তুমি তো আর আসোনা। আমার মন খারাপ লাগে। বয়সতো ক্রমে বাড়তেই থাকে। মন খারাপের ও বয়স হয় জানো! সে ক্রমশ ঝিমুতে থাকে,রাতে ও দিনে। অথচ সে শুতেই পারতো। শোয় না। পাছে ঘুমিয়ে পড়লেই তুমি চলে আসো,আবার চলে যাও!
তোমাকে বলা হয়নি,আমাদের এ শহরে অপেক্ষার রঙ সবুজ। কারণ সেও পুরুষ। সে,আমার অপেক্ষাকে ঈর্ষার চোখেই দেখে। তোমাকে বলা হয়নি,এ শহরের ওপরে মেঘ নেমে এলে,আমি ব্যথা পাই,বৃষ্টির ভয়ে নয়। এতদিন সে যে আসেনি। অথচ কত কত দিন আগে তার হাত দিয়েই চিঠি দিয়েছিলাম তোমায়। সে চিঠি কি সে তবে দেয়নি তোমায়? আজ যেমন সকাল হতেই থলি হাতে তিনি হাজির। আমাদের মংপুর কথা বলছি। মংপুকে মনে নেই? সেই যে গো খাদের পাশে ঘাপ্টি মেরে লুকিয়ে ছিলো! আর আমাদের জিপটা এগিয়ে যাচ্ছিলো দ্রুত। আর তারপরই…ও’কে তুমি অন্ধকার বলেই ডাকতে। আমি আদর করে ডাকতাম মংপু। ঘটনা বা দুর্ঘটনা যাই বল,সে’তো ওই মংপুতেই! তুমি বলতে চাইতে, দুর্ঘটনা! আমি বলতাম ঘটনা! ঈশ্বরের রাজ্যে যা ঘটে সবই ঘটন। অ বা দুঃ বলার সুযোগ কই! আর প্রতিটি ঘটনার যেমন কার্য কারণ থাকে,তেমন থাকে কিছু অনিবার্য ফসলও। সে এসেছিলো,ভাগ্যিস। নইলে এই দৃশ্যমান দুনিয়ার প্রতি আমার যে এত মোহ! তা’তো দুর্নিবার থেকে যেত আগেরই মতন। তাহলে মংপু একটা উপকার অন্তত করেছিলো। সে মানুষ চিনতে শিখিয়েছিল। প্রিয় অপ্রিয় কত কিছুই তো তার হাত ধরেই শেখা! তা যা বলছিলাম,আজ তো সকালই হয়নি। চারদিক থম থম করছে,আর সকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি। অর্ফিউস তখনই হাতে নিয়েছে বীণা। সুর তুলেছে…আর যা ঘটে,সব চিত্রবৎ! কিন্তু অর্ফিউস তো মিনাদদের বশ করতে পারেনি। যেমন মংপু। মংপু মূলত বাজার করতেই আসে। আজ অনেক দিন পর। আর আমি তো গন্ধ পাই,আঁচ পাই। আজ ভোরেও পেয়েছিলাম ঠিকই। অর্ফিউস তখন বীণা বাজানো বন্ধ করেছে। মংপুও চলে গেছে। এবার নিয়ে গেছে ও আমার জিভ! হ্যাঁগো। সত্যি। আর কোনো শব্দ নেই। কিছুক্ষণ গোঁ গোঁ করছিলাম। পরে দেখলাম সে করেই বা লাভ কী! যে যাবার সে তো যাবেই! তাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে তোমায় লিখতে শুরু করলাম।
তুমি তো আর ডাকলেই আসতে পারোনা। তোমার এখন অনেক কাজ! কাজ কে আমি আদর করেই ডাকি কাজল। চোখে কাজল পরলে,সব কিছুই কেমন মনোহরা। এমনকি বিকি কিনির এই হাট ও। এত যে মায়া তোমার শরীরে,তা তুমি কাজের কাজল পরেই হয়ত। দুনিয়ায় দু শ্রেণীর মানুষ। এক শ্রেণী আমার মত ভাবে,কিছু করে না। দুই যারা করে,ভাবেনা। তুমি দ্বিতীয়। তাই তোমার সন্তান,স্বামী হাবি জাবি,এমন কি শাড়ি গয়নাও তো,তোমার সাথেই…নইলে ডাকলে আসোনা কেন? তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারোনা! অপেক্ষার বয়স বাড়ে,সে ক্লান্ত হয়,সে শয্যা খোঁজে,সে গাইতে চায়,জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই…
