
কুমেই । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের প্রায় সকল উৎসব মানে কুমেই । আবার এই ভাষায় শ্মশানের চিতাকে বলা হয় ‘কু’ । মেই মানে আগুন বা আলো । কু+মেই > কুমেই । প্রায় সকল উৎসব তাদের কাছে কুমেই । যার এক মানে দাঁড়াল, চিতার আলো ।
এই চিতার আলো বা আগুনের থেকে শুরু হল জীবন ? কুমেই মানে উৎসব যখন, আমি উৎসব শব্দটির দিকে তাকিয়ে দেখি । উৎ+√সু+অ(অপ) হল উৎসব শব্দের ব্যুৎপত্তি । এ থেকে উৎশব > উচ্ছব । এটা বিশেষ্য । যার মানে হল, ১.আনন্দানুষ্ঠান, পর্ব । ২. ধুমধাম (রঙ্গ ঢঙ্গ বহুল উচ্ছব গীতনাট্য–সৈয়দ আলাউল) ৩. আনন্দানুভুতি, আহ্লাদ (উৎসব হইল মনে সরোবর দেখি ––সৈয়দ আলাউল ৪. কৌতুক, আমোদপ্রমোদ (মত্ত সবে উৎসব-কৌতুকে ।
ব্যুৎপত্তির দিকে তাকালে, দেখি, সেখানে রয়েছে শব । তখনই, ত্রিপুরার এক আদি জনগোষ্ঠীর এক উৎসবের কথা মনে পড়ে গেল । সেই জনগোষ্ঠী হল রিয়াং সম্প্রদায় । তারা মৃতদেহকে ঘিরে আশ্চর্য এক নাচের আয়োজন করে থাকে, যাতে আত্মীয়স্বজন ব্যতীত আর কেউ অংশ গ্রহণ করতে পারে না । মৃতদেহ শোয়ানো থাকে ঘরের ভেতর । তার পায়ের দিকে ধূপ জ্বালানো হয় । কান্না নয়, তখন এই মৃতদেহকে ঘিরে তারা নাচতে শুরু করে । সেই নাচ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । এত সুন্দর এক নৃত্যশৈলী আজও পৃথিবীর আলো দেখল না ।
সৈয়দ আলাউল বলেছেন, উৎসব গীতিনাট্যময় । আবার রিয়াংদের এই নৃত্যও গীতিনাট্যময় । এটা এক রিচ্যুয়াল । আমরা জানি, আদিকালে, রিচ্যুয়াল্কে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল উৎসবের । তাহলে কি প্রথম রিচ্যুয়াল মৃত্যুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছিল ?
উৎসব নানা উপলক্ষ্যে হয়ে থাকে । মনিপুরীদেরও তাই । তার আগে, বলে রাখি, মনিপুরী সমাজ বৈষ্ণব পদাবলীময় । তাদের জন্ম-মৃত্যু থেকে শুরু করে সকল অনুষ্ঠানে এই পদাবলীর এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । হোলি, বিষু সংক্রান্তি, রথযাত্রা, ঝুলন, দুর্গাপূজা, মেরার পালি বা মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মাস ব্যাপী পালা দেওয়ার নাম মেরার পালি, গোবর্ধন পূজা, মহারাস ছাড়াও, গুরুকীর্তন বা অন্যান্য কীর্তন, গিল্লা খেলাও মনিপুরীদের কুমেই । এ ছাড়াও রয়েছে বালা কাপানি । এটা কৌম সমাজের এক নিদর্শন হয়ে এখনও টিকে আছে এই সমাজে । বালা কাপানি মানে ধান কাটার সময় এলে, গ্রামের সব যুবক-যুবতীরা মিলে, এক একদিন, এক একজন চাষীর ক্ষেতের ধান কেটে দেবে, একদিনের মধ্যেই । সে এক অপার্থিব আনন্দের উৎসব ।
