এই যে তিনজন পুরুষ, গণেশ কার্ত্তিক অসুর, এদের মধ্যে বন্ধু হিসেবে তোর কাকে বেশি ভাল লাগে?
আমি কি উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। আমি চড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসি। চড়াইয়ের দুষ্টু দুষ্টু হাসির মধ্যে দুপুরের রোদ আর ঘাম জ্বলজ্বল করছে। চড়াই আমার দিকে চেয়ে আছে।
চড়াই মেয়ে আর আমি ছেলে। আমরা দুজন একই ক্লাসে পড়ি। আমাদের এখন বয়স পনের। চড়াই আনমনে আমাকে বলল, অসুরকে আমার ভাল লাগে, অসুর খুব নরম রে বিশু। আমার ডাকনাম বিশু। আমাদের গ্রামের নাম – সাধনা ঔষধালয়, ঢাকা।
সাধনা ঔষধালয়, ঢাকার পাশে একটা নদী আছে। আর এখন শরতের আকাশ খুব নীল। ফলে নদীর রংও নীল। একটা নৌকো আপনমনে চলেছে স্রোতের উল্টো দিকে। আমি আর চড়াই, আজ স্কুলে যাইনি। আমরা দু’জন নদীর ধারে বসে, স্রোতের উল্টোদিকে যাওয়া নৌকোটাকে দেখছি। মাঝি একা, নৌকা বাইছে, মাঝির নৌকায় দুর্গা সরস্বতী লক্ষ্মী গণেশ কার্ত্তিক অসুর। তিনজন নারী নৌকার লেডিস সিটে বসে আছে, আর তিনজন পুরুষ জেনারেল সিটে বসে নদীর পাড়ের শোভা দেখছে।
নৌকো চলতে চলতে, আমার আর চড়াইয়ের বয়স আরো বেড়েছে। আমরা এখন কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। বাইরের নদী আমাদের ভিতর দিয়ে বইছে।
চড়াই একদিন (সে দিনও শরতের এক সকাল) বলল, অসুরকে আমার কেন ভালো লাগে জানিস? অসুর খুব সহনশীল ভদ্র, কবিতা লেখে, অণুগল্প লেখে, একটু নকশাল মাইন্ডেড – নকশাল মাইন্ডেডটা চড়াই তার জেঠুমণির থেকে জেনেছে। অসুরের মিউজিক সেন্সও নাকি খুব ভালো। সেকারণে অসুরের ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ক্যাকটাস’ এইসব ব্যান্ডের সঙ্গেও একটা লিরিক্যাল যোগাযোগ আছে।
আমি তো বরাবরই একটু বোকার মতো হাঁ করে চেয়ে থাকা পাবলিক। এক্ষেত্রেও আমি চড়াইয়ের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছি। অসুরের এতো গুণ আমি জানতাম না। আমি জানতাম অসুর রাগী, অসুরের নামে জগদ্দল থানায় প্রচুর ক্রিমিন্যাল কেস আছে। পুজোর কটা দিন জামিনে ছাড়া পেয়ে এসেছে আমাদের পাড়ায়! চড়াই-এর মুখে অসুরের এতো গুণ শুনে আমি একটু অবাকই হয়েছি। চড়াই মনে মনে ভালোবাসে কী অসুরকে? আমি চড়াইয়ের নাকে ঘাম জমা, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। নাকে ঘাম জমলে চড়াইকে আমার সিকিমের কোনো ভেজা গ্রাম বলে মনে হয়।
চড়াই-এর মন সবসময় অসুরের দিকে। অসুরের ওই চকচকে খড়্গের মধ্যে নাকি প্রচুর মায়া লুকনো, প্রচুর স্নেহ ভালোবাসা, প্রচুর কবিতার লাইনও ওতে লুকনো আছে।
আমি একদিন চড়াইকে জিগ্যেস করি – কার্ত্তিককে তোর কেমন লাগে? আমার নিজের তো খুব ভালো লাগে। চড়াই কার্তিকের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর চড়াই বলল, মুশকিল হল, কার্ত্তিক ডিএমসি পার্টি করে। যুব-র রাজ্য নেতা। চড়াইয়ের সুন্দর মুখে এক ধরণের অশ্রদ্ধার ছায়া কার্তিকের প্রতি। আমি বললাম – হ্যাঁ, এটা ঠিক। আমাদের এই গ্রামেও কার্তিকেয়র ঝান্ডার অনেক অনুগামী আছে।