সময় ঘড়ি বলছে এখন প্রায় দুপুর দুটো। অথচ আলোর ছিটে ফোঁটাও নেই কোত্থাও! এ সময়ে এই দ্বীপে একটা জাহাজ আসার কথা। ওই যে অর্ফিউস জেসনের নেতৃত্বে আর্গো জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। স্বর্ণমেষের চামড়া আনার অভিযানে,মনে পড়ে? পাশে সাইরেনাম দ্বীপ,সেখানের সব অধিবাসীই গান গায়…ওরা ধ্বংস করতে চাইছিলো,গান শুনিয়ে আর্গোকেও। পারেনি,সাথে যে অর্ফিউস। অর্ফিউস ফিরে এসেছে আমার দ্বীপে। ও বাজায় আমি শুনি। একা আর বোকার জীবন যেমন হয়। আমার শ্রবণ শক্তি কিন্তু তীব্র এখনও। কিছু আগেও শুনছিলাম পাতা ঝরার শব্দ। মনাস্ট্রিতে ঘন্টা বাজে,ড্রামের শব্দ গুম গুম গুম…শুয়ে শুয়েই ওখানে চলে যাই। দেখি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে লামার দল। কেউ ছোট,কেউ বড়। এমনকি শিশু লামাও। ওদের কী একটা শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে। আচ্ছা,যা তৈরি হয়েছিল মানুষের মঙ্গলের জন্য,তাকে কেন এত দেখনদার হতে হয়? সে তুমি দুনিয়াএ যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কথাই বল না কেন! তবে কী ধর্মমাত্রই বেশ্যা! তাকে সেজেগুজে পথে নামতেই হয়? না না আমি বেশ্যাদের খারাপ ভাবিনা। তারা তো খিদে মেটাতেই পথে,কিন্তু ধর্ম,তা তো নিভৃতচারীর যাপন। তার এত সোচ্চার বহিঃপ্রকাশ কেন! ওদের শোভাযাত্রাও অবশ্য থেমে গেছে। এখন তো অর্ফিউস বীণা হাতে। তাই পাতারাও থমকে। ইতিমধ্যে মা এসেছিলো,পায়েস হাতে। আমি খাইনি। মা মা’ই আমিও জানি। কিন্তু মা’র করা অন্যায্য বিচারগুলোর কথা যে মনে পড়ে যায় আজ। সারাজীবন পরের কথা ভাবলো,পরের সু বা কু নিয়ে ভাবাটা খারাপ কিছু না। কিন্তু অত কিছু ভাবতে গিয়ে অভিশাপ কুড়নোর মানেই কী! কাকারা তাদের মত থাকতো,মানুষ একসাথে থাকলে ঝগড়া হয়,ভালোবাসাও। মা’কে এত বিচার করবারই কে দায় দিয়েছিলো? শেষমেশ তো তুমিও পাগলই হলে! অর্ফিউস ও সে কথাই বলছিলো। না খুশি হল পার্সিফোনে,না আফ্রোদিতি,এমন কী যাকে বাঁচাতে এত কিছু,সেই এডোনিস ও না। হাতে রইল পেন্সিল। যেই অর্ফিউস থেমেছে,অমনি মংপু আবার হাজির। এবার ও চাইছে কান। গড়তে সময় লাগে। ভাঙতে আর কতক্ষণ! গেল। সে যাক। আমি তো তোমার আর পদধ্বনিও শুনতে পাবোনা। এবার?
তুমি তো আর আসোনা। মনে মনে কত আলপনা আঁকি,তুমি আসলে পা রাখবে। আমি জল দিয়ে পা ধুইয়ে দেব। এদিকে এখন সন্ধ্যে পুইয়ে রাত। রাতের দিকে আমি টাইম ট্রাভেলে বেরিয়ে পড়ি। উনিশ শতকের ইউরোপে যাই। যেখানে কাজ না থাকলে মানুষ মর্গে গিয়ে মৃত মানুষ নেড়ে চেড়ে দেখতো। তুমি কী ভাবো? আমি মৃত না জীবিত? এত যে মায়ার ঘোরে বাঁচো,কে তোমার সন্তান,কে তোমার স্বামী? মৃতদেহ হলে কেউ ছুঁয়ে থাকবে? আগলে রাখবে তোমায়? তোমার কি মনে হয় না,এই পৃথিবীটাও কেমন মৃতবৎ! পচা গন্ধ বেরুচ্ছে গা থেকে। আর যারা প্রকৃত সৎ,মহাত্মা,তারা দ্রুত ছেড়ে যাচ্ছে,এই মধূময় পৃথিবীর ধুলি…এখনও আসবে না?
