‘কিন্তু আমি তো জ্যঁ জেনে হতে চেয়েছিলাম।’মাতাল লোকটি হাসে। দু’আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ছাই ছড়াতে ছড়াতে লোকটি বলে, ‘মানুষের বয়স কতো?’
পৃথিবীতে অজস্র প্রশ্ন। সবকিছুর উত্তর নেই। সবকিছুর উত্তর দিতে হয় না। এমন ভাবনায় ডুব দেওয়ার আগে লোকটি অর্থাৎ যিনি জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন জেনের মতো; যার মাথাভর্তি জটা চুল, হলুদ দাঁত বের করে হাসলো। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে মানুষের হাসি। এমনকি ক্রুর হাসিরও এক প্রকার সৌন্দর্য আছে। হাসলে মানুষের ভেতর থেকে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। কাঁদলে বেরিয়ে আসে বেদনা ও ব্যর্থতার স্তুপ। আমি জবাব দেবো না। জনাব জঁ— জেনেও প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। যেন সে সক্রেটিস। যেন সে বসে আছে অ্যাথেন্স নগরে।
এই যে আমরা বসে আছি, আমাদের পেছনে দিগন্ত সিনেমা হলের সাইনবোর্ড। পাশে একটি পানের দোকান। সামনে ফায়ার সার্ভিসের অফিস। তার বাঁ পাশে একটি বাঁধানো পুকুর। আমি পুকুরের নাম জানি না। আমি এই জেলা শহরে নতুন। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এমন ভাবনার তাড়া খেয়ে বসে আছি সিঁড়িতে। আমার যাওয়ার জায়গা নেই। ঢাকা শহর ভাল লাগছিল না বলে হুট করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই শহরে এসেছি। কেমন একটা মফস্বল মফস্বল গন্ধ আছে শহরটির। জ্যঁনের অপভ্রংশের কাছে যাই এবার। জ্যঁনেকে চেনা লোক নিশ্চয় যেমন তেমন হওয়ার কথা নয়। আমি তার আরেকটু পাশে ঘেঁষে বসি। এই বসার অর্থ হচ্ছে, আমি তোমাকে জানতে চাই। শুনতে চাই, তোমার ভেতরের কথা। জ্যঁ বুদ্ধিমান লোক। বুদ্ধিমান না হলে পাগল হওয়া যায় না। আমার উপস্থিতি তার ভেতরটা প্রভাবিত করছে। অথবা তার উপস্থিতি আমাকে। এমন দোনামনা এমন হতবিহ্বল এমন সংকটের মুহূর্তে মুখ খুললেন জ্যঁ। কোটের হাতায় মুখ মুছে দাঁড়িয়ে গেলেন উত্তেজনায়। তারপর জনশূন্য রাস্তার দিকে ঘুষি ও পা ছুঁড়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন (আদতে ইহা ভাষণ), ‘রমণীদের দ্বারে দ্বারে আমি ঘুরেছি প্রেম ও ভালবাসার আশায়। কিন্তু তাদের বোকা বোকা স্তন সবসময় প্রতীক্ষায় থেকেছে রাজকুমারদের জন্য। আমি তাদের ঘৃণা করি। ভালবাসি বেশ্যাদের। যারা চোর ও খুনিকেও দেয় আশ্রয়। আর যাওযার সময় বলে, আবার এসো।’