বছরের শুরু হয় বিষু সংক্রান্তি দিয়ে । সাতদিন ধরে এই উৎসব চলে । সংক্রান্তির দিন, সকালেই, রান্না শেষ করে, পথের এক প্রান্তে গিয়ে, পূর্ব-পুরুষদের নিবেদন করা হয় ভোগ । তারপর, এক এক বাড়ির রান্না যাবে অপর বাড়িগুলিতে । এ আসলে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা । রান্নার প্রতিযোগিতা । সেদিন, বিকেলে, শিব বা মহাদেবের থানে লামর দৌর পূজা হয় । এতে পুরুষের প্রাধান্য বেশি । লামর দৌ মানে স্থানের দেবতা । এটাও এক উৎসব । সন্ধ্যের পর, মণ্ডপে বা মালঠেপে, আরতির পর শুরু হয়, মহাভারত পাঠ বা ভাগবত পাঠ । কথক শুরু করেন তার কথকতা । শেষ হলে, খই, যা গুড়ে মাখানো, দেওয়া হয় সকলকে ।
রাত বাড়লেই যুবক-যুবতীরা মণ্ডপে বসে পড়ে পাশা নিয়ে । একে দসু খেলা বলা হয় । সারারাত চলে এই দসু খেলা । এখানেই যুবক-যুবতীরা পছন্দ করে নেয় তাদের জীবন সঙ্গীকে । সব সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না । এই পাশা খেলায় চার দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে তারা । খেলার সঙ্গে থাকে গান । সাতদিন ধরে এই উৎসব চলে । কোথাও কোথাও, দুপুরে, মণ্ডপেই, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে ।
রথযাত্রাও মনিপুরীদের এক প্রিয় উৎসব । কীভাবে এটা তাদের প্রিয় হয়ে উঠল, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । তবে চৈতন্যদেব এর এক প্রধান কারণ । মনিপুরীরা বৈষ্ণব । শৈব ধর্মের রীতিনীতিও তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । এটাও বেশ মজার ।
রথযাত্রা উৎসব টানা দশদিন ধরে পালিত হয় । রথ টানা থেকে শুরু হয়ে উল্টোরথ, তারপর, শয়ান বা শয়ন পর্যন্ত এই উৎসব । এই সময়, রোজ, রাতে পালি । পালি মানে পালা । গ্রামের এক এক পরিবার থেকে দেওয়া হয়ে থাকে এই পালা । এটা সন্ধ্যায় । কেউ কেউ দুপুরে ব্যবস্থা করে । দুপুরে ভাতের ব্যবস্থা । দুপুরে পালা দিলেও রাতের খিচুড়ি পালি না দিলে তা অসমাপ্ত থেকে যাবে । সব কিছুই মণ্ডপে । সন্ধ্যায়, প্রথমে আরতি হবেই । আরতি বিনে মণ্ডপে কিছুই হবে না । তারপর, ঘন্টা খানেক মহাভারত, রামায়ণ বা ভাগবত পাঠ । পাঠ শেষ হলে খই খাওয়ার পালা । তারপর শুরু হবে নাচগান । এই অংশের নাম জয়দেব । গীতগোবিন্দর দশ অবতার গীত হয় নাচতে নাচতে । পুরুষ ও নারীরা গোল হয়ে হাত তালি দিতে দিতে এই নাচ এবং গান । দশ অবতার গীত হবার পর, শুরু করে মনিপুরীদের নিজস্ব লৌকিক গান । আত তুপ্পা জগন্নাথ, বেইলঙ চরা জগন্নাথ । গানের ভাষা বা লিরিক এটা । এর মানে হল, হাত কাটা জগন্নাথ, বেগুন চোর জগন্নাথ । জগন্নাথ তাদের প্রভু বা ঈশ্বর । তাকে এভাবেই সম্বোধন করে মনিপুরীরা । গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে রাত বেড়ে যায় । এবার খিচুড়ি খাওয়ার পালা ।
