসে সে ঋতি আর পর্ণার সঙ্গে। এমনিতে তেমন মিশুক না হলেও শিবানীও আসে মাঝে মাঝে। এখানে এলে সেই ছোটবেলার মতো সবাইকে দেখতে পাওয়া যায়। পাড়ার সব ছেলেপুলের মুখে অকৃত্রিম খুশির হাসি দেখতে বড় ভালো লাগে তার। এ বাড়ির সেই দিন, সেই নাম আর জৌলুশ কিছুই এখন নেই কিন্তু এই কয়দিন অন্তত কাউকে দেখে সে কথা বোঝার উপায় নেই। এ ক’টা দিন নিজেদের অভাব অনুযোগ আর জ্ঞাতিহিংসার ছোঁয়াচটা এক ফাঁকে অনেকখানিই যেন উবে যায়। পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরে বাচ্চারা, বউয়েরা সব সারাদিন নির্ভার থাকে, রাঁধে বাড়ে খায় দায়। সবার বাড়িঘর আগের মতোই বর্ষাশেষের নতুন মাটি দিয়ে ঝকঝকে করে লেপা হয়, সন্ধ্যার পর সবাই কেমন নিশ্চিন্তমুখে প্যান্ডেলে এসে বসে। এ বাড়ির লোকজনের এইরকম নিশ্চিন্ত নির্ভার মুখ দেখতে তার আরাম লাগে।
শুধু এ বাড়ির পূজা মিস করতে চায় না বলে দশমীর সাথে মিলিয়ে প্রতি বছর সপ্তমী থেকে ছুটি নেয় সে, এবার ষষ্ঠী থেকে নিয়েছে। এবারের মতো অবশ্য প্রতি বছরই ষষ্ঠীতে আসা হয় না, সপ্তমীর বিকাল বা অষ্টমীর সকালেই আসা হয় বেশি। বিয়ের পর থেকে পঞ্চমও এ বাড়ির পূজায় আসে হাসিমুখে, কখনোই গাঁইগুঁই করেনি। এই একটা সময় বাড়ির মেয়ে জামাইরা একদিনের জন্য হলেও বেড়াতে আসে। শিলা, বিথী, শিল্পী, দোলা, সীমা- সবার সাথে একবারের জন্য হলেও দেখা হয়, ওদের বাচ্চাদের সাথে, বরদের সাথে দেখাসাক্ষাত হলে ভালো লাগে। বর্ণালির বড় ভালো লাগে ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া গন্ধের একটুখানিও ফিরে পেতে। ঋতির বিয়ের পর এ বাড়িতে প্রথম পূজা, সোহম আর ও দুজনেই ছুটি নিয়েছে পুরো পূজার সময়টা।
প্যান্ডেলে বসে চারপাশে চোখ বোলায় সে। মাঝখানের জায়গাটায় ছেলেমেয়েরা সামান্য আরতির পর উদ্দাম নাচবে, তার পশ্চিমে মেয়েদের আর পুবে ছেলেদের বসার জায়গা। প্রচুর চেয়ার আনা হয়েছে ডেকোরেটরের দোকান থেকে। ওদের ছোটবেলায় প্রতিমা হতো মন্দিরের ভেতরে, এত বিশাল আর বাহারি প্রতিমা হতো না তখন, নরেন জ্যাঠার ছেলে পরেশ মালাকারই প্রতিমা বানাত প্রতিবছর। বড়রা বলত পরেশদার হাতের প্রতিমা দেখতে নাকি অবিকল তার বাবার হাতের মতোই। তখনকার দিনে মন্দিরের দরজা বরাবর আরতির জায়গা রেখে দুপাশে ওরা বসত খড় আর চট বিছিয়ে, কেউ কেউ বাড়ি থেকে টুল বা পিঁড়ি নিয়ে আসত অবশ্য। দুটো ঢাক নিয়ে প্যান্ডেলের সর্বদক্ষিণে বসত ঢাকি আর নির্মলদা। তাদের ঢাকের তালে তালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আরতি চলত। তখন আরতি দেখার লোক হতো অগুনতি কারণ আশপাশের তিন গ্রাম মিলে এই একটিইমাত্র পূজা হতো। এখন পাড়ায় পাড়ায় পূজা, বিাড়ির লোকজন ছাড়া অন্য পাড়ার কেউই তেমন আসে না এসময়ে।
