উৎসব একার হলে হয় না। হতে হয় সকলের। উৎসব মানে আনন্দ। এ আনন্দে শরীক হওয়ার অধিকার সকলের। সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষ একা থাকতে না পেরে একসাথে থাকার উপায় আবিষ্কার করে নিয়েছে। মানুষের যূথবদ্ধ জীবন শুরুর পর একপর্যায়ে কর্মক্লান্ত হয়ে কিছুটা ভিন্নরকম সময় কাটানোরও নানা উছিলা তৈরি করেছে সে। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে পরিবার কেন্দ্রিক মানুষগুলো নানা উপলক্ষে আনন্দ আয়োজনে শরীক হতে শুরু করে, যা এক সময়ে রূপ নেয় উৎসবে। ইংরেজিতে যাকে আমরা ফেস্টিভ্যাল, ওকেজেন ইত্যাদি বলে থাকি।
মূলত আমাদের আদি সভ্যতার সূচনা যে কৃষি থেকে সে কৃষিকে কেন্দ্র করেই উৎসব আনন্দ ডালপালা মেলতে শুরু করে। এ উৎসব ছিল অনেকটা পূজাকেন্দ্রিক। জীবনের অসহায়তা থেকে উত্তরনে মানুষ নানা শক্তির পূজা করতো এবং এ পূজাকে কেন্দ্র করে সমাবেশ ঘটতো সকলের।
কিন্তু একপর্যায়ে মানুষের কমকেন্দ্রিক উৎসবের জায়গা দখল করে ধর্ম। আবার ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি আমরা পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় উৎসবগুলোর আয়োজনও দেখতে পাই। এছাড়া রয়েছে আমাদের নানা ঋতুভিত্তিক উৎসবও।
উৎসবের প্রকারভেদ যাই থাক উৎসব মানে মিলন, উৎসব মানে সমাবেশ। উৎসবের এ আনন্দ আর যাই হোক বিচ্ছিন্নতায় আসে না। দরকার মিলন। সে পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা জাতীয় যে উৎসবই হোক।
বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। ঘরে খাবার থাকুক কিংবা নাই থাকুক উৎসবে মেতে ওঠা তার স্বভাবজ বৈশিষ্ট্য। তাই বলা হয় ‘বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ’। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নানা পূর্জা অর্চনাকে কেন্দ্র করে এ কথাটির আবির্ভাব হলেও এতে আপামর বাঙালির উৎসবপ্রিয়তার কথাই যেন ফুটে উঠেছে। একসময়ে বাংলায় উৎসবের পরিসর সীমিত ছিল ভূস্বামী, জমিদার কিংবা রাজবাড়ির আঙিনা। ক্রমে ক্রমে অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে আজ যে কোন উৎসবের পরিসর ও আমেজ বিস্তৃত ও ব্যাপক হয়েছে। এছাড়া বিশ্বায়ন এসে বাঙালির উৎসবের একেবারে খোলনালচে পাল্টে না দিলেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে বেশ। কারন জীবনধারা দিয়েইতো প্রভাবিত হয় উৎসব। ব্যক্তির স্তর থেকে ক্রমান্বয়ে সমষ্টির স্তরে পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। এ পরিবর্তনের রঙের আঁচড় বর্তমানে সকল উৎসবেই দৃশ্যমান।
আমাদের এ বদ্বীপ অঞ্চলে অন্যান্যদের পাশাপাশি প্রধানত দুই ধর্মের লোকেরই নিরবিচ্ছিন্ন বসবাস। দূর অতীতের দিকে দৃষ্টি ফেরালে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের সুকোমল সুর ধ্বনিত ছিল বলেই আমরা জানতে পারি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে তাদের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতির কারনে সে সুরে তৈরি হতে শুরু করে অনৈক্য আর বিভেদের কালো ঘুণ। এ ঘুণ আজো আমাদের ক্ষয়ে দিচ্ছে, ভেঙে দিচ্ছে, করছে বিপন্ন।
সাদা পুঞ্জ মেঘের নির্মল শরতের স্নিগ্ধ সবুজতায় আবহমান বাঙালির যে বড়ো উৎসব দুর্গাপূজা প্রতিবছরই মহা আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে হিন্দুদের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কি আগের মতোই আছে? নাকি সংকুচিত হচ্ছে? কিংবা বাধাগ্রস্ত?