আমরা আজ আমাদের গ্রাম – সাধনা ঔষধালয়, ঢাকা – থেকে একটা নতুন শহরে এসেছি বেড়াতে। এই শহরের এক পাশে একটা বিরাট সেনা ছাউনি আছে। এখানে সেনারা রাইফেল স্যুটিং প্র্যাক্টিস করে। সারা শহরময় দৌড়োয় তারা। সেনারা ফুলের বাগানও করে। কী সুন্দর সাজানো তাদের এই বিশাল এলাকাটি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রচুর গাছপালা এখানে। কিন্তু শহরের বাকি কিছুটা অংশে কুষ্ট রুগীরা থাকে, তাদের এলাকাটিও খুব সুন্দর সাজানো। এবং আরো একটি সামান্য অংশে অন্ধদের আবাসন। অন্ধদের এলাকাটি সবসময় আলোয় ভরা। অন্ধরা সবসময় আলোর গান গায়, অন্ধরা সবসময় এগিয়ে যাওয়া পথের গান গায়।
এছাড়া এই শহরের আর একটা বিশাল এলাকা জুড়ে মাটির মূর্তি তৈরি হয়। দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এইসব শিল্পীদের মাটির মূর্তি কিনতে আসে, ঘর সাজানোর জন্য। সামনে দুর্গা পুজো। তাই ঠাকুর বানাচ্ছে শিল্পীরা। অনেক দুর্গা, অনেক সরস্বতী, অনেক কার্ত্তিক, অনেক অসুর, সরস্বতীর অনেক বীণা অনেক হাঁস চারিদিকে ছড়ানো।
গণেশজীর বাহন ইঁদুর, চারিদিকে ছড়ানো। ইঁদুরেরা স্থির কিন্তু হাসিখুশি। ইঁদুর হাঁস বীণা অসুর গণেশ লক্ষ্মী – তারা সন্ধেবেলা প্রেয়ারে বসেছে। সেই প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে এসেছে এ শহরের কুষ্ঠ রোগীরা, এ শহরের অন্ধ মানুষেরা এবং সৈন্য ব্যারাকের বেশ কিছু সৈন্য, যারা সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে থাকে।
আমি আর চড়াইও এই শহরের সান্ধ্য প্রার্থনায় বসলাম। অসুর এই প্রার্থনার লিড করছিল। কার্ত্তিক আসেনি। সে নাকি পার্টির কাজে ব্যস্ত। সে নাকি সিএম-এর সঙ্গে দিল্লি গেছে পিএম-এর সঙ্গে দেখা করতে (দুষ্টু লোকেরা যাকে ‘সেটিং’ বলে। পুজোর আগেই তাকে নাকি পার্টির এই কাজগুলো সারতে হবে। অসুর অবশ্য সাধারণ নাগরিক। সে সংবেদনশীল এক সাধারণ প্রজা। সে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে পথ হাঁটে। তার কোনো দল নাই। সে সকলের জন্য। এইরকমই সুনাম চারিদিকে।
প্রার্থনায় এ শহরের সবাই এসে যোগ দিচ্ছেন ধীরে ধীরে। ‘কী শান্তি!’ – চড়াই ফিসফিস করে বলল আমায়। প্রার্থনার সময়ে অন্ধ মানুষদের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তারা তাদের ভিতরের দৃষ্টি দিয়ে গাইছে যেন, এমন সুরে এর আগে কেউ গায়নি বোধহয়। সৈন্যরা সীমান্তে যুদ্ধে যাওয়ার আগে যেন, নিজের জনেদের মধ্য প্রবল ভালোবাসার ফুল ফোটাতে চাইছে এই প্রেয়ারের মধ্য দিয়ে। সৈন্যদের চোখেমুখে স্নেহ ভালোবাসার চিহ্ন। কুষ্ঠ রোগীরাও প্রেয়ারে নিজেদের জন্য নয়, অন্যের জন্য ভালো চাইছে। তাদের সুর এই শহর ছাড়িয়ে সমুদ্র নদী পাহাড় পার হয়ে চলে যাচ্ছে দূরে, আরো দূরে।
মাটির মূর্তি তৈরির শিল্পীদের সঙ্গে, দেবী দুর্গাও, আমাদের সকলের সঙ্গে প্রার্থনা করছেন। যে প্রার্থনা কোনো দেবদেবীর উদ্দেশ্যে নয়, ঈশব্রের উদ্দেশ্যে নয় – যে প্রার্থনা এক ব্যাপক সমুদ্র বা আকাশের কাছে – সকল মানুষের ভালো ও মঙ্গলের জন্য চাওয়া হচ্ছে। যে প্রার্থনা মানুষের কাছে মানুষের জন্য প্রার্থনা।