ওর পাশের চেয়ারে বসেছে টুম্পা, দাদার মেয়ে, তার পাশে ঋতির গা ঘেঁষে সম্পাদি। সম্পাদি আজকেই এলো তাহলে, কেমন মলিন হয়ে গেছে মেয়েটার চেহারা। ওদের এ বাড়ির প্রায় সব মেয়েই বেশ ফর্সা, বংশের ধারাই বোধহয় কিন্তু সম্পাদি একেবারে দুধে আলতা। দুধে আলতা রংয়ের ছোটখাট সম্পাদির ছোট কপাল, চাপা নাক আর গোল মুখের কারণে ওকে দেখতে লাগত চিনা মেয়েদের মতো। কত ছেলে যে সেই সময়ে পাগল হয়ে গেছিল সম্পাদির জন্য! সেই সম্পাদি! অল্প বয়সে স্ট্রোক করে কত ভুগল! মাথাটাও আগের মতো কাজ করে না, সময়ে সময়ে কেমন উদভ্রান্তের মতো আচরণ করে সম্পাদি! গত বছর দেখা হয়েছিল পূজায়, আর এই। বর্ণালির মনে হয় শুধু বিগড়ানো শরীর নয়, রিটনদা যে ঐ সময়ে আরেকটা বিয়ে করার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল, পাতানো বোনের সাথে সম্পর্কটাকে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেটাই হয়ত সম্পাদির সব অসুখের মূলে।
সম্পাদি দেখতে পেয়েছে ওকে, ওর ছোট ছোট দুই চোখ ঝকঝক করে ওঠে। সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে- তুই কোনদিন আসছিস, বিনু? মুই তো আইজে আসনু।
বর্ণালি সম্পাদির ঝকঝকে চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে- মুই তো ষষ্ঠীর দিনেই আসছু দি। তুই একা আসছিস না সবায়?
সম্পাদিরা সবাই এসেছে। কোন লজ্জার মাথা খেয়ে রিটনদা শ্বশুরবাড়ি আসতে পারে, তা বর্ণালির মাথায় ঢোকে না। ঋতি একদিন বলেছিল, লোকটার মাথা পিটিয়ে গুঁড়া করে দেয়া উচিত ছিল যাই বলিস।
ঋতির কথায় হাসি পেয়েছিল বর্ণালির। মাথা গুড়া করে দিতে হলে শুধু কি রিটনদা, কতজনের মাথাই যে ফাটিয়ে দেয়া উচিত, গুড়া করে দেয়া উচিত! সম্পাদির সঙ্গে কথা বলা শেষ করে আরতির দিকে মন দেয় বর্ণালি।
এ বাড়ির পুরোহিত এখন দীপন ঠাকুরের ছেলে রজতাভ। ওদের ছোটবেলায় দীপন কাকু পূজার সময় মাঝেমাঝেই নিয়ে আসত ছোট্ট রজতাভকে। বাবাকে পূজার ডালা কী শঙ্খ, কাশি এগিয়ে দিত সে আর সবার বাড়িতে নাড়ু, লুচি খেয়ে বেড়াত। সেই রজতাভ আজ পূজা শেষ করে আরতি শুরু করে দিয়ে গেছে। এখন এক মাথা জটা নিয়ে উন্মত্তের মতো আরতি করছে বিষাদুদা। বিষাদুদা বরাবরই আরতি করার সময়ে অন্য কোন জগতে চলে যায়, ওরা যখন ছোট ছিল তখন থেকেই, তখন কিন্তু তার মাথায় জটা ছিল না। বিষাদুদার চুলে বছর কয়েক আগে নিজে নিজেই জটা হয়ে গেছে। এই নিজের থেকেই চুলে জটা হবার বিষয়টা কেমন অদ্ভুত লাগে ওর, ঠিকঠাক বিশ্বাস হতে চায় না। যেমন বিশ্বাস হতে চায় না সেবার অমূল্য কাকুর অষ্টমীর সন্ধ্যায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা। কথা নাই বার্তা নাই সেবার অষ্টমীর সন্ধ্যায় কাকু কেমন পাগল হয়ে গেল। মন্দিরের ভেতর সটান শুয়ে শুয়ে কত কী বলছিল! আর কেবলই বলছিল, আমি যার যার কাছে অপরাধ করেছি সবাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। নাহলে বাঁচব না, মা আমাকে বাঁচতে দেবে না।