সেমি জ্যঁ থামলেন। প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে পকেট থেকে বের করলেন দিয়াশলাই। নাতিদীর্ঘ এই ভাষণে তার নাকে ঘাম জমে গেছে। যদিও জুন মাস প্রচণ্ড গরম নিয়ে এসেছে এবার। কুকুরদের দেখছি রাস্তায় জমা ময়লা পানিতে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকতে। আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে দুয়েকজন লোক। তাদের চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। আমরা তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি উপেক্ষা। মনে করো, আমরা তোমাদের চুদি না। আমাদের দিকে তাকালে ছুঁড়ে দেবো গালি ও সিগারেটের ধোঁয়া। এমন পর্যায়ে বাতাস বইলো। জ্যঁ আর আমি একা। আবছা আলোয় বসে আছি সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে। আমাদের পেছনে দিগন্ত সিনেমা হল। তার দেয়াল সিনেমার পোষ্টারে ছাওয়া। আমি বললাম, ‘জ্যঁ, আপনি লেখালেখি করতেন?’ আমার প্রশ্নে সে হাসলো। তার হাসি দেখেই বুঝেছি প্রশ্নটি সম্পূর্ণ বালকসুলভ পর্যায়ের। তার দম ফাটানো হাসি আমার পিঠে চাবুকের আঘাত হয়ে এলো। জ্যঁ থামলেন। ময়লা কোটের পকেট থেকে সামনে নিয়ে এলেন তার ডান হাত। আমি চোখটা ঝুঁকিয়ে দেখি, হাতে মাত্র তিনটা আঙুল। বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী উধাও।
আমাকে এমন হতভম্ব অবস্থায় ফেলে দিয়ে জ্যঁ মুচকি হেসে কিছুটা আনন্দ কুড়িয়ে নিলেন। যেহেতু আনন্দটা আমি তাকে কুড়াতে দিয়েছি সুতরাং তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এই কৃতজ্ঞতাবশত হয়তো জ্যঁ মুখ খুললেন। অথচ তার এই মুখ খোলার ভেতর থেকে ওড়ে এলো অসংখ্য স্মৃতির দিন। অসংখ্য ধোঁয়া ও বেদনার ঘ্রাণ। জ্যঁ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘দেখো, প্রেম সম্পূর্ণ ইতর ও ঐশ্বরিক।’
আমি মাথা নাড়লাম। পুরাতন কথা। তবুও কথার মাঝে সায় দিতে হয়। নয়তো বক্তার উদ্দেশ্য খাটো হয়ে পড়ে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন দ্রুত। এই অভ্যাসটা আমি রপ্ত করেছি ছোটবেলায়। শীতকালের সন্ধ্যার দিকে আমরা অসংখ্য ভাইবোনরা গোল হয়ে বসে দাদীর মুখে গল্প শুনতাম। আর ‘হুঁ—হাঁ বা মাথা নেড়ে দাদীকে উৎসাহ দিয়ে যেতাম। পৃথিবীর গল্পগুলো এভাবেই শুরু হয়।
জ্যঁ জানলেন আমি বিজ্ঞ শ্রোতা। ‘পৃথিবীকে ভ্যান গঘের কেবল ‘সানফ্লাওয়ার’ দিয়ে যাননি। একটি কানও কিন্তু দিয়ে গেছেন। সে তার প্রেমিকার হাতে রুমালে জড়ানো কাটা কান দিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় কেঁদেছিল সারারাত। ভেতরে ও বাইরে গঘের মতো কেউ অতো কান্না করেনি। এই কারণেই তুমি দেখবে ভিনসেন্টের ভেতরটা এতো সুন্দর। পৃথিবী ঋণী হয়ে আছে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের কাছে। ঋণী হয়ে আছে আমার কাছেও। কেননা প্রেমিকাকে আমিও দিয়ে এসেছি দুইটা আঙুল।’