রথোৎসব বেশ আনন্দের । এই সুযোগে ছেলেমেয়েরা সুযোগ পায় মেলামেশা করার । জমে ওঠে পরকিয়াও ।
মেরার পালি কথাটি কি ? একবার, খুব কৌতুহল নিয়ে, প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের পুরোহিতকে । হাসতে হাসতে তিনি বলছিলেন, পক্ষ জান ? কৃষ্ণপক্ষ আর শুক্লপক্ষ । হিন্দুদের দুর্গাপূজা হয় মাতৃপক্ষ এলে । তার আগে পিতৃপক্ষ । দুর্গাপূজার পর লক্ষ্মীপুজা । অর্থাৎ শুক্লপক্ষ শেষ হল । তারপর শুরু হয় মৃতপক্ষ । এ থেকে মেরার পালি । মানে মৃতদের উদ্দেশ্যে যে নিবেদন, তা হয়েছে মেরার পালি ।
এ সময় প্রতিটি মনিপুরী ঘরের উঠোনের এক কোণে, তুলসিগাছের কাছে, এক উঁচু বাঁশে টাঙানো হবে ফিরাল । ফিরাল মানে পতাকা । নিজেদের হাতে বোনা শাদা কাপড়, অনেকটা গামছার মত । এই ফিরাল মৃতদের উদ্দেশ্যে । সন্ধ্যেবেলা, মণ্ডপে, আরতির পর, শুরু হবে মহাভারত বা রামায়ণপাঠ । সঙ্গে কথকের ভাষ্য । সামনে সাজানো থাকে গুড় মাখানো খই । এই খই মনিপুরীদের কাছে অতি পবিত্র । এক একদিন এক এক পরিবারের পালা । এই পালা থেকে পালি । খুব গুরুত্বপূর্ণ এই মেরার পালি ।
মেরার পালির মত আর এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল হোলি । মনিপুরীদের কাছে এটা পবিত্র এক উৎসব । সাতদিন ধরে পালিত হয় মহাধূমধাম করে । ফালগুনের পূর্ণিমা থেকে এই উৎসব শুরু হয়ে থাকে । এদিন চৈতন্যদেবের জন্মতিথি । এ কারণে, সারাদিন উপবাস করে যুবক যুবতীগণ । সন্ধ্যায়, চাঁদ উঠবার পর, মাঠে আগে থেকে তৈরি এক ঘর পুড়িয়ে দিয়ে, মণ্ডপে যায় সকলে । সেখানে আরতির পর উপবাস ভঙ্গ করে, বান্দারা খেয়ে । এদিনের এই বান্দারা অনেকটা পিকনিকের মত, চাঁদা তুলে খাওয়া হয় । বান্দারা মানে সমবেত খাওয়া ।
পরদিন থেকে শুরু হয় আবির খেলা । এই আবির খেলা অন্যরকম । খোল করতাল নিয়ে, যুবক যুবতীরা যায় ঘরে ঘরে । প্রতিটি ঘরে আপ্যায়ন করা হয় তাদের । উঠোনের মাঝখানে, একটা জায়গা লেপে নিয়ে, সেখানে ধূপধুনো আর বর্তি জ্বালানো থাকে । যুবক যুবতীগণ গান গায় সমবেত ভাবে, নাচে । প্রতিটি ঘর থেকে তাদের দেওয়া হয় চাল ডাল সবজি । সঙ্গে টাকাও । তার আগে আবির মাখার পালা ।
এই যুবক যুবতীগণ দল বেঁধে অন্য গ্রামেও যায় । দিনরাত চলতে থাকে এটা । বড়রাও এভাবে বেরিয়ে পড়ে । এমনকি বালকবালিকারাও । সাতদিন পর, সংগৃহীত চালডালসবজি দিয়ে খাওয়া হয় বান্দারা । হোলি প্রেমের উৎসব ।
এছাড়াও রয়েছে দুধ চুরির উৎসব । এটার দায়িত্ব যুবকদের । রাতে, যাদের দুধেল গাই আছে, তাদের বাড়ি গিয়ে দুধ দুইয়ে আনে যুবকরা । সারা গ্রাম ঘুরে এই চুরি চলে । পরের দিন এই দুধ দিয়ে পায়েস বানিয়ে খায় সকলে মিলে। বেশ অভিনব এবং মজার উৎসব এটা ।