অমন ডাকাবুকো মানুষটাকে ওই রকম মুষড়ে পড়তে দেখেই হয়ত সবাই মনে মনে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিল, কে জানে। তবে একবার অমূল্য কাকু ডেকেছিল পর্ণাকে, মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে ছোট্ট পর্ণা ভয়ে কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছিল। অন্যদিকে অমূল্য কাকু তাকে একঘেয়ে খুনখুনে স্বরে ডেকেই যাচ্ছিল। বর্ণালিই পর্ণার হাত ধরে মন্দিরের ভেতর নিয়ে গিয়েছিল ওকে, অমূল্য কাকু বলেছিল- পর্ণা, একমাত্র তুইই আমাকে ক্ষমা করিসনি রে, তুই ক্ষমা করলে তবেই আমি সুস্থ হবো।
ভীতসন্ত্রস্ত পর্ণা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল কারণ তার কদিন আগেই বাবার সঙ্গে অমূল্য কাকু চরম দুর্ব্যবহার করেছিল বলে সেই সন্ধ্যায় সে মনে মনে বলছিল- কিছুতেই আমি তোমাকে ক্ষমা করব না, মরে গেলেও না! কিন্তু এই কথা সে কাউকে বলেনি, ঋতিকে না, দিদিকে না, সীমাকে না তবু কী করে অমূল্য কাকু জেনে গিয়েছিল? দুর্গা প্রতিমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কেঁদে ভাসিয়ে অমূল্য কাকুকে ক্ষমা করে দিয়েছিল পর্ণা। তার অনেক অনেকক্ষণ পরে, একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠেছিল অমূল্য কাকু। বর্ণালি তখন থ্রিতে পড়ে, নিজের চোখে পুরো ঘটনাটা দেখেছিল সে। তবু আজ পর্যন্ত সেই ঘটনার বাস্তবতা নিয়ে ঘোর কাটে না ওর।
পেছন থেকে কে এসে জড়িয়ে ধরেছে ওর গলা। বর্ণালি পেছনে তাকায়, বিন্দু কাকিমা এক মুখ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। এমন মুহূর্তগুলো কেমন সোনায় মোড়ানো আর আদুরে হয়ে ওঠে। কত গল্প, কত অকারণ হাসিঠাট্টায় আজকের মডার্ন ড্যান্সের সময়গুলো কেটে যেতে থাকে। পাশের চেয়ার থেকে পর্ণা একবার ফিসফিস করে ওঠে- এই বিনু, দ্যাখ দ্যাখ কে এসেছে!
কে এসেছে দেখার জন্য চারপাশে তাকায় বর্ণালি। পর্ণা যেমন উত্তেজিত তেমন উত্তেজিত হবার মতো কাউকে খুঁজে পায় না সে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পর্ণার দিকে তাকালে পর্ণা বাঁশের ঘেরার বাইরের দিকে ইশারা করে। বর্ণালি এবার খুঁজে পায়- গোল ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে তার মুখের ওপর ঠায় তাকিয়ে আছে মিরাজ। মিরাজ! এখনো প্রতি বছর এই ছেলে পূজার আরতি হোক আর নাচ দেখতে হোক, নিয়ম করে আসবেই! কেন? শুধু ওকে দেখার জন্য? বর্ণালির সঙ্গে তো তার সম্পর্ক ছিল না কোনোকালে বরং নিয়মিত চিঠি লিখে লিখে বিরক্ত করার কারণে একবার আনছারুল স্যারের হাতে প্রচুর মার খাইয়ে নিয়েছিল ছেলেটাকে। তবু কোনোদিন মিরাজ ওর কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি, অনুযোগ করেনি। অবশ্য যোগাযোগও করেনি আর। অথচ এখনো এই মাঝ তিরিশের ছেলেটা অনৈসলামিক পূজা প্যান্ডেলে প্রতি বছর তাকে দেখতে আসে! বাইরে থেকে এই বয়সের কোনো ছেলে সাধ করে আরতি হোক আর নাচই হোক, দেখতে আসে না আর এ বাড়ির পূজায়। অথচ কোনো বছর মিরাজ আরতির এ সময়টায় আসা বাদ রাখেনি। মিরাজ তো বিয়ে করেছে, দুটো বাচ্চাও আছে তার। তবু? কীসের জন্য? গলা বেয়ে ওঠা অস্বস্তিটাকে গিলে নিতে নিতে বর্ণালি নাচের দিকে মন দেবার চেষ্টা করে।
তিন