জ্যঁ জেনে তার আঙুলের দিকে তাকালেন। গোড়া থেকে কাটা আঙুল, বস্তুত আঙুলবিহীন হাতটির দিকে আমি বেশিক্ষণ তাকাতে পারছিলাম না। বারবার আমার হাতের চিন্তা এসে যাচ্ছিল। মানুষের এই এক ঝামেলা। সে অন্যের অভ্যাস দিয়ে নিজের অভ্যাসটা পরখ করতে চায়। কিন্তু জ্যঁ—কে কাটা আঙুলে কী দিব্যি মানিয়ে গেছে। মানুষের মূলত কোনোকিছু অভ্যস্ত হতে সময় লাগে না। এই যে আমাদের নাক, এই নাক যদি আমরা কেটে ফেলি তো কয়েকটা দিন খুব খালি খালি লাগবে। বেমানান লাগবে। কিন্তু মানুষ যদি তার নাক কাটা শুরু করে দেয়, এবং তা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে যায় তবে কেউ আর নাক কাটা নিয়ে কথা বলবে না। মানুষকে সবকিছুতে এভাবে অভ্যস্ত করে ফেলতে হবে। মানুষের দুই কান ও একটা নাক ছাড়া কেমন দেখাবে তা মানুষই কল্পনা করে নিক। তারচেয়ে এই মধ্যরাতে সিগারেটের রিংটোন ছড়াতে ছড়াতে শোনা যাক আমাদের জ্যঁ জেনের আঙুল হারানোর কাহিনী।
‘আমার প্রেম ছিল পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝখান বরাবর। একদিন আমাদের শহরে দূর থেকে ছুটে এলো একটি ঐতিহাসিক জাহাজ। মূলত সে বয়ে নিয়ে এসেছিল প্রেম ও অভিশাপের দিন। আমি ছিলাম কবি। পাহাড় ও বালুচরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতাম, পৃথিবী সুন্দর ও মমতাময়ী, যেহেতু তখন আমাদের দিনগুলো তরুণতর হয়ে উঠছে কেবল। তুমি নিশ্চয় শুনেছো, কুতুবদিয়ার বাতিঘরের কথা। আমরা দলবেঁধে সেখানে ছুটে যেতাম। এভাবে ছুটতে ছুটতে একদিন আমাকে ডেকে নিলো হেঁয়ালি। বর্ষাকালের কথা। আমাদের উঠোনে ছিল কদমগাছ। তার পাশে ছাতিম। আমার প্রেমে পড়ার পরের দিনই আমার মা ছাতিম চারা নিয়ে এসে কদমের পাশে লাগিয়ে দিয়েছিল। মাকে আমি কখনো বলিনি, আমার প্রেমিকা ছাতিমের ঘ্রাণ পছন্দ করে।’
জ্যঁ’র এসব অস্পষ্ট কথার কোনকিছুই আমি উদ্ধার করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কি পাগলের পাল্লায় যে পড়লাম। ভাবছি জ্যঁ জেনে, হয়ে গেলো বদ্ধ উন্মাদ। তবুও আমি বসে আছি। যেহেতু কোথাও যাওয়ার নেই আমার এই নতুন শহরে। অন্তত পাগলের সাথেই কাটানো যাবে ভোর হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু আমি যেন নিজেই ডেকে এনেছি উপদ্রব। হয়তো দেখা যাবে আরেকটু রাতে সে রাস্তা মাথায় তুলে নাচছে। আরেকটু রাত হোক। তারপর দেখা যাবে। ‘জ্যঁ, আঙুল হারালেন কিভাবে?’
‘আঙুল তো হারায়নি! প্রেমিকাকে দিয়ে দিয়েছি।’
‘তাহলে আপনি তো গঘের প্রতিনিধি। আপনি নিজেকে জেনে—জেনে করছেন কেন?’