শৈশবে গ্রামীণ জীবনে যে দুর্গাপূজায় অনেক মুসলমান পরিবারকেও উৎসবের আমেজকে নিজের করে নিয়ে তাতে শরীক হতে দেখেছি তাতে যে চিড় ধরেছে, সে কথা কি অস্বীকার করা সম্ভব? উল্টো দিকে মুসলমানের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সেমাই ও মাংসে অনেক হিন্দু পরিবারের আহ্লাদিত হওয়ার চিত্রও কি খুব বেশি দূরের কিছু?
আজ সেসব দৃশ্য নেই বলা যাবে না। তবে ম্রিয়মান এ কথা নিঃসন্দেহ। কিছু ফতোয়াবাজ ধর্মের মানবিক বোধ উল্টে দিয়ে তৈরি করছে অসহিষ্ণুতার তীব্র তেজ। এ তেজে আমরা পুড়ছি, মরছি হররোজ। দিনে দিনে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত সাপের ফনা আমাদের আশপাশজুড়ে মাথা তুলছে, কাঁপাচ্ছে তার ধারালো জিহ্বার তিক্ত তীর। সমাজ সংসারে মানুষকে খাটো করে ধর্মের ধ্বজা ওড়ানোর মিছিলে শরীক হওয়া লোকজনের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, কমছে না । এ বড়ো আশংকার, এ বড়ো অশনি সংকেত। কারন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’। মানুষ ও মানবিকতা মূল্যহীন হয়ে পড়লে জাগতিক সকল সাম্য ও সৌম্যের স্বপ্ন যে ধূলায় লুটাবে তাতে কি কারো সন্দেহ?
আমাদের এ দেশে সবচেয়ে আশাজাগানিয়া ও সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ কিংবা বর্ষবরণের আয়োজন। বাঙালির আত্মপরিচয় জড়িয়ে যাওয়া এ উৎসবটি এখন এ দেশের সংস্কৃতির এক অন্যতম অনুষঙ্গ। কৃষিকে কেন্দ্র করে একসময়ে এটি ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠান হলেও এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক আপামর বাঙালি স্বত:স্ফূর্তভাবেই এতে অংশ নেয়। সবধর্মের, সব শ্রেণির সকলের অংশগ্রহণের কারনে বর্ষবরণের এ আয়োজন আমাদের সমাজের অভ্যন্তরে ছড়ানো সাম্প্রদায়িকতা থেকে শুরু করে আরো সব বিষাক্ত ভেদ ঘুচিয়ে দিচ্ছে, মুছিয়ে দিচ্ছে।
আরো কিছু ঋতুভিত্তিক আয়োজন এ দেশের সমাজ সংসারে যে আনন্দের অলৌকিকতা তৈরি করে তার মধ্যে অন্যতম নবান্নের উৎসব। হেমন্ত ঋতুতে এটি অনুষ্ঠিত হয় বলে কেউ কেউ একে হেমন্ত উৎসবও বলে থাকেন। আরো রয়েছে বর্ষাবন্দনা,পৌষ সংক্রান্তি। ঋতুরানি বসন্ত বন্দনার কথা না বললেই নয়।
উৎসব আমাদের দৈনন্দিনতার একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি দেয়। আনন্দের উচ্ছ¡াসে মুছিয়ে দেয় সকল ক্লেশ আর ক্লেদ। শ্রেণিবিভাজনের ক্ষতাক্ত সীমারেখটি সাময়িকভাবে হলেও ভেঙে পড়ে উৎসব প্লাবনে। একে অন্যকে চেনার, জানার এবং ভাব বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে নানামাত্রিক আয়োজনের বহু বর্ণের উৎসব।
আমরা যেন সকল বিভেদ, বিভাজন ভুলে কেবলমাত্র মানুষ পরিচয়ে উৎসবে একে অন্যের আনন্দের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারি। ঋদ্ধ হতে পারি লালনের এই চেতনাতে,
‘সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে’

কবি, প্রাবন্ধিক
জন্ম কুমিল্লায় ১৯৭৩ সালের ১ অক্টোবরে
অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর
পেশা সাংবাদিকতা
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত
