
লক্ষ্মিণী টোটো
লক্ষ্মিণী টোটোর কথা কেন মনে পড়ে?
টোটো পল্লীতে যাইনি কোনোদিন
যাইনি তো তার ঘরে।
তবে তেলিপাড়া চা বাগানে প্রথম দেখেছি তাকে
যিনি বলেছেন...
কেওয়া(জন্ম) আর শিপুয়া(মৃত্যু) দুই ভাইবোন
নৈঃশব্দ আর চিৎকার
দু’জনকে নিয়ে খেলেছো কি কখনো?
প্রশ্ন শুনে থমকে ছিলাম আমি!!
জন্মের অহঙ্কার নিয়ে এই যে তোর্সা নদী দেখো
এও তো মরে যাবে জানি
কেন তবে এত অহমিকা ছিল তার
যেমন অহঙ্কার, বামুন আর যবনের ফর্সা চেহারার।
এই দেখো প্রবল জোয়ারে ভাঙছে আমার ঘর
এখন ও নদী মরা নদী
যৈবনে খুঁড়ছে নিজেই নিজের কবর।
আমার ভরা যৈবনে তুইলা নিছিল
ফর্সা লোকেরা সেবার
তখন দেইখাছি খুব কাছ থেকে বিভৎস মৃত্যুরে
ওদেরই কেউ একজন হয়েছিল খুন
রাভাবস্তি ধারে লেগেছিল আগুন!
এই দেখ আমি কি সুন্দর বেঁচে আছি
ওরা ছিল মানুষ নামের কতিপয় কানামাছি
লক্ষ্মিনী টোটোর কথা কেন মনে পড়ে
লক্ষ্মিণী টোটোর কথা...
সে কি মরে গিয়ে বেঁচে আছে আমার অন্তরে।
আসলে মরেছে কি সে?
লক্ষ্মিণী টোটো আসলে কে!
আমার মা নাকি আমার মামতো মেয়ে..
গারো পাহাড়ের দেশে
স্পর্শে দো— চোয়ানি নেশা কাটে, কে তুমি সুন্দরী?
ভাদুরিয়া ঘাটে আদুরি হাতে ও জোয়ানি, পরানি আমার
সেই জাজঙ পূর্ণিমা রাতে কোথায় ছিলে তুমি?
না ঘুমায়ে চিকমাঙ পর্বতে ছিলে বুঝি?
কত কত সময় কাটায়েছি সংসর্গহীন মান্দি—রজনী
তবু ফুলপুরে কংস নদী থেকে দূরে
তুমি আসবে বলে আদিবাসী রাত
দখলে নিয়াছে কতিপয় বর্ণবাদী বাঙাল বেজাত!
চন্দ্রস্নান সেরে কংস নদী ধারে তবু বসে থাকি
গারো পাহাড় ধারে তোমায় নিয়ে উড়বো বলে
বেদনা সুরায় চোখ বুজে প্রতিদিন নক্ষত্রগুনি
বিশ্বাসী জোছনা এসে গান শোনায় আর বলে
আবার জাজঙ পূর্ণিমা রাতে রূপসী আত্মার সাথে
তুমি আসবে চিকমাঙ পর্বতে౼ শুধু সেই অপেক্ষায়।
মাহাতো জীবন
কতবার সমুদ্রে গিয়াছি আমি
লিসবনে, হেলসিংকি
আর কুয়াশাটা হয়ে কোবালাম সৈকতে
ভুলে ভরা সমুদ্রে স্নান সেরে কত কত দীর্ঘ রাত কাটিয়েছি
একা একা...
পতেঙ্গা কিংবা কক্সবাজার বন্দরে।
আমার ভাষারা ছেড়ে গিয়াছে আমাকে
ভুল জোছনায় সাঁতার কাটছি
ভুলে ভরা কাটা হাতে রেখেছি হাত!
কাটিয়েছি যৌবনের কত কত ক্ষণ
এ আমার মাহাতো জীবন।
জোছনা বিক্রি রাতে তারা গুনে গুনে
কাটিয়েছি অমৃত যৈবন
বিপন্ন মাহাতো ভাষা, বিপন্ন মন
ভুলে ভরা এই মাহাতো জীবন।
প্রথম প্রেম আম্রপালি শুধু জানে
সেই সব চেনা নদী টিটকারি দেয় আর
ডেকে বলে, কই তোমার সেই প্রথম প্রেম?
স্তব্ধতা ভেঙে গভীর আলোর ভিতরে
অন্ধকার খুঁইজা ফিরি আমি...
চন্দ্রাহত আশ্বিনী পূর্ণিমা মুখ টিপে
হাসে౼ অঙ্গুলি নির্দেশে বলে౼
ষোড়শী সুন্দরীর যে প্রেমের মৃত দেহ
তার মধ্যে কেন পড়ে আছো এখনও?