মৃত আর জীবিতর কি আদতেই কোনো তফাৎ থাকে? অর্ফিউস নেই এই ফাঁকে আমি চলে গেছিলাম কুর্চির কাছে। ও অনেকটা বড় হয়ে গেছে। ওর মা,আমার একমাত্র ধর্মপত্নী হয়ত কোথাও কোনো পার্টিতে,পান আর হুল্লোড়! হাসি আর গালাগালের ফোয়ারা,আর কুর্চি বমি করছে,একা। একাই তো। ফিরে এসে উড পেন্সিলে আঁকছে নদী। ফের মুছে দিচ্ছে। ও আমায় চিনতে পারেনি। আমি ওকে চেনাও দিইনি। কী লাভ! এই যে গোপন গেরিলা জীবনে আমি অভ্যস্ত,তা আর প্রকাশে কিই বা হবে। রাতের নদী বেয়ে লঞ্চ যাচ্ছে আসছে। একটু আগেই দেখা হয়েছিলো,লাইকার সাথে,ও মহাশূন্য থেকে ফিরে আসা ইস্তক,ইশারায় আমায় শেয়ার করে চলেছে ওর দেখা ব্ল্যাক হোলের কথা। আমি গেলে,ও সাথেই চলে। যেন আমি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির,আর সে আমার একান্তু অনুচর। ওই দেখালো,এরিস্টিউস কে। এত হুল যার তার এত কাম? সে গিলেছিলো কুর্চির মাকে। এখন তোমাকেও…আমার খুব শীত করছিলো। তাই পালিয়ে এসেছি…এখন চুপ করে শুয়ে আছি। একটু পর শুরু হবে সিনেমা। মাল্টিপ্লেক্সের সময় এখন। শপিং মলের সময়। রাত বারোটার শুরু হওয়া শেষ শো এর টিকিট কেটে অপেক্ষা করি। ওই যে অপেক্ষা,যা ছাড়া আমার আর কোনো ধর্ম ছিলো না।
এতবার বলার পরও তুমি আসোনি। দেখে এবার আমি রওয়ানা হবো। তোমার খোঁজে। আমায় লাইকা হাত পা নেড়ে জানিয়েছে সব। স্বর্গে গিয়ে তোমায় পাইনি। এবার তাই নরকেই…অপেক্ষার চোখ এখন আরও সবুজ। একটা শপিং মল,একটা জেলে নৌকো,সম্পূর্ণত কালো। সামনে নুলিয়া আরও কালো। কপালের ওপর হাত রেখে,কি যেন দেখছে। একটা কিউরিও শপ, রক্তচক্ষু মহিষের কাটা মুণ্ডু ছড়ানো পথে,একটা পানশালা,রাশি রাশি মদ। কমোড,কমোডিটি,আগুন,ছাই,আমি তোমায় খুঁজছি পাগলের মত। বিশু পাগলা। কে যেন মারছে,কারা যেন কাঁদছে। আমি তো আর শুনতে পাইনা। তাই কানে আসছে না অর্ফিউসের বাঁশিও,সারি সারি সিট,সামনে গ্যালাক্সির পর্দা,ওই তো তুমি,দেখেছি,ব্যালকনিতে বসে বাদাম খাচ্ছো। খোসা ছাড়িয়ে রাখছো ব্যাগে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তোমায় পাঁজাকোলা করে তুলেছি,দৌড়ে আসছি,দ্রুত…অনেক সিঁড়ি ভাঙা বাকি। আমি পালাচ্ছি। দৃশ্যরা পেছন দিকে দৌড়চ্ছে,আমি সামনে…হলের বাইরে বেরুবো,ব্যস শান্তি। এ নরক থেকে আমিই তোমায় মুক্ত করব। একটাই জীবন দুজনে মিলে কেটে যাবে দিব্যি। জামা ধরে টানলো কে? ছোট হাত মনে হয়! আমার কুর্চি ফুলের গন্ধ…আহ! কতদিন কতদিন পর…এ কী তুমি তো ফের চলে গেলে হলের ভেতর! এবার? কান্না পাচ্ছে খুউব! লাইকা বার বার বলেছিলো,পেছন ফিরো না। পথ চলতে পেছনে তাকাতে নেই…
আহহ! মা এ কী তাহলে তোমারই অভিশাপ! পাখিরা,গাছেরা,ওই যে পথ সবাই,সকলে আমার বন্ধু,তাহলে এই শেষ রাতে মংপু আবার এসেছে,এবার দল বল জুটিয়ে…আমায় আঘাত করছে ওরা,হে পিতা তুমি হাত বাড়াও,আমার বুকে খুব ব্যথা,হে আলোর দেবতা…
চলে যাচ্ছি। তুমি তো জানোই দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে আলপথ থাকে,যা আকাশে মিশেছে,আমি অপেক্ষা করব,একটা ভোরের,তোমার,এখন এ নিস্তব্ধ পদচারণার মাঝে বলে যাই,আমি আবার আসবো,যদি একবার হাত ধর সমস্ত অভিমান ভুলে আবার হেসে উঠবো, তখনও হয়ত গ্যালাক্সি থিয়েটারে চলছে, সমস্ত দখল পার করে অন্য কোনো এক অপেক্ষার গল্প,যেভাবে গল্প লেখা হয়…