দশমীর পরদিন সবাই একে একে চলে যাবে এই বাড়ি থেকে। করবী কোথা থেকে বের করে আনেন অনেকগুলো মাটির পুতুল। প্রতিমা তৈরির সময় মাটি আনিয়ে তিনি পুতুলগুলো বানিয়েছিলেন, এবার এ বাড়ির মূর্তি গড়তে এসেছিল চারটা ছেলে, কুড়ি পঁচিশ বয়স হবে হয়ত তাদের। খুব বাধ্য ছেলেগুলো, ওরাই মাটি দিয়ে গিয়েছিল ওদের কাকিমাকে। তার নিজের হাতে তৈরি পুতুলগুলোর ডাঁটা শাকের কালো বীজের চোখগুলো চকচক করে। তার মেয়েরা ছোটবেলায় প্রতিমার মাটি দিয়ে পুতুল বানাত। শুধু কি তার মেয়েরা? এ পাড়ার সব ছেলেমেয়ের ঝোঁক ছিল সেই মাটির উপর, পাঁচ দশ বিশটা করে পুতুল গড়ত একেকজন। একেজনের পুতুল দেখতে হতো একেকরকম। তারা সবাই হেসে গড়িয়ে পড়তেন ওদের বিভিন্ন গড়নের, বিভিন্ন ধরনের পুতুল দেখে। এখন আর এ বাড়িতে টেপা পুতুল বানানোর কেউ নেই। কিন্তু নাতনিগুলো পুতুল খেলতে বড় ভালোবাসে। করবী তাই ওদের জন্য নিজে পুতুল বানিয়েছিলেন এবার।
টুম্পা, টুবাই, অর্হ সবাই দারুণ খুশি হয়েছে দিদার কাছ থেকে পুতুল পেয়ে; মহুল বড় তাই ওর জন্য মাটির পুতুল নেই। দুপুরের পর গাড়ি করে এক এক করে চলে গেল মেয়ে জামাইরা। শিবানী, মহুল আর টোটোকে নিয়ে রক্তিম গেল শিবানীর বাপের বাড়ি, ওখান থেকে পরশু তারা ঢাকায় ফিরবে। শিবানীর খুব ইচ্ছে ছিল অষ্টমীতেই বাপের বাড়ি যাবার কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটো নাছোড়বান্দা! পিসতুতো ভাইবোনদের সঙ্গেই তারা পূজা কাটাবে। অগত্যা মন ভার করে পূজা শেষ করে তবেই ও বাড়ি যেতে হলো ওদের।
ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিদের বিদায় জানিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করেন করবী। এখন আবার তারা বুড়োবুড়ি আর চিনুবালা এত বড় বাড়িটায়! আগে যখন চার চারটা ছেলেমেয়ে ছোট ছোট ছিল এ বাড়িতে, তখন চাকুরির কারণে তারা দুজনের কেউই তেমন সময় দিতে পারেননি তাদের। আজ যখন তাদের হাতে অঢেল সময়, তখন বাড়িটা খা খা মরুভূমি। প্রতিবার দশমীর বিকালে প্রতিমা ভাসানের সময় করবীর বুক ধক করে ওঠে, তার ছেলেমেয়েরাও এমন করে বহু দিনের জন্য মার বাড়ি ছেড়ে চলে যায়! একটা হাহাকার ছাইচাপা দিয়ে রণজয়ের জন্য চা বানাতে যান করবী।
দিনাজপুরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে ঋতি। এ ক’টা দিন খুব ধকল গেল। অন্যরা যখন পূজায় হই হল্লা করে বেড়ায় তখন তাদের বাড়িতে সবাই এটা সেটা রান্না বান্না আত্মীয় স্বজনের দেখভাল করতে করতে ব্যতিব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে কাল দশমীতে খুব খাটাখাটনি গেছে। বাড়ির সব মেয়েজামাইকে ডেকে দশমীর দিন নেমন্তন্ন খাওয়ানোর চল ওবাড়িতে এখন উঠেই গেছে, তবু এবার মা কী মনে করে মেজ আর ছোট কাকুর মেয়ে জামাই নাতি নাতনিদের নেমন্তন্ন খাইয়েছে। অত মানুষের যোগাড়যন্তর করতে করতে নিজেদের অবস্থা কাহিল, যদিও রান্নাবান্না প্রায় সবই বড়দিই করেছে সব সময়ের মতো। সোহমের মা বেঁচে নেই, বাড়িটা তাই খাঁ খাঁ লাগে সব সময়। শ্বশুরমশাই বাইরে কোথাও গেছেন। সোহম ওকে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে দেয়। অনেক অনেকদিন বাদে এবারের পূজা সোহমের জন্য খুবই আনন্দের ছিল। মা মরে যাবার পর থেকে এত হুল্লোড় করে দুর্গাপূজা কোনোদিন করেনি সে।