পরাজিত জোছনার রঙ গায়ে মেখে;
আমি চোখ খুইলা ঘুমাইছি
মৃত সুন্দরীর ছায়া কোলে করে
সুদীর্ঘ নীরাঞ্জনা নদী ঘাটে।
সুজাতার অপেক্ষা করি না আমি,
কত কত প্রেম একজীবনে আসে আর যায়, আম্রপালি শুধু জানে
রাবার গাছের তলে কে কবে জিরিয়েছি কার অপেক্ষায়।
আম্রপালি আসলে কি কোনো নারী?
নাকি সোমরস সুরার রসাসক্ত তরবারী!
এত এত প্রেম কুমারী শরীর বিক্রি শেষে
যে নারী ঘরে এসে হাসি মুখে হেমন্তের
স্বাদ গায়ে মেখে গোসলের ঘরে
সঙ্গে নতুন করে, তারও প্রেমে
পড়ি আমি। যদিও এ প্রেম প্রথম প্রেম
নাহি মনে হয়, আম্রপালির সাথে প্রেম
শুধু জীবন্ত সোমরসে ঘটে নিশ্চয়।
খাসিয়া রমনী ও পেনিলোপি দেবী
এ বাড়ি মৃত বাড়ি; ও বাড়ি বুকের ভিতর কাঁদে
এ গোধূলি আমি দেখিনি কোনোদিন
ও গোধূলি নিঃশব্দে গোঙায় চাঁদে
এ গোধূলি কুয়াশাময়; দূরে বীজগুলো
অবিরাম বৃষ্টি হয়ে ঝরে;
পরাগ ভ্রূণেরা প্রজাপতি ঠোঁটে
খাসিয়া পল্লীতে গমনাগমণ করে।
এ গোধূলি আমি দেখিনি কোনোদিন
ও গোধূলি নিঃশব্দে গোঙায় চাঁদে
মেয়ে মানুষের কাছে খাঁচা বন্দী ওরা
পাশে নদীগুলা গুমরিয়া মরে।
পাহাড় ধারে খাসিয়া এক রমনীকে দেখে
পেনিলোপি দেবীর কথা মনে পড়ে
শুধু মনে পড়ে।
ও নদী আমার নদী
চাইলেও ভিজতে পারবে না জলে
ডুব দিলেই কি অবগাহণ হয়?
প্রকৃত রসিক জানে ধ্যানস্থ কাকে বলে;
সমালোচনা
জানি ইচ্ছামৃত্যু নয়, এ শুধু সেতারার ছড়ে
আছড়ে পড় আহত রাতের হৃদয়।
দূরে অতি দূরে নিশিথে কান্নারা বাইজা চলে
অন্নপূর্ণা দেবীর বিদায়ী সেতারে, সুরে।
মায়াবনে ফোঁপানো সংলাপ বকুলের মত ঝইরা পড়ে
শহরের মৃত চোখ গুলিস্তান, ঝরে...
অচেনা নর্তকীর নূপুর ধ্বনি কাঁদে আর বলে౼
ডুবন্ত তারার ইতিহাস সেই শুধু বলে
যার চোখ উদিত সূর্যের দিকে নাহি চলে
আমিতো ডুবন্ত তারা আর উদিত সূর্যের
ইতিহাস একই সাথে লিখি আর শিখি
দক্ষিণ ঝড়ের দেশে নদীর পাশে জন্ম আমার
উত্তাল ঝড়ের বর্ণনা আমার চেয়ে বেশি কে আবার
উজানী নদীর কোনো, নিশ্চিত তীরের বর্ণনা দেন যিনি
অকমর্ণ্য আর ব্যর্থ সমালোচক তিনি
জানি ইচ্ছামৃত্যু নয়, এ শুধু সেতারের ছড়ে
আছড়ে পড়া আহত রাতের হৃদয়।
সুষমা বালা চাকমা নাকি ওফেলিয়া
পাশাপাশি সারারাত শুইনি কোনদিন
ভালবাসা উষ্ণতায় মাখামাখি বিছানায়;
তবু কেন বেদনারা উঁকি দেয় ওফেলিয়ার
মত ঘুম ঘুম সততায়। রাত আর রাতের
আঁধার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, কর্কশ রাত্রির হৃদয়
ডাকে বুঝি আমাকে অপার প্রেম—পরম সতত হৃদয় তার।
একটা ময়না পাখি ভিতরে পিউ পিউ ডাকে আর
ওড়ে౼ আর বলে, কোন জাহাজে সুদূরের
পথে পাশাপাশি তুমি আমি যাব অনন্তে চলে।
বিষণ্ণ জোছনায় মন খারাপের রাতে
কেন জলপায়রা কাঁদে আমার বিষখালি নদী
ধারে౼এতো জানি এ পায়রা এই নগরীর নয়
তবু কেন ওফেলিয়ার মত নিজেকে মনে হয়।
শ্বাশত শরীর বলে কিছু হয় নাকি
শ্বাশত প্রেম বলে কারো কিছু জানা নেই নাকি?