‘যিনি জ্যঁ, তিনিই গঘ, যিনি রাম, তিনিই কৃষ্ণ।’
হাস্যকর কথাবার্তা। তবুও আমার ভাল লাগতে শুরু করে দিলো পাগল জ্যঁ—কে। কেন জানি না। জানলে হয়তো ভাল লাগতো না। কোনকিছু জেনে ফেললে আমার আগ্রহ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কিছুকিছু মানুষকে হুট করে ভাল লেগে যায়। এমনও গেছে, দুই মিনিটের সাক্ষাতে দুই বছরের ভাব বিনিময় হয়ে গেছে। আবার দুই বছর পার করেও অনেকের সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলা হয়নি।
জ্যঁ কাশলেন। এক মুখ কফ ফেলে হলুদ ডিম্ব চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। আমার দিকেই তাকানো উচিৎ। আমি ছাড়া এখানে মাত্র দুইটি ছায়া বিদ্যমান। ছোট শহরটা অনেক ঘুমে কাবু এখন। অদূরে ঝাপসা আলোতে এক দারোয়ান বোধহয় জেগে থাকতে পারে। যদিও সে বসে আছে চেয়ারে। তার উপরে ডাচ বাংলা ব্যাংকের সাইনবোর্ড। ‘আমি লেখালেখি করতাম আগে। লেখকই হতে চেয়েছি জীবনে।’ জ্যঁ র শ্লেষ্মা জড়িত গম্ভীর কণ্ঠ ভেঙে দেয় রাত্রির সকল নীরবতা। ‘এবং একদিন তাকে দেখলাম এক অচিন বৃক্ষের সঙ্গে দেখা করতে। যেহেতু আমি তাকে ভালবাসি, আমি মেনে নিতে পারি না তার সঙ্গে বৃক্ষের সম্পর্ক। যেহেতু আমি তাকে ভালবাসি, সুতরাং কোনো পাখি তার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি তাড়া করতাম ঢিল নিয়ে। যেহেতু আমি তাকে ভালবাসি, অতএব আমি ব্যতীত আর সবকিছু নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম আমি তার জন্য।’
জ্যঁ’র চোখ রাগ ও ক্ষোভে ভেঙে ফেলতে চাইলো আমাদের সম্মূখভর্তি খাম্বা। ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো যোগাযোগের সমস্ত তার। জ্বালিয়ে দিতে চাইলো ফায়ার সার্ভিস। যেহেতু জ্যঁ ছিল তুমুল প্রেমিক। যেহেতু জ্যঁ ভালবাসতো রক্তমাংসের এক নারী। সুডৌল স্তন ও এক গভীর খাদের নারী। জ্যঁ চাইলে এই মুহুর্তে ছারখার করে দিতে পারে ব্যাংক ও শপিং মল। হোটেল কিংবা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। জ্যঁ দয়ালু ও প্রেমিক। কবি ও বিপ্লবী। সে যাক। জ্যঁ আরেকবার কেশে কণ্ঠটা ধারালো করে নিলেন। ‘কিন্তু এই নয় যে, আমি তাকে ভালবাসি না। আমার ভেতরের স্বাধীনতা আমি তাকে দিতে চেয়েছি। আমি তার ঘুম হতে চেয়েছি। চেয়েছি চুলের উকুন বা তার যৌনাঙ্গের ভেতরে বেড়ে উঠা এক ভীষণ্ণ দানব হতে। কিন্তু পৃথিবী ভর্তি পাখি ও বৃক্ষ। মানুষ আর প্রেমিক। তাকে ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন। অথচ আমি ছুঁলেই তার ভেতর গজিয়ে উঠতো অসংখ্য ছত্রাক। বেদনার ঢিবি। এভাবেই প্রতিদিন সমুদ্রে অজস্র জাহাজ আসতো আর সে অচেনা নাবিকদের সঙ্গে ভেসে যেতো আমাকে ফেলে। এভাবেই সে ব্যস্ততম বাইকারের পেছনে চড়ে চক্কর দিতো পুরো শহর। আর আমি বহুবার পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছি। বহুবার সমুদ্রে ডুবে গেছি তারপর জলের গুঁতোয় আবার ভেসে উঠেছি চরে। এভাবেই একদিন বর্ষার এক আচানক সন্ধ্যায় সে আমার থেকে প্রিয় জিনিস চাইলো। আমি সারারাত ভেবে বের করলাম কি আমার প্রিয় জিনিস। পরের দিন সকালে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনি কেটে রুমাল বেঁধে আমার প্রেমের নামে তাকে দিয়ে এলাম। আর ফিরেও তাকাইনি।’

কবি ও অনুবাদক
জন্ম ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সালে, কক্সবাজারের রামুতে
বর্তমান পেশা সাংবাদিকতা।