মায়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি আড়াল করে মহুল। ইশ! মার যে কী রাগ ওদের ওপর। বেচারা! খুব ইচ্ছে ছিল তার অষ্টমীর দিন দিদাবাড়িতে চলে যাবার। কিন্তু মহুলের কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না যে! অর্হ, টুবাই, ছোটপিসিদের রেখে দিদাবাড়িতে শুধু টোটো আর বাবা-মার সঙ্গে পূজা কাটাতে কিছুতেই তার মন টানল না। আর ওর দোষই বা কী? মাকে তো বলেছিলই বাবা আর টোটোকে নিয়ে দিদাবাড়ি চলে যেতে। মাই ওকে ছাড়া গেল না। এখন মুখটা অত কালোটেপনা করে রাখার কী আছে তাই সে ভেবে পাচ্ছে না বাবা!
বাবার মুখটা খুব মনে পড়ছে পর্ণার। দিনদিন কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বাবাটা! অমন যে উচ্ছ্বল আর সুন্দর বাবা ওদের, এই ক’বছরের মধ্যে কেমন করে বয়স বেড়ে গেল অতখানি? হার্টের সমস্যাটা নতুন করে দেখা দিল এ বছরই, ডায়াস্টোলিক ডিসফাংশন। ডাক্তার শুধু অষুধ দিলেন, বললেন চিন্তার কিছু নেই। আটটা স্ট্রোক পার করা বাবার নতুন সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু কী করে থাকে না, মাথায় ঢোকে না ওর। বাড়িতে ঢুকেই প্রীতম কোথায় গেছে কে জানে। ছেলেটা দিন দিন মোর দ্যান পারফেক্ট মাম্মা’স বয় হয়ে যাচ্ছে। ও বাড়িতে কেউ না জানলেও পর্ণা জানে প্রীতম অষ্টমী থেকেই ছুটি পেয়েছে, ওর মা নিষেধ করেছে বলে শ্বশুরবাড়ি যায়নি। অর্হকে কোলের ভেতর গোল্লা করে নিয়ে বিছানায় হুটোপাটি খেলে সে। তার মন খারাপের কোনো দাম প্রীতমের কাছে নেই আজকাল।
ওদের গাড়িটা যখন ঢাকা-রংপুর হাইওয়ে ধরে আশি কিলোমিটার বেগে ছুটছিল, একটা বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বর্ণালি। বাড়ির বড় জামাইয়ের নতুন প্রেমের খবরটা সে ছাড়া আর কেউ জানে না বলে পঞ্চম পূজার দিনগুলোতে আগের মতোই সবার সঙ্গে হইচই করেছে। কিন্তু এখন গাড়িতে বসে পারতপক্ষে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না একটাও, পারলে উল্টো দিকে তাকিয়ে থাকছে। ভাগ্যিস টুবাই বাবার কোলে গোল্লা পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে! নাহলে এতক্ষণ জোর করে হাসতে হতো, পঞ্চমের সঙ্গে অহেতুক কথা বলতে হতো! একটা হই হই করা পূজাবাড়ি পেছনে ফেলে এসে বর্ণালির ভালো লাগছে না কিছু। ও সারাজীবন একলা, সেই একাকীত্ব এবারে আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সঙ্গে কোনো বইও নেই, কিন্ডলে পড়তে ইচ্ছে করছে না কিছু। এয়ারপড কানে গুঁজে কবীর সুমন চালিয়ে সামনে তাকায় সে। সানগ্লাসের আড়াল থেকে মসৃণ সড়কের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোল চশমার ফ্রেমে ঢাকা মিরাজের মুখ।