অনেক উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে । সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে হিন্দি ভাষীদের উৎসব । সংস্কৃতির এই আগ্রাসন ভয়ঙ্কর । এই আগ্রাসনের মুখে মনিপুরীরা বহু কষ্টে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে তাদের সংস্কৃতি । মনিপুরীরা বলে রুহিবৃত্তি । এই রুহিবৃত্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাদের জীবন যাপনের সাথে । সেই যাপন ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে নানা কারণে । এই যেমন, মাছ ধরাও তাদের কাছে ছিল এক উৎসব । ঘরে ঘরে ছিল পলো । বাঁশের সরু সরু চিলতে দিয়ে তৈরি খাঁচার মত এই পলো দিয়ে দল বেঁধে তারা মাছ ধরত খালেবিলে । নদীতে জৈব বিষ দিয়ে, দশ বারো গ্রামের লোক মিলে ধরত মাছ । সে এক উৎসব বটে । সবাই অংশ গ্রহণ করত এই উৎসবে । আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে । সেই খালবিল নেই আর, ভরাট হয়ে যাচ্ছে । মানুষের লোভ ধ্বংস করতে বসেছে প্রকৃতির দান এইসব খালবিল । নদী গেছে শুকিয়ে ।
অনেকেই আজ স্বীকার করছেন, সংস্কৃতি অর্থনীতির এক দর্পণ । এদিক দিয়ে যদি দেখা যায়, আমরা দেখব, মানুষের হাতে টাকা নেই । নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ লোক । কল্যাণকামী সরকার নিজে এখন লুণ্ঠনকারী । সম্পদের অসম বিকাশ, অসম বণ্টন পঙ্গু করে তুলেছে দেশের অর্থনীতিকে । মনিপুরীদের অধিকাংশ নিম্নমধ্যবিত্ত । আগে তবু এক কৌম সমাজ ব্যবস্থা ছিল, এখন, ধীরে ধীরে, ভেঙে যাচ্ছে সেই ব্যবস্থা । যাদের হাতে টাকা আছে, তারা কীর্তন, মহারাস ইত্যাদি উৎসবের আয়োজন করতে পারছেন । কিছু কিছু এলাকায় এই সব উৎসব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে আপ্রাণ ।
এছাড়াও, আধুনিকতার নামে মানুষ ভুলে যেতে চলেছে তার রুহিবৃত্তি । অথচ এই রুহিবৃত্তি তার সম্পদ । এটা কেবল মনিপুরীদের ক্ষেত্রে নয়, দেশের প্রায় সকল জাতির ক্ষেত্রেও । বাঙালির কত প্রাচীন উৎসব এখন আর তেমন দেখা যায় না । সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে অন্যদের উৎসব । এই তো, সম্প্রতি, দেখা গেল, বাঙালি মেতে রয়েছে গণেশ চতুর্থী উৎসব নিয়ে, যা বাঙালির নয়, ছিল না কোনোদিন ।
এর পেছনে রয়েছে আগ্রাসন । এর নানা রূপ, নানা ধরন । ভাষার আগ্রাসনের মত সংস্কৃতির আগ্রাসনও বড় ভয়ঙ্কর । এটা আমাদের অনুধাবন করা বড় জরুরি । না হলে, মৃতকে ঘিরে যা একদিন শুরু হয়েছিল, তা নিজেই মৃত হয়ে যাবে । অথবা রিয়াং সম্প্রদায়ের সেই নাচটির মত একান্ত পারিবারিক হয়ে থাকবে । অথবা হয়তো মুছে যাবে তাও ।
| ReplyForward |
