স্বীকারোক্তি আমি মানসীকে চিনতাম। সে আমার সময়কে ছুঁয়ে ছিল। তার মুখের মধ্যে গলে যেত কবেকার মুখ, যেন ঝড়ের বাগানের ফোয়ারা , তার ঠোঁটের মধ্যে আরও কত হারানো ঠোঁটের জ্যোৎস্নাদাগ। আমি দেখেছি তাকে - এক লতানে দড়ির ওপর সে হেঁটে যেত ও'পাড়ের লাল বাড়িটা অবধি, যতক্ষণ না দুপুর পুড়ে পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। বাগানে নিশ্চুপ ফুলের থেকে গন্ধ ফিরে গেল আগের বৈশাখে, মা তখন ছিল, বড়ি শুকোতে দিচ্ছিল রোদ্দুরে - সে কাছাকাছি পৌঁছাতে ঘাড় তুলে মা কিছু বলল তাকে - হয়তো আমাদের বেঁচে থাকার অলীকতার কথা। মানসীকে চিনতাম যখন পড়ন্ত বিকেল সন্ধের আকাশে মিশিয়ে এক সময় ফিরে যেত সে - আয়নায় রেখে যেত অলৌকিক কত অশ্রুলিপি। দোকানঘর একটি দোকানঘরের মতো দোকানঘর। গ্রহান্তরের ক্ষয়, যৌনতা, সালতামামিহীন নিরাময়, সবই মিলবে এখানে। এমন কী ভাগিরথীর তীর ঘেঁষা সমস্ত সবুজ মৃণ্ময়তাও। দোকানের বাঁ দিকে অঝোরে এক রক্তকরবীর দোলা। সদ্য ধর্ম করে ফেরা মাসিরুল শেখ দাড়ি উড়িয়ে হাটে চলেছে এই সময়। মাঝে সে এক মুহূর্ত থামবে এখানে, বুক-ভরা বাতাস নেবে। দোকানি তেমনই অন্তরঙ্গ। সেতুর ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে ন'পাড়ার শিবেন পাগল। সে-ও জেনে গেছে দুরূহ প্রশ্নগুলি আসলে নিয়তির ডাক। তিনটি কুকুরছানা মায়ের জীবনতাপে গুটলি পাকিয়ে নির্বিকার ঘুমায়। নদীর অথবা নরকের কিছুমাত্র দেখা যায় না, এমনই কুয়াশাজড়ানো সকাল সেদিন, তবু সমস্ত দিনের মতো সেদিনও গুমটির ঝাঁপ খোলা। দোকানি জন্মান্ধ। হাত বাড়িয়ে সে মুহূর্তকে অনুমানে ছুঁয়ে চলে... অরণির কথা গোধূলি আজ গৃহীণীর ভালোবাসার মতো তদ্গত। নদীর জলে দুখি ধানের ছায়া টলমল করছে, অরণি দেখে। সে যে সম্বিতহীন এক অশ্বারোহী, জানে না সে। সে যে হত্যা ও সন্ধিতে সমান অন্ধ, সে তা জানে না। সে যে জীবনের প্রান্তে এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো কামনাময়, সে জানে না তাও। নদীর সাপুড়ে স্রোত ভরা সময়ের দিকে ডাক দিয়ে যায় গোটা গ্রামকে। গুরুগৃহ থেকে শ্লোকবাক্য উর্ধ্বাকাশে উড়ে যায়। ভূমি পুজোর ঘ্রাণ মিশে থাকে শীতের বাতাসে। ন্যাপার চায়ের দোকানের বাঁশের মাচায় সমিধ হাতে বসেই থাকে অরণি। পারাপারহীন, বেদনাহীন, অন্তরালহীন একা। অঝোরে বৃষ্টি নামে চরাচর আড়াল করে ... আগুন লাগার গল্প আনারসের খেতে আগুন লাগার গল্পটা আমি শুনেছিলাম আমার ঠাকুরদার কাছে। ঠাকুরদাও বোধহয় তার মণিব, জেলাসদরের জজের মুখে গল্পটা শুনে থাকবে। তবু প্রতিদিন আরও সত্যি হয়ে উঠছিল সেটা। এমনকি আমাদের সম্বৎসরের জীবনে সেটা দিব্যি গুলঞ্চলতার মতো জড়িয়ে গিয়েছিল। আমি চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম আদিগন্ত সেই জ্বলন্ত খেত - কতবার পোড়া রসের জন্য নাক টেনেছি আমি, কখনো পেয়েছি মায়ের গয়না বাক্সের লাল ভেলভেটের গন্ধ, কখনো তোমার চুলের। ভাড়ি এসে জল ঢেলে দিচ্ছে ঘড়ার পরে ঘড়া। গ্রামের মানুষজন বিস্ময়ে যখন তাকিয়ে আছে সেই দিকে, তখন তাদের লালচে মুখের পাশে নুরুল কাকার দিগন্ত উথলানো কান্নার কথা মনে পড়ে আমার, হা বাপজান! - "কিন্তু ভাবো, সেই খেতটা যদি কখনোই না থাকে - সেই গ্রামের মানুষজন, কিংবা খোদ নুরুল কাকাই" - সদ্য বিয়ের পর আমার স্ত্রী একদিন চিকণ চোখে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল আমার দিকে। তখন কতই বা বয়স হবে তার! বিয়ের গল্প চাবি লাগানোই ছিল, ঘোরাতেই খুলে গেল। উঠোনে ভিয়েন বসেছে। কুয়োর পাড়ে হাঁটুর ভর রেখে জল তুলছে কাশিকাকা। ওদিকে গোল ঘরে লাল প্রজাপতিআঁকা মেজপিসির বিয়ের অ্যালবাম দেখে ছোট্ ঠাকুমার সে কী হাসি! তখনও দল বেঁধে ছেলেমেয়েদের নাচ শুরু হয়নি, মেঘের বাকলে অন্য মেঘ ঢুকে যেতে দেয়নি মন্দিরের চূড়ায় বসা সেই সাদা বকটা। ওরা এসেছে? - কে যেন দূর থেকে বলে। ওই তো পাওলো আর ফ্রাঞ্চেস্কা, ওই তো রানি আর তার প্রেমিক... তুলসীতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে উঠোনে নামল মা। কিতকিত খেলার ছকের ওপর দিয়ে এক পা তুলে ভেসে গেল ওদিকের বারান্দায়। ঠাকুমা হঠাৎ দুলে দুলে গান ধরল, কালো বিড়াল, কে এনেছে পাড়াতে...
Facebook Comments Box