প্রয়াত প্রেম কাকে বলে?
সমাধি স্তম্ভের ভালবাসা জমে আছে নিশ্চয়
বিস্ময়ে দেখি, সেই বিছনায় সুষমা বালা চাকমা
আমি নাকি মৃত ওফেলিয়া শুয়ে আছে একি।
হারানো হৃদয়
লস্ট এন্ড ফাউস্ট কাউন্টারে আমি তুমি সে
তোমার এবার বোধ হয় কিছু হারিয়েছে?
চোখের কোণে যে জল জমেছিল অনুরাগে
প্রেমহীন হৃদয় কীভাবে দেখতে তাকে।
দেবদাস মত প্রার্থনারত দূরে ওই দেখো চেয়ে
আমার হারানো হৃদয় খুঁজছে এক অচেনা মেয়ে।
প্রয়োজন ছাড়া
শিরা উপশিরায় বেদনার নদী বয়ে যায়
প্রয়োজন ছাড়া কে রাখে কারে মনে কে থাকে অপেক্ষায়!
চেনা নক্ষত্রের চাঁপা কান্না, অচেনা পাখি কাছে ডেকে গান গায়
হৃদয়ের কোষে কোষে যে মধু বিলায়েছি বেদনার
অচল স্টিমার ঘাটের দিকে যেতে যেতে দেখা মেলে তার
এপিটাফ
ব্যর্থ প্রেমের গোপন পুষে রাখি মনে
প্রেমের চিতার পাশে কে তুমি সংগোপনে?
কিশোরি স্তন কেমন করে কুমারী চাঁদ হয়ে যায়
এ রহস্য ফুল ফোটার, যা বলোনি আমায়
যোনিদ্বারে যে শিশুর এপিটাফ লেখা হয়ে যায়
আমি সেই শিশু, যার নামে কিবা আসে যায়।

শামীম রেজা
জন্ম ২৩ ফাল্গুন ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ (৮মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে) মামাবাড়িতে। বরিশাল অঞ্চলের ঝালকাঠি জেলার বিষখালি নদী তীরবর্তী থানা কাঠালিয়ার জয়খালি গ্রামে। তাঁর হাতেখড়ি ১৯৪৩ সালে দাদার প্রতিষ্ঠিত সাউদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ রাজাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন কলেজে (বিএম কলেজ) উচ্চ—মাধ্যমিকের পাঠ শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্তির পর একই বিভাগ থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। একাদশ শ্রেণিতে পাঠদানকালে লিটল ম্যাগাজিন ‘ধানসিড়ি’ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। লেখালেখি ও বিদ্যায়তনিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে তিনি পৃথিবীর নানান দেশে ভ্রমণ করেছেন, যেমন ভারত, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, চেকরিপাবলিক পতুর্গাল, সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড।
তাঁর কর্মজীবনের শুরু সাংবাদিক হিসেবে। বেশ অনেকটা বছর কাজ করেছেন কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে। ছাত্রাবস্থায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আজকের কাগজের ‘সুবর্ণরেখা’ সম্পাদনা ও পরবতীর্ সময়ে দৈনিক কালের কন্ঠের ‘শিলালিপি’ সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। ২০০৩ মে থেকে নভেম্বর ২০১১ পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। একই বছরের ডিসেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট।’ বর্তমানে এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে কর্মরত। ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রবর্তিত ‘কৃত্তিবাস’ পুরস্কার লাভ করেন ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়াও বিনয় মজুমদার সম্মননা ( ২০১০) বাংলার মুখ সম্মাননা (২০১৬) তুষার চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭) কবিতা আশ্রম পুরস্কার (২০১৯) বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার (২০২০) খালেকদাদ পুরস্কার (২০২১) প্রভৃতি লাভ করেন।
শামীম রেজার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ; পাথরচিত্রে নদীকথা (২০০১), নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে (২০০৪), যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে (২০০৬), ব্রহ্মাণ্ডের ইস্কুল (২০০৯), হৃদয়লিপি (২০১৪), দেশহীন মানুষের দেশ (২০১৮), চর্যালোক (২০১৯), গল্পগ্রন্থ: ঋতুসংহারে জীবনানন্দ (২০০৯), প্রবন্ধ: সময় ও সমান্তরের চিত্রকল্প (২০১৮), নাটক: করোটির কথকতা (১৯৯৮), শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা: আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহ- এক ও দুই (২০০২, ২০০৩) ইত্যাদি।
